বয়স ও শিক্ষা শ্রেণীর সংঘাত, শিশুশ্রমে আইনগত উৎসাহ
স্বাভাবিকভাবেই বলা হয়েছে গাড়ি চালানোর জন্য বয়স অন্তত ১৮ বছর হতে হবে। আগের নিয়মেও তা-ই ছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে অষ্টম শ্রেণী পাস করতে হবে। এতে দেশের মানবসম্পদ ব্যবস্থার কৌশলগত সমস্যা সৃষ্টি করা হয়েছে। একজন নাগরিক যেখানে ১২ থেকে সর্বোচ্চ ১৪ বছর বয়সেই অষ্টম শ্রেণী পাস করে, সেখানে পেশায় চালক হতে চাইলে তাকে ১৮ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তার জীবনের এ চার থেকে ছয় বছরের কর্মহীনতা ও আইনগত বেহিসাবের দায় কে নেবে?
নতুন আইনে বলা হয়েছে, চালকের সহকারীকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে। টেকসই মানবসম্পদ উন্নয়নের কৌশলগত লক্ষ্য হিসেবে আমরা দাবি করে আসছি বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বর্ধিত করার (যদিও দ্বাদশ পর্যন্ত ১৮ বছর বা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার মৌলিক সুবিধা নিশ্চিত করার দায় আছে রাষ্ট্রের)। অথচ একটা নতুন আইনে মাত্র পঞ্চম শ্রেণীর পরেই শিক্ষার্থীকে স্থায়ীভাবে কাজে উন্মুক্ত করার (শিশুশ্রম) আয়োজন করা হয়েছে। স্কুলকালীন বয়সে হেলপার হওয়া এ শিশু শ্রমিক কীভাবে চালক হতে শিক্ষাকে এগিয়ে নেবে? আসলে আইনটা একেবারেই একটা অদক্ষ মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্ম দেবে। এতে শিশুশ্রম ও দুর্নীতিকে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। বর্তমানের লাখ লাখ চালক, যাদের অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তাদেরও ভুয়া ও জাল শিক্ষা সনদ নেয়ার বাধ্যবাধকতা তৈরি করেছে। তৈরি করেছে নতুন আরেকটা ঘুষের শাখা। নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের এ ধরনের সস্তা ও উদ্দেশ্যহীন আইন তৈরির দৃষ্টান্তে খুবই লজ্জা বোধ করছি।
সাজার অসামঞ্জস্য
ক. বলা হয়েছে লাইসেন্সহীন চালকের সাজা ছয় মাস, আর জাল লাইসেন্সধারীর সাজা দুই মাস; যা বড়ই অবাক করার ব্যাপার। জাল লাইসেন্সধারী প্রথমত. লাইসেন্স ছাড়া চালনার অপরাধ এবং দ্বিতীয়ত. জাল লাইসেন্স বানানোর মতো আরেকটি বড় অপরাধে দায়ী হয়ে বেশি সাজা পাওয়ার কথা। এ আইন জাল লাইসেন্স বানানোর চক্রকে উৎসাহ দেবে।
খ. নতুন আইনে সাজার মেয়াদ নির্ধারণ করে দেয়া হলেও অর্থদণ্ড নির্ধারণ করা হয়নি জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘সিচুয়েশেনের ওপর নির্ভর করে অর্থদণ্ডের পরিমাণ নির্ধারণ করতে পারবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।’ একদিকে বাংলাদেশে জেল বছর ছোট, আসামিকে সুবোধ দেখিয়ে সাজা কমানোর ব্যবস্থা আছে, আবার আছে যেকোনো সাজা মওকুফের নির্বাহী ক্ষমতা। অন্যদিকে অনির্ধারিত অর্থদণ্ড রেখে ঘুষ-দুর্নীতি সহযোগে চালক ও মালিকপক্ষের একচেটিয়া সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।
গ. দুর্নীতি ও লুটের মডেলে বাস্তবায়িত অতি নিম্নমান রাস্তা, লাইসেন্সহীন অযোগ্য চালক, রাস্তার মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন বেপারোয়া গতি, ফিটনেসহীন ও দুর্ঘটনাপ্রবণ ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি, একই গাড়ির বিরামহীন চালনা, বেপরোয়া লাভে অধিক যাত্রী ও পণ্য বহনে মালিকপক্ষের চাপ, মাফিয়া রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঠিক রাস্তার উপরেই গড়ে ওঠা বৈধ-অবৈধ ব্যবসা, রাস্তা ব্যবহারের নাগরিক নৈরাজ্যসহ বহু কারণে সড়ক পরিবহন হয়েছে মরণফাঁদ। অথচ আইনে এসব পক্ষকে অব্যাহতি দিয়ে শুধু চালকের শাস্তির কথা বলা হয়েছে, যা অন্যায্য ও অগ্রহণযোগ্য। আবার দেখা যাচ্ছে, চালক ও হেলপারের দৈনিক সর্বোচ্চ শ্রমঘণ্টার বিধান, এমনকি পরিবহনের দৈনিক সর্বোচ্চ কর্মঘণ্টার বিধানও রাখা হয়নি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিষয়বস্তুর দিক থেকে আইনটি কাঠামোগতভাবেই ত্রুটিপূর্ণ।
লাইসেন্স ব্যবস্থাপনা— ড্রাইভিং শিক্ষা ও লাইসেন্স প্রাপ্তিকে সহজ, সাশ্রয়ী ও প্রতিষ্ঠানগত ভিত্তি না দেয়া
দরকার ছিল অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাধ্যতামূলক শিক্ষার সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে আইনি কাঠামো তৈরি করা আর ড্রাইভিং শিক্ষা ও লাইসেন্স প্রাপ্তিকে সহজ, সাশ্রয়ী ও প্রতিষ্ঠানগত ভিত্তি দেয়া। দেশীয় রাস্তার সাইন ও কারিগরি ব্যবস্থার আলোকে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের মানসম্পন্ন অনলাইন-অফলাইন কারিকুলাম, শিক্ষণ পদ্ধতি নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, রাস্তায় সাইনই নেই খুব একটা, নেই মোড়গুলোর প্রায়োরিটি নির্দেশনা, নেই গতি ব্যবস্থাপনা, নেই সার্ভিস লেন, মহাসড়কে ঢোকার বা বের হওয়ার লেন নেই, এমনকি নেই লেন পার্থক্যকারী লেনও; নেই ওভারটেক রেখাও। আইনে এ কারিগরি ব্যবস্থাপনাগুলো নিশ্চিত করার কথা বলা হয়নি। আইনে নেই তাত্ত্বিক (থিউরি) অনলাইন পরীক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তনের কথা। বেসরকারি এজেন্ট ও তৃতীয় পক্ষের যাচাইসাপেক্ষে ব্যবহারিক পরীক্ষা কাঠামো করা নিয়ে কোনো নির্দেশনা নেই আইনে।
অথচ বয়স ও শিক্ষা শ্রেণী বেঁধে দেয়ার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষা নেয়ার প্রযুক্তিগত স্বয়ংসম্পূর্ণ কাঠামো তৈরি করা (এবং সেই অনুযায়ী শিক্ষা কোর্স সাজানো)। আধুনিক ড্রাইভিং কোর্সে অন্তত চারটি বিষয়ে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষাদান ও মূল্যায়নের বিধান রাখা হয়। ক. সড়ক নিরাপত্তার ধারণা (রোড সেফটি) খ. ট্রাফিক সাইন ও সংকেত গ. প্রায়োরিটি (যেমন— ১. সবার আগে পথচারী, তারপর ইঞ্জিনবিহীন যান, তারপর গণপরিবহন এবং সব শেষে যাত্রী ও পণ্যবাহী। ২. তিন, চার বা পাঁচ রাস্তার মোড়ের প্রায়োরিটি) ঘ. গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ ও সমস্যা সমাধান (হ্যাজার্ড প্রটেকশন— ব্রেক ও এক্সিলারেশনের ব্যবহার)।
অন্যদিকে যানবাহনের ফিটনেস যাচাইয়ে কী কী পয়েন্ট বাধ্যবাধক থাকবে এবং দেশে কী কী পয়েন্টে অপরাধ ঘটে (যেমন স্পিড গভর্ন্যান্স মিটার টেম্পারিং, যানবাহনের উচ্চগতিসীমার সক্ষমতা, বয়স লুকানো) তা নিয়েও কোনো নির্দেশনা নেই। অর্থাৎ কাজের কাজ না করে করা হয়েছে ফাঁকফোকরে ভরা জোড়াতালির আইন। অর্থাৎ লাইসেন্স প্রদানের মাফিয়া চক্রকে উপড়ে ফেলে একটি সুন্দর স্বচ্ছ ও আধুনিক ব্যবস্থাপনা কাঠামো তৈরিতে আইনটির কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
আইনের নিয়ন্ত্রণ ও প্রয়োগ কাঠামো আস্থাহীন
মোটরযান চালনাজনিত কোনো দুর্ঘটনায় গুরুতরভাবে কোনো ব্যক্তি আহত বা প্রাণহানি ঘটলে তা ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩০২ ও ৩০৪ ধারা অনুযায়ী অপরাধ বলে গণ্য হবে বলা হয়েছে। কিন্তু দণ্ডবিধির কোন ধারায় মামলা হবে তদন্ত কর্মকর্তা তা সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে নির্ধারণ করবেন। দুর্নীতি-ঘুষ ও তদবিরভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো এবং দুর্বৃত্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতির দেশে সড়কে অবিচার ও নৈরাজ্য জারি রাখার এটাই মূল আইনি পয়েন্ট। অতীত ও বর্তমান দেখে কোনোভাবেই এ আশা রাখা যায় না যে, তদন্ত কর্মকর্তা যথেষ্ট সৎ হয়ে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। ধর্ষণ মামলায় সর্বদাই যেমন মেয়েটির সম্মতি দেখানোর চেষ্টা হয়, তেমনি সড়কে সব অপমৃত্যুই শুধু ‘দুর্ঘটনা’ হয়ে উঠবে এ আইনে।
আইনের প্রায়োগিক দিককে স্বচ্ছ রাখতে, পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন আর মালিক সমিতির কাউকে সরকার ও সংসদীয় কমিটিতে রাখা যাবে না। এতে ক্ষমতার সংঘাত ও অবৈধ প্রভাববলয় তৈরি হবে। শ্রমিক ও মালিকের প্রতিনিধি যিনি, তাদের স্বার্থ দেখবেন তিনিই, যদি সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন তাহলে কোনো আইনই আর কাজ করবে না। তাই এ দিকগুলো সড়ক আইনে বিবেচনায় নিয়ে আসতে হবে।
প্রায় দুই যুগ ধরে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত দেশের প্রায় সব সম্মানিত নাগরিক পরামর্শ দিয়েছেন দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ির ফিটনেস যাচাই, দুর্ঘটনার তদন্ত ও মামলা দায়েরে শুধু ‘তদন্ত কর্মকর্তা’র ইচ্ছানির্ভর দুর্নীতি সহায়ক অবিচারের ব্যবস্থা বহাল না রেখে সেখানে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞ ও পেশাজীবীদের (সাবজেক্ট ম্যাটার এক্সপার্টদের) ভেটো ক্ষমতাসহ সংযুক্তি করার যৌক্তিক বিষয়ে। সাজা নির্ধারণেও মানা হয়নি নাগরিক দাবি।
মাত্র কয়েক মাস আগে পাস হওয়া বিতর্কিত ৫৭ ধারায় শুধু সামাজিক মাধ্যমে কটূক্তিকে অপরাধ বিবেচনা করে সর্বোচ্চ ১৪ বছর ও সর্বনিম্ন সাত বছর কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেয়ার বিধান আনা হয়েছে। আর একই সরকারেরই একটি নতুন আইনে সড়কে প্রাণহানিতে প্রতারণাপূর্ণ আইনি কৌশলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের শাস্তি এবং অনির্ধারিত অর্থদণ্ড রাখা হয়েছে। শাসকদের রাজনীতি সুরক্ষার বিপরীতে নাগরিকের প্রাণ সুরক্ষার দাম এতই নিতান্ত এ দেশে।
সব মিলিয়ে আমরা দেখছি, নাগরিক মতামতকে চূড়ান্তভাবে তাচ্ছিল্য দেখিয়ে একটি ইচ্ছাকৃত ভুলে ভরা দুর্নীতিপ্রবণ দায়সারা ও লোক দেখানো আইন প্রস্তাবনা করা হয়েছে। হলফ করে বলা যায়, এ আইন নৈরাজ্য থামিয়ে সড়ক নিরাপদ করতে কোনোই ভূমিকা রাখবে না।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই আগস্ট, ২০১৮ দুপুর ২:০৪