somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লিখবো লিখবো করে চিঠিটা এখনো লেখা হলোনা…

০৬ ই জুলাই, ২০১০ বিকাল ৪:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


………আপনাকে একটা চিঠি লিখবো বলে ভাবছি সে দু'দিন ধরে। কিন্তু সাহস করে কুলিয়ে উঠতে পারছিনা। বন্ধুরা বলে 'তোর মত করে মনের কথা যদি লিখতে পারতাম তাহলে লিখে-টিখে এতদিনে দুনিয়া উদ্ধার করে ফেলতাম'; আর আমি যখন আপনার নীল-কে লিখা চিঠিটা পড়ি তখন ভাবি 'আপনার মত করে যদি লিখতে পারতাম, তাহলে আমিও দুনিয়া উদ্ধার করে ফেলতাম হয়তো'! সে যাই হোক, দুনিয়া তো আর আসলে কেউ উদ্ধার করতে পারেনা! যদিও জীবনের একটা সময়ে অনেকেই হয়তো স্বপ্ন দেখে দুনিয়া উদ্ধারের। আমি, এ্যাশ, মুসানি আমাদের কথা মনে আছেতো আপনার? আপনার বন্ধু নীলের কাছের মানুষ, তিনটা মানুষ, তিনটা মেয়ে।

……মেয়ের কথা বলতেই মনে পড়লো, আজকে সকালেই ফেইসবুকে আরিফ একটা লিংক পাঠালেন। একটা মেয়ের লাশ, হাতে আর পায়ে বেঁধে একটা বাঁশে ঝুলিয়ে ভারতীয় পুলিশরা স্বগর্বে হেঁটে নিয়ে যাচ্ছে ঠিক হরিণ শিকারের পর শিকারীরা যেভাবে বুক ফুলিয়ে ছবি তোলার জন্যে পোজ দিতে দিতে যায় সেভাবে। অনেক ছবি দেখেছি এই ছোট্ট জীবনেই, সেই বিশ্ববিখ্যাত ছবিটাতে- যেটা জলজ্যান্ত ছেলেটাকে মাথায় গুলি করে মেরে ফেলার ঠিক আগ মুহূর্তে তোলা- ছেলেটার চোখের অন্যমনষ্কতাকে কতবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি, এমনকি কেন যেন এই না জানা, না চেনা ছেলেটার জন্যে কেঁদেছি পর্যন্ত! বার বার ভেবেছি মরার ঠিক আগমুহূর্তে ওর যখন ছবি তোলা হচ্ছিলো, কী ভাবছিলো ও?! অথবা সেই ছবিটা, পিছনে আনবিক বোমার মেঘের মত অন্ধকার ধোঁয়া আর ছোট ছোট বাচ্চাগুলো দৌঁড়াচ্ছে, ওরা জানেনা কোথায় যাচ্ছে, কী হচ্ছে! যখন ভাবি এই বাচ্চাগুলোর একজন আমিও হতে পারতাম, ছবিটা তখন বিভিষীকার মত মনে হয়। কিন্তু অত অত ছবি সব মার খেয়ে গেলো এই ছবির কাছে। ডিকশনারীতে ‘অমানবিক’ শব্দের পাশে কোনো ব্যাখ্যা লিখার আর দরকার নেই, এই ছবিটা দিয়ে দিলেই হবে। ছবিটা দেখে বার বার মনে হচ্ছে, যে চিঠিটা আপনাকে লিখবো লিখবো ভাবছি, সে চিঠিটা এবার লিখতেই হবে।

…………ক'দিন আগে বাংলাদেশে জাহাজ ডুবে অনেকেই মরে গেলো। আব্বু একবার বলেছিলেন একবার সৌদি রাজপরিবারের সাথে এক মিটিং-এ গিয়েছিলেন কার সাথে যেন। ওখানে মিটিং এ আগত অথিতিদের খাবারের পরিমাণ দেখে আব্বু ভড়কে গিয়েছিলেন। পরে ইনকোয়ারী করে জেনেছিলেন, যে খাবার গুলো বেঁচে যাবে ওগুলো শিপে করে নিয়ে গিয়ে সমুদ্রে ফেলে দিয়ে আসা হবে। আমার কাছে ইদানীং মনে হয় বাংলাদেশ সহ তৃতীয় বিশ্বের মানুষদের প্রাণের মূল্য ওই সৌদি রাজা বাদশাদের উচ্ছিষ্ট খাবারের মত। একসাথে বিশ-ত্রিশ-একশ দুইশ প্রাণ ডাম্প হয়, কারো কোনো বিকার নেই। সেই ভেবে ভেবে ভাবলাম, এইবার আপনাকে আমি চিঠিটা লিখবই।

……… কিন্তু লিখতে লিখতেই কনফারেন্সে যেতে হল। সে এক অবস্থা আরকি। আপনি কী হাসছেন? আমি জানি হাসছেন। এই ভেবে যে সেদিনের সেই পুচকে মেয়েটা কী গালভরা সব কনফারেন্সে যাচ্ছে রে বাবা! হাসতে হাসতেই শুনুন কী হলো। অনেক আশা নিয়ে গেলাম। ইদানীং পশ্চিমের 'পপুলার' লেভেলে না হলেও, একাডেমিক লেভেলের নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ-মূলক অবস্থানের উপর একটা হালকা আস্থা এসেছিল। ওরা নিজেরাই যখন নিজেদের অতীতের 'ওরিয়েন্টালিস্ট' লেখাগুলোর 'স্ক্রুটানাইজ' করে তখন একটু হলেও আস্থা না এনে উপায় আছে বলুন? সেদিন দেখলাম বার্টনকে একজন এমন ক্রিটিসাইজ করেছে, বেচারাকে পুরা নেংটুপুটু করে ছেড়েছে। কারণ বার্টন এশিয়ার মেয়েদেরকে নিয়ে লিখেছে, “I’m told, your Asiatic beauties are the most convenient women alive, for they have no souls; positively there is nothing in nature I should like so much as ladies without souls; soul, here, is the utter ruin of half of the sex”! কথাটা অনুবাদ না করে ইংলিশেই দিলাম, পাশ্চাত্যের চরম ওরিএন্টালিস্ট ইন্টেলেক্টের সামান্য ক্ষুদ্র একটা নমুনা মাত্র।

……….যাই হোক, যা বলছিলাম, ওরা নিজেরাই যখন এইসবের ক্রিটিসাইজ করছে, ভেবেছিলাম, যাক, ওরা তবে এখন মনে হয় আসলেই 'বস্তুনিষ্ঠ' পর্যবেক্ষণ বলে যে জিনিসটা দাবী করে, তার লাইনে এসেছে। কনফারেন্স আমার সে আশার গুড়ের মধ্যে বালি ঢেলে দিলো। ওদের মধ্যে এখনো কেমন হিংস্র জিঘাংসা ইসলামের প্রতি, দেখে বিশ্বাস করুন, ভয় করছিলো রীতিমত। একজন একটা পেপার দিলেন পুরোটার মূল বিষয় হচ্ছে, বাইবেলের সাথে কোরানের তুলনা। কোরান কীভাবে সন্ত্রাসকে জিহাদের নামে উৎসাহিত করেছে! অবাক হয়ে শুধু চেয়ে চেয়ে শুনলাম, কীভাবে কোরানের আয়াতকে বিকৃত করে ব্যাখ্যা করা হলো! বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ যেভাবে ক্ষমতায় টালমাটাল হলেই 'যুদ্ধাপরাধী' ইস্যুকে টান দিয়ে মানুষজনকে চাংগা করে তুলে, রাজনীতিকে নিজেদের ফেভারে নিয়ে আসে, ঠিক সেভাবে পাশ্চাত্যও এখন মুসলিম দেশগুলোর রিসোর্স দখল করার মনষ্কামনায় দুইটা বিষয়কে ক্ষণে ক্ষণে চাংগা করে তুলে, এক- মুসলিম দেশগুলোতে মেয়রা কীভাবে নির্যাতিত হচ্ছে, দুই-কোরান মুসলিমদেরকে কীভাবে সন্ত্রাসী বানাচ্ছে!

…......... সোশিওলজি পড়াতে গিয়ে আরেকটা বিষয় শিখেছিলাম, 'ডিহিউম্যানাইজেশান প্রসেস'। সোশিওলজিস্টরা বের করেছেন, যখন একটা গোষ্ঠী আরেকটা গোষ্ঠীকে দখল করতে চায়, ধ্বংস করতে চায়, তখন প্রথমে তারা উক্ত টার্গেট গোষ্ঠীকে মানুষের কাছে, সাধারণের কাছে খারাপ করে তুলে। ঠিক যেমনটা নাৎসীরা করেছিল ইহুদীদেরকে হলোকাস্টে মেরে ফেলার আগে। সাধারন জার্মান জনসাধারণের কাছে ইহুদীদেরকে কীটের চেয়েও নোংরা করে তুলেছিল। ছোট বেলায় ইংলিশ বইয়ে পড়া ‘শাইলক’ চরিত্রটার মত সব ইহুদীদেরকে লোভী, পাপী করে দেখানো হয়েছিল এমনকি স্কুল-কলেজের বইয়ে পর্যন্ত। এটাকেই বলে ডি-হিউম্যানাইজেশান, টার্গেট গ্রুপকে মানুষের পর্যায় থেকে নীচে নামিয়ে আনা। ঠিক এই প্রসেসটাই এখন পাশ্চাত্য চালাচ্ছে মুসলিমদেরকে নিয়ে। পাশ্চাত্যের সাধারণ মানুষের কাছে মুসলিম ইয়াং-ম্যান মানেই, ‘এংরি-ম্যান’ যে কিনা বোমা হামলা করার জন্যে সারাক্ষণ তড়পায়, যে কিনা পাশ্চাত্যের মেয়েদেরকে ‘বেশ্যা’ মনে করে, আর যার ঘরে কিনা কমপক্ষে তিনটা-চারটা বউ আছে, যেসব বউরা আবার মাথা থেকে পা পর্যন্ত কালো কাপড়ে ঢাকা! – এমন বর্বর মুসলিমদেরকে ‘সভ্য’ বানানো তাই পাশ্চাত্যের নৈতিক দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালন করতেই ওরা আক্রমণ করেছে ইরাক, আফগানিস্তানে, তড়পাচ্ছে ইরানে আক্রমন করতে। ঐযে, ‘অসভ্য’ মুসলিমদেরকে ‘সভ্য’ বানানো যে ওদের নৈতিক দায়িত্ব!!

……. কনফারেন্স থেকে বের হয়ে তাই আমার মাথা ভো ভো করে ঘুরছিলো। তখনও ভাবছিলাম, চিঠিটা এবার অবশ্যই লিখব। কারণ সব কিছু মিলে মাথার ভিতর যেভাবে ধোঁয়াশা হয়ে আছে, চিঠিটা না লিখলে যে মাথা পরিস্কার হবেনা। কনফারেন্সের শেষ দিন নেদারল্যান্ডের এক মেয়ের সাথে কথা বলছিলাম। ও বার বার বলছিলো, ‘দেখো, ধর্ম আর রাষ্ট্রের এইসব দ্বন্দ কখনোই শেষ হবেনা। একটাই উপায় ধর্মকে ধর্মের পথে চলতে দেয়া। রাষ্ট্রকে রাষ্ট্রের পথে’। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘তুমি কি সেক্যুলারিজমের কথা বলছো?’ ও বললো, ‘হ্যা’। আমি বললাম, ‘ইউরোপ-এমেরিকা সহ উন্নত দেশগুলোতে তো এখন সেক্যুলারিজম মোটামোটি পাকাপোক্ত, সমস্যা কী কমে গেছে? কই, সেক্যুলারিজম তো আমার ব্যক্তি জীবনের ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি। বরং সেক্যুলারিজম উলটা নিজেই একটা ধর্ম বনে গেছে, যে ধর্ম প্রচন্ড ভাবে এন্টি-রিলিজিয়াস, বিশেষ করে এন্টি-ইসলামিক। যে ধর্ম আমার মাথার হিজাবকে টেনে ফেলে দিতে চায়, যে ধর্ম আমাকে ওয়েস্টের আর দশটা মেয়ের মত বিকিনি পড়িয়ে সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে আমার শরীর প্রদর্শন করাতে চায়, যে ধর্ম আমার মডেস্ট ড্রেস আপকে সাপের চেয়েও বেশী ভয় পায়…”! বেচারী আর কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি।

………সেক্যুলারিজমের কথা বলতে গেলে ফেমিনিজমের কথাও চলে আসে। আমার প্রাক্তন সুপারভাইজার একদিন খেতে বসে কমেন্ট করেছিলেন, ‘সো, তুমি তাহলে ফেমিনিস্ট, কী বলো!’ এই নিয়ে তার সাথে বেশ ক’দিন ধরে তর্ক চলছিলো। আমি অস্বীকার করে বললাম, ‘না, আমি ফেমিনিস্ট না, আমি হিউম্যানিস্ট’। সে আমাকে বলেছিলো, ‘ডিপ ডাউন ফ্রম ইউর হার্ট, ইউ আর আ ফেমিনিস্ট। দ্য অনলি ডিফরেন্ট ইজ, ইউ ডোন্ট নো দ্যাট ইউ আর আ ফেমিনিস্ট’। আমি প্রতিবাদ করে বলেছিলাম, ‘আমি হতে পারে মেয়েদের অধিকারের জন্যে ফাইট করছি, কিন্তু মেয়েদের জায়গায় যদি ছেলেদের এই দশা হতো, তাহলে খুব সম্ভব আমি ছেলেদের জন্যেও একই ফাইট করতাম’। ভাগ্যিস, ফেমিনিস্টদের দলে যোগ দেইনি। ফেমিনিজমের নাম দিয়ে এরাও যে ‘হোয়াইট ইম্পেরিয়ালিজম’র চামচাগিরী খাটছে, তা আমার মত একজন মুসলিম মেয়ের চেয়ে আর কে বেশী বুঝবে?! ‘নারী অধিকার’ এর নাম দিয়ে এরা গলা ফাটিয়ে ফেলছে, অথচ যখন ‘মুসলিম নারী অধিকার’ এর কথা আসে, এরা তখন পুরো উলটে যায়। আমাকে ওদের মত ড্রেস পড়তে হবে, ওরা আইন করে আমার মাথার হিজাব নিষিদ্ধ করবে, আমি মুসলিম থাকতে পারবোনা, তাহলে আমার ‘নারী অধিকার’ অথবা ‘মানবাধিকার’ গেলো কই?! … ঐ যে বললাম, সেক্যুলারিজম ইটসেলফ একটা ‘এক্সট্রিম ধর্ম’ বনে যায়!! ভারতীয় চিন্তাবিদ আশিস নন্দী দারুন একটা কথা বলেছেন, “সেক্যুলারিজম নামক ধর্মে বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ আর ব্যুরোক্রেটিকরা হচ্ছে পুরোহিত। এই ধর্মের পুরোহিতরা অন্যান্য ধর্মের পুরোহিতদের চেয়েও চরমপন্থী, কারন এরা সাধারন মানুষের কাছ থেকে ‘অন্ধ আনুগত্য’ না পেলে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে…”! ফেমিনিস্ট সেক্যুলারিস্টরা তো ডাবল জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, সাধারণ একটা বাচ্চাও টের পাবে কেমন অদ্ভূদ বৈপরীত্য এদের কথাবার্তায়…

…… এইসব ভাবতে গিয়ে আমার মাঝে মাঝে মাথা-টাথা সব প্যাঁচ খেয়ে যায়। রাষ্ট্র জিনিষটাকে উঠিয়ে দিলে কেমন হয়? কিন্তু তারপরেই ভাবি, রাষ্ট্র উঠিয়ে দিলে সমাজ চলবে কী করে? রাশিয়ার প্রাক্তন আর চীনের বর্তমান সমাজতন্ত্র, যেখানে কিনা সরকার বিরোধী একটা কথা বললে সাথে সাথে জীবন্ত মানুষ গুম হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়, যেখানে কিনা একজন ব্যক্তি মানুষ কয়টা বাচ্চা নিতে পারবে তা রাষ্ট্র ঠিক করে দেয়, একের বেশী বাচ্চা হলে এমন ফাইন করে যে ফাইন টানতে গিয়ে পরিবার চাংগের আগায় উঠে যায়; আর পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদ? যেখানে ক্লাস ব্যবধান এত্ত বেশী যে চিন্তা করতে গেলে পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়, সেক্যুলারিজম যেখানে নিজেই একটা ধর্ম যে কিনা প্রচন্ডভাবে এক্সট্রিম পর্যায়ের এন্টি-ধার্মিক (নাকি শুধু এন্টি-ইসলামিক?!); এই দুই ব্যবস্থার রাষ্ট্র-যন্ত্রে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি অনেক আগেই। সেদিন এমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব নিভাডা’র জুদিশিয়াল স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর প্রফেসর জেইমস টি রিচার্ডসন এসেছিলেন আমাদের পিএচডি রিসার্চারদের একটা ওয়ার্কশপে। ‘মুসলিম মেয়ে’ বিষয়ে বিশ্ববিখ্যাত্ ইউরোপীয়ান হিউম্যান রাইটসের দিনের আলোর মত প্রকাশ্য ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের কথা বলে গেলেন। আমি ওয়ার্কশপ থেকে বের হয়ে অনেক্ষন হতভম্ব হয়ে বসে ছিলাম। কী করে সম্ভব যারা ‘মানবাধিকার’র বড় বড় বুলি আওড়ায়, সেই ইউরোপ-এমেরিকার দেশগুলোর মানুষগুলো মুসলিমদের ‘মানবাধিকার’র কথা আসলেই কাকের মত চোখ বন্ধ করে রাখে, ভাবখানা এমন যেনো ‘আমি কিছু দেখিনি!’ এমন চোখের সামনে দিনের আলোয় এরা নিজেদের ডাবল স্ট্যান্ডার্ডস নিয়ে কী করে মুখ দেখায়?!

………ইসলামিক মাইন্ডের মানুষদের সাথে এসব পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে গেলে ওনারা বলেন, একমাত্র থিউ-ড্যামোক্র্যাসি’ই অল্টারনেটিভ ব্যবস্থা হওয়ার যোগ্য। সমস্যা হলো, এই থিউ-ডামোক্র্যাসি জিনিষটাই বুঝলাম না। আমি কোনো জ্ঞানী না, সাধারন এক মেয়ে যে অনার্স-মাস্টার্স করে সুযোগ পেয়ে পিএইচডি করছি। হতে পারে সাধারণদের দলে পরি বলেই আমার বুঝে আসেনা। আল্লাহ কি প্রেসিডেন্টের পদে বসে রাষ্ট্র চালাবেন?! তিনি তো আকাশ থেকে নেমে আসবেন না। তার মানে কী দাঁড়ালো?!! থিউ-ড্যামোক্রাসি’র নামে আসলে তখন এমন একদল মানুষ দেশ চালাবে, যারা আল্লাহ’র দেয়া কোরানকে নিজেদের মত করে ইন্টারপ্রেট করে নিবে, যাদের ইন্টারপ্রিটেশানের বিরুদ্ধে কথা বললেই অভিযোগ উঠবে ‘আল্লাহ’র বিরুদ্ধে কথা বলার (আস্তাগফিরুল্লাহ)! যারা রাষ্ট্রকে ব্যবহার করবে নিজেরা যেভাবে ধর্মকে বুঝে, সেই বুঝের উপর ভিত্তি করে। অন্য কেউ যদি ধর্মকে অন্যভাবে বুঝতে চায়, তাহলেই সে তখন হয়ে যাবে রাষ্ট্র বিরোধী, আল্লাহ-বিরোধী! ধর্মের নাম দিয়ে তখন যে একইভাবে গলা চিপে ধরবে শক্তিধর রাষ্ট্র! সেইতো ঘুরে ফিরে একই কথা হয়ে গেলো! সব রসুনের কোয়া যেমন একজায়গায় এসে ঠিকই মিশে যায়, তেমন! ……মাঝে মাঝে মনে হয় পাগল হয়ে যাবো! অরুন্ধতী রয় যে নতুন সম্ভাবনাময় পৃথিবীর কথা বলেন সেই পৃথিবী কী আসলেই সম্ভব?! বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি। আর তখনই আপনাকে চিঠি লিখার কথা মনে পড়ে যায়।

……কনফারেন্স থেকে ফিরে চিঠিটা লিখবো লিখবো ভাবছি, কিন্তু লিখার আর সময় পেলাম কই? এরমধ্যেই দেশে কেমন কান্ড হলো দেখুন! দ্য-গার্ডিয়ানের মত পত্রিকায় ছবি আসলো টোকাই শিশুটাকে পুলিশ কেমন দুইহাতে শরীরের সব শক্তি দিয়ে মোটা লাঠি দিয়ে পিটাচ্ছে! বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা কম্বলের ভিতর তুলার বদলে টাকা ভরে টাকার কম্বল দিয়ে ঘুমায়; সে ব্যাপারে কারো হুশ নেই, কিন্তু কেনো টোকাই পিটালো, বাংলাদেশে পুলিশ কর্তৃক শিশু নির্যাতন হয়ে গেলো আন্তর্জাতিক ইস্যু!..... একদিনের মজার কথা বলি; ক্লাসে উন্নত-বিশ্ব আর অনুন্নত বিশ্বে মানুষদের দৈনিক আয়ের তুলনা নিয়ে কথা হচ্ছে। বাংলাদেশের একটা রিকশাওয়ালা সারাদিন রিকশা চালিয়ে এত কষ্ট করে অষ্ট্রেলিয়া’র দুই/তিন ডলারের সমান টাকা কামায় শুনে ছেলে-মেয়েরা যখন হাহুতাশ করছে, বললাম, “ওয়েট, ভেবোনা বাংলাদেশ গরীব রাষ্ট্র”। ওরাতো অবাক, এত টাকার ব্যবধান, তারপরও আমি বলছি বাংলাদেশ বড়লোক?! ব্যাখ্যা করে বললাম, “আমাদের দেশের পলিটিশিয়ানরা আক্ষরিক অর্থে টাকার জাযিমের উপর শুয়ে, টাকার বালিশে মাথা রেখে, টাকার লেপের তলে ঘুমায়”!! ওদের হাঁ হয়ে যাওয়া চেহারাগুলো যদি দেখতেন!

…… উন্নত বিশ্বে রাষ্ট্র ন্যাশনাল সিক্যুরিটি, ট্যাক্স, সিভিল-হেলথ ইস্যু ইত্যাদি মনভুলানো টার্ম ব্যবহার করে এইসব টার্মের আড়ালে জনগনকে বোকা বানিয়ে ক্ষমতা’র চরম ব্যবহার করে। কিন্তু অনুন্নত বিশ্ব যেমন বাংলাদেশে টার্ম-মার্মের কোনো বালাই নেই, এখানে জনগনকে বোকা বানানোর কিছু নেই। জনগন জানে প্রতিটা রাজনৈতিক দল কেমন হাড়ে হাড়ে বজ্জাত, হাড়ে হাড়ে বেঈমান, আবার এই জনগনই নাচতে নাচতে গিয়ে অল্টারনেটিভলি একেকটা রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে গলার মালা পড়িয়ে দিয়ে আসে। আমার শ্বাশুড়ী অশ্রুসিক্ত চোখে তার মুক্তিযোদ্ধা বড় ভাই’ যাকে পাকিরা ঈদের দিন সবার সামনে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরেছে তার কথা বলতে বলতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে সোচ্চার হোন; সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করা আমার মুক্তিযোদ্ধা বড়মামা-যিনি শুধুমাত্র জামাত করেন বলে আব্বুকে এখনো মেনে নেননি- রক্তচোখে যুদ্ধাপরাধীদের পাবলিক ফাঁসি দাবী করেন; এইসব জনগন নিজেরাও জানে যুদ্ধাপরাধী শব্দটাকে ক্ষমতাশীল দল কেমন পাপোশের মত নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে ভিন্নমত দমনের জন্যে। জেনে বুঝেও এরা নিজেদের অমূল্য ইমোশনকে সস্তা মূল্যে বিক্রি করে দেন রাজনীতিবিদদের পায়ের-তলার পাপোশের মূল্যে।

………… এশিয়ার রাজনীতি’র উপর পিএইচডি করছে কুয়েতের এক ছেলে, সেদিন ওয়ার্কশপে নাস্তার ব্রেকে সবাই একেকটা কৌতুক বলছিল। একাডেমিক লেভেলের কৌতুক, বুঝতে কষ্ট হয়, কিছু বুঝি কিছু বুঝিনা। কিন্তু কুয়েতের ছেলেটা যখন বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কৌতুক করছিল, আমার বুঝতে এক ফোঁটা কষ্ট হয়নি। ঘরশুদ্ধ মানুষ সবাই যখন হাসছিল, আমার একফোঁটা হাসি পায়নি। দুঃখে কান্না চলে এসেছিল উলটা। কারন ও যে কৌতুক করেছে, এর চেয়ে চরম সত্য কৌতুক মনে হয় বাংলাদেশীদের জীবনে আর নেই। হুবুহু কৌতুকের কথোপকথনগুলো তুলে দিলাম-
- ‘হ্যাই গাইজ, আমাকেও একটা কৌতুক বলতে দাও; অবশ্য ফারজানা যদি অনুমতি দেয় আরকি!’
- (আমি অবাক হয়ে) আমার অনুমতি লাগবে কেনো?
- কারন কৌতুকটা বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে, হো হো হো (বলার আগেই ও হাসছে। হাসি একটা সংক্রামক রোগ; অন্যদের মুখেও হালকা হালকা হাসি…)
- আচ্ছা বলো, সমস্যা নাই।
- লিসেন, বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা থাকলে সবাই নিশ্চয়ই জানো ওখানে এখন ওয়ার-ক্রিমিনাল-জাস্টিস বিষয়টা খুব গরম। তো ক্ষমতাশীল দল আওয়ামী লীগ দাবী করে ওরা এই জাস্টীস আনবে বাংলাদেশে। আওয়ামীলীগের প্রধান শেখ হাসিনা হচ্ছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। রাইট ফারজানা?
- (ও কোন দিকে এগুচ্ছে বুঝতে না পেরে কিছু আশংকিত হয়ে মাথা নাড়লাম) হু।
- সো, হোয়াট হ্যাপেন্ড, মিডিয়া খুঁজে পেয়েছে শেখ হাসিনা’র মেয়ের শ্বশুড় নিজেই ওয়ার-ক্রিমিনাল!!! হোহোহোহোহো! হোয়াট এন অক্সিমরন গাইজ!!! (সবাই হো হো হাসিতে গড়িয়ে পড়ে) লিসেন লিসেন, আমি এখনো শেষ করিনাই… তারপর কী হয়েছে শোনো… ফারজানা তুমি আমার মাইন্ড করছো নাতো? হাহাহাহাহাহাহা… যেহেতু মেয়ের শ্বশুড়কে বাঁচাতে হবে, কী করা যায়? মেয়ের শ্বশুড় আবার বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বাইরে থাকে, তাই আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিয়েছে শুধু ঢাকার ওয়ার-ক্রিমিনালদের বিচার হবে, অন্য ডিসট্রিক্টের ওয়ার ক্রিমিনালদের বিচার হবেনা! হাহাহাহাহাহাহাহাহা! ক্যান ইউ বিলিভ ইট?!
সবার সম্মিলিত হাসির চোটে নিজে যখন মুখ আমসত্ত্বা বানিয়ে বসে আছি, দেখলাম, ফ্রান্সের মেয়ে ন্যান্সি না হেসে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে! হাসি থামলে ও ভীষন হতভম্ব গলায় বললো, “হাউ ফানি!! ইদ ইট পদিবল? অর আর ইউ ম্যাকিং ইট আপ? হ্যাই ফারদানা (ন্যান্সি কেনো যে জ’ উচ্চারণ করতে পারেনা, আল্লাহই জানে!) হোয়াট এবাউট দ্য পিপল?! দে দোন্ট আন্দারস্ট্যান্দ?!” জনগন যে আসলে কী বুঝে, ন্যান্সিকে কী করে বুঝাই! আমি নিজেই তো জানিনা।

………বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ভাবতে গেলে প্রচন্ড একটা ফ্রাস্টেশান কাজ করে। কারণ যে ইয়াং জেনারেশনকে ‘পরিবর্তনের একমাত্র উপায়’ বলে সমাজবিজ্ঞানীরা আখ্যা দেন, সে ইয়াং জেনারেশান যে অন্ধ! ভাবছেন আমি বাড়িয়ে বলছি?! মোটেও না। আমাদের ইয়াং জেনারেশান দুই এক্সট্রিম প্রান্তে বিভক্ত। দুইদলের দুইটা উদাহরণ দেই।
সেদিন একজন ফেইসবুকে ক্লিক করে বললেন, “আপু আপনি কি এক্স-আইআইইউসিয়ান?”
বললাম, ‘জ্বী’।
বললেন, “আপনার তো তাহলে একটা দায়িত্ব আছে। আপনারা যারা আইআইইউসিতে পড়ালেখা করেছেন, তারা একটা কমিটি করুন। আপনাদের মিলে যদি প্রস্তাব দেন তাহলে হয়তো ভিসি স্যাররা শুনবেন”।
অবাক হলাম, ঘটনা কী?! আইআইইউসিতে এমন কী হলো যার কারনে এমন সিরিয়াসলি ছেলেটা প্রাক্তনদের কমিটি গঠনের কথা বলছে?! বললাম, “ঘটনা কী খুলে বলুন দেখি”।
ছেলেটা যা বললো তার সারমর্ম হলো, “আইআইইউসি’র ছেলে মেয়েরা উচ্ছন্নে গেছে আপু। প্রেম করাতো নতুন কিছুনা, ওরা এখন এমনকি লিভ-টুগেদার পর্যন্ত করে! হলে বেশীরভাগ ছেলে নামায পড়েনা। এখনো আমার রুমমেট বিশ্বকাপ খেলা দেখার জন্যে নামায না পড়েই ঘুমাচ্ছে। ছেলেরা ক্যাম্পাসে সিগারেট খায়না ঠিকই, কিন্তু ঠিকই বাইরে খায়। এইসব বিষয়ে আপনারা না দেখলে কে দেখবে?!”
আমি এত অবাক হয়েছিলাম ছেলেটার কথায় কিছু বলতে পারিনি। শুধু একটা ছেলে না, আইআইইউসি’র বেশ কয়েকটা স্টুডেন্ট যাদেরকে ইউনি’র নাম দেখে নতুন এড করেছি, একই ধরনের কথাবার্তা! ওদের কথার টোনে আমি বিষ্মিত- কেমন খবরদারীসূলভ, ক্ষমতাবান প্রহরীর সুর এদের কন্ঠে! যেন ওরা ইসলামের একমাত্র ঠিকাদার, সবাইকে বেতিয়ে ঠিক করা ওদের নৈতিক দায়িত্ব! যখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার বাবা-মা আপনাকে কি আইআইইউসিতে পড়ালেখা করতে পাঠিয়েছে নাকি অন্য স্টুডেন্টদের উপর খবরদারী করতে পাঠিয়েছে?” রেগেমেগে বললো, “লিবারাল হতে হতে আপনারা ইসলামকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন!”… আমি অবাক হইনি মোটেও। দুঃখিত হয়েছি। প্রচন্ড রকম হতবাক হয়েছি এইসব রক্ত গরম স্টূডেন্টদের টগবগ করে ফুটতে থাকা আদর্শিক প্রান্তিকতা দেখে। শুধু ভাবি, সামান্য স্টুডেন্ট কমিটির ছোট খাটো ক্ষমতা পেয়েই এদের এত খবরদারী, দেশের ক্ষমতা পেলে এরা না জানি কী করবে!!

………এতো গেলো একপ্রান্তের উদাহরণ, আরেকপ্রান্তের উদাহরন দেই এক বিখ্যাত বাংলা ব্লগ-সাইট থেকে। যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে তর্ক-বিতর্ক’র (তর্ক-বিতর্ক বলার চেয়ে নোংরা ভাষার ঝগড়া বলাই ভালো। ভাবার বিষয় হলো- বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহার করে সাধারনত তরুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা যারা বেশীরভাগ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে। বড়লোকের ছেলে মেয়েদের পার্টী, গার্ল বা বয়ফ্রেন্ড, ফ্যাশন ইত্যাদি করে করে অত সময় নেই বসে বসে ব্লগ কপচাবে, আর গরীবের ঘরে তো ইন্টারনেটই নেই। বাণী বসু না কে যেন লিখেছিলেন, ‘বিপ্লবের শুরু এবং শেষ হয় মধ্যবিত্তে এসে’- ইন্টারনেটে এই মধ্যবিত্ত তরুণ প্রজন্মের প্রচন্ড নোংরা গালিগালাজ দেখে আমিও এখন বিশ্বাস করি, বিপ্লবের শুরু না হলেও অন্ততঃ শেষ হয় মধ্যবিত্ত তরুণ প্রজন্মে এসে)… যা বলছিলাম, যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে ‘সবাক’ ছদ্মনামের একজন বলতে বলতে শেষে এসে বললেন, বাংলাদেশে ইসলামিস্ট (এই শব্দটার ব্যাখ্যা না হয় পড়ে দেয়া যাবে) পরিবারের মেয়েরা হচ্ছে ‘গণিমতের মাল’; কমেন্টের পটভূমিকা পর্যবেক্ষণে সারাংশ দাঁড়ায়- এসব পরিবারের মেয়েদেরকে শারিরীকভাবে ও মানসিকভাবে ধর্ষণ করা পূণ্যের কাজ। দেশের ইয়াং ছেলেদের উচিত রাস্তা-ঘাট যেখানে এইসব মেয়েদেরকে পায় সেখানেই এদেরকে লাঞ্চিত করা!

…… কমেন্টটা পড়ে যতটা না ভীত, হতাশ, মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিলাম; তারচে’ও হতবাক হয়ে ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম ঐ কমেন্টের সাথে একমত পোষণ করা বেশ অনেকজন ‘শিক্ষিত’ ব্লগারের অবস্থানে। একাত্তুরের মত পবিত্র একটা যুদ্ধকে এরা নামাতে নামাতে কোথায় নামিয়ে এনেছে তাই দেখে কান্না পাচ্ছিলো। ভেবে পাচ্ছিলাম না, পাকি সৈন্য যারা বাংলাদেশের মা-বোনদেরকে ধর্ষন করেছে; তাদের সাথে এইসব ছেলেদের কী পার্থক্যদ যারা সামনে না পেলেও লেখায় হলেও ধর্ষন করে যাচ্ছে নিজের দেশের মেয়েদেরকেই! এরাতো ওদের চেয়েও জঘন্য!! আগে ভাবতাম, প্রান্তিকতারও সীমা আছে। কিন্তু এখন জানি, প্রান্তিকতার কোনো সীমা নেই। প্রান্তিকতার শেষ যেখানে, সেখানে বর্বরতার, অন্ধকারের শুরু। আমাদের দেশের তরুণ সমাজের দুই ধারা সে অন্ধকারের দরজা পেরিয়েছে অনেক আগেই। এখন সে অন্ধকারে শুধু হতাশার ক্রন্দনের আওয়াজ শুনি আমি।

……… আপনার মনে আছে? একবার লিখেছিলেন, “আদিম মানুষ পাখি পুষতো না, হত্যা করে খেয়ে ফেলতো! আধুনিক মানুষ পাখি হত্যা করতে ঘেন্না করে, কিন্তু খুব আহ্লাদ করে পুষে। সভ্যতা আর প্রযুক্তি মানুষ কুটবুদ্ধি আর সবকিছুকে বশে আনার ক্ষমতা দিয়েছে, মনুষ্যত্ব হরণ করে নিয়েছে বিনিময়ে। কিন্তু আদিম মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামটুকু অনেক মহৎ ছিলো”। আমি সেই বেঁচে থাকার মহত্ব খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে এখন নীলকে লেখা আপনার এই লাইনগুলো পড়তে পড়তে ভাবি, আদিম থেকে সভ্য হতে হতে মানুষ বেঁচে থাকার সংগ্রামের এই মহত্বটুকু রাস্তায় আসার পথে হারিয়ে ফেলেছে। দুঃখ আমাদের জন্যে! আমাদের সভ্যতার জন্যে!

………এইসব সময়ে কী মনে হয় জানেন? পৃথিবী গোল্লায় যাক, গোল্লায় যাক পিএইচডি, গোল্লায় যাক দেশের, বিশ্বের জঘন্য সব রাজনীতি; গ্রামে দাদুর যে ছোট্ট একটা বাড়ি আছে একটুকরো উঠান সহ, সে বাড়িতে গিয়ে বসে থাকি। এইসব ভয়ংকর সব মানুষদের থেকে দূরে, এদের আদর্শিক প্রান্তিকতার বর্বরতা থেকে দূরে। দাদু’র জীবনের খুব দুঃখ- সব রাজনীতিবিদদের কত দালান-কোঠা, অথচ আব্বুর সামান্য এই বাড়িটাকে এক তলা বিল্ডিং বানানোর সামর্থ্য নেই। যতবার দাদু বাড়ি যাই; আব্বুর সামর্থ্য না থাকাটাকে আশীর্বাদ মনে হয়। নাহলে এই যে টিনের উপর ঝুম বৃষ্টির নুপুরের মত একটানা সুর, সামনের উঠানের মাটির গন্ধ, মাটির চুলোর ধোঁয়া উঠা সাদা ভাতের গন্ধ, পিছনের ছোট্ট জায়গাটায় দাদু’র নিজ হাতে লাগানো পেঁপেঁ গাছটার পাতা বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়া কুয়াশা’র ফোঁটা- এইসব যে তাহলে হারিয়ে যেতো। … মনে হয় এটাই বুঝি স্বর্গ। কিন্তু একটু পরেই বুঝি, কত অসম্ভব একটা ইচ্ছা লালন করে যাচ্ছি বুকের ভিতর। এই অসম্ভব ইচ্ছাটা যত তীব্র হয়, তত চোখে পানি চলে আসে, তত আপনাকে চিঠিটা লিখতে ইচ্ছা করে।

………… শেষে ভাবলাম সব ভাবনা-বাটি ছেড়েছুড়ে দিয়ে, এমনকি সব ইচ্ছেগুলোকেও জলাঞ্জলি দিয়ে, যখন একদম সিধেসাদা আটপৌড়ে ঘরের বউ হয়ে যাবো, তখনই নাহয় চিঠিটা লিখবো। কিন্তু সেও কী হওয়ার? আমরা সব ছেড়ে দিলেই কী সব আমাদের ছেড়ে দেয়? সোশিওলজি পড়াতে গিয়ে নতুন এক থিউরীর সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। সোশিওলজিতে ওরা সমাজের স্ট্রাকচারকে তিনভাগে ভাগ করে- ম্যাক্রো, মাইক্রো আর গ্লোবাল। থিউরীটা হলো, এই তিনটা একটা আরেকটার সাথে এমনভাবে প্যাঁচ খেয়ে আছে যে, কেউ যদি বড় ক্যানভাসে চিন্তা করে তাহলে টের পাবে, পৃথিবীর এক প্রান্তে কী ঘটছে না ঘটছে তার ইফেক্ট পৃথিবীর অপর প্রান্তে এমন একজনের উপর গিয়ে পড়তে পারে যে হয়তো তার ছোট্ট ঘর, ছোট্ট মহল্লা আর ছোট্ট গ্রামটার বাইরের আর কিছুই চিনেনা, জানেনা। যেমন উন্নত দেশগুলো যেহারে গ্রীন হাউজ ইফেক্ট বাড়িয়ে চলছে, তার প্রভাবে বাড়ছে প্রাকৃতিক দূর্যোগ, বাড়ছে নদীর ভাংগন, বাংলাদেশের পদ্মার পাড়ে যে লোকটা তার বউ-বাচ্চা নিয়ে বসবাস করে, সে ঘরছাড়া হচ্ছে; অথচ গ্রীন হাউজ ইফেক্ট কী জিনিষ সে সম্পর্কেই তার হয়তো বিন্দুমাত্র ধারণা নেই! এই ছোট্ট জ্ঞানটুকু ঝাড়লাম শুধু একথা বুঝাতে, ছেড়ে দিতে চাইলেই ছেড়ে দেয়া যায়না। কারন আমি কিছু না করলেও, অন্যরা যা করছে তার ইফেক্ট আলটিমেটলী আমার উপর পড়ছেই। অথবা ধরুন, আমরা ছেড়ে দিলাম; আমাদের পরের প্রজন্মও ছেড়ে দিলো, তারা তাদের পরের প্রজন্মকেও ছেড়ে দিতে শেখালো- এইভাবে কি একটা নপুংশক প্রজন্ম তৈরী করতেই পৃথিবীতে এসেছিলাম? যে এবং যারা কিনা সব দেখে শুনে চোখ বুজে শুধু প্রাণপনে প্রার্থনা করবে, ‘খোদা, দুনিয়ার যা হওয়ার হোক, শুধু আমাকে আর আমার ছেলে-মেয়েগুলোকে ভালো রাখো’! এ যে হওয়ার নয়। আর এ হওয়ার নয় যখন বুঝি, তখন মেরুদন্ডহীনের মত আমি আশংকায় কেঁপে কেঁপে উঠি। ভাবি, চিঠি লিখে আপনাকে ভয়গুলোর কথা বলি, তাহলে হয়তো একটু শ্বান্তনা পাবো।

……… কিন্তু শ্বান্তনা আর পাওয়া হয়না আমার। আমার খাটের পাশের জানালা দিয়ে তাকালেই চোখে পড়ে বিশাল একটা আকাশ। নীলকে লেখা আপনার চিঠিতে একবার লিখেছিলেন আপনাদের রুমের জানালা দিয়ে একদিন হঠাৎ এক চিলতে আকাশ দেখা যায় আবিষ্কার করে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন! … যে সময়টা আমার আকাশ দেখার আকুতি ছিল, সে সময়টাতে আকাশ ছিলনা। এখন আকাশ আছে, কিন্তু সেই সদ্য কিশোরী মেয়েটার পরিস্কার মনটা আর খুঁজে পাইনা। তখন এত রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ বুঝতামনা (এখনো যে বুঝি তা কিন্তু না!), তখন ‘ইম্পেরিয়ালিজম’র প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আব্বুম্মু, আর তাদের আদর্শের প্রান্তিকতা। ছোট্ট যুদ্ধ, ছোট দুনিয়া, ছোট ছোট স্বপ্ন… জানলায় তাই উইন্ডশাইম লাগানোর স্বপ্ন ছিলো, উইন্ডশাইমের টুংটাং আওয়াজকে কবিতা মনে করে ভুল করার উচ্ছলতা ছিলো, বারান্দায় মানিপ্ল্যান্ট গাছ লাগিয়ে চাঁদের আলোয় সে মানিপ্ল্যান্টের যে নকশা পড়বে বারান্দার ফ্লোরে সে নকশা দেখে মুগ্ধ হওয়ার বাসনা ছিলো, রুমের সিলিং-এ চাঁদ আর তারার রেডিয়াম স্টীকার লাগিয়ে রাতের লাইট নিভিয়ে দিয়ে অন্ধকারে আকাশের নীচে শুয়ে থাকা কল্পনা করার ইচ্ছা ছিলো… এখন উইন্ডশাইমের বদলে সত্যিকারের পাখির সুর শুনি, রেডিয়াম স্টীকারের বদলে সত্যিকারের চাঁদ আর তারার নীচে ঘুমাই, মানিপ্ল্যান্টের বদলে অর্কিড গাছ লাগিয়েছি, কিন্তু তারপরও কী যেন নেই। এ্যাশ নেই, মুসানি নেই, আপনার নীলকে লেখা আর কোনো চিঠি নেই। আছে শুধু বড় বড় আশংকা, বড় বড় হতাশা, বড় বড় মার-প্যাঁচ, আর বড় বড় রাজনীতি। এইসব আশংকা, হতাশা আর মার-প্যাঁচের ভীড়ে শেষপর্যন্ত আমার আর চিঠিটা লেখা হয়ে উঠলোনা!

(ছবি কৃতজ্ঞতা- ইন্টারনেট)

৩৮টি মন্তব্য ৪১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×