somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লজ্জিত নই

০৯ ই এপ্রিল, ২০১০ বিকাল ৫:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক-

একটা মানুষ, যাকে আমি চিনিনা, জানিনা, যাকে গিলোটিনে হত্যা করা হয়েছে আজ থেকে কমপক্ষে দুইশ সতের বছর আগে, তার জন্যে কি আমার মন খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক? প্রশ্নটা বিশাল হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু যতবড় প্রশ্নই হোক, সত্যতো এই যে, আমার মন খারাপ থেকে খারাপ হতে থাকে। ইতিহাসের একটা সময়, বেশ বড় মাপের একটা সময় আমার চোখের সামনে সিডনীর আইমেক্সের বিশাল পর্দার সমান বড় হয়ে এমনভাবে ভাসতে থাকে, হতভম্ব আমি ইতিহাসকে আমার চোখের সামনে মুভি’র মত চলতে দেখতে থাকি। আর মন খারাপ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ওদের সমস্যা কী ছিল? ওরা কী করে এত সহজে গিলোটিন অবশ্যম্ভাবী জেনেও নিজের মনের কথাটা বলেই ছেড়েছে?!

-‘সো, ইউ নো, ইউ আর আ ফেমিনিস্ট’, ফোনের ওপাশের সামার জোড় দিয়ে বলে।
-‘নো, সামার, আ’ম নট’। আমি হতাশ হয়ে বলি। সামারের সাথে এই আর্গুমেন্ট চলে আসছে গতবছরের জুন থেকে।
-‘কাম অন মাই ডার্লিং, আই নো ইউ। ইটস জাস্ট ইউ ডোন্ট নো দ্যাট ইউ আর আ ফেমিনিস্ট’!

বরাবরের মত হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেই। প্রসংগ পাল্টাই। না, আমি ফেমিনিস্ট না। শব্দটা’র সাথে এত বেশী পলিটিক্স জড়িত, এত বেশী নোংরামী জড়িত, আর এখন থার্ড-ওয়েভে এসে জেন-ওয়াই’র সেক্সুয়াল ইমানসিপেশান’র নামে এতবেশী সেন্সুয়ালিটি জড়িত যে শব্দটাতে আমি এখন কোনো মাহাত্ন খুঁজে পাইনা। কিন্তু শব্দটার সাথে অতীতের যেসব রক্ত জড়িত, তাও তো আমি অস্বীকার করতে পারিনা!

অথচ এমনকি সামার, যে কিনা নিজে লেসবি, সে পর্যন্ত মন খারাপের কারণ শুনে বিরক্তিতে কুঁচকে উঠে, ‘আর ইউ কিডিং মী? দ্যাট ওমেন… ওয়েল শী ওয়াজ আ ফেমিনিস্ট, বাট শী ওয়াজ… আই মিন… উই নিড আন আপ্রোপ্রিয়েট ওয়ার্ড হেয়ার, ওয়েল… ইউ নো হোয়াট আই মীন’!

আমি ভাল করেই জানি সামার কী মীন করতে চায়। কিন্তু সামার জানেনা, অনেক মানুষের জীবনে একটা সময় আসে, যখন ‘সমাজের তথাকথিত মূল্যবোধের বিপরীতে দাঁড়ানো’টাই একমাত্র পথ হিসেবে বাকী থাকে বিদ্রোহের। আর যে নারী কিনা ‘ডিক্লারেশান অব দ্য রাইট অব উইমেন এন্ড দ্য সিটিজেন’র মত লেখা লিখে যেতে পারে, যখন মেয়েদের জন্যে লিখাটাই ছিল অপরাধ, তখন; সে যদি নিজের জীবন দিয়ে সমাজের দুশ্চরিত্রের মোরালিটি’কে ইম্মোরালিটির বিপরীতে দাঁড় করিয়ে সমাজকে চোখে আংগুল দিয়ে দেখাতে চায় এবং তার জন্যে গিলোটিনে নিজের মাথা পেতে দেয়ার মত সাহস রাখে বুকে, এত্তগুলো বছর পর সে নারীর জন্যে মন খারাপ হওয়ার অপরাধে অপরাধী হয়ে আমি লজ্জিত নই।

দুই-

‘ইন্টেলেকচুয়াল গেদারিং’ বলে একটা শব্দ চালু আছে, যার সাথে আমি নতুনভাবে পরিচিত। আমার দু’টো প্রতিভা আছে, যে দুই প্রতিভা’কে আমি লালন করতে বেশ পছন্দ করি। এক- সবকিছু দেখা। দুই- মনে যা আছে, ঠিক মনে যেভাবে ভাবি, সেই মনের ভাষায় বলে ফেলতে দ্বিধা না করা। প্রথম প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে আমি ইভা’কে দেখছিলাম। ‘বুরোক্র্যাটিক ম্যানারস’কে পাশ এড়িয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে যখন গেদারিং-এ ইনফর্মাল, ‘সত্য’ ‘সত্য’ একটা ভাব আনার জন্যে খাওয়া দাওয়া বিশাল টেবিলটার মাঝখানে নিয়ে সবাই ইচ্ছামত খাচ্ছে আর কথা বলছে, ইভা খুব মনযোগ দিয়ে একদম পুরোপুরি ‘বৃটিশ’ স্টাইলে খাচ্ছে। ঠিক আঠারোশো সালে’র আভিজাত্য নিয়ে। একটা কাঁটাচামচ, একটা চামচ, আর একটা ছুরি। কোলের উপর ন্যাপকিন। মুরগীর টুকরাটা ও কী করে এই কাঁটাচামচ দিয়ে এত সুন্দর করে নিঁখুতভাবে খাচ্ছে- সেটাই আমি অবাক হয়ে দেখতে থাকি!

জুনি ইন্দোনেশিয়া থেকে এসেছে দশদিন মাত্র। কিছু মানুষ আছে যারা কেন যেন আমার সাথে পরিচিত হওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যে মনের কথা অকপটে বলে ফেলতে শুরু করে। জুনি তাদের একজন। আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, ‘আই উইশ আই ক্যুড ইউজ মাই হ্যান্ড’!

আমি এখনো খাওয়া শুরু করিনি, ইভা’র কাঁটাচামচের নিঁখুত খাওয়ার দিকে তাকাই, আর জুনি’র দিকে তাকাই। মাত্র দশদিন আগে আমাদের এখানে জয়েন করা মেয়েটাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে ইচ্ছে করলো। নিজেই জানিনা কখন কথা বলতে শুরু করেছি, কিন্তু এখন যতদূর মনে পড়ে যা বলেছিলাম, তার সারমর্ম হলো, ‘দুঃখিত লেডিস এন্ড জেন্টস, একটা কথা। আপনারা এখানে যারা আছেন সবাই জানেন বাংলাদেশ, অর্থাৎ তৎকালীন ইন্ডিয়া প্রায় দুইশ’ বছর বৃটিশদের অধীনে ছিল। বাদামী চামড়ার আমাদের মধ্যে সাদা’দের প্রতি যে ভক্তি এবং দুইশ’ বছরের যে গোলামীর অভ্যাস, তার একটা প্রবল প্রভাব আমার মধ্যেও আছে। কিন্তু আমি সবসময় সে অভ্যাসকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করি। আপনাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো তর্ক করতে পারেন ‘হোয়েন ইউ আর ইন রোম, শ্যুড এক্ট লাইক আ রোমান’; আমি সে তর্কে যাচ্ছিনা। প্লীজ, যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি আমার হাত দিয়ে খাই’।

মানুষগুলো অন্যরকম। জীবনে কিছু দূর্লভ মুহূর্ত আসে যখন মানুষদের ভাল কিছু দিক দেখার সৌভাগ্য হয়। সবার আগে ইভা ঝটপট সব চামচ-ছুরি পাশে গুছিয়ে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, ‘ইউ মাইন্ড ইফ আই জয়েন উইদ ইউ’? জুনি’র দিকে তাকাই। মেয়েটার মুখ ঝলমল করছে। কী যে অদ্ভূদ এক ব্যপার হয়, আমার সুপারভাইজারও শার্টের হাতা গুটান, ‘ওহ, আই উড আলসো লাভ টু জয়েন ইউ গাইজ’! অনভ্যস্ত মানুষটা ডান হাতের বদলে বাম হাত দিয়ে খেতে গিয়ে প্লেট থেকে খাবার ফেলে দেন। সবাই হো হো করে হাসতে শুরু করে। তিনিও হাসেন। আমার হাসতে হাসতে নাকে খাবার উঠে যাওয়ার উপক্রম। এই প্রথম অনেকদিন পর কেমন যেন একটা মুক্তি’র স্বাদ ঠেকলো মনে। টের পেলাম হাত দিয়ে খাওয়ার আমাদের এই আদিম সংস্কৃতিতে আমি মোটেও লজ্জিত নই।

(ছবিতে, অলিম্প দি গজেস’র গিলোটিনে হত্যা’র কাল্পনিক ছবি)
৩০টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×