আমার যত প্রিয় টীচার এবং অবশেষে আমি নিজেই যখন টীচার! -২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
আর ইউনি’তে……… প্রতিটা টীচারই কী একেকভাবে আমাকে সমৃদ্ধ করেননি? এমনকি ইএলএল ডিপার্টমেন্টের রেহনুমা ম্যাডাম, যার কোনো ক্লাসই করিনি!! অথচ যে কোনো ব্যক্তিগত সমস্যায় পর্যন্ত টুকটুক করে নক করেছি যার অফিস রুমে। শাকির স্যারের কথা না বললেই না, যার জেন্ডার-আন্ডারস্ট্যান্ডিং আমি কখনোই মেনে নিতে পারিনি, এরপরও যার ক্লাসে স্যার কী একটা কাগজে চোখ বুলানোর সময় ক্লাসে সার্কেল করে বসা এক পাশে আমি আর সার্কেলের অপর পাশে এ্যাশ, পা দিয়ে জুতা মারামারি করছি, এ্যাশের জুতাটা শিইইইইই করে ফ্লোরের বালু স্কী করে চলে এলো আমার কাছে। এইবার আমার পালা। যেই পা বাকা করে জুতাটাকে স্কী করতে ঠেলে দিয়েছি, জুতাটা এমন বেয়াক্কলের মত শাই শাই করে নিমেষে উঠে গেলো উপরে! একদম ক্রিকেটের বলের মত শোঁওওও করে ঘুরতে ঘুরতে পুরো ক্লাস পার করে স্যারের টেবিলের সামনে দিয়ে উড়ে গিয়ে ঠিক এ্যাশের পায়ের কাছে গিয়ে ল্যান্ড করলো! পুরো ক্লাস স্তম্ভিত!! আমি পারলে মাটি ফুঁড়ে নীচের তলায় গিয়ে পরি! চরম বকা খেতে প্রস্তুত আমাকে স্যার শুধু অবাক হয়ে বললেন, ‘বড় হবা কখন?! এখনো ক্লাসে জুতা নিয়ে খেলো!’
তবে পুরো ইউনি লাইফে সবচেয়ে প্রিয় টীচার ছিলেন মুহিব্বুল্লাহ স্যার। ক্লাসের কেউই স্যারকে পছন্দ করতোনা, কারন স্যারের কোনো সিলেবাস নেই। কোনো বই নেই! বিষয়- বাংলাদেশ স্টাডিজ। স্যার একটানা এক ঘন্টা লেকচার দেন। লেকচার থেকেই পরীক্ষা হবে! রাজশাহী ইউনি’র প্রফেসর, আমাদের ইউনিতে গেস্ট প্রফেসর এক সেমিস্টারের। সিএসসিতে সাদিয়া’দেরও একই বিষয়ে ক্লাস নেন। কেউই ওনার ক্লাস নিতে চায়না। কারণ একটাই- কোনো সিলেবাস নাই, কিছু নাই, পরীক্ষায় কোথা থেকে লিখবো?! আর আমি, পুরো সপ্তাহ বসে থাকি কখন স্যারের ক্লাস আসবে। প্রতিটা মুহূর্তে গোগ্রাসে গিলি স্যারের লেকচার, চোখ আঠার মত স্যারের দিকে আর হাত আঠার মত পৃষ্ঠার সাথে। পাগলের মত একদিকে শুনি আর একদিকে লিখি! ১২০৩, ১৭৫৭, ১৯৪৭, ১৯৭১ ইতিহাসের একেকটা অধ্যায় আমার চোখের সামনে নাচানাচি করে! এখন পিএইচডি করছি, অথচ স্যারের সেই ক্লাস নোটের খাতা এখনো ঠিক আমার চোখের সামনে’র আর্ক ফাইলটাতে স্ট্যাপল করা।যদিও সে দু’টা সাবজেক্টে এপ্লাস না পেয়ে এ পাওয়ার কারণে সেভেন্থ সেমিষ্টারে ফোর আউট অব ফোর পাইনি, সে দু’টা সাবজেক্ট’র একটা ছিল মুহিবুল্লাহ স্যারের বাংলাদেশ স্টাডিজ!... অনার্স, মাষ্টার্স দু’টোতেই প্রোভিসি স্যারকে সুপারভাইজার হিসেবে পাওয়ার দূর্লভ সৌভাগ্য হয়েছিল স্যারের স্নেহের কারণেই। এত্ত ব্যাস্ততা, অফিস রুম থেকে নামায রুমে যেতে যেতে বলে দিচ্ছেন কোথায় কী ঠিক করতে হবে। সেই সাথে তালুকদার স্যারের স্নেহ, এখনো দেশে গেলে যাদের আশীর্বাদ নিতে না গেলে অস্বস্থি লাগে নিজের কাছেই।
তবে আমি আজন্ম ঋণী থাকবো ইসলামাবাদের দারাখশাহ ম্যাডামের কাছে। টীচার হলে হয়তো এমনই হতে হয়। স্টুডেন্টের চেহারা দেখেই যে বুঝে ফেলতে পারে সে দুইদিন ধরে না খেয়ে আছে। স্কলারশিপ নিশ্চিত জেনে গিয়ে দেখি স্কলারশিপের এখনো ডিসিশানই হয়নি! আব্বুর দিয়ে যাওয়া রুপী থেকে প্রচন্ড দরকারী জিনিষপত্র কিনে হাতে আছে মাত্র চৌদ্দ রুপী। বাধ্য হয়ে কিনতে হয়েছে কম্বল। মাইনাস দুই ডিগ্রী ঠান্ডায় বারান্দার পাশের রুমে গির গির করে কাঁপতে কাঁপতে যত কাপড় নিয়ে গেছি দেশ থেকে সব গায়ে দিয়েও শেষে বিছানার কোনায় কোনো রকম দুই হাঁটুর ভিতর হাত মুখ গুঁজে দিয়ে রাত কাটিয়ে বুঝেছি, কম্বল না কিনলে শীতেই মরে যাবো! যক্ষের ধনের মত আগলে আছি শেষ চৌদ্দ রুপী, যখন হাঁটার শক্তিও চলে যাবো তখন কিছু কিনে খাবো ভেবে। ডিপার্টমেন্ট হেড দারাখশাহ ম্যাডাম ওনার অফিসের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ডাকলেন, ‘ক্যায়া হুয়া বেটী? তাবিয়াত ঠিক নেহী হে ক্যায়া?’… মিথ্যা বলতে বলতে গলা শুকিয়ে ফেলেছিলাম যে না, সব ঠিক আছে। নিজের পার্স খুলে দুইশ রুপী বের করে আমার ব্যাগে জোড় করে গুঁজে দিয়েছিলেন। প্রচন্ড কনজারভেটিভ, মুখ খারাপ করার মত জঘন্য কতগুলো ধর্মান্ধ’র মাঝখানে দারাখশাহ ম্যাডাম যেন লেডি উইথ আ ল্যাম্প। শুনেছি কিছুদিন পর ম্যাডাম ইউনি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, যেখানেই থাকুন ম্যাডাম, ভাল থাকুন।
সবচেয়ে বিতর্কিত যে দু’জন টীচার, যাদের জন্যে মানুষের হাজার রকম কথা মুখ বুঁজে সহ্য করতে হয়েছে, কিন্তু যারা আমার জীবনে না আসলে যতটুকু আলো দেখি চোখে সে আলোও অন্ধকারেই থেকে যেতো, তাদের একজন হলেন ইসলামাবাদের গাজালা ম্যডাম। ক’দিন ধরেই ডিপার্টমেন্টে শুনছিলাম নিউজিল্যান্ড থেকে একজন প্রফেসার আসছেন। কম্পারেটিভ রিলিজনের ক্লাসটা নতুন প্রফেসারই নিবেন। ঠিক দারাখশাহ ম্যাডামের পাশেই বিশাল এক অফিস সাজাতেও দেখলাম করিডোর দিয়ে যাওয়া আসার পথে। এবং সবচেয়ে অবাক হয়ে দেখলাম সে প্রফেসর আসার আগেই ইউনি’তে জমিয়তে তালিবা’র মেয়েদের প্রতিবাদ ফিসফাস! সব অবশ্য আমার মাথার উপর দিয়ে, কোনো রকমে এক একটা দিন সার্ভাইভ করাই তখন আমার একমাত্র সাধনা। বাবলা মামা, কামরুল ভাই আর জেসমিন আপুকে প্রতিদিন তাগাদা, একটা চাকরি না হলে তো মরেই যাচ্ছি!
ইউনি’র বেশীরভাগ বাংলাদেশী স্টুডেন্ট রেডিও পাকিস্তানে ট্রান্সলেটিং আর ইন্টারপ্রিটিং’র জব করে। বেশ ভাল বেতন। আমারও একটা চাকরি হয়ে যাবে হয়ে যাবে, তখনি বজ্রপাত! কামরুল ভাইয়া আমার ভাল করতে গিয়ে উলটো সর্বনাশ করেছেন। রেডিও’তে ওনাদের বস ‘সিলভিয়া ম্যাডাম’কে কথায় কথায় আমার প্রশংসা করতে করতে আবেগে বলে ফেলেছেন ‘ওর বাবা-মা তো জামাতের বিশাল নেতা’! ব্যাস, মিস সিলভিয়া, যিনি আমাকে তখনো দেখেননি, কথাও বলেননি, চিনেনও না, সোজা জানিয়ে দিলেন, ‘ওর চাকরি হবেনা, জামাত শিবির ঘরের মেয়ে আমাদের এখানে চাকরি পাবেনা’। যতটা না কষ্ট পেয়েছি, তার চেয়ে বেশী অবাক হয়েছি! স্বাধীনতার পর থেকে যেই মহিলা দেশে না গিয়ে পাকিস্তানেই রেডিও পাকিস্তানে জব করছেন, যেই মহিলা চাকরির খাতিরে পাকিস্তানীদের পা চাটেন, সেই মহিলা কিনা জামাত নেতা নেত্রীর মেয়ে বলে আমাকে চাকরি দিলেন না! না খেয়ে আছি জেনেও! মানবিকতা বলেও তো একটা কথা আছে!... বাবলা মামা, জেসমিন আপু যতটুকু পারেন করেন। কিন্তু এই করে কী পেট চলে? দিন জেগে ক্লাস, লাইব্রেরী ওয়ার্ক, স্টাইপেন্ডের জন্যে দৌঁড়াদৌঁড়ি, আর রাত জেগে অন্য মেয়েদের এসাইনমেন্ট টাইপিং করে যা পাই ………
৩৫টি মন্তব্য ২১টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।
ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন
সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।
সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা
সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন
...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না
...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না
ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়
প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন