somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একাত্তরের অ্যান্টিথিসিসের মা জননী শর্মিলা বোসের লাশগণনার ভুতুড়ে ইতিহাস

২৪ শে মার্চ, ২০১১ রাত ১২:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একাত্তরের গণহত্যা ও গণধর্ষণের ব্যাপকতাকে খাটো করার নতুন সৈনিক শর্মিলা বোসের নতুন বইয়ের নাম Dead Reckoning: Memories of 1971 Bangladesh War’ ব মৃতশুমারি : ১৯৭১ এর বাংলাদেশ যুদ্ধের স্মৃতি'। মৃতশুমারিটা কে করছে? স্মৃতিটা কার? শুমারির জন্য তিনি নির্ভর করেছেন পাকিস্তানী সেনাভাষ্যকে আর স্মৃতিটা প্রধানত তাদেরই। কারণ, যুদ্ধটা তাদের কাছে ভারত-পাকিস্তানের বাংলাদেশ যুদ্ধ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নয়। আমেরিকার জন্য যা ইরাক যুদ্ধ, ইরাকীদের জন্য তা আগ্রাসন এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধটা স্বাধীনতা যুদ্ধ ছাড়া আর কিছু নয়। তাঁর গবেষণার সারসংকলন তাঁর বইয়ের নামানুসারেই তাই করা যায় মৃতদের শুমারি: হারানো বাংলাদেশের ভুতুড়ে স্মৃতি। হ্যাঁ, যে পূর্ববঙ্গের মুসলমানের আন্দোলন ও ভোটের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যারা ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের প্রাণ, ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশে কেবল পাকিস্তানের পূর্ব অংশেরই মৃত্যু ঘটেনি, মৃত্যু ঘটেছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের কনসেপ্ট তথা দ্বিজাতিতত্ত্বের। রাষ্ট্রের কনসেপ্ট বা চেতনা মারা গেলে রাষ্ট্রের শারীরিক মৃত্যুটা সময়ের ব্যাপার। পাকিস্তান এখন সেই সময়টাই পার করছে ভুতুড়ে অস্তিত্ব নিয়ে। সেই যে, সুকুমার রায়ের রামছাগলের মেজোদাদার অর্ধেকটা বাঘে খেল বলে বাকি অর্ধেকটার সেই দুঃখে মারা যাওয়ার মতো। নেতাজি সুভাষ বোসের নাতনিরও দুঃখটা তেমনই।

এক.
মুক্তিযুদ্ধের একাডেমিক ইতিহাস চর্চার খাতাটা প্রায় সাদাই ছিল অনেক দিন। শর্মিলা বোস সেখানে একের পর এক কদর্য কিছু দাগ রেখে চলেছেন। তাঁর একাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং সাম্প্রতিক প্রকাশিত বই দিয়ে তিনি স্বাধীনতা অর্জনে বাংলাদেশের মানুষের আত্মত্যাগ, গণহত্যা ও গণধর্ষণের অলংঘনীয় বাস্তবতাকে অস্বীকার করে চলেছেন। তাঁর দাবি মানলে মুক্তি সংগ্রামের রাজনীতি নাকচ হয়ে যায়। গবেষক বা লেখকের অনুসন্ধানের একটা অভিপ্রায় বা উদ্দেশ্য থাকে। শর্মিলা বোসের অভিপ্রায় বা উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা ও তত্ত্বের খণ্ডন। তিনি আসলে একাত্তরের অ্যান্টিথিসিস বা পাল্টা তত্ত্ব রচনা করে যাচ্ছেন। নতুন বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে গবেষণা ও মাঠকর্ম করতে আসার পর মুক্তিযুদ্ধে জড়িত ও সাক্ষিরা তাঁকে বলেছে, ‘এইসব ঘটনায় দুর্ঘটনাবশতভাবে ছাড়া সেনাবাহিনী নারীদের কোনো ক্ষতি করেনি। এসব ঘটনা থেকে যে ধরনটা দাঁড়িয়ে যায় তা হলো, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নারী ও শিশুদের বাদ দিয়ে কেবল বয়স্ক পুরুষদের নিশানা করেছিল।’ এটা বলেছেন কয়েকটি ‘ঘটনার’ ব্যাপারে। এরপরে সমগ্র মুক্তিযুদ্ধ বিষয়েই তাঁর রায় হচ্ছে, ‘কোনো সন্দেহ নেই যে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। অবস্থার সুযোগ নেওয়া সুবিধাবাদী যৌন অপরাধ বাদ দিলে, প্রশ্ন হলো, কোন মাত্রায় ধর্ষণ ঘটেছিল, কে কাকে শিকার করেছিল এবং সেসময় কোনো পক্ষ লাগাতারভাবে পরিকল্পনামাফিক ধর্ষণ চালিয়েছিল কিনা।’ তাঁর সিদ্ধান্ত: সেরকম কিছু পাকিস্তানী বাহিনী করেনি।

তাঁর দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি গণহত্যা বিষয়ে। অ্যানাটমি অফ ভায়োলেন্স প্রবন্ধের উপসংহারে তিনি লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের গৃহযুদ্ধে দুটি পক্ষ লড়েছিল, যাদের একপক্ষের বিশ্বাস তারা পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষার জন্য লড়ছে, অন্যপক্ষ লড়েছে সুবিচারের সুযোগ এবং স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের উন্নতি হবে এমন বিশ্বাসে। উভয়ের অবস্থানই রাজনৈতিকভাবে বৈধ। উভয় পক্ষই সহিংসতার পথে সমাধান চেয়েছে, সবাইই যুদ্ধের গৃহীত নিয়মকানুনের বাইরে গিয়ে নৃশংস কর্মকাণ্ড করেছে, এবং উভয়ই মানবতার অংশ। এই বৈশিষ্ঠ্যের কারণে অপরাধীকরণের (পাকিস্তানী সৈন্যদের) দাগ মেরে দেওয়ার বদলে বরং ১৯৭১-এর সংঘাত বিশেষভাবে সমঝোতা প্রয়াসের উপযোগী।’

এটাই শর্মিলা বোসের অভিপ্রায়, এই-ই তাঁর উদ্দেশ্য। অর্থাৎ তিনি পাকিস্তানের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়মুক্তি ঘটাতে চান এবং চান শত্র“ভাবাপন্ন দুটি দেশ ও জাতির মধ্যে, নিপীড়ক ও নির্যাতিতের মধ্যে, ঘাতক ও নিহতদের মধ্যে সখ্য স্থাপন করতে। কারণ, উভয়পক্ষই তো সমান দোষী! কারণ, তাঁর চোখে একাত্তরের যুদ্ধটা স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল না, ছিল ‘গৃহযুদ্ধ’। কারণ বাঙালিরা কোনো সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কারণে নয়, কেবল ‘উন্নতির আশাতেই’ স্বাধীনতা চেয়েছিল, কারণ বাঙালিরাই অসহযোগ আন্দোলনের নামে আগে সহিংসতা ঘটিয়েছে, উস্কানি দিয়েছে, তারাও নৃশংস কর্মকাণ্ড করেছে। এই যদি হয় ইতিহাস তাহলে ‘ভুল বোঝাবুঝি’ মিটমাট করে নেওয়াই ভাল! মনে রাখা দরকার, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামেই, মুক্তিযুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ বা ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ আখ্যা দিয়েই রাজাকার-আল বদর, জামাতে ইসলামী যাবতীয় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সুতরাং শর্মিলা বোসের প্রস্তাবটা কেবল পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের মাফ করে দেওয়ারই নয়, বাঙালি ও বাংলাদেশি যুদ্ধাপরাধীদেরও মেনে নেওয়ার প্রস্তাব। এককথায়, এটা হলো বাংলাদেশের নাগরিকদের একাত্তরের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অস্বীকারের বুদ্ধিবৃত্তিক প্ররোচনা।

মুক্তিযুদ্ধে সবার ভূমিকার সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু শহীদদের প্রাণদান আর যোদ্ধাদের সংগ্রামকে কোনোভাবেই বাতিল বা হেয় করা যায় না। মানবতার বিপুল ধ্বংসের পক্ষের যুক্তি বা অবস্থান যেমন মানবতাবিরোধী, তেমনি শর্মিলা বোস কিংবা মানেকশ’র স্বাধীনতা যুদ্ধকে ‘গৃহযুদ্ধ’ বা ‘ভারত-পাকিস্তান’ যুদ্ধ বলার মাধ্যমে বাংলাদেশের যুদ্ধকে এর অধীনস্থ করে দেখার অবস্থানও বাংলাদেশবিরোধী।

পাকিস্তান একে গৃহযুদ্ধ, ধর্মযুদ্ধ যে কোনো নামেই ডাকতে পারে, তাতে করে তাদের ঐতিহাসিক বিকার আরো প্রলম্বিতই হবে। ভারতেও অনেকে বৃহত রাষ্ট্রের উচ্চম্মন্যতার বাতিক থেকে একাত্তরের যুদ্ধকে ভারতের যুদ্ধ বলতে পারে এবং তার বাইপ্রডাক্ট হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে থাকেন। ১৯৭১-এ ভারতের বাংলাদেশকে সর্বোতভাবে সাহায্য করা নিশ্চয়ই ভারতের মহিমা, কিন্তু বাংলাদেশের জন্ম বা বিজয় কোনোটাই সেই মহিমার গুণে হয় নাই। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম এ অঞ্চলের জনগণের রাজনৈতিক ইতিহাসের বিকাশ এবং স্বাধীনতার আকাঙ্খার মধ্যে। এ বিষয়ে ছাড় দেয়া মানে ঐ রাজনৈতিক ইতিহাসকে ভুল বলে বাতিল করা নতুবা তাকে ঠিক মতো বুঝতে না পারা। শর্মিলা বোসও সেটাই করেছেন। গণহত্যা ও গণধর্ষণ অস্বীকারে তাঁর প্রয়াসের রাজনৈতিক মাজেজা এটাই এবং এখানেই তাঁকে মোকাবেলা করতে হবে একাত্তরের প্রতিরেধী চেতনা ও আধিপত্যবিরোধী সংগ্রামের প্রতি দায়বদ্ধ গবেষকদের। এ ধরনের চিন্তা মনে করে, একাত্তরে পাকিস্তান বাড়াবাড়ি না করলে, কিংবা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা তুলে দিলে, কিংবা আরো কী কী যেন করলে পাকিস্তান ভাংতো না। (সম্প্রতি লারকানা থেকে পাঠানো এক পাকিস্তানী সামরিক নির্দেশিকা পা্ওয়া গেছে, যাতে একাত্তরে তারা বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছে যে, শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাবে, অতএব তাকে ঠেকাও বা হত্যা করো, যেভাবে তারা জিন্নাহ-লিয়াকত-সোহরাওয়ার্দিকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ) সমস্যাটা আচরণের ছিল না, ছিল উভয় খণ্ডের ঔপনিবেশিক সম্পর্কের মধ্যে। দ্বিতীয় সমস্যা হলো খোদ পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শিক ভিত্তির দুর্বলতা। পাকিস্তান কেন এক থাকবে, এর যুক্তি তারা কাল্পনিক মুসলিম জাতীয়তাবাদ দিয়ে করে। ভারত যেমন করে কখনো প্রগতির নামে (নেহরুর জাতীয়তাবাদ), কখনো হিন্দুত্ববাদ (বিজেপির জাতীয়বাদ), কখনো পরমাণুবোমাসমৃদ্ধ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি এবং হিন্দি ভাষা ও হিন্দি ছবির নামে (নিওলিবারেল সোনিয়া-মনমোহনের ইন্ডিয়া)। এখনো ভারত রাষ্ট্রের মধ্যে সব জাতি-বর্গ-শ্রেণীকে ধারণকারী মতাদর্শ ও রাজনীতি নির্মিত তো হয়ইনি, বরং দিনকে দিন সেই সম্ভাবনা তিরোহিত হচ্ছে। আলবৎ সেই রাজনীতি বাংলাদেশেও নেই। তারপরও আমরা এক জাতি বলেই এক স্বাধীন রাষ্ট্রে থাকবো তা-ই নয়, একাত্তরের ঐক্য ও যন্ত্রণার স্মৃতিও আমাদের সংহতির রসায়ন। সেকারণে আমরা বারবার মুক্তিযুদ্ধের নাম নেই, সকল কিছুর প্রেরণা বা প্রণোদনা আকারে এর কথা বলি। অনেক সময় রাষ্ট্রীয় বা দলীয় শয়তানির দোহাইও এখান থেকে টানা হয়। তাহলেও, একাত্তরের অভিজ্ঞতা এত ব্যাপক যে সহসা তার জীয়ন ক্ষমতা ফুরাবার নয়।

স্বাধীনতাযুদ্ধের আত্মদান, সংগ্রাম ও ধ্বংসের অভিজ্ঞতা হলো সেই বুনিয়াদি ভিত্তি যার ওপর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভিত্তি দাঁড় করানো। আবার দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক শক্তি এই ভিত্তিকে ওল্টানোর প্রকাশ্য ও গোপন কর্মসূচিও জারি রাখছে। এই দুই-ই মোটাদাগে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের রাজনীতি বলে চিহ্নিত_ যদিও কার্যত মুক্তিযুদ্ধ রাজনৈতিক উত্তরাধিকারহীন। তাহলেও জনইতিহাস ও জনস্মৃতির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ তেমনই এক পরম ঘটনা, যাকে আগলে রাখার কাজ জনগণ করে এবং বারে বারে তা থেকে বৈধতার তকমা রাষ্ট্রকেও গলায় ঝোলাতে হয়। যুক্তিটা এরকম: বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কারণ মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ সার্বভৌম থাকবে, কারণ তা লক্ষ লক্ষ শহীদের আত্মদানের ও সংকল্পের অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতা। একাত্তরের রাজনীতির আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে এই স্বীকৃতি দানের পরেই।

বাঙালিরা স্বাধীনতার ইচ্ছা করেছে এবং তার জন্য যুদ্ধ করার প্রস্তুতিও নিয়েছে। এই সংকল্প না থাকলে কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না বাংলাদেশকে মুক্ত করা। এই সংকল্প তিনটা ধারায় দিনে দিনে দানা বেঁধেছিল। প্রথমটি সাংস্কৃতিক: জাতীয়তাবোধের জায়গা থেকে বাংলার মানুষ পাকিস্তানি পরিচয় এবং তার মতাদর্শের সঙ্গে দূরত্ব বোধ করছে_ অর্থনৈতিক বঞ্চনা এর কার্যকারণ মাত্র। বাস্তবের পাকিস্তানের আগেই মনের পাকিস্তান শুকিয়ে মরেছে। এ থেকেই জন্ম নিয়েছে জাতীয়তাবাদের রাজনীত। জাতির মুক্তিকে এই রাজনীতি একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের আধারে প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেছে (না পারুক, সেটা অন্য আলোচনা)। ৪৮-৭১ পর্যন্ত এরই বিকাশ আমরা বহুধারায় বহু ঘটনার মধ্যে দেখি। এরই চরম পর্যায়ে জন্ম নেয় তৃতীয় ধরনের সংগ্রাম: সামরিক সংগ্রাম। ৫২ সাল থেকে শুরু করে আগরতলা মামলা (আগরতলা ষড়যন্ত্র যে শেখ মুজিব করেছিলেন, সেটা এখন আওয়ামী লীগের নেতারাও স্বীকার করছেন) পর্যন্ত এর প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপে দেখা দেয় একাত্তরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সশস্ত্র প্রতিরোধ। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস হচ্ছে স্বাধীনতার সেই পর্বত, সশস্ত্র যুদ্ধ যার শিখর। এই শিখর পর্বেই ভারত-সহ আন্তর্জাতিক নানান শক্তির ভূমিকা দেখতে পাই। কিন্তু কেবল শিখরকেই স্বাধীনতার মূল দেহ ভাবলে পর্বতটাকে টিলা বলে ভ্রম হতে পারে। শর্মিলা বোসের সেই মতিভ্রমই হচ্ছে।

ঠিক যে, ১৯৭১ সালে উপমহাদেশে দুটি যুদ্ধ হয়েছিল। একটি বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের অন্যটি ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের। পাক-ভারত যুদ্ধ হচ্ছে সেই টিলা বিজয়ের যুদ্ধ। ভারত রাষ্ট্রের ইতিহাসে এটা এক গৌরবজনক অধ্যায় মাত্র, তার সমগ্র অস্তিত্বের প্রতীক বা তার সমমূল্য এই বিজয় পায় না। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য তা তার জাতীয় অস্তিত্বের সমতুল ও পরিণতি। মানেকশ'র বিজয় বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা সম্ভব করেছে বা সেই বিজয়ের ফলে বাংলাদেশের জন্ম, এমন মনোভাবের মধ্যে যে অধিপতি সুলভ দৃষ্টিভঙ্গি বা তাকে মেনে নেয়ার মধ্যে যে সমর্পিত মনোভাব থাকে, তা আপত্তিকর। সৈনিকের কাজ নয় কোনো দেশ স্বাধীন করা। সেটা তাদের ক্ষমতার বাইরের ব্যাপার। সমগ্র জনগণের গভীর সাংষ্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক প্রস্তুতি ও সংকল্প না থাকলে জাতীয় যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া যায় না। এই জিনিষ সেনা কমান্ডে গঠিত হয় না।

যে পাকিস্তান মুসলমানদের একজাতি বলেছে, সেই পরে প্রমাণ করেছে, তারা এক জাতি নয়। ঐক্যটা কংগ্রেসি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সাময়িক ও রাজনৈতিক কৌশলগত ছিল, এবং রাজনৈতিক কারণেই হিন্দু জমিদার শ্রেণীর ভীতি অপসারিত হওয়ায় ঐক্যটাও প্রয়োজন হারিয়েছে এবং ভেঙ্গে গেছে। একে দেশভাগ বলে না, বলে ভাঙ্গন এবং তা রাষ্ট্রের ভাঙ্গন। এর মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্র পেয়েছে তার আসল রূপ। যে রূপটা বণিক-সামরিক পাঞ্জাবি এলিটতন্ত্রের, যা ব্রিটিশ-মার্কিনের ঔপনিবেশিক জের বহন করছে, ঔপনিবেশিক ব্রিটেন আর সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার উত্তরাধিকার ও রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে কাজ করছে। আর বাংলাদেশের আবির্ভাব এই জোটেরই বিরুদ্ধে। যে কোনো রকম উপনিবেশিকতা ও আঞ্চলিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে ভাষাভিত্তিক, সেক্যুলার, কৃষকমেজাজি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে_ একজাতি এক রাষ্ট্র হিসেবে (এটাই নিশ্চয় এই রাষ্ট্রের মকসুদে মঞ্জিল নয়, তবে সেটা অন্য আলোচনা)। দ্বিজাতিত্ত্বের মিছা আশা, কিংবা ভারতবর্ষীয় একজাতিতত্ত্বের মায়ার নাগপাশের বাইরে এর আবির্ভাব হয়েছিল, এই সত্যটা আমাদের মনে থাকা চাই। আর মান্য করা চাই যে, এই রাষ্ট্রের ভিত নির্মিত হয়েছে সংগ্রামে, রক্তে, অশ্র“তে আর আগুনে। যার সম্মান ও সার্থকতা আজ অবধি আমরা দিতে পারি নাই। সংশোধনবাদী ইতিহাস চর্চা এরই সুযোগ নিচ্ছে এবং নিতে থাকবে।

পরের পর্ব দেখুন :

(দয়া করে এখানে এখনই মেহেরজান নিয়ে বিতর্ক তুলবেন না। দুটি পর্ব পড়া শেষে যাদের আগ্রহ আছে তারা মেহেরজান প্রসংগে আলোচনা চালাতে পারেন। আশা করি, উত্তেজনা ও আতংক প্রশমিত হয়েছে, তাই আমার আগের লেখাগুলোকে ঠাণ্ডা মাথায় বুঝতে পারবেন। আমি আমার অবস্থানেই আছি, আশা করছি নিন্দাবাদীরা ভুল বুঝতে পারবেন, বাঙলা ভাষায় লেখা আমার বাক্যগুলোর বাঙলা মানেই করবেন। না পারলেও অসুবিধা নাই, চরিত্রহননের স্বাধীনতা আপনাদের আছে। আপনার সেটা চালিয়ে যান। আমি কেবল এখান থেকে সরে যাব।)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০১১ রাত ১:৩৩
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×