somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যুদ্ধ ও ভালবাসার মালিকানার মামলা ৪ : দুই এলিটের বাসনাবন্দী মুক্তিযুদ্ধ। আমার সিদ্ধান্ত

২৯ শে জানুয়ারি, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অতি ঘৃণা ও অতি ভালবাসা দৃষ্টিকে অন্ধ করে দেয়, বুদ্ধিকে করে দেয় অবশ। এই অবশ চেতনার সঙ্গে সংলাপ হয়ে যায় অসম্ভব। কারণ, যাকে ঘৃণা করি, তাকে আমরা সবসময় পূর্ণভাবে জানতে পারি না।আজকের দিনে চলচ্চিত্র রাজনৈতিক লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ ময়দান। সেকারণেও দায়বদ্ধ আলোচনাটা জরুরি।

মেহেরজানের কাহিনীর প্রধান সংকট হলো মেহেরের প্রেম। এই প্রেমকে ঘৃণার বিরুদ্ধে একটা ‘নান্দনিক সমাধান’ বলে প্রস্তাব করা হয় ছবিতে। ওয়াসিম নিজেও তো ধর্ষক হতে পারতো, কিন্তু তাকে পাকসেনা থেকে রূপান্তর করা হয় বিপদে পড়া নিরীহ চরিত্রে। তাকে দিয়ে মেহেরের সম্ভাব্য ধর্ষণ ঠেকানো হয়। তার এই চরিত্র নির্মাণে বালুচ জাতপরিচয়ও কাজে লাগে। গোড়া থেকেই আমার প্রশ্ন ছিল এই রূপান্তর কোথায় ঘটছে, ইতিহাসে না কল্পনায়? মেহেরজানে যুদ্ধটা ঘটছে বাংলাদেশের ইতিহাসে ও জমিনে, কিন্তু প্রেমটা ঘটছে কাল্পনিক এক বাস্তবতায়। একাত্তরে এ ধরনের প্রেম যে ঘটেনি তা নয়, তার অজস্র সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে। কিন্তু তা দিয়ে এই প্রেমকে জায়েজ করা যায় না। সেজন্য যারা ঐতিহাসিক সত্যতা চাইছেন, তারা ঠকবেন? কারণ সেরকম প্রমাণ ভুরি ভুরি আছে। প্রশ্নটা প্রমাণের নয়, প্রবণতায়।



মেহেরজানের মধ্যে দুটো রিকনসিলিয়েশনের প্রস্তাব আছে: একটা ৪৬ এর দাঙ্গা এবং ভারত বিভাগের সমালোচনা হিসেবে হিন্দু ও মুসলিমের মিলনের। যাতে হিন্দু ও মুসলিম পরিচয় ধারণ করেই তারা বাঙালিত্বে উত্তরিত হয়। নানাজান তাই বলেন, ‘আমরা হিন্দু ও মুসলিম পরস্পরকে কতল করেছি!’ এই ‘আমরা’ সম্প্রদায় পরিচয় ছাপিয়ে জাতি পরিচয়কে সামনে আনে। আবার অন্যত্র সেই জাতি পরিচয়কে ছাপিয়ে কৃষক বাঙালির কথা বলে। নানাজান যেকারণে আমার কাছে এক উত্তরণ-সন্ধানী চরিত্র। দ্বিতীয় রিকনসিলিয়েশনের প্রস্তাব হলো: নির্যাতিত ও নির্যাতকের জাতিকে ঘৃণা থেকে মুক্ত করার ‘নান্দনিক সমাধান’। সেই নান্দনিক সমাধানের আমেজই প্রেমের দৃশ্যাবলির ‘সৌন্দর্যে’, ফুল-পাখি-লতাপাতা দিয়ে আনা হয়। পুরো ছবিতেই বিভিন্নভাবে ‘বিউটি’ তৈরি করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে এই ‘বিউটি’র মনস্তত্ত্ব ও রাজনীতি কী? এটা কি ওরিয়েন্টালিস্ট চোখ নয়? এই মন কি বাস্তব অভিজ্ঞতাবিরোধী নয়? এই রোমান্টিক সংবেদন কি ভাববাদী মারেফতি নয়? এ দিকটি এখন পর্যন্ত ঘৃণার পূজারিদের কেউ মনে হয় খেয়াল করেননি।

আমার প্রশ্ন হলো, ব্যথার পূজা সমাপন করে আমাদের মন নির্ভার হলো কীভাবে, যে বিপরীত ‘অন্য’ কে ভালবাসতে পারি? কোন বাস্তবতায় সেটা সম্ভব? সেই বাস্তবতা বাংলাদেশে কবে তৈরি হলো? কিংবা যে অহিংসা (নানাজান) ও প্রেমের সমাধানের (বড় মেহের) ইশারাপাত হলো তা কার সমাধান, কার উপকারে? কোনো ব্যক্তির বেলায় এটা হলেও হতে পারে কিন্তু যে জাতির ত থেকে এখনো রক্ত ঝরছে, যে স্বজন হারানোরা এখনো ফরিয়াদি, তাদের এটার প্রয়োজন নেই। শৈল্পিক সাজেশন হিসেবেও এটা ধোপে টিকবে না। আন্তর্জাতিক পুরস্কারের আশা, পোস্ট কলোনিয়াল লিটারেচারের ঝোঁক কি এর পেছনে কাজ করেছে? হয়তো। তার আগে জানা প্রয়োজন, পাকিস্তান কি ক্ষমা চেয়েছে? সকল যুদ্ধাপরাধীর (বাংলাদেশি কি পাকিস্তানী) কি শাস্তি হয়েছে? পাকিস্তানের জনগণ কি তাদের দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রের মানবিক রূপান্তর ঘটানোর মাধ্যমে একাত্তরের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করেছে? বাস্তবত এসব প্রশ্ন আসবে। ঐতিহাসিক ন্যারেটিভ, পলিটিক্যাল ন্যারেটিভ আর মানসিক ন্যারেটিভ এখানে এক মনজিলে পৌঁছে না। মেলে যে না তার প্রমাণ ছবির ভেতরেই আছে।

ছবির কোথাও এই প্রেমের বৈধতা দেওয়া হয়নি। নানাজান বলেন, ‘মেহের, তোমার কাছে আমি এটা আশা করিনি’। মেহেরকে তার ‘নিষিদ্ধ’ প্রেমের জন্য সবারই লাঞ্ছনা পায়। ফলে প্রেম দেখালেও প্রেমকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি ছবিতে। কেবল একদম শেষে পরিণত মেহেরজানের একটা উক্তি ও একটা ভাস্কর্য অন্য কথা বলে। বলে ‘ক্রিয়েটিং এ নিউ ফর্ম’ এর কথা।



কী এই ‘নিউ ফর্ম’? আলিঙ্গনাবদ্ধ দুই নরনারীর ভাস্কর্য, যারা একাকার হয়ে নতুন আকার গঠন করেছে। এই আকারটাই কল্পনার ইউটোপিয়া। মেহের তার প্রেম নিয়ে অপরাধবোধেই ছিল এতদিন। কিন্তু যুদ্ধশিশু সারার সঙ্গে সংলাপ তার সেই অপরাধবোধ থেকে মুক্তির একটা পথ দেখায়। সারা যদি তার মায়ের ইতিহাস জেনে, একাত্তরের ইতিহাস বুঝে ক্ষমা করতে পারে, তাহলে তিনি কেন পারবেন না নিজেকে ক্ষমা করতে? তাই মেহের কানে প্রেমের ফুল গুঁজে নতুন এক ভাস্কর্য নির্মাণ করতে বসে। পরিকল্পনা করে নতুন এক প্রদর্শনীর, যার নাম হবে ‘ক্রিয়েটিং এ নিউ ফর্ম’। এই নিউ ফর্মটা হলো আরেকটা ইউটোপিয়া। ক্রিয়েটিং এ নিউ রিয়েলিটি, যেখানে বিচার হবে, অপরাধীরা বিলীন হবে, মানুষ ন্যায়বিচার পাবে। এর বিকল্প হতে পারে না কল্পনার মধ্যে নির্যাতক ও নির্যাতিতকে মিলিয়ে দেওয়ার ‘নিউ ফর্ম’।



কিন্তু অন্য একটি ব্যাখ্যা বলবে, মেহের আর ওয়াসিমের এই মিলন তো ইতিহাস ও দেশকালের বাইরে এক ব্যক্তিগত মিলন, যেখানে উভয়ই নিরীহ। তারা একাত্তরের দায়মুক্ত, কারণ তাদের প্রেম একাত্তরের মুক্তির চেতনার পক্ষেই। তাই তা বাস্তবতাকে অস্বীকার করে না। এটা বলবার জন্য মেহের ও ওয়াসিমকে ইনোসেন্ট ও বিউটিফুল করে নির্মাণ করা হয়েছে। তাদের অন্য চরিত্রগুলোর থেকে সুন্দর ও মানবিক করে দেখানো হয়েছে। তার জন্য এখানেও নেওয়া হয়েছে আমার আগে দেখানো সেই রূপান্তরের গতিসূত্র। মেহেরজানের চরিত্রগুলো সবাই প্রথমে যা থাকে শেষে তা থাকে না। বদলে যায়। কিন্তু সবার বদল একাত্তরে ঘটলেও (কারণ সেটাই তাদের জীবতকাল) মেহের ও যুদ্ধশিশু সারার বদল বর্তমানকাল পর্যন্ত চলতে থাকে। দুইজন এই রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে শেষাবধি গ্লানিমুক্ত হয়: মেহের তার প্রেমের অপরাধবোধ থেকে আর সারা তার জন্মের কলঙ্ক থেকে। তাদের এই দায়মুক্তি সম্পন্ন হয় ইনোসেন্স থেকে এক্সপেরিয়েন্সের প্রক্রিয়ায়।



রবার্ট ব্লেইক ইনোসেন্স আর এক্সপেরিয়েন্স নামে দুটো অবস্থার কথা বলেছিলেন তাঁর সংস অফ ইনোসেন্স এন্ড সংস অফ এক্সপেরিয়েন্স নামক দুই গুচ্ছ কবিতায়। এখানে মেহের আর ওয়াসিম সংস অফ ইনোসেন্স এর প্রতীক। আর নানাজান আর নীলা হলো সংস অফ এক্সপেরিয়েন্স এর প্রতিভূ। মেহের অভিযোগ করে, ‘তোমরা কেউ আমাকে বুঝলা না।’ তার ইনোসেন্স দিয়ে সে যা বোঝে, তা আর কেউ বোঝে না বলে তার এই অভিযোগও ‘ইনোসেন্ট’। তাকে এরকম অ্যাবসলিউট ইনোসেন্ট বানাতে গিয়ে তার ভেতরকার সব খারাপ অভিজ্ঞতাকে নিষ্কাশন করে বের করে দেওয়া হয়, যাতে সে ঘৃণা করতে না শেখে। একাত্তরের অমানবিক দুর্দশার চিত্র ভুলিয়ে তার মনকে শিশুর মতো শূণ্য করা হয়। সেজন্য গণমৃত্যুর বীভৎসতার সাক্ষি মেহেরের মুখ দিয়ে বলানো হয়, ‘আমি স্ট্রং, আমি সব খারাপ কথা ভুলে যাব।’ কারণ না ভুলে যেতে পারলে তার ইনোসেন্ট ডিজুস টাইপের প্রেম ঘটতে পারে না। তবুও অন্তর্দ্বন্দ্বে টালমাটাল তার মনে হয়, ‘এটা (প্রেম) অসম্ভব’। এই টানাপড়েনের পরও মেহের ইনোসেন্টই থাকে। অথচ তখন চলছে জীবন-মরণ লড়াই। মেহেরের প্রেম যদি বাঙালির ন্যায্য ঘৃণা ধারণ করেই মনের সঙ্গে গভীর ফয়সালা করে ভালবাসাকে গ্রহণ করতো, তাহলে এতো সমস্যা হতো না। একাত্তরের নয় মাসে যেখানে মানুষের নয় বছরের সমান, সেখানে মেহেরের বয়স ও অভিজ্ঞতা বাড়ে না কেন? ঢাকার মেয়ে সে, রাজনীতি সচেতন পরিবারের মেয়ে সে, তার তো এমন হওয়ার কথা নয়? কেন একাত্তরের বাংলাদেশ থেকে লুকিয়ে সময় ও স্থানের বাইরে তার প্রেম বিরাজ করে? পোশাক-ভঙ্গিমা ইত্যাদি খুঁটিনাটি আলোচনায় না গিয়েও বলা যায়, কেন তার অভিজ্ঞতা তাকে কিছু শেখায় না, এটা আমার প্রথম প্রশ্ন?



একই কথা ওয়াসিম সম্পর্কেও। মেহেরের প্রেম সম্ভব করবার জন্য ওয়াসিমের বালুচ পরিচয়ে জোর দেওয়া হয়। এর ওপর দাঁড়িয়ে এখানেও রূপান্তরের লীলা চলে। ওয়াসিম মসজিদে গুলি চালাতে নারাজ হওয়ায় দলত্যাগী সেনা হিসেবে কোর্টমার্শালের সম্মুখীন হয়। এটা বিশ্বাস্য ঘটনা, এমনটা লাখে একটা হতে পারে। নৈতিক ও রাজনৈতিক বিচারে কারো জীবনই বিশুদ্ধ নয়। অবিশুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিশুদ্ধ আচরণও আমরা মেহের ও ওয়াসিমের কাছে দাবি করছি না। তা দাবি করলে পাঠ্যপুস্তক লেখা ভাল, চলচ্চিত্র বা উপন্যাস করার দরকার নেই। কিন্তু তাকে তো তার নিজস্ব শৈল্পিক বা নৈতিক যুক্তির ওপর দাঁড়াতে হবে। সেটা করতে গিয়েই অনাবশ্যকভাবে প্রেমদৃশ্যগুলো দীর্ঘ করা হয়। তাতে ছবির রাজনৈতিক মেসেজটা হারিয়ে যায়, বড় হয়ে ওঠে ‘অরাজনৈতিক প্রেম’। তাই নানাজান ও মেহেরের চরিত্রের গতি শেষপর্যন্ত মেলেনি। ছবির নাম নানাজান না হয়ে কেন মেহেরজান হলো তা পরিষ্কার হয় না।



যাই হোক, বিশেষ ব্যতিক্রম নিয়েও সিনেমা হতে পারে। কিন্তু সেটাকে সর্বজনস্বীকৃত করতে ওয়াসিমের জন্য যে যত যত্ন নেওয়া হয়, সেই যত্ন মুক্তিযোদ্ধা পুরুষ চরিত্রের একজনও পায় না। যদিও শিমুল ও সুমন চরিত্র যথেষ্ঠ জোরদার। লাস্ট সামুরাই ছবিতেও শত্র“র মিত্র হওয়ার কথা আছে। সেখানে টম ক্রুজ দলত্যাগ করে সামুরাইদের নারীকে ভালবেসে সামুরাই হয়ে যায়। অর্থাৎ সে মার্কিন সেনা থেকে জাপানি সামুরাই হিসেবে সাংস্কৃতিক পুনর্জন্ম লাভ করে। এখানেও, ওয়াসিম কেবল দলত্যাগই করে না, সে মেহেরকে নিশ্চিত ধর্ষণ ও হত্যা থেকে বাঁচায়। তারপর নিয়ম অনুযায়ী মেহের তার প্রেমে পড়ে। প্রেমের টানে মেহেরও ব্যক্তিগতভাবে তাকে আর ঘৃণা করে না। আর ওয়াসিমও দিনে দিনে বদলে যেতে থাকে। সে বাঙালি হিন্দুর ধুতি আর বাঙালি মুসলমানের পাজামা-পাঞ্জাবি পরে। হাঁসকে ধান ছিটিয়ে খাওয়ায়। বাংলার পথ-ঘাটের ফুল-লতাপাতার সঙ্গে পরিচিত হয়, ছাগল ছানা কোলে নিয়ে আদর করে, মেহের তাকে বাংলা বলতে না পারার জন্য ভর্তসনাও করে। এককথায় বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির মধ্যে নিমজ্জিত করে তাকে একধরনের মেটামরফসিসের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। মেহেরের প্রতি প্রেম ও সেনা হিসেবে অপরাধবোধ তাকে বদলে দেয়। এই বদলে যাওয়া ওয়াসিমকেই মেহের গ্রহণ করে, কারণ সে তখন আর পাকিস্তানী নয়, সাংস্কৃতিকভাবে রূপান্তরিত প্রায় বাঙালি। এভাবে একজন সম্ভাব্য ধর্ষক ও হত্যাকারী মানবিক ও প্রেমিক হয়ে দেখা দেয়। আর মেহের তার দ্বারা যেমন রক্ষিত হয়, মেহেরও তাকে রক্ষা করে। দর্শকের সামনে তখন উভয়কে গ্রহণ করার আবেগি চাপ তৈরি হয়।



ওয়াসিমকে বন্দী হয়। কিন্তু ওয়াসিম না হয়ে যদি আশ্রয় চাইতো কোনো পাকিস্তানী মেজরের কন্যা বা স্ত্রী, তার জন্য কী বরাদ্দ হতো? এই প্রশ্নও রয়ে যায়। যাহোক, এই দীর্ঘ পুনর্জন্ম প্রক্রিয়ার (দুই ঘন্টা ছবির প্রায় ২০-২৫ মিনিট) পরও তাদের প্রেম ডিজুস প্রেমের থেকে বেশি কিছু থাকে না। তাদের প্রেম ও বিচ্ছেদ দর্শকের মনে তেমন দাগ কাটে না, যতটা কাটতে পারে নীলা ও নানাজানের সংকট ও মৃত্যু। এই প্রেমের গল্পটা একাত্তরকে বোঝার জন্যও জরুরি বলে মনে হয় না। এটা যদি কেবল একাত্তরের যুদ্ধের মধ্যে একটা প্রেমের গল্প হতো, তাহলে একরকম। আবার ছবিটা মুক্তিযুদ্ধের একটা ভিন্ন রাজনৈতিক আখ্যান হলেও অসুবিধা ছিল না। কিন্তু এখানে ছবিটার রাজনীতি আর প্রেম তেল-জলের মতো আলাদাই থাকে। বঙ্কিমচন্দ্র মধ্যযুগীয় পটভূমিতে পাঠান রাজকন্যা রওশন আরা এবং রাজপূত বীর জয়সিং এর প্রেমকে এমন গভীর আত্মদহনের মাধ্যমে দেখান যে, তা অস্বীকার করা কঠিন হয়। সেই প্রেম বাতিল হলেও তাদের প্রতি একটা সহানুভূতি রয়ে যায়। কিংবা বিফোর দা রেইন ছবির কথাও বলা যায়। মেহেরজানে সেরকম তীব্রতা দেখা যায় না, যার জন্য দর্শকের মনে যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যেও মানবিকতার জন্য কোনো স্থান বরাদ্দের প্রযোজন জাগতে পারে। আগে যেটা বলেছি, মেহেরজানের একাত্তর রাজনৈতিকভাবে যতটা আসে, মানবিক অভিজ্ঞতার ভয়াবহ দুঃসহনীয়তা হিসেবে ততটা আসে না। যে প্রেম এত গভীর নৈতিক সংকটের জন্ম দেয়, সেই প্রেমকে এত পাতলা হওয়ায় ছবির সম্ভাবনাটা থমকে যায়।



কোনো মানব-মানবী সম্পর্কের সীমান্ত ডিঙাতেই পারে, কিন্তু পরিণতির দায় তাদের বহন করতে হবে, আবেগের ভিত্তিটাকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মেহেরজানে সেটা হয়েছে দুর্বলভাবে। নানাজান যেমন ইতিহাসবন্দী, মেহের এখানে বাসনাবন্দী। এবং সেই বাসনার নিজস্ব দাবি ততটা জোরালো নয়। ফলে ওয়াসিমও নানাজানের মতো হারিয়ে যায়। নানাজান অমহিমান্বিত মৃত্যুর মধ্যে, আর ওয়াসিমের নৌকা কুয়াশার অস্পষ্টতার মধ্যে হারিয়ে যায়। সে কোথাও পৌঁছাবে না, কারণ সে এক ‘ভাগাওয়া সিপাহি’। ভারতের হাতে পড়া এবং বেঁচে যাওয়া নিরানব্বই হাজার পাকিস্তানী সেনার মধ্যে সে পড়বে না, বাংলাদেশ তাকে হত্যা করবে, পাকিস্তানও তাকে ছাড়বে না। সে তাহলে কোথায় যাবে? ওয়াসিম ইতিহাসের অনিবার্য অপচয়ের অনুভূতিই কেবল জাগাতে পারে। এটুকুই যা সাফল্য এই চরিত্রের, এর বাইরে পুরোটাই এই ছবির সবচেয়ে দুর্বল ও সমস্যাজনক অংশ। এই সমস্যার অস্তিত্ব মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অধিপতি চিন্তার মধ্যেও যেমন, তেমনি বিরাজ করে অভিজাত কল্পনাতেও। এজন্যই আগেই বলেছিলাম, মেহেরজান ছবির মেসেজ আসলে শাসকশ্রেণীর মুক্তিযুদ্ধ দর্শনের অন্তর্দ্বন্দ্বকেই প্রকাশ করে। আমরা যারা এর বাইরে তাদের প্রতিরোধী বয়ান হাজির করার সুযোগ তৈরি করে দেয় এই ছবি। মেহেরজান যা বাস্তবে দেখাতে পারে না, তার ফাঁক ইউটোপিয়া দিয়ে পূরণ করে। সেজন্যই বাস্তবে যুদ্ধাপরাধের বিচারের আগেই, অপরাধের প্রায়শ্চিত্য পাওয়ার আগেই চলে আসে রিকনসিলিয়েশনের নান্দনিক সমাধান। যে সুন্দর কষ্ট আর যন্ত্রণাকে আড়াল করে পাশ্চাত্যের মানবাবতাবাদী ভাবনার কাঁথায় ওরিয়েন্টালিস্ট সুঁইয়ের সেলাইমাত্র। কিন্তু এ জন্যই এই ছবিকে গণ বা মুক্তির শত্র“ বলে গণ্য করা অতিপ্রতিক্রিয়া হবে। অনুভূতি ও চেতনাকেও গণতান্ত্রিক করতে হয়। প্রথমত, যে প্রজন্মএই ছবি বানাচ্ছে এটা তার কল্পনার সীমাবদ্ধতা। একাত্তর তার কাছে বিষয় বা আবেগ, শরীর-মন দিয়ে জানা-বোঝা বাস্তবতা নয়। দ্বিতীয়ত, একাত্তরের সামাজিক ও পারিবারিক ইতিহাস আবেগের আতিশয্য আর ইতিহাস বিকৃতির লাল সালুতে ঢাকা। তৃতীয়ত, যে শ্রেণীর লোকেরা মূলত একাত্তরকে ব্যাখ্যা করে, একাত্তর সম্পর্কে সেই শ্রেণীর দূরত্বের বোধ। এই শ্রেণী একাত্তরেও মুক্তি সংগ্রামের রাজনৈতিক তীব্রতা ও ধ্বংসের ভয়াবহতা থেকে দূরে নিরাপদই ছিল। আজো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবন ও আকাংখা থেকে তারা দূরে। তাদের বাসনা জাতীয় বাসনা হতে পারে না। এই দূরত্বের কারণেই যুদ্ধের মানবিক-অমানবিক সব মাত্রাই মেহেরজানে ফিকে হয়ে যায়।



দাঁড়িয়ে থাকে কেবল রাজনৈতিক চিন্তাটা, যা ইতিহাসের অনেক গুমর ফাঁস করার সম্ভাবনা ধারণ করে। শ্রেণী বিবেচনার পাশাপাশি এই নিরিখটাও তাই আমাদের ভুলে যাওয়া চলবে না। একারণেই এই ছবি নিয়ে আমার অবস্থানটা দ্বান্দ্বিক গ্রহণবর্জনের ভারসাম্য রা করে বলে আমি মনে করি। পরিচালক সযতনে একাত্তরের সংগ্রামে কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক ভূমিকার স্বীকৃতি দিলেও সুমনের মুখ দিয়ে ধর্ম সম্পর্কে যে কথা বলেন, তা মার্কসের শিক্ষাও নয়, ইতিহাসের সত্যও নয়। তারা যদি ধর্মকে আফিমই মনে করবে, তাহলে মাওলানা ভাসানী এত প্রভাব বিস্তার করেন কীভাবে? কীভাবে সেসময়ের কমিউনিস্টরা আওয়ামী লীগের থেকেও বড় কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র সংগঠন ষাটের দশকে গড়ে তুলতে পেরেছিল? অবচেতনের সুক্ষ্ম কমিউনিস্ট বিদ্বেষের সঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের কমিউনিস্ট বিদ্বেষ তাই মিলে যায়। ছোটো মেহেরের মতো বড় মেহেও উচ্চশ্রেণীর মনমানসিকতা বহন করে। মেহেরজান ধনী ভাস্কর। একা থাকেন, নির্জনে শিল্পচর্চা করেন। এবং যে সৌন্দর্য চর্চা করেন, তা গ্রিক হেলেনিক-আর্য সংস্কৃত-আর ইউরোপীয় রেঁনেসার উচ্চবর্গীয় আদর্শের রসসিক্ত। বাংলার নিসর্গ ও লোকায়ত ফুলগুচ্ছ দিয়ে অবশ্য মাঝেমধ্যে একে ব্যালান্স করা হয়। একইভাবে নানাজানের ইসলাম আর কৃষকের ইসলামও এক নয়। নানাজান কৃষক স্বার্থের কথা বলেন কিন্তু নিজের শ্রেণী ভূমিকা সম্পর্কে অসচেতন। এটা তাঁর জন্য ‘স্বাভাবিক’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্যও ‘স্বাভাবিক’। অন্যদিকে শিল্পী মেহের যে সর্বধর্মসমন্বয় করে, সেটাও কি আরেকটা ইউটোপিয়া নয়? আরেকটা ব্রাহ্মধর্ম বা সম্রাট আকবরের দিন ই এলাহির মতো উচ্চবর্গীয় হেজিমনিক প্রকল্প নয়?



মেহেরজানের গুরুত্ব হচ্ছে, তা ইতিহাসের অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নকে আবার আলোচনায় এনেছে। ১৮৭২ সালের জনশুমারিতে আবির্ভূত হওয়া সংখ্যাগুরু বাঙালি মুসলমান, ৪৬-৪৭ এর দাঙ্গা ও দেশভাগ, একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষবিপক্ষে সব ধারা, নারীর একাত্তর ও যুদ্ধশিশু, সমকামিতা, কমিউনিজম, সেকুলারিজম, জাতীয়তাবাদ, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য, অহিংসা ও সৌন্দর্যসহ এত প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে যে, ছবির ভরকেন্দ্রটা অনেক সময় হারিয়ে গেছে। আর এসব প্রসঙ্গ যেসব তত্ত্বকাঠামো দিয়ে দেখা হয়েছে, তার সীমাবদ্ধতা নিয়েও ভাবা হয়নি। তত্ত্ব দিয়ে শিল্পের শরীর নির্মাণ করা যায় না। শিল্পকে তত্ত্বের সহায়তা নিলেও নিজস্ব দাবির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়। মেহেরজান ছবি তাই এক দারুণ উদ্যোগ হয়েও ট্রিটমেন্টে কেয়ারলেস। ইতিহাসের আখ্যানের মধ্যে উচ্চবর্গীয় বাসনার আধারে, তা শেষপর্যন্ত আমাদের ইতিহাসের মতোই অমীমাংসিত। কারণ, মুক্তিযুদ্ধকে এখানে উচ্চবর্গীয় এক ইতিহাস থেকে অন্য ইতিহাসে দেখানো হলেও তা শেষপর্যন্ত উচ্চবর্গীয় বাসনারই শিকার হয়।
২৯.১.১১
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:২৯
২০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×