somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটা কবিতার গোড়াপত্তন

২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমাদের ছোটোবেলায় পদ্মা নদী খুব উত্তাল, বিশাল ও ভয়াবহ ছিল। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে বাবাকে জিজ্ঞাসা করতাম, ‘বাবা, গাঙের কি ঐ-পার নাই?’ বাবা হেসে জবাব দিতেন, ‘আছে। অনেক দূরে। দেহা যায় না।’
আমি তখন গাঙের বুকে পালতোলা নাওয়ের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবতাম, আহা, একদিন যদি ঐ-পারে যাইবার পারতাম!
কলেজবেলায় গ্রামে গিয়ে মাঝে মাঝে পদ্মার পাড়ে যেতাম বন্ধুদের সাথে বেড়াতে। পদ্মা ডুবে গেছে চরের বালুতে। কলাপাতায় সবুজের ঢেউ দেখি, আর শুকনো তটে দাঁড়িয়ে দেখি পদ্মার বুকে সাদা বালু খাঁ-খাঁ করছে। চিকন খালের মতো মরা নদী বুড়ির মতো ধুঁকে ধুঁকে হেঁটে যাচ্ছে।

অনেকদিন পর।
গুলিস্তান থেকে শুরু। বাবুবাজার ব্রিজ কিংবা পোস্তগোলার চীনমৈত্রী সেতু পার হয়ে ঢাকা-মাওয়া সড়ক ধরে চলতে থাকুন।
শ্রীনগর।
সদর পার হয়ে কামারগাঁও ছাড়িয়ে শাইনপুকুর।
দোহার উপজেলা শুরু।
কিছুদূর গিয়ে নারিশা। ছোটোবেলায় এখানে অনেক এসেছি। ছোটো চোখে নদীর ঐ-পাড় ধু-ধু করতো। কলেজবেলায় এখানে ধু-ধু বালুচর।

আজ।
নারিশা গ্রাম ভেঙে ডুবে যাচ্ছে নদীগর্ভে। গ্রামবাসীর প্রাণান্ত চেষ্টা তা প্রতিরোধে।
গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ি। পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখি ও-পাড়ে সূর্য পাটের উপরে, স্রোতোময়ী পদ্মার শরীরে ঢেউয়ের ভাঁজে ভেঙে পড়া রোদ চিকচিক করছে।
এই পথে, একটু দূরে প্রমীলাদের বাড়ি। স্কুলজীবনে শুধু প্রমীলার সাথে কাকতালে দেখা হবার সম্ভাব্যতায় এখানে ঘোরাঘুরি করতাম। আর আছে সায়ন্তনীদের বাসা। ওর মতো সুন্দরী মেয়ে আমার চোখে আজও আর একটাও পড়ে নি। মিনাদের বাড়ি আর ইমরানদের বাড়ি পাশাপাশি। মিনার সাথে মাঝে মাঝে কথা হয়। ইমরান বাবা হয়েছে বছর দুই আগে, ও এ-খবর দিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে।

আর সোহানা?
রাতুলের চাচাত বোন সোহানা। স্কুলজীবনের পর ওর সাথে আর দেখাই হলো না। প্রমীলা বলে, ‘সোহানার দিনে দিনে বয়স কমে।’ শামীম ওর সাথে প্রেম করতো। ওদের দু পরিবারে অহি-নকুল পরিস্থিতি সারাজীবন। ও-বাড়ির মেয়ে এ-বাড়িতে? এ-বাড়ির ছেলে ও-বাড়িতে? পৃথিবী উলটে গেলেও না।
এসএসসির পর পর ওর বিয়ে হলো এক গণিতজ্ঞের সাথে। রাতুলের সাথে দেখা করতে গেছি; এগিয়ে এলো ভুবনমোহিনী সোহানা ওর হৃদয়হরা হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে।
‘তুই না খুব চিকন আছিলি? মাত্র কয় মাসেই এত মোটা হইয়া গেছস?’ আমার কথা শেষ হবার আগেই ‘স্টুপিড!’ বলে এক ঝামটায় আমার গাল টেনে দিয়ে পৃথিবীকাঁপানো একটা হাসি হেসে ঘাড় বাঁকিয়ে বেণি দুলিয়ে চলে গেলো সোহানা। ওর সেই হাসি চোখের সামনে ভাসে, ওর কথা মনে হলে, বা না হলেও। আমাকে ভর্ৎসনা করে রাতুল বলেছিল, ‘তুমি এত বোকা কেন? ও প্রেগন্যান্ট হইছে বোঝো না?’
আরো অনেকে। শাপলা। ঝিনুক।
একেকটা মেয়ে একেকটা অনবদ্য কবিতা, ভিন্ন ভিন্ন রস ও স্বাদের। এই দেখুন, কোনো ছেলের নামই আমার মাথায় আসছে না এখন। আমরা মেয়েদের কথা বেশি মনে রাখি; ওরা আমাদের নিয়ে কী ভাবে তা জানতে খুউব খুউব সাধ হয়। আমার মতো সবগুলো ছেলেই হয়তো এমন করেই সবগুলো মেয়ের কথা ভাবে। আর মেয়েগুলো? ওরা মনে হয় আমাদের আর মনে রাখে না। আমরা যেমন বউয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে আর তার বুকের উপর শুয়ে একবার হলেও ওদের প্রত্যেকের কথা ভাবি, ওরা কি স্বামীর বুকে মাথা রেখে একটি মুহূর্তের জন্যও মনে করেছে আমাদের কথা? আমার কথা? ওরা খুব স্বার্থপর। ওরা স্বামীদের সাথে বেইমানি করে না, আমরা যেমন বউদের সাথে করি। ওরা নয় প্রেমিকা, নয় বান্ধবী। ওরা আমাদের কেউ না।
একদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে প্রমীলা বলেছিল, ‘তোরা এত নিষ্ঠুর কেন রে? তোদের কথা ভেবে ভেবে মরি... ।’ তারপর ওর কণ্ঠ গলে যেতে থাকে, করুণ ফিসফিসে স্বরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘তোর কথা কত ভাবতাম... খুব নিষ্ঠুর রে তুই!’
আমি যখন পদ্মার গভীর থেকে স্কুলবান্ধবীদের ছিনিয়ে নিয়ে আসছিলাম, দেখি আমার সরলা বউ আর সন্তানেরা উজ্জ্বল ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আনন্দে ঝলমল করছে।
এখানে একটা কবিতার ভাব জাগে। সর্বপ্রথম যে শব্দটা মাথায় টোকা বা উঁকি দিল, সেটা হলো— ‘দিধিষু’। কবে কোথায় এই শব্দটা পড়েছিলাম মনে নেই। অর্থটাও তত পরিষ্কার নয়। কিন্তু ‘দিধিষু’ দিয়েই কবিতা শুরু করি।

দিধিষু শরীর নদীর বিভায় ঘুমিয়ে পড়ে পাখিদের অগোচরে।
জলের জোনাকিরা কোমল বাতাসে ভেঙে ভেঙে
মাছের সারিতে মিশে যায়।


এই হলো কবিতা। এর কী অর্থ দাঁড়ায় তা জানি না। আদতে এর কোনো অর্থ নেইও। সব কবিতার অর্থ থাকে না।

অহনার সাথে যদি আবার আরেকদিন, কালের স্রোতে ভাসতে ভাসতে কোনো এক চরের কন্দলীবনের হরিৎ ছায়ায় অলৌকিকভাবে দেখা হয়ে যায়, এ দু চরণ কবিতা ওকে শোনাবো। এ কবিতা শুনে সে যারপরনাই খুশি হবে; খুশির ঘোরে বহুক্ষণ কেটে যাবে, তারপর যথাস্বভাবে বলবে, ‘এবার এর অর্থটা আমাকে বুঝিয়ে বল, সোনাপাখি।’
আমি অহনাকে অতি চমৎকারভাবে কবিতাটার অর্থ বুঝিয়ে দেব। সে বিস্ময়ে ডগমগ হয়ে শুধু এ কথাটাই বলবে, ‘তোর মতো কবি হয় না রে পাগল; তুই একদিন অনেক বড়ো কবি হবি!’

২৩ এপ্রিল ২০০৯
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:০৯
১৮টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×