somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাজটা ঠিক হয়নি

০৪ ঠা জুন, ২০১০ বিকাল ৫:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তোর কথা যখনই মনে হয়, তখনি অবাক হয়ে ভাবি, একটা মৃত্যুকে ভুলতে মানুষের কতদিন লাগে? ধর একদম দিনক্ষণ গুনে যদি হিসাব করি তাহলেও তুই আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছস সে আজ নয়বছর ছয় মাস তিন দিন। এত্তগুলো দিন পরেও তোকে আমার কাছে এখনো কত জীবন্ত মনে হয়! এই দেখ, চোখের পানি নাকের পানি মুছতে মুছতে নিজেই হাসছি! তোর ক্যারাম খেলার ছবিটা দেখতে দেখতে। একদম বাঁকা হয়ে শুয়ে খুব মনযোগ দিয়ে তুই গুটিটা মারছিস! অথচ ক্যারাম খেলা বুঝার বয়স হওয়ার আগেই কেমন চলে গেলি। আমি বার বার তোর এই ছবিটা দেখি, তোর চোখে মুখে উত্তেজনা। সে তুই আমাদেরকে দেখেছিলি গুটি মারার সময় কেমন হৈ হুল্লোড় পড়ে যেত! বড়ভাইয়া ছিল ক্যারাম খেলায় ওস্তাদ। ও তাই গুটি মারার সময় বাকীরা সবাই ‘ছু মন্তর ছু’ বলে ফুঁ দিতাম, যেন সেই ফুঁয়ের মন্ত্রের শক্তিতে ও লাল গুটিটা খেতে না পারে! তুই আমাদেরকে খেলতে দেখেই নিশ্চয়ই শিখেছিলি গুটি মারার সময় চোখ মুখ অমন করে ফেলতে হয়!

এখন খেয়াল করলাম তোর সাথে আমার কোনো ছবি নেই। শুধু আমার সাথে না, একমাত্র পাখি ছাড়া আর কারো সাথেই তোর কোনো ছবি নেই! পাখি নামের সেই কাজের মেয়েটাকে এখন আমার ঈর্ষা লাগে। তুই যে চলে যাবি জানলে নিশ্চয়ই অনেক ছবি তুলে রাখতাম। কী জানি, হয়তো জানলে তখন আমরা সবাই দুঃখেই পাগল হয়ে যেতাম। এজন্যেই হয়তো কার মৃত্যু কখন হবে কেউ জানেনা।

তোর আরেকটা ছবিতে ফয়সলের স্কুলের সাদা শার্ট পড়া, শার্টটা ঝুলে মাটির কাছাকাছি! হাতে ছাতা, চোখে চশমা, চশমাটা কার ছিল অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারছিনা। আব্বুর না শিউর, আব্বু তখন চশমা পড়তোনা। আমার কী? উমম, মনে হয় ওটা আমারই। আর মাথায় আব্বুর টুপি। আমার স্পস্ট মনে আছে, তোকে ঘটক সাজিয়ে একদম ঘটকদের মত করে ছাতা হাতে পোজ দিয়ে ছবি তুলেছিলাম। আর তুই ও কেমন শান্ত হয়ে পোজ দিয়েছিস ছবিটাতে! তুইতো প্রচন্ড চঞ্চল ছিলি, তাহলে তোকে ঠিকঠাক মত দাঁড় করিয়ে এই ছবিটা তুললাম কী করে? ভাবতে চেষ্টা করছি ছবিটা কী তোর শেষ দিকের তোলা কিনা। যখন তুই আস্তে আস্তে কেমন নিস্তেজ হয়ে এসেছিলি। বেশ অনেকদিন তোর জ্বর ছিল।

আর এই ছবিটা, যেটাতে তুই বড়ভাইয়ার ক্রিকেট ব্যাটটা দিয়ে বল মারার ভংগি করছিস! হাহাহাহা, ব্যাটটা তোর চেয়েও ভারী, আলগাতে গিয়ে তাই তোর মুখ বাঁকা হয়ে গিয়েছে! আমি তোর ছবিগুলার দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থেকে কেমন যেন ঠিক ঐ দিনগুলো, এমনকি ঠিক ঐ সময়গুলোকে পর্যন্ত এখনো ছুঁতে পারি। এই যে তুই ব্যাটটা আলগাতে গিয়ে বাঁকা হয়ে গিয়েছিস, আমি স্পস্ট শুনতে পাচ্ছি আমার নিজের হাসি’র শব্দ, পাখির হাসির শব্দ! ফয়সলের তোকে ঠিকমত ব্যাট ধরানোর চেষ্টা। এমনকি তোর পিছনের সেলাইয়ের মেশিনটা… একটু আগেই আম্মু ওখানে সেলাই করছিল কিছু একটা। ঢাকনাটা রাখার সময় যে শব্দটা হয়েছিল, ওটাও আমার কানে বাঁজছে। আর রান্নাঘরে রুবির মা, যে কিনা আমার জন্মের ছয়মাস থেকেই আমাদের বাসায় কাজ করতেন, রুবির মা’র কথাও শোনা যাচ্ছে। বারান্দার পিছনের রেলিং দিয়ে পিছনের হিন্দু বাড়ীর মহিলাটাকে কী যেন বলছেন। তুই একটু পরেই ব্যাটটা ধপাস করে ফেলে দিবি। ফেলে দিয়ে আমাদের হাসি দেখে নিজেই হাসবি… দেখ, কত স্পষ্ট সব!

আর কক্সবাজারে রেস্ট হাউজে তোলা তোর সেই সেরা ছবিটা। তুই তখন সুস্থ। জীবনে ঐ একবারই আমাদের বাসার সবাই মিলে দাদু বা নানু বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও দল বেঁধে বেড়াতে যাওয়া। তুই কী খুশী! অত্ত বড় রেস্ট হাউজ, খালি পাগলের মত এঘর ওঘর দৌঁড়াচ্ছিস! আমি বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে আব্বু থেকে ক্যামেরাটা পেয়েছি, ভীষন উত্তেজিত ছবি তুলতে! এর আগে পরে যত ছবি তুলেছি, খুব সম্ভব তোর এই ছবিটাই আমার তোলা সেরা ছবি। তুই দৌঁড়াচ্ছিস, হাত ডানার মত ছড়ানো, হাসি তোর এগাল ওগালে ভরা! …… তোর হাসিতে পুরা ছবিটা হাসছে যেন। আম্মু বলে আমাদের মধ্যে ফয়সল সবচে’ সুন্দর। অনেকবার ভেবেছি তোর এই ছবিটা আম্মুকে দেখায়ে বলি, আম্মু দেখো, তোমার ধারণা ভুল। ফুয়াদের হাসি আমাদের পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবচে’ সুন্দর। কিন্তু অনেকবার ভেবেও আম্মুকে ছবিটা দেখাতে পারিনি। আম্মু সেবার তোর কবরের সামনে যেভাবে ঢুকরে কেঁদে উঠেছিল, আম্মুকে তোর ছবি দেখানোটা বোকামী হয়ে যাবে।

তুই শুনলে হাসবি, আমি প্রায় সবাইকে বলতাম, এখনো বলি, ফুয়াদ জন্ম হওয়ার আগে আমরা গরীব ছিলাম। ফুয়াদ হওয়ার পর আমরা গরীব থেকে মধ্যবিত্ত হয়েছি। হাহাহাহাহা! যদিও হাসছি, কথাটা কিন্তু সত্যি। তুই কেমন যেন অল্প কিছুদিনের জন্যে চরম ভাগ্য নিয়ে এসেছিলি। আব্বুর ছোট্ট প্রেসের ব্যবসা আর দোকানটাতে লাভ হতে লাগলো, আমার কোনো পড়ার টেবিল ছিলনা। প্রথম পড়ার টেবিল পেলাম। একটা ওয়াড্রবের জন্যে কত আবদার ছিল, সেই ওয়াড্রবও এলো! আর সেই ওয়াড্রব নিয়ে আমাদের কত কাড়াকাড়ি! অবশেষে আব্বু ভাগ করে দিলেন, ঠিক আছে, চারটা ড্রয়ার চার জনের জন্যে। তুই তো ছোট, তোর কাপড়চোপড় আম্মুর আলনাতেই থাকে, তাই তোর কোনো ড্রয়ার নাই। তুই যদি তখন বুঝতি, তাহলে তুই ও নিশ্চয়ই আমাদের মত চিল্লাচিল্লি করতি, ঠিক না?

তোর বাকী ছবিগুলো আমি দেখিনা। কখনো অজান্তে পৃষ্ঠাগুলো চলে এলে, দ্রুত উলটে দেই। ঐ দুই দিনের কথা ভাবতে গেলে এখনো কপালের দু’পাশের রগ চিন চিন করে উঠে, মাথা ব্যথা উঠে যায়।

আমি এখনো গর্ব করে বলি, তুই আমাকে সবচেয়ে ভালবাসতি, অজ্ঞান হওয়ার পর জ্ঞান ফিরলে তুই শুধু আমার নামই ডেকেছিল যে! কিন্তু তুই জানিস কিনা জানিনা, বড়ভাইয়া তোকে প্রচন্ড ভালবাসতো, কীভাবে বুঝেছি জানিস? আমার গল্পের আর আউট বই পড়ার মেইন উৎস ছিল বড়ভাইয়া। কিন্তু তুইতো জানিস, ও সব হয় তালা দিয়ে রাখতো, নয় লুকায়ে রাখতো। কোথায় কোথায় যে চাবি লুকাতো!! কিন্তু শার্লক হোমসও আমার কাছে মার খাবি বড়ভাইয়ার ডেস্কের চাবি ট্রেস করার কাছে। ওর রুমে নতুন কোনো বই এলেই আমি গন্ধ শুঁকেই বুঝে যেতাম! তুই চলে যাওয়ার পরও সে অভ্যাস ছিল। তো একদিন ঐরকম বই খুঁজতে গিয়ে দেখি বড়ভাইয়ার ডায়রী। আর আমাকে পায় কে!! কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখি তোর কথা লিখা। তুই বড়ভাইয়া আর আম্মুর সাথে নানাকে যখন দেখতে গেলি ঢাকা, হাসপাতালের করিডোরে তোর দৌঁড়াদৌঁড়ি’র কথা লিখা। বড়ভাইয়া আর ফারহানা আমাদের মধ্যে সবচে’ ইন্ট্রোভার্ট, একদম কম কথা বলে। কিন্তু ফুয়াদ, তুই যদি বড়ভাইয়ার ডায়রীর ঐ পৃষ্ঠাগুলা পড়তি! আমি হেঁচকি তুলে কাঁদছিলাম। আমার কান্না শুনে আম্মু এসে কী পড়ে কাঁদছি দেখতে গিয়ে আম্মুর নিজেরও কান্না! বড়ভাইয়া এখনো জানেনা ওর ডায়রীতে তোর লেখা পড়ে সেই প্রথম আম্মু আমাকে জড়ায়ে ধরে অনেক্ষন কেঁদেছিল।

আমরা সবাই তোকে আসলে ভীষন ভালবাসতাম রে! তারপরও তুই চলে গেলি। আর এত্তগুলো দিন পরে, নয়বছর ছয়মাস তিনদিন পরে, এখন কী ভাবছি জানিস? তুই চলে না গেলে কী খুব বেশী ক্ষতি হতো? আব্বুম্মুর সামর্থ্য না হলেও আমরা চারভাইবোন মিলে তোকে ঠিকই পেলে পুলে রাখতে পারতাম। দেখ, বড়ভাইয়া টাকা কামায়, আমি টাকা কামাই, ফারহানা ক’দিন পরে ডাক্তার হয়ে যাবে! ও কিন্তু তোকে সবচেয়ে বেশী বুঝতে পারতো। কিন্তু তুই ওকে সে সুযোগ দিলিনা। কাউকেই সুযোগ দিলিনা। কী সুন্দর টা টা বাই বাই বলে চলে গেলি। কাজটা ঠিক হয়নি।

৩৪টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×