'তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়, দুখের দহনে করুণ রোদনে তিলে তিলে তার ক্ষয়' - বাংলার গানপিপাসু জনগণ এ গানটি শোনেন নি, এবং গুনগুন করে কণ্ঠে সুর তোলেন নি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। এটি একটি ছায়াছবির গান। 'এতটুকু আশা'। আমি যে আমলে ছায়াছবি দেখা শুরু করেছি, তখন এ ছবিটির কোনো নামডাক শুনি নি। সিনেমা দেখতে যেয়ে দেখি আমাদের দোহার থানার একমাত্র সবেধন নীলমণি 'জয়পাড়া সিনেমা' হলে 'এতটুকু আশা' ছবিটি চলছে। খুব সম্ভবত তখন ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি। সে সময়ে সিনেমা দেখতাম ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু আবুল বা নূরু বা দুজনের সাথেই। সেদিন গেছি আবুলের সাথে। 'বুলবুল-এ-বাগদাদ' হলো আমার প্রথম দেখা ছায়াছবি, যেটি ছিল 'আংশিক রঙিন', নায়ক নায়িকা ছিলেন সে-সময়ের হার্টথ্রব জুটি ওয়াসিম ও অলিভিয়া। আমার চোখে তখন তারা দুজনই তারকাদের তারকা। আর আমার ভালো লাগে টগবগিয়ে ঘোড়া-দাবড়ানো রাজ-রাজড়াদের 'পোশাকি' ছবি, তুমুল তলোয়ারযুদ্ধ-সর্বস্ব ফাইটিং দৃশ্য, যা মনে ভীষণ উত্তেজনা সৃষ্টি করে। সেখানে ভিলেন থাকে জসীম এবং আহমেদ শরীফ।
কিন্তু বাইরে টাঙানো সিনেমার দৃশ্যগুলো দেখে আমার মন মরে গেলো। এটা নিতান্তই সামাজিক ছবি, যা গ্রামের দৃশ্যাবলিতে ভরপুর, একটাও ঘোড়া নাই, তলোয়ারের ঝনঝনানি নাই। সবার কাছে নাকি সামাজিক ছবিই ভালো লাগে। গ্রামের দৃশ্য দেখে বুক নাকি ভরে যায়। সবই ফাও কথা। গ্রামের ছেলে, গ্রামের কাদামাটি, খালবিলপুকুরে, আমগাছ, গাবগাছ, জামগাছ আর খেঁজুর গাছে ঘুরে ঘুরে বড়ো হচ্ছি, সারাজীবন তো গ্রামের দৃশ্য দেখতে দেখতে চোখ গেল অন্ধ হইয়া, হালার সিনেমার ভিত্রেও আবার সেই গ্রামের সিনারিই দেখতে হবে?
আবুলের সাথে সিনেমা দেখা শুরু করলাম। তবে, কাহিনিটা ভালো লাগলো। এর আগে আমার ঘনিষ্ঠতম ক্লাসমেট জসীমের কাছ থেকে 'চিতা বহ্নিমান' (লেখক - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়) নামক এক বই এনে পড়েছিলাম। দারুণ গল্প ছিল। আল্ট্রা মডার্ন স্ত্রীর কাছে এক গ্রামীণ, নিরীহ, ভদ্র ও শিক্ষিত স্বামী পদে পদে অপমানিত হয়, শেষমেষ অবশ্য স্ত্রী তার ভুল বুঝতে পারে এবং স্বামীর কাছে পদানত হয়। 'এতটুকু আশা' ছবিতেও ওরকম গ্রাম্য, মেধাবী স্বামী তার অতি-আধুনিকা স্ত্রীর কাছে অপদস্ত হতে থাকে। এরকম গল্প। সিনেমায় রাজ্জাক ও সুজাতা হলেন নায়ক-নায়িকা, তবে প্রধান চরিত্র ছিলেন আনোয়ার হোসেন ও রোজী সামাদ। আমার ধারণা, ছেলেরা সবাই নিজেকে রাজ্জাক না ভেবে আনোয়ার হোসেনের জায়গায় বসাতে থাকেন। আমিও নিজেকে আনোয়ার হোসেনেই ডুবিয়ে ফেললাম। ছবিতে একসময় যে গানটা বেজে উঠলো, আমার না-চেনা এক অভিনেতার মুখে (আলতাফ), সেটি আমার পরিচিত গান, আমি জানতামও না যে এ গানটা এ ছবিতে আছে। গানটার কথা আমি সবার আগে শুনেছিলাম আমাদের এক ক্লাসমেট জাহিদ কিংবা শের খানের কণ্ঠে। তারপর মাইকে ও রেডিওতে শুনেছি। এটি হলো সেই বিখ্যাত গান - তুমি কি দেখেছো কভু, জীবনের পরাজয়। সিনেমায় গানটা শুনে খুব মুগ্ধ হলাম। গানের দৃশ্যে এটিএম শামসুজ্জামানকে দেখে হলভর্তি মানুষ হেসে দিচ্ছিলেন। কারণ, সিনেমাটি ১৯৬৮ সালে বানানো হয়। ঐ সময়ে এটিএম শামসুজ্জামান সম্ভবত বড়োসড়ো ভিলেন হয়ে ওঠেন নি, সাধারণ চরিত্রে অভিনয় করতেন। কিন্তু যখন আমরা এ ছবিটি হলে দেখছিলাম (১৯৮০-৮১ সালে হবে), ততদিনে তিনি দেশসেরা (আসলে কুখ্যাত) ভিলেন অভিনেতায় পরিণত হয়েছেন। সবাই তার ভিলেনীয় নৃশংসতা দেখেই অভ্যস্ত এবং সবাই তাকে ভিলেন রূপেই তাকে দেখতে চান।
তবে, 'তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়' গানটি ছাড়া ঐ ছবির আর কোনো গান সেই সময়ে আমার কিংবা আমার বন্ধুদের মধ্যে কোনো সাড়া ফেলেছিল বলে মনে হয় না। এমনকি এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও আমি জানতাম না ঐ গানটি ছাড়া আর কী কী গান আছে 'এতটুকু আশা' ছবিটিতে। সম্ভবত আব্দুল জব্বারের মৃত্যুর পর ইউটিউবে তার গান সার্চ দেয়ার পর যে গানগুলো উঠে আসে, তার মধ্যে 'এতটুকু আশা' ছবির অন্য গানটা উঠে এসেছিল। এরপর 'এতটুকু আশা' ছবির গানগুলো সার্চ করে যেগুলো পাই তা শুনে আমি খুবই মুগ্ধ ও বিস্মিত হই - এ ছবিতে দুটো বিখ্যাত রোমান্টিক গান আছে, যা আমাদের সোনালি যুগের হিরন্ময় প্রতিনিধিত্বস্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে আছে - 'শুধু একবার বলে যাও, আমি যে তোমার কত প্রিয়' (খন্দকার ফারুক আহমেদ ও ফেরদৌসী রহমান) এবং 'রাগ করবার আরো যে কত সময় আছে যে পড়ে' (আব্দুল জব্বার)।
রোমান্টিক গানদুটোর মধ্যে 'রাগ করবার' গানটি আমার কাছে অনেক বেশি ভালো লাগলো, প্রধানত এর সুর এবং দ্বিতীয়ত এর গায়কীর জন্য। এ চমৎকার গানটি আমিও গেয়ে ফেললাম। যে-কোনো গানই আমরা যখন শুনি কিংবা গানের সাথে কণ্ঠ মিলাই, মনে হয় সুরটা কত সহজ। কিন্তু গানটা গাইতে গেলে বোঝা যায়, প্রতিটা সহজ গানেও সঠিকভাবে সুর তোলা মোটেও সহজ কাজ না। এটা আপনি এখনই প্রমাণ করতে পারেন, আপনার কাছে সহজ মনে হওয়া যে-কোনো একটা গান মোবাইলে রেকর্ড করে শুনে দেখুন, ঠিক সুরে কতখানি গাইতে পেরেছেন। তবে, সুর ও গায়কী সম্পর্কে ভালো অভিজ্ঞতা না থাকলে আপনি নিজেও সেটা ধরতে বা বুঝতে পারবেন না।
রাগ করবার
আরো যে কত সময় আছে যে পড়ে
অনেক আশার এইটুকু ক্ষণ
খুশিতে দাও না গো ভরে
চেয়ে দেখো ঐ
রঙ লেগেছে
মৌসুমী ফুলে ফুলে
নীল আকাশে মেঘের মেলা কী কথা যায় বলে
কে জানে এমনও দিন আসবে কিনা আর ফিরে
রাগ করবার
আরো যে কত সময় আছে যে পড়ে
অনেক আশার এইটুকু ক্ষণ
খুশিতে দাও না গো ভরে
যদি তুমি ভাবো রাগ করলেই
তোমাকে দেখায় খুব ভালো
আসলেই
উঁহু
মোটেই তা নয়
যদি তুমি ভাবো রাগ করলেই
তোমাকে দেখায় খুব ভালো
আসলে তা নয়
দেখতে লাগে ঠিক হুতুম প্যাঁচার মতো কালো
এই তো বেশ
হাসলে পরে
মধুর মধুর লাগে
ঝিলমিলিয়ে ঝিলের জলে কাঁপন যেন জাগে
ক্ষতি কী হেসে খেলেই যাক না বেলা বয়ে এমনি করে
রাগ করবার
আরো যে কত সময় আছে যে পড়ে
অনেক আশার এইটুকু ক্ষণ
খুশিতে দাও না গো ভরে
কথা : ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান
সুর : সত্য সাহা
ছায়াছবিতে কণ্ঠ : আব্দুল জব্বার
মিউজিক ও কভার : খলিল মাহ্মুদ
ছায়াছবি : এতটুকু আশা (১৯৬৮)
ছায়াছবি পরিচালনা : নারায়ণ ঘোষ মিতা
শ্রেষ্ঠাংশে অভিনয় : রাজ্জাক, সুজাতা, আনোয়ার হোসেন ও রোজী সামাদ
গানের লিংক : প্লিজ এখানে ক্লিক করুন - এতটুকু আশা
আব্দুল জব্বার - রাগ করবার আরো যে কত সময় আছে যে পড়ে
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ৯:০৪