অষ্টম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষা, বাংলা। ১৯৮১ সন। সচরাচর ভালো প্রিপারেশন নিয়েই পরীক্ষার হলে গিয়ে থাকি, সেবারও। প্রশ্ন হাতে নিয়েই খুশিতে নেচে উঠি, সবই কমন। কিন্তু পরের পাতায় ভাব সম্প্রসারণ অংশে গিয়ে মাথা ঘাবড়ে গেলো, কারণ ভাব সম্প্রসারণ কমন পড়ে নি। দুটোর মধ্যে প্রথমটা জীবনে প্রথম বারের মতো পড়লাম :
দ্বার রুদ্ধ করে দিয়ে ভ্রমটাকে রুখি
সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?
সাথে সাথেই দু-তিনবার পড়লাম। না, মাথার ভেতর মগজ কিছুতেই খুলছে না। গেলাম পরেরটাতে,
সংসার-সাগর মাঝে সুখ-দুঃখ তরঙ্গের খেলা
আশা তার একমাত্র ভেলা।
দ্বিতীয়টা অবশ্য অপরিচিত নয়, রচনাবইতে এটা দেখেছি, কিন্তু পড়া হয় নি একবারও। কিন্তু তারপরও কথাগুলো খুব সহজ- সংসার একটা সাগরের মতো, সেখানে অনেক বড় বড় ঢেউ আছে। আমি পদ্মা নদী ও আড়িয়াল বিলে পাহাড়ের সমান উঁচু উঁচু ঢেউ দেখেছি, লঞ্চ ও নৌকা করে সেই ঢেউয়ের উপর দিয়ে নদী ও বিল পাড়ি দিয়েছি। একেকটা ঢেউয়ের তোড়ে মাঝে মাঝে লঞ্চ ও নৌকাগুলো ডুবে যাবার উপক্রম হতো, তখন প্রচণ্ড ভয় পেতাম, বুক কাঁপতো। তখন মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করতাম, আর ভাবতাম কতোক্ষণে এই ঢেউ পাড়ি দেব। একসময় ঢেউ পড়ে গেলে লঞ্চ আবার শোঁ শোঁ করে পানি কেটে চলতে থাকতো, তখন খুব আনন্দ হতো। সুতরাং আমাদের জীবন বা সংসারটা হলো এরকম পদ্মা নদী ও আড়িয়াল বিলের মতো। ঢেউগুলো হলো দুঃখ, আর ঢেউ পড়ে যাবার পরের অবস্থাটা হলো সুখ, আর ঐ যে মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করা, ঐটা হলো আশা, যাকে ভেলার সাথে তুলনা করা হয়েছে। এ অবস্থায় খটকা লাগলো, লঞ্চ বা নৌকা না বলে তাহলে ভেলা কেন বলা হলো? আমি বড় বড় কলাগাছ কেটে সুসজ্জিত ভেলা বানিয়েছি অনেক, কিন্তু সেগুলো বাইতে খুবই কষ্ট। বেশিদূর যাওয়াও যায় না। ঢেউয়ের মধ্যে তো ভেলা নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নও ওঠে না। সেজন্য, আশা তার একমাত্র ভেলা না হয়ে আশা তার একমাত্র লঞ্চ বা নৌকা বললে কবিতাটা যেমন অধিক অর্থবহ হতো, আমার ভাবসম্প্রসারণ করতেও সহজ হয়ে উঠতো, অন্তত এ ধরণের একটা খটকা বাঁধতো না।
যাই হোক, এরকম ঢেউ, ভেলা ইত্যাদির সাথে আমার আগে থেকেই পরিচয় ছিল। তাছাড়া, সুখের সাথেও আমার সামান্য পরিচয় ছিল জীবনের কোনো এক সময়ে, কিন্তু আমার বাবা সমস্ত জমাজমি, সহায়সম্পত্তি বিক্রি করে আরেকজনের সাথে ভাগাভাগি করে লঞ্চমালিক হতে গিয়ে প্রতাড়িত হয়েছিলেন, ফলে তিনি ফকির হয়ে গিয়েছিলেন, যার ফলে আমার দুঃখের সাথে আরও বেশি ঘনিষ্টতা জন্মেছিল। এভাবে সবদিক বিবেচনা করে দ্বিতীয় ভাবসম্প্রসারণটা আমার কমন না পড়লেও কবিতাটা যেন আমাকে উদ্দেশ্য করেই রচিত হয়েছিল, পরীক্ষার খাতায় ওটা পড়ে আমার এমনটা মনে হয়েছিল, তাই দ্বিতীয় ভাবসম্প্রসারণটাই এ্যাটেম্পট করতে হয়েছিল অগত্যা।
পরীক্ষার পর প্রথম কবিতাটা নিয়ে অনেক তফছরা করেছিলাম। কী হতে পারে এর অর্থ? দ্বার অর্থ দরজা, রুদ্ধ অর্থ বন্ধ, ভ্রম অর্থ ভুল বা মিথ্যা। বাকিগুলোর অর্থ পানির মতো তরল। তাহলে ব্যাপারটা কী রকম হয়? একটা ঘর, তার দরজা চারদিক থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, কিন্তু কে বন্ধ করেছে সে ব্যাপারে একটা প্রশ্ন থেকে গেলো। এবার সে ঘরে মিথ্যা বাবাজি ঢুকতে চায়। মিথ্যা যাতে ভেতরে না ঢুকতে পারে সেজন্যই বোধহয় এমন সুব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, সত্য মামাও সে ঘরে ঢুকতে চায় মনে হয়। কিন্তু সত্য'র জন্য তো কোনো দরজা খোলা রাখা হয় নি, তাহলে উপায়? মনে হয় ব্যাখ্যাটা মিললো না। তাহলে অন্যভাবে দেখি। ঘরের ভেতর মিথ্যাকে আটকে ফেলা হয়েছে। কিন্তু সে ঘরে এখন সত্য'রও ঢুকবার প্রয়োজন, হয়তো মানিব্যাগ বা আন্ডারওয়্যার ভেতরে রয়ে গেছে, ওগুলো আনতে হবে। অতচ ঘরের দরজা চারদিক থেকে বন্ধ, সত্য কোন্ পথে যাবে ঘরের ভেতর? অর্থাৎ, এটাও বুঝলাম না। কিছুই না বুঝতে পেরে সাব্যস্ত হয়েছিল, কবিতায় গোঁজামিল আছে। গোঁজামিলঅলা এমন কবিতা কার লেখা? অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছিলাম, ওটা রবিকাকার লেখা। আর ঢেউ-তরঙ্গের কবিতাও নাকি রবিকাকাই লিখেছিলেন? খুব আফসোস হয়েছিল, এমন গোঁজামিলঅলা একটা কবিতা বৃত্তি পরীক্ষায় ভাবসম্প্রসারণে দেয়া হলো? রবিকাকার উপর তখন খুব রাগ হয়েছিল। তিনি এরূপ আজগুবি কবিতা আরও লিখেছেন- ভেঙে মোর ঘরের চাবি... আপনারা কেউ কোনোদিন শুনেছেন, ঘরের চাবি ভেঙে চোর ঘরে ঢুকেছে? ভাঙা হয় ঘরের দরজা বা তালা। অতএব, বলা সঙ্গত ছিল- ভেঙে মোর ঘরের তালা বা ভেঙে মোর ঘরের দরজা...
এরপর নবম শ্রেণীতে উঠে নতুন বইয়ে পেয়েছিলাম- দ্বার রুদ্ধ করে দিয়ে... অনেক পড়ে বুঝবার চেষ্টা করেছি, বুঝি নি। তখন যেমন বুঝি নি, তার পরের ক্লাসেও বুঝি নি, আজও বুঝি না। শুধু ছেলেমেয়েদের রচনা বইটা হাতের কাছে পেলে খুঁজে দেখার চেষ্টা করি, এটা আছে কিনা...
দ্বার রুদ্ধ করে দিয়ে ভ্রমটাকে রুখি
সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৩৫