'মানুষের মুক্তি'। এই বিষয়টি আর সবার চেয়ে বেশি বলে থাকে বামপন্থীরা। অথচ বাংলাদেশে নিপীড়িত মানুষের জন্য কাজ না করে উল্টো নিপীড়নকারীদের পক্ষে কেন যাচ্ছে তারা?
-বহু দিন ভেবেছি এ বিষয়টি।
প্রকৃত পক্ষে, 'মানব মুক্তির জন্য রাজনীতির' বিপরীতে 'রাজনীতির জন্য নিপীড়িত শ্রেণী অন্বেষণের' ব্যাপারও থাকতে পারে- এটা আমদের মাথায় সহজে আসেনা। বিশেষ করে মানবতাবাদের মত বিষয়ে স্বাভাবিক ভাবে আমাদের মাথা পুরোপুরি বিপরীতে গিয়ে ভাবতে অভ্যস্ত নয়।
খুব খেয়াল করে দেখবেন, একটা ভূখন্ড যদি বাংলাদেশ হয়। সেই ভূখন্ডে মানবতার পক্ষে অনর্গল কথা বলা শ্রেণীটি যদি 'বামপন্থী' হয়; সেক্ষেত্রে চলমান দেশব্যাপী নিপীড়নে 'বামদের' অবস্থান ঠিক কোথায় থাকবার কথা ছিলো?
মূলত মানবাধিকার ও মানবতাকে ক্ষমতারোহনের সিড়ি করে নেয়ায়, মানবাধিকার লংঘনের কাজে নেতৃত্ব দিয়েও নিজেদেরকে মানবতার মহান কাজে নিয়োজিত শ্রেণী বলে মনে করছে বামরা। এমন একটি ফানুশ তাদের সামনে ঝুলেছে যা, দৃশ্যমান মানবাধিকার অস্বীকার করার মাধ্যমেই অদৃশ্য মানবাধিকার অর্জনের কথা ভাবতে বাধ্য করছে তাদের। সোজা ভাষায় সবচেয়ে বিজ্ঞান মনস্ক দাবিদার ব্যাক্তিরাই সম্মিলিত ভাবে আজ জাদুর ঘোরে আবদ্ধ!
খ,
বাংলাদেশের বুকে সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট খ্রিষ্টান মিশনারী। যারা টাকা-লোভ-ভয়-প্রভাব দেখিয়ে মানুষকে নিজ ধর্মচ্যুত করে খৃষ্টান বানায়। মোটা দাগে- ধর্মীয় ফ্রেমে সাম্রাজ্যবাদ। এদের আলটিমেট উদ্দেশ্য ধর্মীয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী প্রতীষ্ঠা করে পূনরায় এশীয়ার দখল নেয়া।
খ্রিষ্ট মিশনারী? -কোনদিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী 'বামশক্তিকে' এদের বিপরীত অবস্থানে পাবেন না। নিরব সাম্রাজ্যবাদী ততপরতায় না কোন মানবিক মানববন্ধনের আয়োজন। কিংবা এসি ক্লাবের প্রেস কনফারেন্স। স্বাভাবিক ভাবেই যেকোন তীব্র ক্রিয়াশীল গোষ্ঠী বিপরীতে না থাকলে পক্ষেই থাকে। খুব ভালো ভাবে বিষয়ের পক্ষেই কাজে লেগে যায়। এখানেও তাই হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী হিসেবেই মিশনারীর পরবর্তী রক্ষাকবজ হয়েছে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী 'বামশক্তি'।
বাংলাদেশে পশ্চিমাদের আরেকটি বিশাল প্রজেক্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম। এখানে পশ্চিমাদের বাফার স্টেট প্রতীষ্ঠায় ভূমিপুত্র বাঙ্গালীদের তাড়িয়ে দেয়া, 'আদিবাসী' নাম দিয়ে জাতীসংঘের আওতায় আরেক পূর্বতীমুর প্রতীষ্ঠা ছাড়াও স্থানীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর ব্যাপারে তাদের নিরব ভূমিকা উল্লেখ্য। একটি প্রতিষ্ঠিত সংবিধানের 'মানবিক সাম্য অধিকার' অস্বীকার করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ চুক্তির দ্বারা ভূমি ক্রয়ের অধিকার একপাক্ষিক করে সেটাকে বেগবান করা হল। বিপক্ষে তো নয়ই বরং কবে নাগাদ অসাম্য পাকাপাকি হবে তার দিন গুনেন তারা। অন্যদিকে এই চুক্তির বিরোধীতায় থাকা অধিকারকামীদের তীব্র আর্তনাদ মূল্য পায়নি।
একাধিক সশস্ত্র উপজাতি গোষ্ঠীর প্রচলিত হাজার অপকর্ম গোপন হয়ে যায় শুধুমাত্র নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের টেরোরিস্ট সাব্যস্ত করার উদ্দেশ্যে। ভাবতে পারেন? এক্ষেত্রে আগাগোড়া চোখ বন্ধ রেখে উপজাতিদেরকে আদিবাসী সাব্যস্ত করার পর বাঙ্গালীদের বহিরাগত বলে প্রচার করছে তারা। ফিলিস্তিনের দখলদার ইজরাইলীদের যে স্যাটেলার নামে ডাকা হয়, নিজ ভূমে বাঙ্গালীদের নাম দেয়া হচ্ছে সেই শব্দে! এমনকি এরা বাংলাদেশেরও উপজাতি নয়। তারা 'বার্মার ট্রাইবাল'।
এদেশে তাদের নজিরবিহীন ভাবে নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছে '৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পর। একান্তই মানবিক দিক থেকে। এর আগে দখলদার ইংরেজরাই বার্মা হতে পলায়নকৃত এই 'বার্মার ট্রাইবালদের' আশ্রয় দিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে এদের রক্ষা করে। এদেরকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে আরাকান রাজের অনুরোধলিপি বারবার প্রত্যাখ্যান করা হয়।
দখলদার ব্রিটিশদের চলে যাবার পর পাকিস্তানেও এদের নাগরিকত্ব ছিলোনা। কেবল দেশজ উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতির জন্য এরা আগ্রহী ছিলো। আজও ভারতে বহু বহিরাগত জনগোষ্ঠী 'ভারতীয় উপজাতি' স্বীকৃতি পাবার জন্য প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে। এরা কেউই এসব ভূমির ভূমিজ গোষ্ঠী নয়। বিভিন্ন সময় নানাভাবে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনুপ্রবেশ কিংবা বিশেষ বিবেচনায় প্রবেশ করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রতীষ্ঠার পর একতরফা নাগরিকত্ব লাভের সাথে সাথে আশ্রয়প্রাপ্ত পাহাড়ী এলাকা পৃথক করার অপততপরতা শুরু করে এরা। যা গোটা বাংলাদেশের দশ ভাগের এক ভাগ। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ জনপদ।
গ,
আমার মনে হয়েছে অনেক বামপন্থীই যখন পার্বত্য নিয়ে কথা বলে তখন তাত্ত্বিক ভাবে বলে। যা তাদের দর্শনে আছে সেটাকেই প্রতিষ্ঠিত করার বাসনা কাজ করে মাত্র। কেননা সেই ভাবাবেগের জন্য সমাজে কিছু শ্রেণী বৈষম্য থাকার শর্ত রয়েছে। সব সমাজেই বৈষম্য থাকে, একথাও ঠিক। কিন্তু সেটা না থাকলেও কৃত্রিম ভাবে হলেও বাম আদর্শে আসক্তরা তা নির্মান করবে বলেই আমার মনে হয়েছে। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদ কিংবা ধর্মীয় ভাবে বৈষম্যের শিকার মানুষ এখন ক্ষমতার সিড়ির বাইরে থাকায় এদের 'মুক্তি' তাদের কাছে প্রাসংগিকতা পায়নি।
এজন্য শোষিতের পক্ষে নয়, একদিকে মানবাধিকারের পক্ষে একেকটি ঘুমন্ত আগ্নেয়গীরির সমতুল্য বাম প্রতীষ্ঠানগুলো নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে নিজেদের অবলীলায় নিয়জিত রেখেছে।
মানবতাবাদের পক্ষে, যদি আকাশ ছোঁয়া আবেগের নাম বাম আন্দোলন হয়। তবে আকাশ ছোঁয়া শক্তিকে শোষকের পক্ষে নিরব করে রাখা মির্জাফরের বর্তমান রুপও বাম আন্দোলনন। সেই সাথে বাস্তবতা থেকে কয়েক ধাপ পার হয়ে মানবাধিকার প্রশ্নে পূর্ণ নিরবতা ভেঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সহায়তাকারী কার্যকর বর্জুয়া গোষ্ঠীটির জন্ম দাতাও বামপ্রাঙ্গন নিজেই।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:২২