somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একুশে বইমেলা পরিভ্রমণ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২; আমার বই; সতীর্থদের বই কেনা

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ১০:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
পূর্ব পাঠের পুনরালোচনা : একুশে বইমেলা পরিভ্রমণ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১১








একুশে বইমেলা ২০১২ : মেলায় যাবার তারিখ খুঁজে পাচ্ছি না

১ ফেব্রুয়ারিতে বড় ছেলে পাইলটের এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ব্যস্ততার কারণে ছুটি পাই নি বলে প্রথম পরীক্ষার দিন থেকে বাসায় থাকতে পারি নি। শেষে ১ মাসের ছুটি নিয়ে ৩ তারিখ থেকে বাসায়। পাইলটকে আমি সচরাচর পড়াই না, গার্ড দিই, পড়ান ওর প্রাইভেট টিউটরগণ। ওর পড়ার দৌড় হলো স্কুলের পড়া, এবং বাসায় এক-আধঘণ্টা টিউটর যা পড়ালেন তাই। এ-পড়া দিয়ে কি এসএসসি পরীক্ষা হয়? ও সারাক্ষণই একটা না একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত আছে- দম ফেলবার ফুরসত নেই- মোবাইল বা আইফোনে গান শোনা, মোবাইল খুলে এর নাড়িনক্ষত্র ছেড়াবেড়া করা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, আর রাত জেগে টিভিতে মুভি দেখা, আরো কতো কী! আমি বাসায় থাকলে মুভি দেখা বন্ধ হয়; কারণ, টিভি হলো বেডরুমে, যেখানে আমি ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকি। ওর মাকে সকাল-সকাল ঘুমিয়ে পড়তে হয় বলে আমার উপস্থিতিতে টিভি ছেড়ে ডিসটার্ব করার সাহস পায় না, কিন্তু আমি বাসায় না থাকলে কে শোনে কার কথা।

রাতে শোবার আগে পাইলট জানিয়ে যায় ভোর ৫টায় ডেকে দিতে। আমি মোবাইলে এ্যালার্ম দিয়ে শুই। ৫টায় উঠে ওকে জাগিয়ে দিয়ে ওর রুমে ওর বেডেই আমি শুয়ে পড়ি। পাইলট পড়তে বসে। কিছুক্ষণ পরে দেখা যায় ও নিচতলায় গিয়ে শুয়ে পড়েছে, বা আইফোনে গান শোনা শুরু করেছে। তখন পড়ার টেবিলে ফিরিয়ে আনি। একটু পর হয়তো নিজে নিজেই নুডুলস রাঁধতে নিচে চলে গেলো। খাওয়া-দাওয়া সেরে পড়তে বসতে বসতে অনেক সময় নষ্ট করে ফেলে। হঠাৎ হঠাৎ সে বাসা থেকে হাওয়া হয়ে যায়। ফিরে এলে জিজ্ঞাসা করলে বলে, তার এক বড় ভাইয়া বহুদিন পর বাসায় এসেছে, দেখা করতে গিয়েছিলাম। অনেক অনুনয়-বিনয় করে পড়ানোর পর আমি ওকে কিছু সময় ঘুমোতে বলি। সে শুয়ে পড়ে। হঠাৎ দেখা যায় তার ঘরে খুটখাট, টুংটাং আওয়াজ হচ্ছে- দরজা খুললে দেখি সে ক্যামেরার নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ছে, বা মোবাইল-টেকনোলজি আবিষ্কারে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। আমি রেগে যাই- ওর মোবাইল ওর মা তালাবন্ধ করে রাখে, ওটা না পেয়ে সে আমারটার উপর অপারেশন চালায়।

এভাবে সারাক্ষণই পাইলটের পেছনে লেগে থাকতে হয় বলে এক দণ্ডের জন্য বাসা থেকে দূরে থাকবার প্লান করতে পারি না। ১৬ ফেব্রুয়ারিতে ওর ইসলাম ধর্ম পরীক্ষা, এর পরের পরীক্ষা ১৯ তারিখে- ফিজিক্স। ফিজিক্সে সে ভালো। একদিনের রিভিশনেই নাকি এ+ পাওয়া সম্ভব হবে। ১৫ তারিখ রাতে আমি ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, ১৬ তারিখে ২টার দিকেই ঢাকা যাবো, ঢাকায় রাত কাটিয়ে তারপরদিন পুরোটা বইমেলায় ঘুরে ১৭ তারিখে বাসায় ফিরবো। কিন্তু ১৫ তারিখের রাতে ভালো ঘুম হলো না, চোখ জ্বলতে থাকলো, সকালেও ঘুমানো সম্ভব হলো না বলে সিদ্ধান্ত পালটে ১৬ তারিখের বদলে ১৭ তারিখে বইমেলায় যেয়ে ঐদিনই বাসায় ফিরে আসার প্লান করি।

ঢাকায় যাবো কী যাবো না

আমাদের ক্লাসমেট শাহনাজ শুক্রবারদিন রাতে ৩ ছেলে সহ ইনডিয়া যাবে, ওর বড় ছেলের চিকিৎসার জন্য। ভাবলাম ১৭ তারিখে ৮টার দিকে ঢাকা রওনা হবো। ১০টা নাগাদ সায়েদাবাদ, ১১টার মধ্যে শাহনাজের বাসায়। ওর বাসায় ঘণ্টাখানেক থাকবার পর দুপুর ১টার মধ্যে বইমেলায় চলে আসবো। বইমেলা শেষ করে ৬টার মধ্যে সায়েদাবাদের উদ্দেশে রওনা দিয়ে ১০টার মধ্যেই বাসায় ফিরে আসবো। কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙে সাড়ে ৯টার দিকে। আজও ভালো ঘুম হয় নি। চোখ জ্বলছিল। উঠে হাতমুখ ধুয়ে ল্যাপটপ অন করে ব্লগ ও ফেইসবুকে ঢুঁ মারি। ১০টা বেজে গেছে ততোক্ষণে। হঠাৎ করেই প্লান স্থির করে ফেলি, আজই একমাত্র দিন বইমেলায় যাবার। এরপর সময় পাবো না। পরের পরীক্ষাগুলোর সময় পাইলটের পিঠে পিঠে লেগে থাকতে হবে। পরীক্ষা ২৮ তারিখে শেষ হলে ২৯ তারিখেও বইমেলায় যাওয়া যায়- তবে শেষদিনের বিরাট ভিড়ের মধ্যে বইমেলার আনন্দ উদ্‌যাপন করা সম্ভব হবে না।

তখনো সকালের নাস্তা হয় নি। স্ত্রীকে বইমেলায় যাবার কথা বলতেই সে ঠেস দিয়ে উঠলো- তাতো যাইবাই? ঐটাই তো তোমার জীবন:) এ বলেই সে নাস্তা বানাতে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর একথালা নুডুল্‌স নিয়ে হাজির। নুডুল্‌স খাচ্ছি, আর ছোটো ছেলে তার বায়না জানান দিচ্ছে, সেও আমার সাথে বইমেলায় যাবে। এর আগে তাকে বলেছিলাম তোমাকে বইমেলায় নিয়ে যাবো। সে কয়েকদিন পর পরই তাগাদা দিত বইমেলায় কবে যাওয়া হবে। আজ যাওয়ার কথা শুনে সে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। কিন্তু তার লাফানো থেমে গেলো যখন বললাম- তোমাকে নেয়া যাবে না। শুক্রবারে এমনিতেই খুব ভিড় হয়। হাঁটতে হবে দীর্ঘ লাইন। তা ছাড়া আজই চলে আসতে হবে বলে খুব চাপের মধ্যে থাকবো। তোমার খুব কষ্ট হবে। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা, যাবেই। তার জন্য অনেক কিছু আনা হবে, এ কথার বিনিময়ে সে শেষপর্যন্ত রাজি হলো- বইমেলায় যাবে না।

অবশেষে বাসা থেকে বের হলাম

অবশেষে ১১:৩৫-এর সময় বাসা থেকে বের হলাম। একটা স্কুলব্যাগ কিনেছি। যাতায়াতের সময় এটাতে কিছু কাপড়চোপড় ও ল্যাপটপ রেখে ছাত্রদের মতো পিঠে ঝুলিয়ে আরামসে দৌড়ে হাঁটা যায়। তবে ছেলেমেয়েরা এটা নিয়ে আমাকে হাঁটতে দেখলেই ঠাট্টা করে- আমি নাকি বুড়ো ছাত্র! ফাইন, ছাত্রদের কোনো বয়স থাকে নাকি?:):) স্কুলব্যাগের ভেতরে সবুজ অঙ্গনের পুরো সংখ্যার গোটা দশেক কপি ও ব্লেজার ঢুকালাম। ল্যাপটপ গুছিয়ে ওয়ার্ড্রবে রাখলাম। একবার ভাবলাম মডেমটা সাথে নিয়ে যাই, পরে কী মনে করে ওয়ার্ড্রবের এক কঠিন ঘুপচিতে রেখে দিলাম, যাতে পাইলট খুঁজে বের করতে না পরে। বাসস্ট্যান্ডে যাওয়া মাত্রই টিকিট পেয়ে গেলাম। জানালো ২ মিনিটের মধ্যেই বাস চলে আসবে। কিন্তু বাস আসতে ২০ মিনিটের মতো লাগলো। ১২টার সময় বাস ছাড়লো। আনুমানিক ২টার দিকে সায়েদাবাদ পৌঁছবো। চিন্তায় পড়ে গেলাম, শাহনাজের বাসায় গেলে বইমেলায় ঘোরা যাবে না, আবার ঢাকায় এসেছি অথচ ওকে আজ সি-অফ করতে যাই নি এটা ও যেদিন জানতে পারবে, খুব কষ্ট পাবে, এবং মাইন্ড করবে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনে মনে যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই হলো। গৌরীপুর থেকে ২ কিলোমিটার শর্টে থাকা অবস্থায়ই জ্যামে পড়লাম। কঠিন জ্যাম। বাসে বসে থেমে থাকা গাড়ির সুদীর্ঘ লাইন প্রায় ১ কিলোমিটার পর্যন্ত দেখা যায়, এরপর বাঁক। বাসে বসে আছি তো আছিই। এর মধ্যে বাসায় বেশ কয়েকবার কথা বলেছি। ছোটো ছেলে অস্থির হয়ে পড়েছে- আমি কতোক্ষণে বাসায় ফিরবো। হাসি পাচ্ছিল, এখনো ঢাকায়ই যাওয়া হলো না, আবার ফিরবো কখন? মাঝখানে একবার বাস থেকে নামলাম। বাসা থেকে এসেছি মাত্র ৩৫ কিলোমিটার, সামনে আছে ৪৫ কিলোমিটার। বাসায় ফিরে গেলে কেমন হয়? ... নাহ্‌, ঘুরেই আসি। একবার পেলাম মেয়ের ফোন, তার জন্য চকোলেট নিয়ে আসতে হবে। তার বিশেষ পছন্দের চকোলেট আছে, সেগুলো আনতে হবে। ছোটো ছেলের আরেকটা আবদার যোগ হয়েছে- স্প্রাইট নিয়ে যেতে হবে তার জন্য। এতেও খুব হাসি পেলো। ঢাকা থেকে স্প্রাইট নিয়ে যেতে হবে? বাচ্চাদের কথা কী আর বলবো?:) শেষ পর্যন্ত ৩টার দিকে জ্যাম ছাড়ে। গাড়ি চলতে থাকে। ঠিক ৪টার সময় সায়েদাবাদ পৌঁছি- কাঁটায় কাঁটায় ২ ঘণ্টা লেট।

সকালে নুডুলস খেয়েছি খুব কম পরিমাণে। খিদে লেগেছিল বেশ আগেই। কোনো ভাজাপুরি বা ফাস্টফুড খেলে পেটে সমস্যা দেখা দিতে পারে। ভাত খেতে হবে। বাস থেকে নেমেই রিকশা নিলাম- সোজা গুলিস্তান 'রাজধানী হোটেলে।' ঢাকা কলেজে পড়ার সময়ও মাঝে মাঝে এ হোটেলে খাওয়া-দাওয়া করেছি। এরপরও। এর দোতলায় মিনি চাইনিজ। নিচতলায় মোটামুটি ভালো মানের দেশজ খাবার। আমার ভালো লাগে।

ও, শাহনাজের কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। জ্যাম থেকে ছোটার পর বাসে বসে শাহনাজকে কল দিয়েছিলাম। ধরেছিল ওর ছেলে। জানতে পারলাম ওরা আজ যাবে না, যাবে রবিবারে। হাঁফ ছাড়লাম। এখন রিকশায় উঠতেই শাহনাজের ফোন। বললাম, জরুরি কাজে বইমেলায় যেতে হচ্ছে। ও যাতে বাসায় যাওয়ার জন্য পীড়াপিড়ি না করে সেজন্য চালাকি করে বললাম, তুই বইমেলায় চলে আয়, মাত্র তো ১০ মিনিটের রাস্তা। ও জানালো বেশ কিছু ছোটোখাটো কেনাকাটা আছে বলে আসা সম্ভব না। কিন্তু উলটো আমাকেই সে জোড়াজুড়ি করতে লাগলো বাসায় যাওয়ার জন্য। আমাকে আজই ফিরে যেতে হবে, মেয়ের জন্য চকোলেট, ছোটো ছেলের জন্য নানারকম গিফ্‌ট। ওরা অধীর হয়ে বসে আছে আমার ফিরে যাবার জন্য। শাহনাজের বাসায় গেলে বইমেলায় যাওয়া হবে না, অথচ বইমেলার জন্যই আমার ঢাকায় আসা। ২০০৩-২০০৫ পর্যন্ত প্রতি বইমেলায় ২৮ দিনে আমার কমপক্ষে ২৮ বার বইমেলা ভ্রমণ হয়েছে (কোনো কোনোদিন একাধিকবারও)। তখন ঢাকায় ছিলাম বলে এটা সম্ভব ছিল। এরপর বইমেলার সময় মন খুব কাঁদতো, অথচ যাওয়া হতো না, গেলেও বড়জোর একবার। এতো হিসাব-নিকাশ করে আজকের দিনটা বের করলাম, যা থেকে আবার ট্র্যাফিকজ্যাম খেয়ে ফেলেছে অতি মূল্যবান ২ ঘণ্টা, এতোদূর এসে যদি বইমেলা মিস করি তাহলে আমি মর্মে মরে যাবো। শাহনাজকে সাত-পাঁচ বুঝিয়ে বললাম আজ কিছুতেই তোর বাসায় আসা সম্ভব না। শেষ পর্যন্ত ওর কাছ থেকে মুক্ত খুব স্বস্তি বোধ করতে লাগলাম।।

রিকশা থেকে নেমে ঝড়ো গতিতে হোটেলে ঢুকি। বেসিনে হাতমুখ ধুয়ে খাবারের অর্ডার দিই। কইমাছ, পাতলা ডাল, টমেটোর চাটনি দিয়ে এক প্লেট ভাত খাই। এরপর এককাপ চা। চা-টা ছিল দারুণ। খাবার শেষ করলাম ১৫ মিনিটে। বের হয়ে আরেক রিকশা নিয়ে সোজা বইমেলায়।

বইমেলায় ঢুকবার পথে

দোয়েল চত্বরের মোড়ে যখন রিকশা থেকে নামি তখন আমার ঘড়িতে ৫টা ১ মিনিট। শুক্রবারের বিকেলের প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে মেইন গেইটের দিকে প্রায় দৌড়ে যাচ্ছি, মাঝেমধ্যে ক্যামেরা অন করে হাত উঁচু করে এক হাতে ছবি তুলি। মেইন গেইটে একটা অফিশিয়াল কাজ আছে। ওখানে আমার অফিসের এক ব্যক্তি একটা চেকবই নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। ১০টি পাতায় আমার বিশটি সিগনেচার দিতে হবে। অতীব গুরুত্বপূর্ণ।













খুব তাড়াহুড়োর উপরে চেকবই সাইন করার পর মেইন গেইট দিয়ে যখন ভিতরে ঢুকছি তখন ৫:১৫ বাজে। একদণ্ড দাঁড়াই। স্কুলব্যাগের বাইরের পকেট থেকে লেখকদের তালিকা বের করি। সকালে ব্লগ ও ফেইসবুক থেকে প্রিয় লেখকদের তালিকাটা করতে হয়েছে, তাও করতে হয়েছিল খুব তাড়ার উপর। এই তালিকাটা এ পোস্টে আপনাদেরকে দেখাবার প্রয়োজন পড়বে তা তখন মনে পড়ে নি, মনে পড়লে হাতের লেখা সুন্দর করবার চেষ্টা করতাম:) ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত শিক্ষকগণ আমার সুন্দর হাতের লেখার খুব তারিফ করতেন। স্কুলসেরা ছিল আমার হাতের লেখা। ক্লাসের ফার্স্টবয়ও আমি। হাতের লেখা থেকেই তা বোঝা যেতো:) এসএসসি দেবার আগে হাইস্কুলের হেডস্যার একদিন বকতে বকতে বললেন, ইমরানের হাতের লেখা কত্তো সুন্দর, আর তোর হাতের লেখা বাচ্চা পোলাপানের মতো। তখনও ক্লাসে আমি ফার্স্টবয়, কিন্তু আমার হাতের লেখায় নাকি তা বোঝা যেতো না:( এরপর ইন্টারমিডিয়েটে পরীক্ষা দিয়েছি বলপয়েন্টে। ওখান থেকে আমার হাতের লেখার যাচ্ছেতাই অবস্থা শুরু হতে থাকে। সেই যে গেলো, আর কোনোদিন নিজের সুন্দর হাতের লেখার সন্ধান পেলাম না। অথচ সুন্দর হাতের লেখার গুরুত্ব অপরিসীম তা আমি চাকরিজীবনে ঢুকে বুঝতে পেরেছি। স্ট্যান্ডার্ড হাতের লেখার জন্য আমি বহুদিন চর্চা করেছি। শেষ পর্যন্ত দেখলাম মরে গেলেও হবে না। আমি যে একটা বুকলিস্ট করেছিলাম তা প্রমাণের জন্য ওটার ইমেজ এখানে জুড়ে দিলাম। হাতের লেখা দেখে কেউ লজ্জা পাবেন না আশা করছি। আর ইচ্ছে করেই ওটা বাঁকা করে তুলে বাঁকা করে ইনসার্ট করেছি; অতি আগ্রহী বন্ধুরা ডাউনলোড করে রাইট-রোটেট করে ভিউ বাড়িয়ে দেখতে পারেন লিস্টে কাদের বইয়ের নাম ছিল।



আমার লিস্টের প্রথম বইটির নাম চন্দ্রহারা মানবী, লিখেছেন ব্লগার মাহী ফ্লোরা, প্রকাশনীর নাম 'আড়িয়াল'। কিন্তু যন্ত্রণা হলো স্টলের নাম দেয়া নেই। স্টল নম্বর না থাকলে আজকাল বইমেলায় স্টল খোঁজা অন্ধকারে সুঁইয়ে সুতা ঢোকানোর চেষ্টার চেয়ে বেশি কিছু না। মাহী ফ্লোরার উপর রাগ হলো- তিনি আমার প্রিয় লেখক, তাঁর একটা বই আমার চাই-ই, অথচ সামান্য স্টল নম্বরটা তিনি দিতে পারলেন না! ধ্যেত বলে লিস্টের দ্বিতীয় নামটি দেখে মেজাজ তিরিক্ষি হলো- এ বইটির প্রকাশকেরও স্টল নম্বর দেয়া নেই, শুধু লেখা আছে 'ভনে।' এবং এখানেও স্টল নম্বর দিতে যিনি ব্যর্থ হয়েছেন তিনি স্বয়ং মাহী ফ্লোরা, যাঁর আরেকটি বইয়ের নাম সে এক আশ্চর্য জলপ্রপাত। ব্লগে প্রকাশনী ও প্রাপ্তিস্থানের ব্যাপারে আরো কী কী যেন লেখা ছিল, মনে করতে পারলাম না। আমার হাতে সময় খুবই কম, মাত্র দেড় ঘণ্টার মতো। মহাভিড়ের মধ্যে প্রিয় লেখকদের বইগুলো কিনতে হবে, প্রিয় দু-একজন মানুষের সাথে দেখা করতে হবে, এবং 'র‌্যানডম বেসিসে' দু-একটা স্টল থেকে কিছু 'প্রথম দেখায় ভালো লাগা' বা পূর্বেই নাম হয়েছে এমন কিছু বই কিনতে হবে। এসব সম্পন্ন করে ঠিক ঠিক সাড়ে ৬টার মধ্যে আমার বইমেলার প্রাঙ্গন ছেড়ে উড়াল দিতে হবে সায়েদাবাদের পথে- আমাকে আজই বাসায় ফিরতে হবে- ছেলেমেয়েরা অধীর আগ্রহে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। শেষমেষ মাহী ফ্লোরার বই লাস্ট অপশন হিসেবে রাখতে হলো।

লিস্টে চোখ বুলিয়ে বাকি বইগুলোর স্টল নম্বর দেখে নিলাম। স্টল নম্বর ৬০-৬১। নন্দিতা প্রকাশনী। প্রকাশক বিভি রঞ্জনদা আমার একজন প্রিয় মানুষ। তাঁর ওখান থেকে আরেকজন প্রিয় মানুষ মনোয়ারা মণির বই বের হচ্ছে। চলুন যাওয়া যাক।

নন্দিতা প্রকাশনী। স্টল নং ৬০-৬১

বইমেলার সর্ব-উত্তরের গেইট দিয়ে ঢুকেছিলাম। যেখানে দাঁড়িয়ে লিস্টি পড়ছিলাম ঠিক তার বাম দিকের গলির শেষের দিকে নন্দিতা প্রকাশনীর স্টল। আমি ভিড় ঠেলে দ্রুত এগোচ্ছি। অনেকের সাথেই বিপরীতমুখি কলিয়্যুশন হচ্ছে, কাউকে আবার ডানে-বামে-পেছন দিক থেকে আমার ধাক্কা বা কনুই খেতে হচ্ছে, আমি অনবরত 'স্যরি' বলে যাচ্ছি:(



স্টলের সামনে অনেক ভিড়। এবং ভেতরেও ভিড় কিছুটা কম নয়:) লোকজনকে সামান্য ঠেলেঠুলে স্টলের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। 'এটা কি নন্দিতা প্রকাশনী?' প্রশ্ন শুনে কয়েকজনে হেসে উঠে বললেন, 'জি, এটা নন্দিতা প্রকাশনী।' 'প্রকাশক মহোদয় কি আছেন?' জিজ্ঞাসা করতে করতেই দেখি এককোণে ল্যাপটপ ছেড়ে 'ফেইসবুকিং' (?) করছেন প্রকাশক মহোদয়। আমার গলার আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে প্রাণখোলা হাসিতে শোরগোল করে উঠলেন প্রিয় রঞ্জনদা, তারপর হাত বাড়ালেন হ্যান্ডেশেকের জন্য, '...অনেক অনেক দিন পর দেখা। কেমন আছেন খলিল ভাই?' স্বল্প সময়ে আন্তরিক কুশল বিনিময়ের পর লিস্ট বের করতে করতে বলি, 'মনোয়ারা মণির বই বের হয়েছে না? ওটা দিন।' তারপর বইয়ের উপর লিস্টটা ছড়িয়ে দিলে তিনি নিজেই ওটা থেকে নাম দেখে মনোয়ারা মণির বই বের করে দিলেন। মুনীব রেজওয়ান নামটা পরিচিত মনে হলো। রঞ্জনদাকে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বলেন, 'হ্যাঁ, এখানে যাঁদের বই দেখছেন তাঁরা অনেকেই আপনার পরিচিত।' আমি আমার পরিচিতদের বইগুলো দেবার কথা বললে তিনি নিচের বইগুলো প্যাকেট করে দিলেন :

একজন অভিবাসীর জার্নাল - মনোয়ারা মণি
ত্রয়ী ও নীলাঞ্জনা - আদিত্য অনীক, মনোয়ারা মণি, বিভি রঞ্জন
বৃষ্টির প্রেম ও বিষণ্ণ বসন্ত - বিনোদ বিহারী সরকার
নীলকণ্ঠ - মুনীব রেজওয়ান
ভালোবাসার প্রবল প্রতাপ - সোনাম মনি
ভালোবাসি তোমার রোদ্দুর হাসি - নাফিয়া সুলতানা
অবিরত তুমি - রুকসানা কাঁকন
অতীত জলে তুমি - সামিউন নবী সামিম
সংকলিত শ্রাবণ - প্রতাপ শেখর মোহন্ত
শ্রাবন্তীর কষ্ট - মাহফুজা আফজাল মিনি







কাঁধ থেকে স্কুলব্যাগ নামিয়ে দ্রুততার সাথে সবগুলো বই ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম দৌড়। বটতলায় হয়তো কোনো বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হচ্ছিল। ওদিকে যাবার সময় হলো না, একটা ছবি তুললাম দূর থেকে।



এর পরের স্টল নম্বর ১১৭-১১৮। বটতলাকে ডানে রেখে একটু পশ্চিমে এগোবার পর ডানে মোড় নিলেই এ ব্লকের শেষ মাথার দিকে ১১৭-১১৮ নম্বর স্টল

মৌনমুখর বেলায়, রেজওয়ান তানিম

জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশনের স্টল নম্বর হলো ১১৭-১১৮। এখানে বেশ ফাঁকা। স্টলের সামনে ৩-৪ জনের মতো লোক ছিল। আমি যাবার পর আরো দুজন কমে গেলো। স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করি, 'ভাই, এটা কি জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন?' ভেতরে ৩ ব্যক্তি ছিলেন। হেসে বললেন, 'জি।' 'রেজওয়ান তানিম কে?' জানতে চাইলে বলেন, 'সে মেলায় আসছে, তবে এখানে নাই।' বললাম, 'তাঁর বই বের হয়েছে না?' জিজ্ঞাসা করতেই তানিম রেজওয়ানের 'মৌনমুখর বেলায়' এগিয়ে দিলেন। আমি তানিমের দুটো বই নিয়ে কাঁধের স্কুলব্যাগে ঢুকালাম, আর তানিমের জন্য সবুজ অঙ্গন ১৬শ সংখ্যার (সর্বশেষ সংখ্যার আগের সংখ্যা) এক কপি স্টলে রেখে দ্রুত চলে যাই।



'মৌনমুখর বেলায়'-এর ব্যাকপেইজে 'সুধীজনের প্রতিক্রিয়া' অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে সঙ্গীত শিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী, কবি, ছড়াকার, কলামিস্ট, ব্লগার ও ফেইসবুক ফ্রেন্ড ডাঃ সুরাইয়া হেলেন এবং ব্লগার স্বদেশ হাসনাইনের পাঠপ্রতিক্রিয়া লিপিব্ধ রয়েছে। তাঁরা সবাই বইয়ের প্রশংসা করেছেন। ইনার ফার্স্ট ফ্ল্যাপে কবিতাসদৃশ বক্তব্য বা কবিতা, লাস্ট ফ্ল্যাপে কবির জীবনবৃত্তান্ত বিধৃত রয়েছে। এটি তাঁর প্রথম বই। অধিকাংশ কবিতার রচনাকাল উল্লেখ করা আছে, আর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, অনেক কবিতার নিচে 'প্রাককথন' হিসাবে কবিতার পটভূমিকা বর্ণনা করা হয়েছে। মোট ৩৭টি কবিতা আছে এতে। পুরোপুরি কোনোটাই পড়তে পারি নি, কেবল চোখ বুলিয়ে গেছি। তবে 'পরম্পরা' কবিতাটিকে প্রায় নির্দোষ মনে হয়েছে।



মূল চত্বর! নিকাশের দায়! আজ তোমার মন খারাপ মেয়ে! ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ এবং ঢাকা কলেজে আমার টিচার কবি শামীম আজাদের প্রিয়ংবদা

মূল চত্বরের দিকে হাঁটতে থাকি। এবারের লক্ষ 'সূচিপত্র', স্টল নং ২১১-২১৩। কোন্‌ গলিতে এটা? মূল একুশে চত্বরের এক ধারে দাঁড়িয়ে প্রত্যেক গলির প্রথম দিকের স্টলগুলোর নম্বর পরখ করতে থাকি। আর তখনই চোখে পড়লো, ভাস্কর্য থেকে সোজা পশ্চিম দিকে সে সরণি চলে গেছে, ঠিক তার ডানের কোনার প্রথম স্টলটিই সূচিপত্রের।





৩ ইউনিটের সূচিপত্রের স্টলে বেশ ভিড়, চত্বরের মোড়ে হওয়ায় ভিড় আরো বেশি। তবে স্টলের কাছ ঘেঁসে দাঁড়ানোর ঠাঁই পেয়ে গেলাম। ভিতরে ৭-৮ ব্যক্তি বসে-দাঁড়িয়ে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। এঁদের মধ্যে যে-কোনো একজন হানিফ রাশেদীন না হয়ে যান না। হানিফ রাশেদীন ব্লগে আমার একজন প্রিয় লেখক। তাঁর গদ্য ও কবিতায় আমি মুগ্ধ। প্রতিভাধর একজন ব্লগার, বুদ্ধিদীপ্ত তাঁর লেখা। সাবলীল, এবং শৈল্পিক উৎকর্ষতায় উত্তীর্ণ। তাঁর সাথে দেখা হলে বেশ ভালো লাগবে। খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে জিজ্ঞাসা করলাম, 'ভাই, আপনাদের মধ্যে হানিফ রাশেদীন কে?' প্রশ্ন শুনে দু-একজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলে আরেকবার বললাম, 'হানিফ রাশেদীন কি এখানে আছেন?' তখন জবাব পেলাম যে তিনি আসেন নি। 'তাঁর বই বেরিয়েছে না? বইটা কি এসেছে?' এক ব্যক্তি তখন ভিতর থেকে এক কপি আমাকে বের করে দেখালেন। আমি ২ কপি চেয়ে নিয়ে ব্যাগে ঢুকাচ্ছি, তখন এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলেন, 'ভাই, আপনি কি খালি নতুন লেখকদের বই-ই কিনছেন?' আমি হেসে বললাম, ‘জি। তবে হানিফ রাশেদীন নতুন লেখক হলেও অনেক ভালো লেখেন।'



বইটির উপর আজ বিকেলে চোখ বুলিয়ে গেলাম। আমি রীতিমতো মুগ্ধ। বইয়ের ভিতরে-বাইরে দৃষ্টিকটূ ও বাগাড়ম্বরপূর্ণ কোনো অতিরিক্ত সাজসজ্জা নেই, লেখক-পরিচিতিটুকু পর্যন্ত দেয়া হয় নি। ফার্স্ট ফ্ল্যাপে জনৈক জাভেদ হুসেন লিখিত একটা ভূমিকা আছে, যা ভাবগাম্ভীর্যে উত্তীর্ণ। ৩ ফর্মার এ বইয়ে ৪০টি কবিতা রয়েছে। তাঁর রচনাশৈলি অসাধারণ, বিষয় নির্বাচনে তিনি পরিণত। কলমচর্চা অব্যাহত থাকলে অচিরেই আমরা দেখবো প্রবীণ ও প্রতিষ্ঠিতদের সাথে পরিপক্বতার দিক থেকে তাঁর পার্থক্য ক্ষীণ। নিরন্তর শুভ কামনা তাঁর জন্য।



এরপর? রানার বই। ‘আজ তোমার মন খারাপ মেয়ে।' সবাই জানেন যে এ-কথাটি তাঁর 'পরী' গানের অন্তর্গত। সে থেকে এ বইয়ের নাম। একই গলি ধরে সামনে এগোতে হবে। স্টল নম্বর ২৯৩-৯৫। সামনে হাঁটছি। একটু এগোতেই রাস্তার মাঝ বরাবর রঙিন কর্কশিটে 'রানা?' লিখিত একটি বোর্ড টাঙানো দেখতে পাই। পেয়ে গেছি স্টল। কিন্তু না, এটি শিখা প্রকাশনী বরারবর টাঙানো হয়েছে, রানার স্টল হলো 'অন্বেষা'। 'অন্বেষা' আর কতোদূর?



'রানা?' লিখিত বোর্ডটি পার হবার কিছু পরই 'অন্বেষা'র স্টল পেয়ে গেলাম। প্রচণ্ড ভিড়। কোনোরকমে কয়েকজনের মাথার উপর দিয়ে আমার ঘাড় উঁচু করে একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'এখানে কি রানা আছেন? রানা আছেন এখানে?' 'না, উনি সামনে আছেন।' 'তাঁর বইটা কি মেলায় এসেছে?' 'হ্যাঁ।' 'আমাকে ২ কপি দিন'। ৩-৪ জনের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে রানার 'আজ তোমার মন খারা মেয়ে' বইয়ের মোড়ক তুলে নিই।



'রানা। পুরো নাম শেখ আবদুল্লাহ আল মতিন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ঢাকাতে জন্ম আর বেড়ে ওঠা হাইকোর্ট কম্পাউন্ড এর সবুজ নির্ভার পরিবেশে। ... লিরিক লিখছেন ৯৯-২০০০ থেকে। সুমন আর সঞ্জীব চৌধুরীর লিরিকের ভক্ত। বাপ্পা মজুমদারের অসাধারণ সুরে লিরিকগুলো দারুণ সব গান হয়েছে একের পর এক। ইদানীং নাগরিক লিরিক লিখছেন বেশি। ...। ব্লগে লেখালেখি করেন নস্টালজিক নামে। ... 'আজ তোমার মন খারাপ মেয়ে' - লেখকের প্রথম প্রকাশিত লিরিকের বই।
..... এভাবেই লাস্ট ফ্ল্যাপে রানা সম্পর্কে সামান্য তথ্য দেয়া আছে। ফার্স্ট ফ্ল্যাপে আছে ক্ষুদ্র এক টুকরো কবিতা (বা তাঁর লিরিকও হতে পারে) :

রেখে গেলাম সে সব কথা
ভুবন চিলের সাঁঝ
দেখুক সবাই নগর পথে
বিষাদ কারুকাজ
আমি কোথাও থাকবো না, তাই
শব্দ সাজাই আজ...



এ বইয়ের চমৎকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন তাঁর বন্ধু মুরাদ, যার পটভূমিকা তাঁর সাম্প্রতিক এক পোস্টে লেখা রয়েছে। এ বইয়ে রানার ৫৬টি লিরিক ও ১৪টি লিরিক লেখার পেছনের গল্প অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ লিরিক লেখার পেছনের কাহিনির নাম দিয়েছেন 'নস্টালজিয়া', ব্যতিক্রম 'বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১১-এর অফিশিয়াল থিম সং এবং কিছু আন-অফিশিয়াল কথাবার্তা।' আমি এ পর্যন্ত 'পরী' ও 'মাথা ঘুরিয়ে'র লিরিক ও পটভূমিকা পড়তে পেরেছি। 'মাথা ঘুরিয়ে'র কাহিনি শুনে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছি রানা ভাইয়ের বস শাওন ভাইয়ের তাৎক্ষণিক ও সাহসী সিদ্ধান্তে।

'ডুবসাতারে পেরিয়ে সাগর, দুনিয়াটাকে লেটস শো আওয়ার ড্রিম
হাল্লা গুল্লার খুশির বৃষ্টি, ভাসিয়ে দেবে ঝম ঝমা ঝম
চল খেলোয়াড়, ওয় রে ও্য রে...'

গত বিশ্বকাপের থিম সং হিসেবে উপরের কিম্ভুত বাংলা-লিরিক লিখেছিলেন জনৈক ভারতীয় লিরিসিস্ট। রানাকে অনোরোধ করা হয়েছিল এটাকে সংশোধন করে দেয়ার জন্য। 'আমাদের দেশে হবে বিশ্বকাপ, আর থিম সং করছে ইন্ডিয়া, আচ্ছা মানলাম এই থিম সং তিন ভাষায় হবে, কিন্তু তাই বলে এর বাংলাটাও ওরা করবে, আর এই হবে তার বাংলা!' পুরোপুরি দেশাত্ম চেতনাবোধ থেকে রানার মন এর বিরিদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তিনি তাঁর বস শাওন ভাইকে কথাটা বলা মাত্র তিনি বললেন, 'ধুরো, এইটা কিছু হইলো ওয় রে ওয় রে... তুই তোর মতো লেখ।' এ কথাগুলো পড়তে পড়তে আমি নিজেই খুব আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়ি। ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা রানা ও শাওন ভাইকে।

'অন্বেষা'র স্টল থেকে বেরিয়ে সামনে এগোলে ডানদিকে চোখে পড়ে 'ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের' স্টল। ভিড় ঠেলে স্টলের সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, 'আচ্ছা ভাই, ইত্যাদির স্টলটা কোথায় বলতে পারেন?' কবি আদিত্য অন্তর হেসে জবাব দেন, 'ঐ যে দূরে দেখা যাচ্ছে...'। 'আপনার নামটা কি জানতে পারি?' জহিরুল আবেদীন কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে হেসে ফেলে বললেন, 'আমার নাম খলিল মাহ্‌মুদ।' খুব সংক্ষিপ্ত কুশল বিনিময়ের পর বলি, 'একটু পর আসছি, কাজ সেরে।' এই বলে পশ্চিম দিকে হাঁটতে হাঁটতে জাগৃতি প্রকাশনীর স্টল নং ২৪১-২৪২-এ গিয়ে উঠি।





জাগৃতি প্রকাশনীর সামনে ভিড় খুব কম ছিল, তাই কম ঝামেলার মধ্য দিয়েই 'প্রিয়ংবদা'র খোঁজ পাওয়া গেলো। শামীম আজাদ ঢাকা কলেজে আমাদের টিচার ছিলেন ১৯৮৪-৮৫ সনে। 'প্রিয়ংবদা' একটি ছোটোগল্প সংকলন। এতে ১০টি গল্প আছে। বেশিরভাগ গল্পই ২০০৯-২০১১-তে রচিত, তবে ১৯৯৬ সনে লেখা একটি গল্পও এতে আছে। সবই প্রবাসজীবনকালে লেখা। ঢাকা কলেজে তাঁর শিক্ষকতাকালীন ছাত্রদের উৎসর্গ করা হয়েছে এ বইটি। এজন্য এটি আমার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আমি তাঁর ছাত্র, এ নিয়ে খুব গর্ব বোধ করি। বইটি বের হবার খবর জানতে পাই ফেইসবুক থেকে অনেক আগেই। মেলায় আসবার আগে আমার ভয় ছিল, যদি 'প্রিয়ংবদা' এখনো স্টলে না এসে থাকে তাহলে কী হবে? তবে স্টলের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমার খুব গর্ব হচ্ছিল এ দেখে যে, আমার সামনেই আরো কয়েকজন 'প্রিয়ংবদা' কিনলো, এবং কয়েকজনে এ সম্পর্কে খোঁজখবরও নিচ্ছিল। আমি ৩ কপি প্রিয়ংবদা নিয়ে চলে আসি।





মূল চত্বরে যাওয়ার আগে ভাষাচিত্রের স্টল ২০৩-২০৪-এ গেলাম মামুন ম. আজিজের বই সংগ্রহ করতে। ওখানে তাঁর দুটি বই পাওয়া গেলো। ১) নৈঃশব্দ্যের শব্দযাত্রা, ২) উদ্‌ঘুটি। দুটো বই নিয়ে মূল চত্বর পার হয়ে লিটল ম্যাগ কর্নারে যাবার টার্গেট নিয়ে হাঁটতে থাকলাম।



মূল চত্বরের এক পাশে চ্যানেল আইয়ের 'বইমেলা সরাসরি' অনুষ্ঠানে লুৎফর রহমান রিটন ও আহমদ মজহার অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন। তার একপাশে 'হ্যামিলনের বংশীবাদক' খুব করুণ ও নিখুঁত সুরে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। আমি তাঁকে লক্ষ করে ক্যামেরা তাক করি। তিনি বুঝতে পেরে ক্যামেরার দিকে ঘুরে দাঁড়ান। আমি দু-তিনটি ক্লিপ নিই, দেখাদেখি আরো কয়েকজন তাঁর ছবি তুললেন। আমার খুব সাধ হলো বংশীবাদকের সাথে কথা বলবার। কিন্তু বাঁশি বাজানো থামালেন না। পরে মনে হলো, তিনি সরাসরি অনুষ্ঠানের জন্য ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসাবে হয়তো এই বাঁশি বাজাচ্ছিলেন।





এর একটু পরই দেখা গেলো 'সময় চ্যানেল' থেকে সঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীরের সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে।



সাক্ষাৎকারের অন্যপাশে আরেকটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হচ্ছিল।



সিঁড়ির উপর চ্যানেল আইয়ের আরেকটা সাক্ষাৎকার ধারণ করা হচ্ছিল।



এটা পার হয়েই লিটল ম্যাগ কর্নার।

লিটল ম্যাগ কর্নার

ঢাকা বইমেলা-২০০২ এর কথা। জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বৃষ্টি, বাতাস, কনকনে শীত। আমি, করিম এবং প্রয়াত জাহিদ- এই তিনজনে মিলে 'সবুজ অঙ্গনের' প্রথম সংখ্যার জন্য লিফলেট বিলি করছি প্রতিটা স্টলে গিয়ে। কোনো এক গলির এক কোণে ছোট্ট একটি স্টল। সাজসজ্জা খুব নিম্ন মানের। চট দিয়ে বাতাস ফেরানো হচ্ছে। বইপত্রগুলো গুছিয়ে একটা ট্র্যাংকের ভিতরে রাখা। সেই ট্র্যাঙকের উপর খুব জবুথবু হয়ে বসে আছেন একটি লোক। আমাদের খুব মায়া হয়। তাঁর স্টলে ঢুকি। তাঁর সাথে কথা বলি। তিনি খুশি হোন। তাঁর কয়েকটি বই বের হয়েছে। গদ্য ও কবিতা দুটোই তিনি লেখেন। শুকনো কয়েকটা কপি বের করে হাতে দিলেন। তাঁকে সবুজ অঙ্গন-এর লিফলেট দিই। সেই বইমেলাতে ঐ দরিদ্র স্টলটিই ছিল লিটল ম্যাগ কর্ণার। আর তাতে বসেছিলেন যে লোকটি, তিনি কবি শাকিল হাসান।



এরপর থেকে শাকিল হাসানের সাথে আমাদের পরিচয় গভীর হয়, এবং বন্ধুত্ব হয়। সবুজ অঙ্গনে মাঝে মাঝে লেখা পাঠাতেন। একুশে বইমেলায় গেলে কোনো না কোনোভাবে তাঁর সাথে দেখা ও আলাপ হতোই। খুবই সরল, সদাহাস্য ও মিশুক স্বভাবের তিনি। সাবলীল গদ্য, প্রতিবাদী তাঁর ভাষা, সামাজিক অনিয়মের বিরুদ্ধে। এর আগে তাঁর ১ ফর্মার পেপার ব্যাকের 'শিকড়' ও 'বাউড়ি' পড়েছি। শাকিল হাসান ভাইয়ের সাথে শেষ দেখা হয়েছিল ২০০৫ সালে বা তার আগে।

মূল চত্বর থেকে লিটল ম্যাগ কর্নারে ঢুকতে প্রথম স্টলটি শাকিল হাসানের। দূর থেকেই তাঁর সাথে চোখাচোখি হয়। আমার দ্বিধা ছিল, তিনি হয়তো আমাকে চিনতে পারবেন না, কিন্তু কাছে যেতেই তিনি প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, 'আরে ভাই, ভাই, সেই কতোদিন পর দেখা..।' শাকিল হাসান আমার নাম জানেন না, বলা হয় নি। অনেককেই আমার নাম কখনো বলা হয় না, বা বলতে ভুলে যাই, বা বলবার প্রয়োজন বোধ করি না। শাকিল হাসান ভাইকে দেখে আমার খুব ভালো লাগলো। আমাদের সবুজ অঙ্গনের সহ-সম্পাদক মোঃ জাহিদুল ইসলামের বাইক এক্সিডেন্টে আর্জেন্টিনায় মরে যাবার ঘটনা তাঁকে জানালাম। তিনি খুব আফসোস করলেন। মৃত্যুর দিন তারিখ লিখে নিলেন। শাকিল হাসান ভাইয়ের ৩টি বই পাওয়া গেলো।



লিস্টে লেখা সব বই কেনা হয়েছে- বাদ মাহী ফ্লোরা। ঘড়িতে বাজে ৬টা। হাতে ৩০ মিনিটের মতো সময় আছে। পান্থ বিহোসের বইমেলায় আসবার কথা ছিল। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে। মাসউদ আহমাদ-এর গল্পপত্রের স্টলটা খুঁজছি। ও হ্যাঁ, মাহী ফ্লোরার বই লিটল ম্যাগ কর্নার ভনে'তে পাওয়া যাবে। 'ভনে আর গল্পপত্র কোথায়, শাকিল ভাই?' শাকিল ভাইয়ের ঠিক বামে ভনে। ভনে'তে তখন ২ পুরুষ ও এক নারী উপবিষ্ট ছিলেন। ইনিই হয়তো মাহী ফ্লোরা। বরাবরের মতোই আত্মবিশ্বাসের সাথে বলি, 'মাহী ফ্লোরা কি আছেন?' তাঁরা হেসে দেন। জানালেন নাই। তাঁর একটা বই পাওয়া গেলো। 'সে এক আশ্চর্য জলপ্রপাত।' দাম ৭০ টাকা। বিপত্তি বাঁধলো, আমার কাছে ১০০০ টাকার নোট, তাঁদের কাছে ভাংতি নেই। ভাংতি না থাকায় বই না নিয়েই অন্যদিকে চলে গেলাম 'গল্পপত্র' খুঁজতে। পান্থ বিহোসের সাথে মোবাইলে কথা বলে গল্পপত্রে গেলাম। মাসউদ আহমাদ আমার প্রথম বই 'স্খলন'-এর প্রথম রিভিউ-মেকার, ২০০৩ সালের কথা। খুব ভালো লেখেন। মেধাবী, এবং পরিশ্রমীও। প্রথম আলোতে কাজ করছেন। অচিরেই সাহিত্যে তাঁর একটা ভালো অবস্থান আমরা দেখতে পাবো। সে আনিসুল হকের খুব স্নেহধন্য। মাসউদ আহমাদ আমাকে ভালোবাসেন এবং সম্মান করেন। আমি তাঁকে খুব স্নেহ করি। তাঁর সাথে দেখা হলে ভালো লাগতো। কিন্তু মাসউদ স্টলে নেই। ওঁর ম্যাগাজিন বা বইয়ের সবগুলো কপি আমার কাছে আছে। কিন্তু গল্পপত্রের সর্বশেষ সংখ্যার কপি নেই। ওটা স্টলে ফুরিয়ে গেছে। স্টলে সবুজ অঙ্গনও নেই।

বাকি অংশ মন্তব্যের ঘরে দেখুন
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ১২:৩৫
৩৩টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×