শিশু বয়সেই ছেলে-মেয়েদের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে একে অপরের গোপন বিষয় সম্পর্কে আকর্ষণীয় তথ্য। ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে শিশুদের দেয়া হচ্ছে যৌনতার ধারণা। বয়ঃসন্ধিকালের এই আলোচনার কারণে শারীরিক শিক্ষার ক্লাস নিতে বিব্রতবোধ করছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। পুরুষ শিক্ষকরা মেয়েদের জন্য আর মহিলা শিক্ষকরা ছেলেদের জন্য অস্বস্তিবোধ করেন। শিশু বয়সে ছেলে-মেয়েদের জন্য একই বইয়ে গোপন বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা ঠিক হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রগতিশীল শিক্ষার নামে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পাশ্চাত্যকরণ করা হচ্ছে বলে শিক্ষাবিদরা অভিযোগ করেন। মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য হলেও ছেলেদের জন্য এতো অল্প বয়সে আলোচনা করা ঠিক হয়নি বলে মনে করেন অভিভাবকরা।
২০১৩ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ষষ্ঠ শ্রেণির নতুন প্রণিত শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিষয় বইটিতে ছেলে-মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বইটির চতুর্থ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে ‘আমাদের জীবনে বয়ঃসন্ধিকাল’ শীর্ষক একটি অধ্যায়। এই অধ্যায়ে বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের পরিবর্তন এবং করণীয় বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে একই বইয়ে ছেলে- মেয়েদের বিষয়গুলো তুলে ধরার বিষয়টিতে আপত্তি জানিয়েছেন শিক্ষক-অভিভাবকরা।
বইটির ৩৯ নম্বর পৃষ্ঠায় ছেলেদের পরিবর্তনগুলো শিরোনামের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে জ. নম্বরে দেয়া হয়েছে বীর্যপাত হয়। মেয়েদের পরিবর্তনগুলোর মধ্যে
ক. মেয়েদের ঋতুস্রাব শুরু হওয়া,
খ. মেয়েদের কোমরের হাড় মোটা, উরু ও নিতম্ব ভারী হয়,
গ. মেয়েদের বুক বড় হয়ে ওঠে।
৪০ নম্বর পৃষ্ঠায় বয়ঃসন্ধিকালে মানসিক পরিবর্তন শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে- গ. যৌন বিষয়ে চিন্তা আসে।
৪১ নম্বর পৃষ্ঠায় পাঠ-২ এ উল্লেখ করা হয়েছে- ছেলেদের মধ্যে বড় পরিবর্তন হচ্ছে বীর্যপাত। অনেক সময় ঘুমের মধ্যে এটা ঘটতে পারে। মেয়েদের বিষয়ে বলা হয়েছে- প্রথম পরিবর্তন ঋতুস্রাব হয়। মেয়েদের গোপন অঙ্গ থেকে যে রক্তপাত হয় তা দেখে তারা ভীত ও দিশেহারা হয়ে পড়ে। একই পৃষ্ঠায় বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন এবং মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন বিষয়ে দুটি পৃথক ছক দেয়া হয়েছে। যে ছকটি ছেলে-মেয়েদের পূরণ করার জন্য রাখা হয়েছে। এর ফলে একটি ছেলেকে তার পরিবর্তনের সাথে সাথে মেয়েদের পরিবর্তনগুলোও শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে মেয়েদের বেলাতেও একই ঘটনা ঘটছে। তাদের পরিবর্তনের সাথে সাথে ছেলেদের পরিবর্তনগুলোও শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।
৪২ নং পৃষ্ঠায় কাজ-১-এ লেখা আছে, বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েদের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের ফলে যেসব ঝুঁকির সৃষ্টি হয় তা একটি দল প্রথমে বোর্ডে লিখবে। এর ওপর অন্যদল আলোচনা করবে। কাজ-২-এ উল্লেখ করা হয়েছে, বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তন সম্পর্কে জানা থাকার সুবিধা এবং জানা না থাকার অসুবিধাগুলো পোস্টারে লিখে রাখবে।
৪৬ পৃষ্ঠায় বলা হচ্ছে ছেলেদের বীর্যপাত হলে কিভাবে পরিচ্ছন্ন হতে হবে, দাড়ি, গোফ কমাতে কিভাবে রেজার, ব্লেড, শেভিং ক্রিম ব্যবহার করতে হবে তা অভিভাবক থেকে জানবে।
৪৭নং পৃষ্ঠায় বয়ঃসন্ধিকালে ঝুঁকি শিরোনামের সাথে ছেলেমেয়েরা যেসব ঝুঁকির সম্মুখিন হয় তা উল্লেখ করে ২ নম্বর পয়েন্টে বলা হয়েছে, কৌতূহলের বশে বা খারাপ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ধুমপান, মাদকাসক্তি, অবৈধ ও অনিরাপদ যৌন-আচরণসহ নানা ধরনের অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে। ৩ নম্বরে বলা হচ্ছে, প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে প্রজননতন্ত্রে নানা ধরনের রোগ সংক্রমণ বা অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণের ঝুঁকির আশঙ্কা বেড়ে যেতে পারে। এছাড়া বইটির অধ্যায়টিতে ঋতুস্রাব কেবল কথাটিই ১৭ বার ব্যবহার করা হয়েছে, বীর্যপাত কথাটি ৮ বার। এছাড়া মাসিকসহ এ জাতীয় বিভিন্ন শব্দ একাধিকবার ব্যবহার করা হয়েছে। যা বিপরীত লিঙ্গের শিক্ষার্থীদের কৌতূহল বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছে।
৪৮নং পৃষ্ঠায় বয়ঃসন্ধিকালের ঝুঁকির নিরাপত্তার জন্য অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া হয়। কিভাবে তারা তাদের সন্তানদের খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখবেন। অভিভাবকদের প্রশ্ন হলো এই বইটি কি শিশুদের জন্য প্রণিত হয়েছে নাকি তাদের অভিভাবকদের জন্য? যদি শিশুদের জন্য হয় তাহলে অভিভাকদের উদ্দেশ্য করে যেসব পরামর্শ দেয়া হয়েছে তা কয়জন শিক্ষার্থীর অভিভাবক পড়বেন? আবার যদি অভিভাবকদের জন্য হয়, তাহলে শিশুদের এই যৌনতা শেখানোর কি দরকার।
এই আলোচনার মাধ্যমে শিশুদেরকে একে অপরের সম্পর্কে যৌনতার ধারণা দেয়া হচ্ছে। মেয়েদের কিছুটা আগে বয়ঃসন্ধিকাল আসলেও এই বয়সে ছেলেদের ব্যাপারে এই আলোচনা ছিলো অপ্রয়োজনীয়। এছাড়া একই বইয়ে উভয়ের সম্পর্কে আলোচনা ও শিক্ষা দেয়ায় তা তাদের জন্য খারাপ হবে বলে মনে করেন তারা। প্রয়োজন হলে তাদের পৃথকভাবে দেয়া যেতো।
ষষ্ঠ শ্রেণির এই বইটি রচনা করেছেন- আবু মুহম্মদ, মো. আবদুল হক, মো. তাজমুল হক, জসিম উদ্দিন আহম্মদ। আর বইটি সম্পাদনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর আ ব ম ফারুক।
ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ে এত অল্প সময়ে এ ধরনের আলোচনা ঠিক হয়নি। বাংলাদেশের মতো মুসলিম দেশে এটি হয় না। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ভিন্ন। তাদের সংস্কৃতিতে অনেক কিছু যায়। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতির সাথে তাদের সংস্কৃতি মিলবে না। সেক্স এডুকেশনের ভাষা মার্জিত ও আরও দেরিতে হওয়া উচিত। ষষ্ঠ শ্রেণিতে শিশুদের যৌন শিক্ষা নেতিবাচক, এটি সমর্থন করা যায় না।
যৌনতার এই আলোচনার কারণে অনেক শিক্ষক শারীরিক শিক্ষা ক্লাস নিতে চান না। বিশেষ করে মহিলা শিক্ষকরা এই বিষয়টি পড়াতে বেশি অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন। শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রগতিশীল করার নামে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। নৈতিকতার বদলে যৌনতার শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।
এতো অল্প বয়সে আলোচনা ঠিক হয়নি এর সত্যতা স্বীকার করে বইটির সম্পাদক প্রফেসর আ ব ম ফারুক বলেন, আমরা বিষয়টি নিয়ে প্রথমে আলোচনা করেছি। কিন্তু পরবর্তীতে দুটি কারণে উল্লেখ করেছি। এর একটি হলো- বয়ঃসন্ধিকাল জটিল বিষয়। এজন্য কিছু ধারণা দেয়া উচিত। তা না হলে ছেলে-মেয়েরা বিপথে যায়। মারাত্মক সংক্রমণ হয়। এ থেকে দূরে রাখতে এটা দেয়া হয়েছে। এছাড়া এখন স্কুলগুলোর শিক্ষা পদ্ধতি পাল্টে গেছে। প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত, আবার অষ্টম ও দশম শ্রেণির দুটি ধাপ রয়েছে। এর মধ্যে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পরে তাই তাদের কিছুটা ধারণা দেয়ার জন্য এটি করা হয়েছে। তবে যদি কোন সুপারিশ থাকে তাহলে তা মোডিফাই করা হবে।
সূত্র: ইনকিলাব।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ৩:২৭