পর্ব ১
।। বারান্দা বালক ।।
চারতলার এই ঘর থেকে বাইরে খুব একটা নজর চলে না । চারটা দিকেই উঁচু উঁচু দালান গুলো শুধু চোখের দৃষ্টি আটকে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, মনের গণ্ডীও গুটিয়ে দিয়েছে অনেক খানি, নিজেকে মনে হয় গভীর কোন কূপের তলদেশে বন্দী কেউ, শ্যাওলা পড়া ইট বেয়ে বেয়ে নজর ওঠালে দূরে বহু দূরে একটু খানি নিষ্প্রাণ আকাশ ।
আজমলের প্রাণিবিদ্যা বইয়ে দুপুর থেকে ঘাড় গুঁজে থেকে হাঁপিয়ে ওঠা মেয়েটা জানালা দিয়ে বাইরে নজর গলালো । সরু গলির এপারের বাসিন্দা হয়ে ওপারের চারতলার ঘরবসতি দেখতে একফোঁটা বেগ পেতে হয় না। যদিও আজ পর্যন্ত দৃষ্টি আটকে দেবার মত কিছুই চোখে পড়ে নি তার ।
ওই চারতলার গ্রীলঘেরা বারান্দায় কখনো কেউ আসে না, জীবনের কোন অস্তিত্বই নেই ওখানে; না কোন গৃহপরিচারিকার ব্যস্ত হাতে মেলে দেয়া সদ্য নিংড়ানো কাপড়ের লেবু সাবানের সুবাস, না বিকেলে গিন্নীর ডুবো তেলে ভেজে তোলা লুচি অথবা পাকোড়ার জিবে জল আনা ঘ্রাণ ।
ওই বারান্দায় কোন শিশু হাত থেকে ছুটে যাওয়া বল কুড়াতে আসে না, নতুন বর বউয়ের সন্ধ্যা চায়ের কাপে টুংটাং শব্দে ওই বারান্দার নিস্তব্ধতায় আজতক টোল পড়ে নি ।
সামনের প্রতিদিনের এক ঘেয়ে অপরিবর্তিত শুন্য বারান্দার দৃশ্য, যেটা দেখতে দেখতে একসময় তার মনে হতে শুরু হয়েছিল, জানালাটার বাইরে কেউ বিশাল একটা ক্যানভাসে এঁকে স্থির এই দৃশ্যপট টাঙিয়ে দিয়ে গেছে ।
আজ সেই একঘেয়ে দৃশ্যে জ্যান্ত একটা পরিবর্তন !
চশমার পেছনে চোখ গুলো এই দিকে দেখছে না, মুখ উঁচু করে আকাশে দৃষ্টি ছড়িয়ে রেখেছে ছেলেটা । ধুসর টিশার্ট থমকে থমকে আসা তীব্র বাতাসে শরীরের সাথে বারবার লেপ্টে গিয়ে পেশীগুলোর জানান দিচ্ছে, পরনে কালো জিন্সের পায়ের ঝুল হাঁটু পর্যন্ত গোটানো, এক পা পেছনের দেয়ালে ঠেকিয়ে উদাসীন হেলান দেয়া শরীর ।
কানে গোঁজা হেডফোনের অন্য প্রান্ত বুকের উপর দিয়ে অবহেলিত হয়ে এঁকেবেঁকে প্যান্টের পকেটে ঢুকে গেছে ।
বাঁ পকেটে জায়গা করে নিয়েছে একটা হাত, অন্যটা অসতর্কভাবে হাটুর ওপরে পড়ে আছে, দুটো আঙুলের অপরিচিত তালে আলতো ঠোকাঠুকি দেখে ধারণা করা চলে, কানে বেজে চলা গানের সুর মগজের ধুসর কোষের ফাঁক গলে ছড়িয়ে পড়েছে ছেলেটার ভেতরে ।
বাতাসে কপালের চুল গুলো চোখ ঢেকে দিচ্ছিলো তার। উদাসীনতায় এতটুকু বিচলতা না এনে নিঃস্পৃহ হাতে চুলে আঙুল চালালো ছেলেটা। মুখ ঘোরালো, এই প্রথমবার সরাসরি তার মুখটা দেখতে পেলো মেয়েটা ।
এককালে ফরসা ছিলো হয়তো, এখন রোদে পুড়ে চেপে এসেছে রঙটা, মুখে দুদিনের না কামানো দাঁড়ি । কালো ফ্রেমের চৌকো চশমা, পেছনে দুটো চোখ অন্যকোন দিকে না গিয়ে সরাসরি মেয়েটার চোখকে শরবিদ্ধ করলো ।
প্রথমে শুন্য অপরিচিত দৃষ্টি, ভ্রু দুটো একটু কুঁচকে উঠল এরপর, সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য তীক্ষ্ণ একটা স্ফুলিঙ্গ দেখা গেলো তারা গুলো তে, কিন্তু পরক্ষনেই সৌজন্যের হাসি ফুটলো পাতলা ঠোঁটে ।
অপরিচিত বাঙালী পুরুষের মধ্যে এমনটা দেখেছে বলে মনে পড়লো না মেয়েটার । বিপরীত জানালায় বিপরীত লিঙ্গের কাউকে দেখা মাত্র ঔৎসুক্য আর কৌতূহল সদ্য খোলা কোমল পানীয়ের মত বিজবিজিয়ে ওঠে ছেলেগুলোর মধ্যে, চোখ দিয়ে পুরো আকার অবয়বটা মনে গেঁথে নেয়া হয়ে যায়, এর পর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা, বারবার পুকুরে ছিপ ফেলার কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে মেয়েটাকে ।
তাছাড়াও, বাঙ্গালীর সৌজন্য ঠিক আসে না, অপরিচিত কারো চোখে চোখ পড়লে কঠিন দৃষ্টি বিনিময়ই এখানে স্বাভাবিক ধরে নেয়া হয় । অথচ এই অচেনা বারান্দা বালক, সে হেসে আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে, এখন সে ঘাড়টা ঈষৎ বেঁকিয়ে তাকিয়ে আছে নিজের বুকের কাছে, ডান হাতের মধ্যমায় পড়া আংটিটা ঘোরাচ্ছে অন্য হাতে, আর এমন মনোযোগে সেটা পর্যবেক্ষণ করছে, যেন ওই এক আঙটির ঘূর্ণন দুনিয়ার তাবৎ ইলেকট্রনের একসাথে ঘোরার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ।
নাহ, এত চিন্তাগ্রস্ত কেনো?
মেয়েটার এইচএসসি চলছে, তাই প্রথমে পরীক্ষার কথাই মনে হলো – বছর পাঁচেকের বড়ো হবে ছেলেটা, হয়তো চাকরীর পরীক্ষা দিচ্ছে, হয়ে উঠছে না ।
কিন্তু না, দেখতে ঠিক ওদের ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রটার সিনিওর সংস্করণ, আর চিন্তাগ্রস্ততার ভেতরে দুশ্চিন্তা বা অস্থিরতার ছাপ নেই, নিখাদ চিন্তামগ্নতা, যেন প্রিয় অনুশীলনীর প্রিয় অঙ্কটা করতে বসেছে কেউ ।
তাহলে কি প্রেমিকার কথা ভাবছে ?
উহু, এত আবেগ শুন্য ভাবে কেউ প্রেমিকাকে ভাববে না, হয় সেই ভাবনায় মিশে থাকবে হাল্কা হাওয়াই মিঠাইর মত মিষ্টি কোন স্মৃতিকে আরেকবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখা, আর ঠোঁটের কোনে, চোখের কোনে ফুটবে প্রশ্রয়, স্নেহ, অনুরাগ।
অথবা আগুনের আঁচ থেকে মাত্র সরিয়ে আনা তিক্ত কফির মত কোন স্মৃতি হলেও, বিরক্তি, ক্ষোভ বা নির্ভেজাল বেদনা লুকিয়ে নির্লিপ্ততা ধরে রাখা এই তরুণকে মানাবে না।
আর তাছাড়া, এই ছেলেটির কোন প্রেমিকা থেকে থাকলে, এভাবে অযত্নে বেড়ে ওঠা চুল, দুদিনের না কামানো দাঁড়ি আর হাঁটু পর্যন্ত গোটানো জিন্সের নিচে দুটো খালি পা কোন মতেই বরদাস্ত করতো না, কোন মেয়েই তা করে না।
হেলে পড়া সূর্যকে হটিয়ে যায়গা করে নেয়া মেঘে মার্কার কলমের কালচে রঙ ছড়িয়ে গেছে মনে হচ্ছে, ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাওয়া মেঘ গুলোকে সেলাই করে জুড়ে দেবার জন্য বজ্র গুলোর কি আগ্রাসী চেষ্টা!
দমকা বাতাস এতক্ষণ ধরে কাঁপতে থাকা জানালার পর্দা উল্টেপাল্টে দিয়ে গেলো, আর মেয়েটাকে মনে করিয়ে দিলো, এতটা সময়ে তার চোখের দৃষ্টি কাঁপেনি একবারও, অপরিচিত কারো দিকে এতক্ষণ তাকিয়ে থাকা নিতান্তই অভদ্রতা, তায় আবার অচেনা তরুণ! ছেলেটা মোটেও ভালো ভাববে না।
মেয়েটি লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।
ঠিক সেই মুহূর্তে, মুনীর চোখ তুলে তার এতক্ষণের দর্শকের দিকে সরাসরি তাকালো। একটু আগের ভাবালুতা, সৌজন্য, নির্লিপ্ততা, একটা কিছুর একটাফোঁটা অস্তিত্ব নেই, ধকধক করে জ্বলছে তার দুই চোখ।
।। চলবে ।।
।। আমি ইচ্ছে করে লেখি না, মাঝে মাঝে কেউ একজন আমার মাঝে চলে এসে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়। নিজেকে ভাঙার চেষ্টা করেছি এই গল্পে, অথবা নিজেকে জোড়া দেবার। এই গল্পটা ঝর্ণার মতো বাইরে এসেছে, পুকুরের মত পুরোটার নকশা করে লিখতে বসিনি। গল্পের পরবর্তিতে কি হতে পারে, আমি নিজেও জানিনা। ইচ্ছে হলে চোখ রাখবেন পরের পর্বের জন্য। ।। [/sb
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ১১:০০