প্রমীলার চোখে বুড়িত্বের ভাঁজ। ওর সমগ্র শরীরে ঝরে পড়ে দুঃখ। ওর মন নেই, শুধু খাঁচাটুকু পড়ে আছে।
প্রমীলার কলেজ-পড়ুয়া এক ছেলে। পিতৃহারা দুঃখিনী মেয়েটা অকালে স্বামীর ঘরে। প্রমীলার জামাই একজন স্বর্ণকার ছিলেন। প্রমীলার সংসারে প্রচুর সুখ ছিল।
একদিন জ্বলন্ত মধ্যাহ্ন। দোকানের সামনে ওর জামাইর বুক বরাবর গুলি ছুঁড়লো আধুনিক দস্যুরা। সেই থেকে প্রমীলা বিধবা।
আমরা কয়েকজন ক্লাসমেট একদিন প্রমীলার মুখোমুখি হলাম। কয়েকটা নিরুত্তাপ কথায় প্রমীলা ওর দিন যাপনের কথা বলছিল। আমরা কাঁদছিলাম। প্রমীলার স্বর নির্লিপ্ত। প্রমীলার অনেক দুঃখ। ওর দুঃখ মোচনের সাধ্য আমাদের নেই। আমরা কাঁদছিলাম।
অবশেষে প্রমীলাও কেঁদেছিল। কেঁদে কেঁদে বলছিল- তোরা আমার ভাই, তোদের কাছে আমার দাবিআমার ছেলেটাকে তোরা মানুষ করে দে।
প্রমীলা আর কেউ নয়- প্রমীলা আমাদের বোন।
একটা মেয়ে প্রায়ই আসে। প্রায়শ নয়, সর্বদা। তারও নাম ‘প্রমীলা’। অবশ্য কবিতার ‘প্রমীলা’ আর বাস্তবের ক্লাসমেট- ভিন্ন দুই সত্তা।
প্রমীলা বুড়ি হয়ে যাচ্ছে। বুড়ি হয়ে যাচ্ছে শাহনাজ, পারুল, পারভিন। আমাদের যৌবনে যারা সর্বগ্রাসী তুফান ছিল, কেমন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে তারা।
জাহিদের কথা কত অল্প দিনেই ভুলে গেলাম, তাই না? চিরদুরন্ত, অফুরন্ত প্রাণময় জাহিদ দু হাজার এগারো’র ৯ সেপ্টেম্বরে ব্রাজিলের রাজপথে ঝড়োগতিতে বাইক চালিয়ে অ্যাক্সিডেন্টে পড়লো, এর দুদিন পর ওর মৃত্যুর খবর পাই। আমি অনেকদিন মর্মে মর্মে ছটফট করেছি- আচমকা জাহিদের মুখ ভেসে উঠতো চোখে; এখনো স্বপ্নের ভেতর হু হু করে বুক; কেঁদে উঠি। হায় অলঙ্ঘ্য মৃত্যু- স্ত্রীর অবাধ্য যৌবন, তিন মাস বয়সী মেয়ের হাসিমুখ- নির্দ্বিধায় পেছনে ফেলে জাহিদকে টেনে নিয়ে গেলো গহিন সুদূরে। ... খায়ের- যে ছেলেটি হাডুডু’র মাঠে ছিল ত্রাস- এক থাবায় গোটা ছয়েক পালোয়ানকে দাবড়ে, থাপড়ে, টেনে-হেঁচড়ে করে দিত ‘মার’- আর মেয়েরা ওর জন্য পাগল ছিল, সতীর্থ প্রেমিকেরা হিংসায় জ্বলেপুড়ে ছাই হতোখায়েরকে এখন পথ দেখায় নিঃস্বপ্ন ছড়ি; হৃৎপিণ্ডে ‘ভাল্ভ’ লাগিয়ে কোনোরূপে টেনে যাচ্ছে জীবন।
নিজেদের বয়স ভুলে আদিম আনন্দে উন্মত্ত হই স্কুলের আড্ডায়- সন্ধ্যায় ম্লান চোখে বাড়ি ফেরার পথে মনে পড়ে- এই পথ আমার ৪০ বছরের সাক্ষী। হায় পথ- সেও তার যৌবন হারিয়ে জীর্ণ হয়েছে। আমরা? আমরাও কি হারিয়ে ফেলেছি ঝড়ের যৌবন? হায় যৌবন, মাটিতে কান পাতলেই শুনি- নিভৃত মাটির ডাক। এ মাটির কী যে মায়া- মায়াবতী মাটি শুধু ডাকে।
প্রাণের সহেলিরা, দুরন্ত সহচর, তোদের দেখলেই মুহূর্তে জ্বলে উঠি- মনে হয়, একটুও বয়স বাড়ে নি, এখনো স্কুলের ১৬ বছর বয়সেই থির দাঁড়িয়ে আছে আমাদের উন্মাতাল কৈশোর।
২০ নভেম্বর ২০১২
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০২১ রাত ১০:০৭