somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাবা-কিশোর

২১ শে জুন, ২০২০ বিকাল ৪:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কর্মকর্তা যদিও, মাস শেষে বেতন জোটে নেহায়েত সাদামাটা
যদিও বেতন স্বল্প, বিশাল পৈতৃক সংসার বিস্তৃত ডালপালায়
এবং বলে রাখি, আমিই কর্ণধার
এবং
ছোটো দুটি ছেলেমেয়ে, স্ত্রী আর নিজে... এই মিলে
শহরের এককোণে আপন সংসার

অফিসের ছুটি শেষে ঘরে ফিরি, অমনি
ওরা হাওয়ার বেগে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোলে
ত্বরিত হাঁতড়ে পকেট কিংবা কোমর
বের করে একটি-দুটি চকোলেট অথবা চুইংগাম।
কোথাও বেড়াতে যাই... চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, শিশুপার্ক,
ওয়ান্ডারল্যান্ড, আশুলিয়া
ওদের সবুজ উৎসুক চোখ সারাক্ষণ খোঁজে রংবেরঙের চকোলেটবক্স,
মচমচে চিপস, শিশুতোষ যতসব লোভনীয় খাবার।
আইসক্রিমঅলা কিংবা ফেরিঅলা দেখলেই
অতি ব্যস্তভাবে, ‘আইসক্রিম চাই.... চুইংগাম আমার চাই।’

ওদের সঙ্গে নিয়ে কখনো মার্কেটে যাই, শখের সামগ্রী কিনি
পোশাকআশাক, কসমেটিকস; একটি দুটি দোকান ঘুরতে
না ঘুরতেই ওদের
আর্জিআবদারে কান ঝালাপালা... এটা চাই, ওটা চাই,
একবার দু’বার, বহুবার চাই, বড়োদের মতো
আরও চাই স্যুট টাই শাড়ি।

মাছতরকারির কাঁচাবাজারে, চালডাল-রসুনপেঁয়াজ, নিত্যপ্রয়োজনীয়
সওদা কিনতে ব্যাগ হাতে ঘর থেকে বেরুতে উদ্যত হতেই
তড়িঘড়ি তৈরি ওরা সামনে দাঁড়ায়... ‘আমরাও সঙ্গে যাব।’
যতই বলি না আমি... এ গরমে
মাছহাটায় যায় না হাঁটা, একদম সিদ্ধ হয়ে যাবে
দারুণ দুর্গন্ধে বমি হবে
বড্ড আপসহীন ওরা, শক্ত করে হাত চেপে
বলে, ‘যাবই বাজারে, যাবই।’

অতএব আমরা বাজারে চলি, এটাসেটা সওদা কিনি,
এক হাতে থলে
অন্যহাতে মেয়ে, সতর্ক চোখে চেয়ে দেখি অনুজার ফ্রক ধরে
পেছনে হাঁটে ছেলে।
এখানেও স্বস্তি নেই, একভাগা মাছ কিনতেই ওদের
সনাতন হাঁক... পুতুল চাই, মেয়ে বলে, লম্বা সাদা চুলঅলা পুতুল,
ছেলের জন্য স্পাইডারম্যান, রোবোকপ চাই-ই চাই।

কী যে ছাই বাজার করি! ঘরে ফিরলে অনলবর্ষী তিরস্কারে গৃহিণীর
মুখে ফোটে খই... ‘আনাজ আনো নি? রসুন কই?
গোলআলু? তেজপাতা? তেল? কিছুই আনো নি?
কেন বাজারে যাও ওদের নিয়ে?
সবগুলো টাকা নষ্ট করেছো
কীসব হাবিজাবি কিনে। এসবে কি সংসার চলে?
এই আমি দিচ্ছি বলে, খবরদার, ওদের বাজারে নেবে না কক্ষণো আর।’
নিছক ‘হাবিজাবি’ কিনে উড়িয়ে দিলাম এতগুলো টাকা!
আমারও খারাপ হয় মন। অথচ দেখি ভাইবোনে মিলে
মহোল্লাসে উঠেছে মেতে সদ্যকেনা খেলনায়, ওরা চকোলেট খায়,
চুইংগাম খায়
আমাদের হাবিজাবি কী অপরিহার্য সম্পদ ওদের!

কখনও কখনও একাই বাজারে যাওয়া হয়, অথবা অন্য কোনও কাজে
পাঁচতলার সিঁড়ি বেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে দরজায় বেল টিপতেই
দৌড়ে এসে কবাট খোলে ওরা। বাজারের থলেটি
মেঝেতে রাখার ঢের আগে
ঝুঁকে পড়ে
তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে ওদের আরাধ্য ধন
একটি দুটি চকোলেট
চুইংগাম।
কিছুই পাই না ভেবে.....কী এমন অমৃতময়
এসব চকোলেট কিংবা চুইংগাম!

একদিন চাল নেই ঘরে, মাছমাংস তাও, বাজারের বেলা পড়ে যায়
এমনি সংকটে গৃহিণীর তাড়ায় বেরুবার কালে
ঘরে আমার বৃদ্ধ বাবা এগিয়ে এসে বলেন, 'আমিও আসি?'
অতিশয় বিরক্তি ভরে
তাকাই তাঁর দিকে ফিরে, অমনি চোখ পড়ে বাবার চোখে.....
জ্বলজ্বলে একজোড়া চোখে কী যেন নিদারুণ নেশা তাঁর
অকস্মাৎ দেখি এক পিতৃ-উন্মাদ কিশোর :

.................. সেই কবে, কতদিন আগে, বাবার কোলে চড়ে, কাঁধে চড়ে, হাত ধরে
.................. গুটিগুটি পায়ে দৌড়ে চলতো বালক মেঘুলা কিংবা দেবীনগরের হাটে
.................. পালদের রসগোল্লা, বালুশাই আর আমিত্তি কী যে প্রিয় ছিল
.................. বাজারে ঢুকেই ওসব তার চাই, তারপর অন্যসব কাজ।
.................. কখনও কখনও বাবা তার
.................. বহুদূর কোমরগঞ্জ কিংবা শিবরামপুর হাটে যেতেন। সকাল-দুপুর-
.................. বিকেল-সন্ধ্যা, পুরোটা দিন প্রতীক্ষায়
.................. তাকিয়ে থাকতো সে পথের পানে, যে-পথে প্রাণাধিক বাবা তার
.................. ফিরে আসবেন ঘরে। মাথার ঝাঁপিতে বাজারসওদা থাক বা না থাক
.................. তার জন্যে থাকবেই থাকবে মোড়কভর্তি বালুশাই, আমিত্তি অথবা রসগোল্লা।
.................. কখনও সখনও প্রতীক্ষায় থেকে থেকে
.................. কখন ঘুমিয়ে যেতো বালক, আর্দ্র আঁখিকোণে অশ্রু শুকিয়ে
.................. হঠাৎ ঘুম ভাঙলে
.................. দেখতো, কুপি হাতে অদূরে তার মা, তন্দ্রায় ঢুলুঢুলু
.................. নিজেকে করতো আবিষ্কার বাবার কোলে... হাঁটু ভেঙ্গে গুটিসুটি,
.................. বাবার হাসিমুখ, ডানহাতে মুখের সামনে মস্তবড়ো বালুশাই এক
.................. ‘ঘুমাইয়া গ্যাছাও বাজান? বালুশাই খাও।
.................. খালি খালি দেরি হয় আজকাল।’

আমার বাবাকে আমার কৈশোরে দেখি, আমার বিরক্ত ও কঠিন
এবং নিষ্ঠুর অবয়বে নেমে আসে কী এক করুণ মমতা। সহসা
আমি বাবা হয়ে যাই
আর
বাবা যেন একটি কিশোর, আমার সেই কিশোরবেলার মতো :
ঠিক আমার ছেলেমেয়ে দুটোর মতো
আমার হাত ধরে ধরে বাজারময় হাঁটবেন বাবা
পছন্দের কিছু দেখলেই বলবেন, 'জিনিসটা খুব সুন্দর বানাইছে বাজান।
এইখানে ভালো পায়জামা পাওয়া যায়? একটা তসবির দরকার।
দাঁড়াও, তোমার মা'র জন্য একখানি পানদানি কিন্যা লও।'

আমি বাবা হয়ে যাই আমার বাবার। তারপর তাঁর কঙ্কালসার পিঠে
আমার নরম হাত রেখে বলি: 'বাজারে যাইবা তো আগেই কও নাই ক্যান?
তাড়াতাড়ি তৈরি হও।' মুহূর্তে চঞ্চল হয়ে
পায়জামা খোঁজেন, পাঞ্জাবি খোঁজেন
চটিজুতো খোঁজেন আমার বাবাকিশোর।

আমি একধ্যানে
আমার পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কৈশোরের দিকে তাকিয়ে থাকি।

২০০৩

.................. .................. .................. ..................

সকাল ৯টার দিকে ছোটোছেলে লাবিব দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেই মিষ্টি করে ডেকে উঠলো- 'আব্বু!' আমি বেডে বসা ছিলাম। ওর দিকে তাকাতেই ও বলে উঠলো, 'হ্যাপি ফাদার্স ডে, আব্বু'!! আমি একটু অবাক হলাম। আমি ভেবেছিলাম কিছুদিন আগে ফাদার্স ডে ছিল। অবাক হয়েই ছেলেকে জিজ্ঞাসা করি, 'আজকে ফাদার্স ডে? এটা কিছুদিন আগে পার হয়ে যায় নাই?' 'নাআআআ। এটা আজকেই।' তারপর সে আমার দিকে এগিয়ে এসে গলা জড়িয়ে হাগ করলো। এরপর অফিসে গেলাম। অফিসে বসে মেয়ের এসএমএস পেলাম- 'হ্যাপি ফাদার্স ডে, আব্বু!!'

সকল বাবার উদ্দেশ্যে আমিও বলছি - হ্যাপি ফাদার্স ডে। শুভ বাবা দিবস। সকল বাবার সন্তানেরা যেন একজন ভালো বাবা পায়, সেই কামনা করছি।

সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০২০ বিকাল ৪:৩৮
২০টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×