মাফিয়াতন্ত্রের অশুভ হাত
যোগাযোগের বেলায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে আছে পরিবহন খাতে মাফিয়াতন্ত্রের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হওয়া। এই মাফিয়াতন্ত্র কার্যকর আইন প্রণয়ন, তদারকি ও শাস্তিদানের ব্যবস্থার সামনে বড় বাধা হয়ে আছে। আজ বৃহস্পতিবারের প্রথম আলোর সংবাদে বলা হয়েছে, পরিবাহন খাত সরকারের মন্ত্রী, সাংসদসহ আওয়ামী লীগের নেতা এবং তাঁদের আত্মীয়দের কবজায়। ‘ক্ষমতার ছায়ায় থাকা চালকেরাও হয়ে ওঠেন বেপরোয়া’। সংবাদেই সত্যটা প্রকাশিত: ‘রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, সদস্যরা বেনামে পরিবহন ব্যবসায় যুক্ত হওয়ায় রাস্তায় আর কোনো আইনি নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে।’
যোগ্যতাসম্পন্ন চালক সরবরাহে বড় সমস্যা নৌমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের তদবির। সেখান থেকে নির্দেশ এলে যে-কাউকেই ড্রাইভিং লাইসেন্স না দেওয়ার সাধ্য কারও নেই; যদিও বলা হয় সিস্টেম ডিজিটাল! বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্র জানায়, ১৯৯২ সাল থেকে নৌমন্ত্রীর সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের দেওয়া তালিকা ধরে প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার চালককে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ ২০১১-১২ সালেও শাজাহান খানের স্বাক্ষরসংবলিত তালিকা ধরে যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া হাজার হাজার লাইসেন্স পেশাদার চালককে দেওয়া হয়েছে।
দুর্নীতির কাছে আইন পরাজিত
বিআরটিএ অত্যন্ত হাস্যকর মানের ড্রাইভিং পরীক্ষা নিয়ে লাইসেন্স দিয়ে থাকে, যা এখনো ঘুষের বিনিময়ে পাওয়া যায়। বিআরটিএর গাড়ির ফিটনেস যাচাই মান ভয়ংকর পর্যায়ের নিম্ন। এই ধরনের মানহীন ফিটনেস পরীক্ষার কোনো সুফল নেই। তবে এর বাইরেও কিছু পরোক্ষ ব্যাপার আছে, যা একেবারেই অনালোচিত। এ রকম তিনটি ব্যাপার হলো:
১. যাত্রী ও পণ্যবাহী প্রতিটি বাহনে ব্যাপক চাঁদাবাজি। এর কারণে কম ট্রিপে অনিরাপদ সড়কে বেশি মাল ও যাত্রী পরিবহনের ঝোঁক প্রাধান্য পায়। (উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৭ জুলাই একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বলছে, দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যেতে ৪৩৯ কিলোমিটার চলতে একটি ১০ টনের পণ্যবাহী ট্রাকে ২২ হাজার টাকা শুধু চাঁদাবাজিহয়। পাঁচ বছর পর অঙ্কটা আরও বাড়ার কথা।) এটাই নৌপরিবহনমন্ত্রীর ক্ষমতার উৎস। এই চাঁদার আনুপাতিক হার চলে যায় নেতা, এমপি, মন্ত্রীদের পকেটে। আর পরিবহন খাতটা তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকায় বিশাল শ্রমিক বাহিনীকে জিম্মি করে তিনি সরকারের কাছেও অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন।
গত পাঁচ বছর পর অঙ্কটা আরও অনেক বেড়েছে।
২. দুর্নীতি ও অধিক চুরি নিশ্চিত করতে সড়কের লেন চুরি হয়েছে সর্বকালেই। বড় বড় আধুনিক যাত্রী ও পণ্যবাহী বাস-ট্রাকের উপযোগী লেনের স্পেস এবং ভার বহন সক্ষমতা কম। প্রয়োজনের সঙ্গে সমন্বয় করে রাস্তায় প্রশস্ত লেন, সহনীয় বাঁক, সমতল পিঠ নির্মাণ করা হয় না। রাস্তার বাঁক বৈজ্ঞানিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি, নেই সঠিক ও পর্যাপ্ত সড়ক সংকেত। নির্মাণসামগ্রী নিম্নমানের, পিচে নিম্নমানের বিটুমিন দেওয়া হয়, যাও আনুপাতিক হারে দেওয়া হয় না। অতি নিম্নমানের ইট ব্যবহৃত হয়। অতি চুরির কারণে রাস্তায় গর্ত হয় প্রচুর, রাস্তার উপরিতল বেশ উঁচু-নিচু। মহাসড়কে ঢোকা ও বের হওয়ার জন্য আলাদা লেন নেই, রাস্তায় সার্ভিস লেন নেই, নেই বাস বা ট্রাকের স্ট্যান্ড, একেবারে সাইডের লেন ওঠানামার জন্য প্রশস্ত নয়। নেই নিম্নগতির বাহনের জন্য আলাদা রাস্তা, চুরি করতে গিয়ে রাস্তা প্রশস্ত না করে হাঁটার জায়গাও পিচঢালা পথে দখল হয়ে পড়ে।
৩. সড়ক ধারণ ক্ষমতার ধারণা বাস্তবায়িত নয় একেবারেই। যেনতেন মানের ইট ও বালু দিয়ে ১, ৩ ও সর্বোচ্চ ৫ টন ধারণ ক্ষমতার যানবাহনের জন্য সড়ক বানানো হয়, অথচ টাটার ট্রাকই ১৫ টন বহনে সক্ষম। রাস্তায় জ্যাম, সেতুতে টোলের কারণে ট্রাকচালক ও মালিক ৫ টনের কথা বলে ১২ থেকে ১৫ টন বহন করেন। এটা মালিক-চালকের একতরফা সমস্যা নয়, বরং অদূরদর্শী অবকাঠামো, বাস্তবায়নকারীদের চুরি ও ব্যক্তির ব্যবসায়িক লাভের চাহিদা ইত্যাদি বহুমাত্রিক হীনতার প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক আচরণের মিশ্রণ। যানবাহনের ভারের অনুপাতে ভিত্তি তৈরি না থাকার ফলে পিচের নিচের মাটি উঁচু-নিচু হয়ে ও বড় বড় গর্ত তৈরি করে মরণফাঁদ তৈরি করে রাস্তায় রাস্তায়।
এই লেইনের রাস্তা ও বেপারোয়া গতি
আন্তঃ জেলা, আন্তঃ বিভাগ সহও থানা গুলোকে কানেক্টেড প্রায় সব সড়কই ডিভাইডারহীন, বহু জেলা এবং থানা সড়ক মাত্র ১ লেইনের। রাস্তার ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি যান থাকায় ওভার টেকিং এ চালক খুবই কম সময় এবং স্পেইস পেয়ে থাকে। ডিভাইডারহীন সংকীর্ণ সড়কে ওভারটেকিং বিপদজনক সত্ত্বেও সময়কে বীট করতে গিয়ে বহু মুখোমুখি সংঘর্ষে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে লেইনের প্রস্থ কম হবার কারনে আধুনিক বড় বড় বাস ট্রাকের বেলায় দেখা যায় বিপরীতমূখী ২টি বাস ট্রাককে ডিভাইডারহীন সড়কে অতি নিন্ম সেইফটি মার্জিনে ওভার টেইক করতে হয়, এতে একই রাস্তায় চলা কম গতির বাহন (নসিমন-করিমন-টেম্পু, মটর বাইক) আঘাত প্রাপ্ত হয়। এর বাইরে রাস্তার মান ও সক্ষমতার সাথে গতিসীমা সমন্বিত না থাকায় বেপারোয়া গতির যান নিয়মিতই দুর্ঘটনা ঘটায়।
সড়ক বনায়নের ঝুঁকি পুর্ণ দিক
রাস্তার পাশে সড়ক বনায়ন হয়েছে এমন গাছে যার প্রধান মূল ছিল না (নার্সারির নন টেকসই চারা উৎপাদন), ফলে ঝড়ে এইসব গাছ উপড়ে পড়ে। উপরন্তু বন বিভাগ সড়ক গাছের পুরানো বা আধা ভাঙা ঢাল কাটিয়ে সরানোর রুটিন কাজ করে না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে।
সিট বেল্ট না থাকার ও না পড়ার হীন সংস্কৃতি
স্বল্প কিংবা দূরপাল্লার কোন যাত্রী বা পণ্য বাহী বাস ট্রাকেই এখনও সীট বেল্ট বাঁধার আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করা হয়নি, কোন পর্যায়ের যাত্রীবাহী যানেই সিটবেল্ট ব্যবহারও করা হয় না। এই কালচারই দেশে নেই। অধিকাংশ বাসে সিটবেলেটই নেই ফলে দুর্ঘটনা মানেই বহু প্রাণহানি।
চালকেরাও ভালো নেই
ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদানের স্টান্ডার্ড অনলাইন-অফলাইন কোর্স কারিকুলাম, শিক্ষণপদ্ধতি, বেসরকারি এজেন্টভিত্তিক প্রক্রিয়া প্রণয়ন করা করা হয়নি, করা হয়নি মানসম্মত পরীক্ষাপদ্ধতি প্রবর্তন। শিক্ষাহীন, কর্মহীন কিশোর-যুবক দীর্ঘদিন হেলপারি করে পেটেভাতে ঠেলা-গুঁতা খেয়ে ড্রাইভিং শেখে, কিন্তু রাস্তার সংকেত বোঝার বাধ্যবাধকতা তার থাকে না। অর্থাৎ অতি নিম্নমানের রাস্তায় অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা নেওয়া চালক নিজেও বড্ড নিরাপত্তা ঝুঁকিতে গাড়ি চালান।
জ্যামের বিপরীতে লাভের আর্থিক চাপ
যানজটে ব্যয়িত হয় অনেক শ্রমঘণ্টা এবং নষ্ট হয় পণ্য। ফলে একই পরিবহন (বাস, ট্রাক) দিয়ে চাঁদাবাজি এবং যানজটে ব্যয়িত ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নির্দিষ্ট সময়ে বেশি ট্রিপ দিতে বাধ্য হন চালক। এতে করে এমনিতেই অনিরাপদ সড়কে যেনতেনভাবে ফিটনেসহীন গাড়ি চালিয়ে, একটানা অতি সময় ঘুমহীন শ্রান্তভ্রান্ত চালককে গন্তব্যে পৌঁছার আর্থিক, মানসিক ও স্বাস্থ্যগত তাড়নাগুলো তাড়িয়ে বেড়ায়। পরিবহনশ্রমিকেরা ব্যাপক গরম, দীর্ঘ যানজট, অধিক ট্রিপের বাধ্যবাধকতা, অনিয়মিত কিংবা স্বল্প আহার, মালিকের গালিগালাজ, যাত্রীর ভিড় ও ভাড়াসংক্রান্ত টানাপোড়েন, অধিক ভাড়া আদায়ের চাপে ফলে হররোজ লম্বা সময়ের অবসরহীন একটানা পরিশ্রমের ক্লান্তি দূর করতে ব্যাপকভাবে মাদক ও ইয়াবার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। সব মিলে আমাদের সড়ক প্রাণহানির এক সাক্ষাৎ উপকরণ। নাগরিক যেন জান হাতে নিয়ে যানে ওঠেন।
চালকের নিয়ম ও শৃঙ্খলা বিধান নেই। চালক মোবাইল ফোনে কথা বলেন অবিরত! ধূমপান করেন ড্রাভিং অবস্থায়। অবিরত কথা বলে চলেন হেল্পার ও কন্ডাক্টরের সাথে।
স্পীড মিটার ট্যাম্পার্ড (গভর্নেন্স) করা থাকে
নিন্ম মান ও মেইন্টেইনেন্স হীন যানবাহনের স্পীড মিটার ট্যাম্পার্ড (গভর্নেন্স) করা থাকে। ফলে চালক গাড়ীর সক্ষম সীমার বাইরেও বেপারোয়া স্পীড তোলে এবং গাড়ী নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মুখোমুখি সংঘর্ষ তৈরি করে বা রাস্তার পাশের গাছে বা খাদে পড়ে।
ফলে মাফিয়া গিরি, দুর্নীতি, লূট এবং বহু কারিগরি ত্রুটির কারনে আমাদের রাস্তা মরণ ফাঁদ।
রাস্তা মানুষের অর্থনোইতিক কর্মকান্ডের অনুষঙ্গ
রাস্তা বাজার বসার বড় স্পেইস। মিছিল মিটিং সহ রাজনৈতিক কর্মকান্ড রাস্তা কেন্দ্রিক।ঠিক ঠাক জেব্রা ক্রসিং নাই। এখানে নাগরিক মাল রাখে, উঠা নামা করায়। গরু চরায়, খড় শুঁকায়, আড্ডা দেয়, ফোনে কথা বলে। রাস্তা পারাপারে কোন নিয়ম নেই।
ঠিক রাস্তার উপরেই বসে হাট-বাজার-দোকান-টেম্পু ও স্থানীয় পরিবহনের স্ট্যান্ড। রাস্তা পারাপারে কোন নিয়ম প্রতিষ্ঠা পায়নি দেশে (ফুট ওভারব্রীজ অপর্যাপ্ত, থাকলেও সেটা ব্যবহার না করে হুট করে সড়ক পার হবার প্রবনতা প্রবল)। ফলে নন টেকনিক্যাল কারনেও রাস্তায় দুর্ঘটনার মিছিল।
পর্যবেক্ষন সহ সুনির্দিস্ট নির্দেশনা হীন অন্যায্য বিচারকি কাঠামো
সড়ক আইনে চালকের সর্বোচ্চ শাস্তি কয়েক বছরের সাজা এবং যৎসামান্য কিছু অর্থদন্ড। এই সাজা বাস্তবে কয়েক মাস যেহেতু আদালতের বছর গুনা হয় কয়েক মাসের হিসেবে, আবার ঘুষ খেয়ে নিয়মানুবর্তী ও বাধ্য দেখিয়ে এটাও এক তৃতীয়াংশ হয়ে পড়ে, তার উপর সাজা মওকুফের নির্বাহি ক্ষমতাও আছে। বিচারের দীর্ঘসুত্রীতা তো আছেই। দেখা যায় একজন বিশিষ্ট নাগরিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে বা চাঞ্চল্যকর কিছু হলেই আদালত দৃষ্টান্ত মূলক ভাবে চালককে কিছু শাস্তি দেন। (যা নাগরিকভেদে আইনের শাসনকে অসম ভাবে প্রমোট করছে), আদতে অনিরাপদ সড়কে লাশের মিছিল কমাতে এই ধরনের লোক দেখানো বিচারকি আদৌ ভূমিকা রাখছে না। কারণ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অদক্ষ চালক, বেপারোয়া পরিবহণ চাঁদা, মাফিয়া দুর্বিত্তপনা এবং আরো কিছু কারিগরি ও আর্থ সামাজিক ব্যবপার আছে যা আদালতকে গভীরে গিয়ে বুঝতে হবে। তাই আমরা বলছি চাঞ্চল্যকর অথবা ধরা খেয়ে একটি বিশেষ দুর্ঘটনা বা সেলিব্রেটি কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরে কিছু করার চাইতে আদালত প্রকৃত কারণ খুঁজে তার সমাধান বের করতে নির্বাহী বিভাগকে টেকসই পর্যবেক্ষন সহ সুনির্দিস্ট নির্দেশনা দিক।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) একটি সমীক্ষা বলছে, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য, আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। ঘণ্টায় মাত্র সাত কিলোমিটার গড় গতিবেগের রাজধানীতেও আশঙ্কাজনক হারে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে, কোনো হিসাবেই এমন জ্যাম ও এমন নিম্নগতির রাস্তায় প্রাণহানি তৈরির মতো দুর্ঘটনা হওয়ার কথা নয়।
আজকের অনিরাপদ সড়ক ও মৃত্যুর মিছিল বিচ্ছিন্ন নয় বরং বহু নৈরাজ্যের ফসল। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নৈরাজ্যতন্ত্র ও বেশুমার দুর্বৃত্তপনার কাছে সড়ক পরিবহন খাতের সব ব্যবস্থাপনা হেরে গেছে, তারই প্রতিচিত্র আমাদের রাস্তার মৃত্যুর মিছিলগুলো।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০১৮ রাত ২:২৭