ঘটনার বিবরন পুনরাবৃত্তি করার মনোবৃত্তি নেই। কিন্তু মনের অতল বৃত্তে জমিয়ে রাখা শত স্মৃতিগুলো হঠাৎ ভাসমান হয়ে মাথা কুটে আছড়ে পড়ছে। গত বছরের ঘটনা মনে পড়ল। চ্যানেল আই-তে কাজ করার সুবাদে নারীদিবসের এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রন জানাতে যাই আমার সারাজীবনের সবচাইতে প্রিয় স্মৃতিগুলো ঘিরে থাকা অভয়ারন্যে। গেইট দিয়ে ঢুকতেই দারোয়ান চাচা ঠিকই চিনলেন, “কেমন আছেন আম্মু? অনেকদিন পর?” কি স্পর্শকাতর শব্দগুলো! অজানা এক উছ্বাসে উচ্ছ্বল মন নিয়ে চললাম স্কুলের টিচার্স রুমের দিকে। থমকে দাড়ালাম ক্লাস ওয়ানের নিস্পাপ বাচ্চাগুলোর দুস্টকীর্তি দেখে। কেমন এক দলাপাকানো অনুভূতি রক্তের সাথে মিশে অশ্রু হয়ে ফেটে পড়তে চাইছে। ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডামের অবাক দৃস্টির সামনে পড়ে ছলছল চোখ সামলে কোনমতে বললাম “আমি এই স্কুলের এক পুরাতন ছাত্রী” বলেই স্থানকালপাত্র ভুলে ভ্যা। তখন আমাকে বুকে জড়িয়ে আপা বললেন, “বোকা মেয়ে! কাঁদছ কেন? এটা তো তোমাদেরই স্কুল। তোমরা তো আজীবন আমাদেরই মেয়ে।” এরপর ক্যান্টিন, মাঠ পেরিয়ে যখন যাচ্ছি, শতশত নীল-সাদা চঞ্চ্বল মেঘগুলো ঘুড়ে বেরাচ্ছে কি নিশ্চিন্তে। মনে হল, ছুটে গিয়ে প্রত্যেককে বলি, আমিও ভিকি, আমিও তোমাদেরই একজন! কত স্মৃতি এখানে প্রিয় বান্ধবিদের সাথে। কলেজের টিচার্স রুমে চেনা অতিপ্রিয় মুখগুলো দেখে যন্ত্রচালিতের মত শুধু বলি, “ম্যাডাম, চিনতে পেরেছেন? আমি আপনাদের এক্স স্টুডেন্ট” ওমনি কি হইচই পড়ে গেল! লক্ষীদি, পিটি আপা যাদের ভয়ে একসময় তটস্থ থাকতাম তারাই স্নেহে জড়িয়ে ধরে অশ্রুসজল চোখে বলল “আমাদের মেয়েরা এখন বড় হয়ে কতকিছু করছে! দেখো, মিডিয়া থেকে অনুষ্ঠানের আমন্ত্রন!” কি শিশুসুলভ উত্তেজনা ওই কড়া মুখোশের ওপাশে। এ যে আনন্দাশ্রু! এ যে বর্ননাতীত! এ যে স্বর্গীয় ভালোবাসায় ভেজা!
আজ এমন নির্লজ্জ সত্য মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিছুতেই বিশ্বাস হয়না। বহু দুর্বৃত্তকারী এই প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষকের আসনে বসে সেই একই কাতারের অন্য শিক্ষকদের-যারা আমাদের অত্যন্ত পুজনীয় তাদেরও অপমান করে গেলো, যাচ্ছে। অনেকেই হয়তো বলছেন, মেয়েদের স্কুলে পুরুষ শিক্ষক নিয়োগ করা উচিত নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে এর প্রতিবাদ করি। শিক্ষক আদর্শের প্রতীক। আর আদর্শের কোনো লিঙ্গ ভেদাভেদ নেই। এর মানে কি কোন পুরুষই শিক্ষকের মর্যাদার আসনে অধিষ্টিত হয়ে ছাত্রীদের সুশিক্ষাদানের জন্য নিরাপদ নয়? তাহলে তারা কী বলবেন আমাদের পিতৃসুলভ সুভাস স্যার, শাহ আলম স্যর, মহসীন স্যারদের অকৃত্তিম আদর্শকে? যাঁরা শাসন করে আবার পরম মমতায় মাথায় হাত রাখলে এক আশীর্বাদস্বরূপ নিরাপদ আশ্রয়ে মনে হয়, আমি পারব!
কোথায় গেল আমাদের সেই আশ্বাস, কোথায় আমাদের সন্দেহাতীত নিরাপত্তা? সুশিক্ষার নামে আমরা কতদিন স্বশিক্ষাকে এভাবে শোষন করব? শিক্ষাই যদি জাতির মেরুদন্ড হয়, আর কতদিন এই শিক্ষাকে রাজনীতিকরন, বাণিজ্য ও দলীয়করন করে নিজেদের মেরুদন্ড নিযেরাই কুরেকুরে খাবো? রাজনীতির সুবিধাবাদী ছত্রছায়ায় থেকে সহস্র আতংকিত মুখের কথা ভুলে গিয়ে কতদিন পরিমলদের মত নির্মলতাহীন অমানুষদের আড়াল করতে গিয়ে rape কে mutual sex বলে ধামাচাপা দেয়ার মত অন্যায় করা হবে? কিভাবে ভিকারুননিসার মত স্বনামখ্যাত একটা স্কুলের কৃতিত্বঘেরা নাম পালটিয়ে রাজনৈতিক কুটকৌশলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মা’য়ের নামে নামকরনের প্রস্তাব আসে? সুবিচার তো দূরে থাক! রাজনীতি কোন নীতিবলে শিক্ষাঙ্গনেও দুর্নীতি করে চলবে? আমরা নিজেরাই যখন মা হব গর্বিত মুখে মেয়েকে একই স্কুলে না পাঠিয়ে কেন দু’চারটা নরকের কীটের ভয়ে দুশ্চিন্তা করব? যে স্কুল থেকে সুশিক্ষা গ্রহন করে আমরা নিজেদের জীবনে সাফল্যের পথে চলছি, আজ সেই স্কুলের প্রতি, আমাদের ছোটবোনদের প্রতি কি কোনোই দায়িত্ব নেই আমাদের?
"দ্বাররুদ্ধ করে দিয়ে ভ্রমটাকে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি" আমরা নিজেদের মনের দ্বার রুদ্ধ করে নির্বাক দর্শকের মতো ভুলকে বা কোনো অন্যায় কে দেখে বসে বসে হা-হুতাস করতে চাই না। সত্যের প্রকাশ চাই। শিক্ষাঙ্গনে অনৈতিক অন্যায়ের সুবিচার চাই। পরিমলদের শাস্তি চাই। আমরা কি নতুন প্রজন্মকে একটা সুস্থ সমাজ, পরিমল-বিহীন নির্মল পরিবেশ রেখে যেতে পারি না যেখানে কিছু বিশ্রী নোংরা শব্দের আতংক নিস্পাপ মুখগুলো থেকে চিরতরে মুছে যাবে?
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১১ রাত ১০:১৮