বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ধারণা লাভ করার পর থেকে আজ পর্যন্ত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে যত কেলেঙ্কারি দেখেছি (প্রশ্ন পত্র ফাঁস, এ নিয়ে পরীক্ষা পিছানো, পরীক্ষা বাতিল), তার মধ্যে ঢাবিতে ২০১১ সালের ‘গ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে যে কেলেঙ্কারী হয়েছে তা জাতিকে ভাবিয়ে তুলেছে।
গত ২৮ অক্টোবর শুক্রবার ‘গ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষার ফলাফল ৩১ অক্টোবর সোমবার প্রকাশিত হয়। ‘গ’ ইউনিটের ৮টি বিভাগের অধীনে ৯৮০টি সিটের জন্য ৩৭ হাজার ৪৮৮ জন পরীক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন এবং এদের মধ্যে ২ হাজার ৭২৭ জন উত্তীর্ণ হন।
গত ১ নভেম্বর প্রত্যাশিত ফলাফল না পেয়ে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিনের কাছে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা। এর পরপরই ভর্তি কমিটির জরুরি সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। বৈঠকে উত্তরপত্রের অসঙ্গতিগুলোর সত্যতা পাওয়া যায়। এরপরই কমিটি ফলাফল বাতিল ঘোষণা করে উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়ন শুরু করে।
গত ২ নভেম্বর পুনর্মূল্যায়িত ফলাফল প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়। এরপরও আরও অনেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের আবেদন আসায় আবার পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ডিনস কমিটি। কিন্তু বেকে বসেন অনেক শিক্ষার্থী, মামলা ঠুকে দেন আদালতে। ‘গ’ ইউনিটে নতুন করে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করে ফের পরীক্ষার উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নে ১লা ডিসেম্বর আদেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের জন্য শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট শিশুতোষ লেখক, নাট্যকার, সিনেমা প্রযোজক (আদালতের ভাষায় আইটি বিশেষজ্ঞ) জাফর ইকবালের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের ডিন অধ্যাপক জামাল উদ্দিনকে অপসারণেরও আদেশ দেন আদালত।
ফুসে উঠে ঢাবি শিক্ষক সমাজ। ক্ষুব্ধ শিক্ষক সমাজ এই কমিটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চরম অবমাননাকর মন্তব্য করে আদালতের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনুষদের ডিনকে অপসারণের আদেশের সমালোচনা করে শিক্ষকরা বলেছেন, ডিন একটি নির্বাচিত পদ। এ সম্পর্কে আইন-কানুন রয়েছে। এই পদ থেকে কাউকে এভাবে অপসারণ করা যায় না। সংশ্লিষ্ট ডিনকে অপসারণের আদেশ দেয়ার আগে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়নি।
অধ্যাপক জাফর ইকবালের নেতৃত্বাধীন কমিটি গঠনে আদালতের আদেশ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, অধ্যাপক জাফর ইকবালকে দিয়ে কমিটি গঠনের ব্যাপারে আমার কাছে আদালত জানতে চাইলে আমি আদালতকে বলেছি- ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। ১৯৭৩-এর অর্ডার অনুযায়ী এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যবোধ রয়েছে। জাতীয় সংসদই আমাদের স্বাতন্ত্র্যতার সম্মান দিয়েছে। এখানকার শিক্ষকরা ভুল করতে পারেন। তা শোধরাতেও পারেন। আমাদের দক্ষ শিক্ষক আছেন। অতএব এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা সমাধান এবং ভাগ্য নির্ধারণে আমরাই সক্ষম। সেখানে অন্য কাউকে দিয়ে কমিটি করা ঠিক হবে না। এটা বিবেচনাপ্রসূত নয়। অধ্যাপক জাফর ইকবালও তাতে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করবেন না। তিনি বলেন, এ মতামত নেয়ার পরও আদালত ওই আদেশ দেন। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ বিষয়টিকে ভালোভাবে নিচ্ছে না। ডিনকে অপসারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ডিন নির্বাচিত হন। এ সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন রয়েছে। তা অনুসরণ কিংবা সংশ্লিষ্ট ডিনের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়েছে কি না তা জানি না। এসব বিষয়ে আইনি লড়াই করা যায় কি না এ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এসব বিষয় ভেবে দেখা দরকার।
অধ্যাপক জাফর ইকবালকে দিয়ে কমিটি গঠন সম্পর্কে কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সদরুল আমিন বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ আছেন। আমরাই আমাদের সমস্যা মেটাতে সক্ষম। অত্যন্ত দক্ষ ও খ্যাতিমান প্রযুক্তিবিদ শিক্ষক এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছেন। আদালত বাইরের লোক দিয়ে কেন কমিটি গঠন করল তা বুঝতে পারছি না। ডিনকে অপসারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, একজন নির্বাচিত ডিনকে এভাবে অপসারণ করা যায় না। আদালতের এ রায়ের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হচ্ছে বলেও তিনি মনে করেন। উচ্চাদালতে আপিল করার জন্যও তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান।
অধ্যাপক ড. তাজমেরী এস এ ইসলাম বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুল-ত্রুটি সমাধানে আমরা সক্ষম। আমাদের এখানে অনেক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। তিনি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। বাইরের কোনো বিশেষজ্ঞ আমাদের প্রয়োজন নেই। ডিনকে অপসারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ডিন নির্বাচিত। একজনকে ডিনকে এভাবে অপসারণ করা ঠিক নয়। আমার মনে হচ্ছে এটা ’৭৩-এর আদেশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধিকে অমান্য করা হয়েছে। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আলাদতে আপিলের জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাবির এক সাবেক প্রো-ভিসি বলেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার সমাধানে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রয়োজন নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে জাফর ইকবালের চেয়ে অভিজ্ঞ অন্তত ১০ জন বিশেষজ্ঞ শিক্ষক রয়েছেন। আমরা জাফর ইকবালের নেতৃত্বে কমিটি মানি না। বিশ্বধর্ম তত্ত্ব ও সংস্কৃতি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র জাহিদুল ইসলাম অধ্যাপক জাফর ইকবালের নেতৃত্বাধীন কমিটিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অবমাননাকর বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এটা মেনে নেয়া যায় না। আমাদের প্রযুক্তিবিদ রয়েছেন। কেন অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক? সেটা তো আমরাদেরও কথা, একটা ১ম ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা সমাধান করার জন্য ২য় ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রফেসর ধার করতে হচ্ছে কেন? আপনাদের মেধার দৌড় কতদুর জাতি মনে হয় উপলব্ধি করতে শুরু করেছে।
ঢাবি কর্তৃপক্ষ আবারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার।
আমার জানামতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় যা নাকি ১৯২১ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বভাবতই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সকল বিষয়েই অভিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলী রয়েছেন। আমার প্রশ্ন হল এত বছর পর এরকম একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা কি করে ঘটল এবং কেন ঘটল? তাহলে আমরা কি ধরে নিবো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেধা শুন্যতায় ভোগতে শুরু করেছে।
ঢাবি ভিসি প্রফেসর আরেফিন সিদ্দিকী নিয়েই শুরু করা যেতে পারে, উনাকে যতটা না শিক্ষকতার পেশাদারিত্বে দেখা গেছে তার চেয়ে বেশী দেখা গেছে একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে। তিনি প্রায়ই একেবারে লাঠিয়াল কর্মী হিসেবে মাঠে ময়দানে ভুমিকা রেখেছেন। একজন রাজনৈতিক কর্মী যখন ভিসি হন তখন ঢাবিতে এরকম কেলেঙ্কারি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আবার, এ সরকার যেভাবে মেধাকে পাশ কাটিয়ে দলীয় ক্যাডারদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে এবং দিচ্ছে তাতে মেধাশুন্যতা যে শুরু হয়ে গেছে এ ঘটনা তারই প্রমাণ।
যে পরীক্ষায় হাজার হাজার ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যত ক্যারিয়ার নির্ধারিত হবে সে পরীক্ষার প্রশ্ন পত্রে একটা-দুইটা নয় ছয় ছয়টা প্রশ্নই ভুল। কারা করেছে সে প্রশ্ন? প্রশ্ন ফাইনাল প্রিন্টের আগে কি একবারও উনারা চেক করে দেখার প্রয়োজন অনুভব করেননি? নাকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ নিতে নিতে সে সময়ও পাননা ঢাবি শিক্ষকরা? দুই দুইবার উত্তরপত্র মুল্যায়ন করার পরও ভুল ধরা পরে, কেমন পারদর্শী (!) শিক্ষক উনারা? ঢাবি ভিসি কি একবারও জোর দিয়ে বলেছেন যে যারা প্রশ্ন কর্তা, প্রশ্ন সিলেক্ট কর্তা, প্রিন্ট কর্তা, উত্তরপত্র মুল্যায়ন কর্তা তাদের শাস্তি হওয়া উচিত? কিংবা ভবিষ্যতে উনারা ভর্তি পরীক্ষার কোন কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবেননা? বলেননি, মিডিয়াও বলেনি কারণ তখন শাস্তি পেতে হবে সব দলীয় শিক্ষকদের। সাবাস ভিসি! সাবাস! আপনিওই যোগ্য ভিসি!
ঢাবি শিক্ষকরা বললেন আমাদের অনেক বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, তাহলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক ধার করার কথা আদালত কেন বলল? আপনারা কেন নাম প্রস্তাব করলেননা? নাকি নাম প্রস্থাব করলে বিরোধী গ্রুপের শিক্ষকদের নাম চলে আসবে তাই? প্রথমবার যখন ভুল ধরা পড়ল, তখন আপনারা আপনাদের বিশেষজ্ঞদের ডাকলেন না কেন? তার মানে দাড়াচ্ছে, ঢাবি শুধু মেধাশুন্যতায়ই ভুগছেনা, নৈতিকতার শুন্যতাতেও ভুগছে। না হলে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জীবন নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলছেন তাদের শাস্তির কথা কেন বলা হচ্ছেনা, হাজার হাজার শিক্ষার্থী যারা দুরদুরান্ত থেকে আসবে তাদের আসা-যাওয়ার ভাড়া, থাকা-খাওয়ার খরচ কেন উনারা বহন করছেন না? এরকম একটা কলঙ্কজনক ঘটনার সূত্রপাত করার পরও কেন আদালতকে বলে দিতে হবে যে ডীন কে অপসারণ করতে হবে? উনি নিজ থেকেই কেন পদত্যাগ করলেন না? তাহলে রাজনৈতিক নেতাদের মত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরও কি নৈতিকতার অধপতন ঘটেছে?
আরও ভয়াবহ একটা আশঙ্কা মনের মধ্যে উকি দিচ্ছে। এমনও হতে পারে যে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে মোটা অঙ্কের টাকার বাণিজ্য হয়েছে। যাদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়েছে তারা প্রথম বার চান্স পায়নি, পরবর্তীতে দ্বিতীয়বার ভুল শোধরানোর কথা বলে তাদের নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে দেখা যায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী দ্বিতীয়বার বাদ পরে যায়। যদি ভুলই সংশোধন করা হত তাহলে বড়জোর কয়েকজনের পজিশন চেঞ্জ হতে পারে আর শেষের দিকে কয়েকজন বাদ পরতে পারে। এত বিশাল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী বাদ পড়ার কথা নয়। এ জাতীয় ঘটনা ভবিষ্যতে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবেনা।
শেষ পরামর্শ হচ্ছে ভুল প্রশ্ন বাদ দিয়ে তৃতীয়বার নতুন কমিটি (সিনিয়র ও অভিজ্ঞ শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত) করে খাতা মুল্যয়ন করলে এবং প্রতি বিভাগে এ বছর ১০/১৫ জন (প্রথমবার উত্তীর্ণদের মধ্যে কেউ বাদ পড়ে থাকলে) অতিরিক্ত ভর্তি করলে ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের ভোগান্তি কমবে। নতুন করে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই, তাতে জটিলতা আরও বাড়তে পারে।
http://sonarbangladesh.com/article.php?ID=7558
সূত্র

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




