মেঘলাদের আর আমাদের ঘর দুখানা ছিলো একই উঠোনে।
স্মৃতিঘেরা মাটির উঠোনখানি। যেখানে আমার একটা স্বত্বা আজও দাঁড়িয়ে আছে
কিশোরী মেঘলা হাত ধরে। আমার তখন পনের বছর, মেঘলার বয়স চৌদ্দ। প্রতিদিন
ঝগড়া, প্রতিদিন ওর কান্না, আবার প্রতিদিন ওর খিলখিলিয়ে হাসি। কিশোর বয়সে
মেঘলার প্রতি আবেগ এই জীবনের জন্য যে কত বড় মাদকতা ছিলো তখন বুঝতে পারতাম
না। এখন পারি আর হয়তো জীবনে শেষ দিন পর্যন্ত মেঘলার অভিমানী মুখ হঠাৎ ঝলমলে
হাসি দেখার জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকবে। মানুষের বেঁচে থাকার মূল সময় শৈশব
আর কৈশোর। তারুণ্যে তো কাজের ভারে সন্ধ্যা নামে আর বার্ধক্য অবহেলার
অন্ধকারে গুমরে মরে। আমাদের দিনগুলো বেশ কেটেছিলো। কিন্তু একদিন স্কুল থেকে
এসে শুনলাম, মেঘলার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে।আমি অবুঝ হয়ে বাবাকে
জিজ্ঞেস করলাম, ও তো বাচ্চা একটা মেয়ে। এখন ওর কিভাবে বিয়ে হবে? বাবা
বলেছিলেন, ছেলে আর মেয়েদের মানসিক বিকাশ পার্থক্য রয়েছে। মেয়েরা ছেলেদের
থেকে অনেক তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়। মেঘলার বিয়ের পর দেখবি কি সুন্দর গুছিয়ে
সংসার করে। আর তোকে এখন বিয়ে দিলি তো কেঁদে মায়ের আঁচলে লুকোবি।তখন
ঐ কিশোর আর কোতূহলের বয়সে না বুঝলেও আজ বুঝতে পারি মেয়েরা কিভাবে ছেলেদের
থেকে অল্প ব্যবধানে বড় হয়ে ওঠে। মেয়েরা ইচ্ছা করে বড় হয় না, বাধ্য করা হয়
বড় হতে। একটি কিশোরী মেয়েকে তাঁর আশপাশে থাকা পুরুষের লালায়িত চোখগুলো এক
একটি নোংরা হাত হয়ে ওর শরীরের বিকাশকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। বাধ্য করে
নিজের ভেতরে শিশুটাকে মেরে ফেলতে, তাঁকে কিশোরী থেকে হতে হয় নারী। মেঘলাও
পেরেছিলো। কয়েকদিনের মাঝেই মেঘলার বিয়ে হয়ে স্বামীর বাড়ি চলে যায়। ওর
স্বামী বয়স ছিলো প্রায় চল্লিশ। কিন্তু অভিজাত পরিবারের রূপকথা শুনলে
গ্রাম্য বাবারা যেখানে নিজের সন্তানকে জলন্ত অগ্নিকুন্ডে ছুঁড়ে ফেলতে
দ্বিধা করে না সেখান এই বয়সের ব্যবধান নিতান্ত তুচ্ছ। সময়ের সাথে সাথে আমি
বড় হচ্ছিলাম। মেঘলাও স্বামীর বাড়ি বেশ মানিয়ে নিয়েছিলো। বছরে দুই একবার
এখানে এসে কিছুদিন থাকত। সব থেকে ভাল লাগত বিয়ের পর মেয়েরা সংসার ছাড়া
নিজের চারপাশে যে অদৃশ্য সীমারেখা টানে, আমার জন্য সেটার কখনো অস্তিত্বই
রাখেনি। প্রতিবার আসতেই আমার সাথে আগের মত ঝগড়া, মারামারি, ক্ষ্যাপামি। ওর
বাবা-মাও ওকে খুব বকত। আমি বুঝতাম। কিন্তু আমার ব্যাপারে ও কাউকে মান্য করত
না। খুব ভাল লাগত। কখনো কখনো মনে হত মেঘলার কখনো বিয়েই হয়নি, ও তো এখানেই
থাকে। আমি ওর চলে যেতেই আবার অপেক্ষা করতাম আবার কবে আসবে। একবার যাবার আগে
খুব করে বলে গেল পরেরবার আসার সময় আমার জন্য একটা সোয়েটার বুনে আনবে। নতুন
শিখিছে। বরাবরের মত আমি অপেক্ষায় করে রইলাম। মেঘলা এবার এলো না। আমার খুব
মন খারাপ হয়েছিলো সেবার। মেঘলার মাকে যেয়ে প্রায় জিজ্ঞেস করতাম, ও খালা,
এবার এতো দেরি হচ্ছে কেন তোমার মেয়ের? খালা শুনে কিছু বলত না শুধু হাসত।ছয়
মাস পর খবর এলো, রান্নার সময় অসাবধানে মেঘলার আঁচলে আগুন লাগে। আশপাশে
লোকজন এসে নেভাতে নেভাতে ও জ্ঞান হারায় । হাসপাতাল পর্যন্ত আর যাওয়া হয়নি
ওর। তাঁর আগেই মেঘলা মারা যায়। পরে অবশ্য শোনা যায়, ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা
নাকি পুড়িয়ে মেরেছিলো মেয়েটাকে। ও মৃত্যু সংবাদটা শোনার পর আমি একটুও
কাদিনি। শুধু ওর মুখটা একটা ভাববার চেষ্টা করেছি। খুব সুন্দরী ছিল না
মেঘলা। গায়ের রং শ্যামলা। মেদও ছিলো শরীরে। থাকার মধ্যে ছিল হাসি। ও যখন
হাসত একদম পাল্টে যেত মুখটা। একটা হাসি একটা মানুষকে কতটা নিষ্পাপ করতে
পারে সেটা মেঘলাকে না দেখলে কেউ কখনো জানবে না। মেঘলার স্বামী কিছুদিন পরেই
নাকি আরেক টা বিয়ে করেছিলো। এই মানুষগুলো জানোয়ারের মত শুধু শরীর খোঁজে,
একবার যদি মন খুঁজত, দেখতে পেতো প্রকান্ড মহাসমুদ্রও নারীর মনের গভীরতার
কাছে কতটা স্থবির।মেঘলা মরে গেছে। সত্যি মরে গেছে। আজ বিশ বছর পর
কেউ ওকে মনে রাখেনি। এমনকি চার টি সন্তানের জন্মদাতা-দাত্রী ওর মা-বাবাকে
অনেকদিন হলো একবার নামটা মুখে নিতে শুনিনি কখনো। শুধু স্কুল থেকে ক্লাস
নেয়া শেষ করে যখই বারান্দার নগ্ন চাতালে বসি, তখন ঐ শূণ্য উঠোনে আমি
মেঘলাকে দেখতে পাই। বিশ বছর ধরে ওখানে মেঘলা আর আমি একসাথে আছি। কেউ জানে
না।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১:৫৩