পেশাগত জীবনে অনেক দিন থেকে নারীর অধিকার, ক্ষমতায়ন, নারী-পুরুষ বৈষম্য এই বিষয়গুলো কাজ করে আসছি। কাজের এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেখেছি নারী-পুরুষের সমতা নিয়ে যখন কথা বলেছি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রোতা গোষ্ঠী বিষয়ের সাথে একাতœতা প্রকাশ করার চাইতে প্রাকৃতিক লিঙ্গভেদে নিজেদের অবস্থান পৃথক করেছেন বেশী।
“পুরুষতন্ত্র” শব্দটির সাথে “পুরুষ” শব্দটি থাকায় আমাদের অধিকাংশের মনে একটি ধারণা যে,পুরুষতন্ত্রের ধারক, বাহক কেবল পুরুষ। আমরা যারা এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করি তারা জানি যে, এটি প্রমান করতে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয় যে “পুরুষতন্ত্র” নামক নেতিবাচক এই সামাজিক মূল্যবোধটির ধারক-বাহক নারী-পুরুষ উভয়ই হতে পারে। আর আমাদের এই বক্তব্যকে প্রমান করার কাজটিকে অনেক সহজ করে দিয়েছে কানিজ আলমাস, যিনি নারীর চেহারা নিয়ে পুঁজিবাদী পুরুষতন্ত্রের কান্ডারী হিসাবে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের চোখের অন্তরালে ছিল।
নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘ দিন ধরে যারা কাজ করছেন সেই পথে নতুন আরেকটি প্রতিবন্ধকতার নাম কানিজ আলমাস। যে নারী হয়েও নারীর সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে ব্যবসা করে আসছেন দীর্ঘ দিন থেকে। আর তার তার এই ব্যবসার পুঁজি করেছেন নারীর বিশ্বাসকে। পুঁজিবাদী পুরুষতন্ত্রের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার সৌন্দর্য ব্যবসা। আমাদের দেশে গত পাঁচ বছর আগেও সৌন্দর্য চর্চা কেবল উচ্চবিত্ত পরিবারের নারীদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। কানিজ আলমাস সৌন্দর্য বাণিজ্যের নারী উদ্যোক্তা হিসাবে নিজেকে এমন একটি অবস্থানে নিয়ে যেতে পেরেছেন যেখানে তিনি অন্যান্য নারীদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে সৌন্দর্য্য চর্চা কেন্দ্রগুলোতে নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে সকল শ্রেনীর নারীর সেবাগ্রহণ বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি অনেক নারী এই পেশাকে তাদের জীবিকা হিসাবে স্বাচ্ছন্দে গ্রহণ করেন। অন্যান্য সকল ব্যবসার মতো সৌন্দর্য্য ব্যবসার অন্যতম একটি নৈতিকতা হচ্ছে সেবাগ্রহণকারীর আস্থা। সৌন্দর্য্য চর্চা কেন্দ্রগুলোতে সেবার ধরণের কারণেই বিষয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর।
আমাদের সামাজিক ব্যবস্থার কারণেই যখন কোন নারী সেবা গ্রহণের জন্য কোন পুরুষের কাছে যান তখন তার মাথায় কিছু সাবধানতা অবচেতন ভাবেই কাজ করে। বিশেষ করে, নারীর শরীরকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী যে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসাগুলো বিকশিত হচ্ছে এটি কম -বেশী সবাই জানেন। ফলে সেবা প্রদানকারী যখন পুরুষ হন তখন সেবা গ্রহণকারী হিসাবে নারী নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা জনিত কারণে কিছু বিষয় সব সময় মাথায় রাখেন। কিন্তু সেবা প্রদানকারী যখন নারী হন, যেমন কানিজ আলমাস তাহলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধের জায়গাটি অনেক নিরাপদ হয়ে যায়। কানিজ আলমাস বা পারসোনার ব্যবসার মূলপুঁজিই ছিল এ আস্থা ও বিশ্বাস। ভিডিও কেলেংকারীর মাধ্যমে পারসোনা গ্রাহকের এ পবিত্র বিশ্বাসটা ভেঙেছে। এটি একই সাথে ব্যবসার নৈতিকতাকে যেমন ভঙ্গুর করে ফেলেছে তেমনি সকল সৌন্দর্য্য চর্চা কেন্দ্রগুলোকে ব্যবসায়িক হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। এখন তাদেরকে আবার প্রমান করতে হবে সেবাপ্রদানকারী হিসাবে তারা তাদের ক্লায়েন্টদের জন্য কতখানি নিরাপদ! । ইতোমধ্যে কোন কোন পারলার তাদের সাইনবোর্ড-বিজ্ঞাপনে বলতে শুরু করেছে-আমরা কোথাও কোন ক্যামেরা ব্যবহার করি না। অর্থনৈতিক দিক থেকে এটিকে একটি সেক্টর বিবেচনা করলে পারসোনার ঘটনা গোটা সেক্টরের জন্য একটি আস্থাহীনতার জায়গা তৈরি করেছে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বহুল প্রচলিত-প্রতিষ্টিত একটি অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছে “নারীই নারীর বড় শত্র“” । এ ক্ষেত্রে কানিজ আলমাস তাদের জন্য একটি বড় মওকা হিসেবে আবির্ভূত হলেন। নারীর হাতে নারীর নিপড়িত হওয়ার আরেকটি বড় উদাহরণ তৈরি হলো। এমনিতেই হিন্দি মিডিয়াগুলোর কল্যাণে সারাদিন ধরে আমরা দেখতে থাকি পুরুষের চোখে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য কীভাবে নারী চরিত্রগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে লেগে থাকে। এবং এর মধ্য দিয়ে আমাদের মগজ ধোলাই চলতে থাকে ফলে আমরা কেবল নারীর বিপরীতে নারীকেই দেখি, এই নারী যে পুরুষতন্ত্রের সৃষ্টি - ঐ বিষয়টি থেকে আমাদের দৃষ্টি চলে যায় আপাতদৃশ্যমান “নারীরাই নারীদের বড় শত্র“” এই বিষয়টির প্রতি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এখানে কানিজ আলমাস কোনভাবেই নারীর প্রতিনিধি নন। তার পরিচয় একজন ব্যবসায়ী। মুনাফা যার দেবতা। সুতরাং মুনাফা কেন্দ্রীক আচরণে আর যাই হোক নারী মুক্তি, নারীর ক্ষমতায়ন এগুলো বিবেচিত হওয়ার কথা নয়। আর এ কারণেই নিজের ব্যবসায়িক অস্তিত্বের কাছে বাকী ভাবনাগুলো গৌন হয়ে যায়। সুতরাং পারসোনা ও কানিজ আলমাসের ভূমিকাকে এখানে পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ব্যবস্থার প্রোডক্ট হিসেবে পাঠ করাটা জরুরি। এবং নারীর শত্র“-মিত্র এর মেরুকরণটা সে ব্যকরণ দিয়ে করতে হবে। কানিজ আলমাস এ ব্যকারণে অবশ্যই পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি।
চাই আমাদের যুথবদ্ধ প্রতিরোধ
গত কয়েকদিনের ওপর পর্যবেক্ষণে নাগরিক হিসেবে আমাদের এ শংকাটা পাকাপোক্ত হয়েছে যে, পারসোনা বোধহয় আইনী দিক থেকে পারপেতে চলেছে। মূলধারার মিডিয়ারও ভূমিকা এ ক্ষেত্রে হতাশা জনক। সুতরাং আমাদের জন্য একমাত্র বিকল্প হচ্ছে নাগরিক হিসেবে ব্যক্তি পর্যায়ে ও দলগত ভাবে এটি নিয়ে সোচ্চার হওয়া। পরিচিতজনদের সাথে কথা বলা। ঘটনাটি সম্পর্কে জানানো। অনলাইনভিত্তিক সামাজিক মিডিয়াগুলোতে আলোচনাটা চালিয়ে যাওয়া। যতদিন সম্ভব। এর মধ্যে দিয়ে যে সচেতনতা তৈরি হবে আশা করা যায় নাগরিকদের বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের একটি নিরব বিচার সংশ্লিষ্টরা টের পাবেন। আমাদের সকলের যুথবদ্ধ এ উদ্যোগটাই আমাদের জন্য এখন একমাত্র বিকল্প।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১১ রাত ১২:১৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




