(আমার বন্ধু ব্লগার শারমিন রহমান এর জন্ম দিনের শুভেচ্ছা স্বরূপ, ১৪ তারিখ আমার বন্ধুর জন্মদিন)
চৈত্র মাসের দুপুর। মাথার ওপর প্রখর রোদ। যেন প্রতিশোধ নিতে চায়। কিছুতেই সহ্য করা যায়না । পিপাসায় শুকিয়ে আসে গলা। উড়ে যায় ক্লান্ত পাখি। পাখির মত কবিও বেশ ক্লান্ত। সকাল থেকে তার ব্যস্ততা শুরু হয়েছিল আজ। সারাটি দিন ছুটোছুটি। অনেকটা পথ হেটেছে। নীলক্ষেত থেকে বাংলাবাজার সেখান থেকে শাহবাগ,পল্টন আরো অনেক জায়গা। মাথার ভেতর আজ অনেক বুদ্ধি খেলা করেছে। সাহিত্যের বাজারে তার মত কবির কদর কম। তারপরেও থেমে থাকা চলেনা। সুন্দর একটা কাহিনী লেখা দরকার। কি লিখবে? খুঁজে পেতেও অনেক কষ্ট হয় তার। চিন্তা করতে করতে কখন যে দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় চলে গেছে সে দিকে খেয়াল নেই কবির। পকেট হাতড়ে পাওয়া গেল কয়েকটি টাকা। না খেয়ে থাকাটাই সমীচীন। ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঢাকা শহরের যান্ত্রিক জীবনের নির্মম অভিজ্ঞতাটা স্মরণ করা ছাড়া উপায় নেই। লিকলিকে দেহ। মাথার চুলগুলো এলোমেলো। পরনে লাল রংয়ের প্যান্ট। গায়ে ফুটপাত থেকে সদ্য কেনা সস্তা জামা। ময়লা ধরা কালো ব্যাগ কাঁধে। পায়ে চটি। আজ পিছনে ফেলে আসা স্মৃতিগুলো স্মরণ করতে বেশ ভালো লাগছে কবির। আজিমপুর থেকে ছিনতাইকারী তার প্রিয়তমার দেওয়া রুপোর আংটি নিয়েছিল। এ কথাও বাদ পড়ছেনা। বড্ড রোমান্টিক হয়েছে কবি। অভাবি মানুষের রোমান্টিক হওয়া চলেনা। গ্রাম্য প্রেমের কথা মনে পড়ে। হতচকিত হয় কবি। মনে মনে হাসে আর লজ্জা পায়। মনে পড়ে মায়ের বিবর্ণ শাড়ি। বাবার পরিশ্রমী হাত। কিছুই বাদ যায়না। শৈশবে স্বপ্ন ছিল তার। একটা টিনের বাড়ি। বধূ হয়ে আসা গ্রাম্য বালিকাটি, তার ঘর আলোকিত করবে। একটা বাই সাইকেল। আর ১০কাঠা জমির ওপর ছোট পুকুর। মাছ চাষের কাজ। মন্দ হয়না। স্বপ্ন পুরণ হয়নি। চিন্তার শেষ হয়নি এখনও। নতুন কোনো কাহিনী মাথায় আসছেনা। কি লেখবে? উপন্যাস, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা না অন্যকিছ ু? তার জীবনটা যে গল্পের চেয়ে অনেক বেশি তা মাথায় আসেনা। শৈশব স্মৃতি মাথায় ঘুরপাক খেতে খেতে কখন যে কবি শান্তিনগর পেরিয়ে গেছে খেয়াল করতে পারেনি। সূর্যের তাপ অনেকটা কমে গেছে। পড়ন্ত বিকেল।
(আমার বন্ধু শারমিন রহমানের জন্ম দিনের শুভেচ্ছা স্বরুপ)
শান্তিনগর মোড় পেরিয়ে দক্ষিণে রাস্তার পাশে অনেক লোকের ভীড়। মনে হয় পাহাড়ি সাপের খেলার আসর বসেছে। ভীড় ঠেলে কবি এগিয়ে যায়। জানার প্রবল ইচ্ছা। কি আছে সেখানে?শীর্ণ দেহধারী লোকের মৃতদেহ।সত্যি সত্যি! সাপ খেলা নয়,অন্য খেলার আসর।এ খেলা বাস্তবতা বর্জিত নয়। ভয়ংকর এ খেলা। মৃত দেহটির দিকে এগিয়ে যায় কবি। হাত কাঁপে থরথর। পাও কাঁপে তার। অবাক হয় কবি। বিস্ময় বাড়ে। নিশ্চুপ থাকে। কথা বেরোই না। চমকে ওঠে কবি। থমকে দাঁড়ায় ।নিজের অজান্তেই। কান্না পায় খুব। মৃত মানুষটি আয়নাল চাচা। গ্রামের মানুষ। বড্ড সাদা মানুষ। কবির গ্রাম। পলাশবাড়ী। গ্রামের শেষ প্রান্তের যে বাড়িটি সেটা আয়নাল চাচারই। লোকটি কবির কাছের মানুষ। অনেক কাছের।দেহটার ওজন বেশী নয়। মুখে কতকগুলো দাড়্।ি কালো রং। মাথার চুল বেশীর ভাগই পাকা। মাথায় মরচে পড়া টুপি আর পরনে ভাঁজ পড়া পাঞ্জাবি তাঁর ধর্ম ভীরুতার প্রমাণ বহন করে।হাসির ঝিলিক মুখে সবসময়। সময় পেলে আড্ডা জমিয়ে দিত লোকটা। কোনো কথায় অজানা নয় কবির। অভাবের তাড়নায় একবার মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ নিয়েছিল আয়নাল চাচা। সুরেলা কন্ঠ ছিল। আজানের সুর কম্পিত হত আকাশে। সবচেয়ে বড় কথা। লোকটি মুক্তিযোদ্ধা।গৌরবের কথা। খড়ের ছাউনী দেওয়া ঘর। ছোট ঘর।আবাদি জমি কম।অভাবের সংসার। তিন মেয়ে ছিল।নিজের কাঁধেই্ সংসার। পরিশ্রম করে দিনরাত। এভাবেই সংসার চলে। সময় বাড়ে। মেয়েগুলো বড় হয়। সংসারও বাড়ে। অভাব অনটন নিত্য সঙ্গীতে পরিণত হয়। গ্রাম্য মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বিয়ে দিতে হয় মেয়েদের। তারপরেও যৌতুকের টাকা। ঋণের দায় বাড়ে। সুদের হার বাড়ে। মহাজনের অত্যাচার। সংসারে অশান্তি। কষ্ট কর জীবনের অধিকারী। তার পরেও লোকটি মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের সময় লোকটি এক রাতে পাচঁ হানাদার কে গুলি করে মেরেছিল। অনেকেই জানে সে কথা। সাহস আর মনোবল ছিল খুব। মুক্তিযোদ্ধা বলে কথা। দেনার দায়ে আবাদি জমি বিক্রি করে লোকটি । বড়ই হতভাগা বেচারা। ডায়রিয়ায় মারা যায় আয়নাল চাচার সত্রী। অল্প বয়সে বিয়ে করেছিল লোকটি। বড় একা হয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা। লোকটি কে দেখে অনেক কথা মনে আসে কবির। গোপন কথা ব্যাথার কথা। হাসির কথা। জীবন জীবিকার কথা। সংসারের কথা।ুুুযে কথায় হোক না কেনো আয়নাল কথা সব। মাঘের শীতের এক রাতে চাচী নাকি চাচাকে প্রশ্ন করেছিল। চাচা অবাক হয়েছিলেন বেশী।প্রশ্ন শুনে। গোছালো প্রশ্ন। অভিমানের প্রশ্ন। প্রতিবাদের কথা। সবই ছিল চাচীর ক্ষোভের প্রকাশ। নানা অপ্রাপ্তির হিসাব। সরল মনে চাচী বলেছিল কি দরকার ছিলো যুদ্ধের? যুদ্ধ কি আসলে শেষ? আরো যুদ্ধ আছেনা? কি দিয়েছ যুদ্ধ।আমরা কি স্বাধীন আজও? অবাক হলেন চাচা।একটু কাশলেন।নড়ে চড়ে বসলেন।মুখবুজে থাকলেন মাথা গুজলেন। কথা বললেন না মোটেও। দীর্ঘ দিনের জমানো ক্ষোভ। হঠাৎ করে বাড়ল। অপ্রাপ্তি যে মানুষ কে অধিকার সচেতন করে তার প্রমাণ পেলেন চাচীর কথায়। উত্তর দিতে পারেনি আয়নাল চাচা। বুকের বাম পাশে ব্যথা অনুভব করলেন। সারারাত নিজের পঙ্গু পা টি দেখলেন । পলক পড়েনি একটু। পলক পড়বেনা কোনদিন। নিজের অজান্তে গোপনে কাঁদলেন। সবই কবির জানা কথা। জমি হারালেন দেনার দায়ে ।সংসার হারালেন। স্ত্রী কে হারালেন। যে সব হারায় সেখানে প্রাপ্তি থাকেনা। প্রাপ্তির হিসেব বড় কঠিন। দুর্বোধ্য হিসেব্। এ বোঝা যায়না। ঢাকা শহরে ভিক্ষা করতেন আয়নাল চাচা। পঙ্গু মানুষ উপায় কি? বেঁচে থাকা দরকার।হোকনা তা ভিক্ষা। মুক্তিযোদ্ধার ভিক্ষা। আজ লাশ পড়ে আছে পথে। দোষের কি? মুক্তিযোদ্ধার লাশ। পাহাড়ী সাপের লাশ। এ লাশ নিয়ে খেলার আসর জমে ভালে। চেয়ে দেখে হতভাগার দল।গরম নিশ্বাস ফেলে কবি ভাবে ভালোই হলো একজন মুক্তিযোদ্ধা .........। কবি পাথর হয় যেনো। কোনো কাহিনী আসেনা মাথায়। চৈত্রের বাতাসে সে কাহিনী উড়ে যায়।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




