somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিশুদের নববর্ষ যখন বড়দের লজ্জা দেয় (সংগৃহীত)

১৮ ই এপ্রিল, ২০১১ সকাল ১০:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এ লেখাটি ইংরেজিতে যাকে বলে ‘গল্পের চেয়েও আশ্চর্য’ সত্য একটি ঘটনা নিয়ে। শোনার পর দুই দিন শুধু এটাকে ভুলে যেতে চেষ্টা করেছি—কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। ভাবলাম, লিখে না ফেললে এ আমাকে মুক্তি দেবে না। তাই ১০০ ডিগ্রি জ্বর নিয়েই লিখতে বসেছি। আমি চাই, এই ঘটনা সবাই জানুক—সারা বিশ্ব জানুক—সারা বাংলাদেশ জানুক—যদি অবশ্য বাংলাদেশের চেতনা এত দিনে একদমই অসংবেদনশীল প্রাণহীন ভোঁতা সত্তায় পরিণত না হয়ে গিয়ে থাকে।
ঘটনাটি আমাকে যিনি বলেছেন তিনি খুবই দুঃখের এবং লজ্জার সঙ্গে বলেছেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে ঘটনাটি আনন্দের এবং গর্বের। দুই মিনিটেরও কম একটি মুঠোফোন সংলাপে গল্পটা বলে তিনি যোগ করেছেন, ‘যদিও এর কোনো প্রচার হবে না—প্রচার দরকারও নেই আমাদের—আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাব। কাজটাতেই আমাদের আনন্দ।’ কিন্তু আমি মনে করি, এর প্রচার হওয়া উচিত। গল্পটি ছোটও বটে কিন্তু এর বিস্তার অনেক। মন স্পর্শ করে যায়। এবার আসল ঘটনায় আসা যাক। পয়লা বৈশাখ বাঙালির বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। ধর্ম-শ্রেণীনির্বিশেষে এ রকম মিলনমেলা বাঙালির আরেকটি আছে বলে আমার মনে হয় না। সকালবেলা ঘর থেকে বের হলেই মনটা ভরে ওঠে। নতুন কাপড়-চোপড় পরে, মাথায় নানা বর্ণের ফুল গুঁজে, শিশুদের হাতে ঘূর্ণিপাংখা বা ডুগডুগি দিয়ে জোড়ায় জোড়ায় দম্পতি শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে ধেয়ে আসে। দেখলে মনে হয়, বাঙালিরা তো অন্তত একদিন হলেও জেগে উঠেছে। সকালবেলাতেই ‘মেসেজে-মেসেজে’ (ইংরেজি হরফে কিন্তু বাংলায়) টেলিফোন জ্যাম হয়ে যায়। উৎসাহী বন্ধু ফোন করে জানায়, এবার বাঙালি খেপে গেছে—‘আলিশান’ বাড়ির ছাদগুলোয় পর্যন্ত চাঁদোয়া টানিয়ে পয়লা বৈশাখ হচ্ছে। সারা দিন রমনা বটমূলে, ভার্সিটিপাড়ায়, রবীন্দ্রসরোবরে চলতে থাকে গান-আবৃত্তি-নাটক-নৌকাবাইচ। মনে হয়, সারা শহরটা যেন একটা সাতরঙা রংধনুতে পরিণত হয়েছে। অবশ্য ভিড়টা আর গরমটা অসহ্য। তবু অন্তরের টানে তা অতিক্রম করে মানুষ আসে। দলে দলে। অসংখ্য অজস্র। এত অনুষ্ঠানের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া একটি অসাধারণ অনুষ্ঠানের ঘটনা বলছি। প্রতি বড় শহরে রয়েছে একটি অলিখিত ভাগ। নিম্নবিত্ত জনগণের থাকার জায়গাটার নামই হয়ে গেছে ‘ডাউনটাউন’ আর উচ্চবিত্তদের থাকার জায়গাটার নাম ‘সাবার্ব’। ঢাকায় অবস্থাটা এখনো ঠিক তীক্ষভাবে এ রকম নয়। উচ্চবিত্তদের গুলশান বারিধারাতেও এখন আস্তে আস্তে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তরা হানা দিচ্ছে—উপচে পড়ছে মানুষের ভিড়। প্রতিদিন মূল শহরে ঢোকার পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তীব্র যানজটের সমস্যা তো রয়েছেই। সেই তুলনায় পুরান ঢাকা বেশ অপরিচ্ছন্ন ও ঘিঞ্জি হলেও সেখানে সব সময় চলছে রিকশা এবং হাঁটা পায়ের মানুষ। ধীরেসুস্থেই মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে—একে অন্যকে সম্ভাষণ করছে—হাসিমুখে হেঁটে গন্তব্যস্থলে চলে যাচ্ছে। তবে এর পরও পুরান ঢাকার কেউ কেউ যথেষ্ট সচ্ছল হয়েও বেছে নিয়েছেন পুরান ঢাকাকেই। অন্তরের মমতা নিয়ে শত অসুবিধা সত্ত্বেও সেখানেই থেকে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। এদিকে নতুন বিত্তশালী ঢাকার যে জৌলুশ, তার নিচেই ক্রমে ক্রমে জমা হয়েছে বিত্তের-অহংকারের পাশাপাশি আরও অনেক অন্ধকার। বিদেশি সংস্কৃতি ও ইয়াবা এখানে হানা দিয়েছে সদলবলে। নৃশংস খুন, পরস্পর বিচ্ছিন্নতা এবং মিথ্যা আড়ম্বরের প্রতিযোগিতাই মুখ্য হয়ে উঠছে দিনে দিনে। এত সব অন্ধকারের মধ্যে একটি ‘অন্ধকার’ হচ্ছে এখানকার ‘পথশিশুরা’, যাদের কাব্যিক নাম দেওয়া হয়েছে ‘পথকলি’। কিন্তু আমি আজকে যে ঘটনাটির বর্ণনা দেব, তা প্রমাণ করে যে অন্ধকারের মধ্যেই সবচেয়ে নির্মল আলোটি লুকিয়ে থাকে। তাকে চিনতে হয়।
মনে করুন, ঢাকার অভিজাত এলাকার কতিপয় সমাজমনস্ক তরুণ প্রতিদিন গাড়িতে করে যখন শহরে প্রবেশ করেন, তখন দেখেন ভিড়ে গাড়ি থামলেই কতগুলো শীর্ণকায় শিশু এসে গাড়ি ঘিরে ধরে। কারও হাতে ‘পপকর্ন’, করেও হাতে ‘একগুচ্ছ রজনীগন্ধা’, কেউ নিছক একটি ‘কাপড়’ নিয়ে গাড়ির কাচ পরিষ্কার করতে লেগে যায়। পাঁচ থেকে ১২ বছর বয়স্ক এই শিশুগুলোই হচ্ছে এলাকার পথশিশু। অভিজাতপাড়ার গাড়ি বারান্দায় বা পথেই এরা বাস করে। এবং এভাবে উপার্জন বা দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করেই এরা বেঁচে থাকে। এদেরই রনবী তাঁর স্নিগ্ধ তুলিতে বুদ্ধিমান টোকাইয়ের মর্যাদা দিয়েছেন। অধিকাংশ ব্যস্ত ‘এন্ট্রাপ্রেনার’ বা উদ্যোক্তারা এ বিষয়ে দ্বিতীয়বার চিন্তা করার বা নজর দেওয়ার সময় পান না। তবে তাঁদের পাশেই বসে থাকা তরুণী স্ত্রী বা মায়েদের মনটা এখনো এতটা ব্যস্ত না থাকায় কিছুটা বিষণ্নতায় ভরে ওঠে। হয়তো তিনি তাঁর নিজের শিশুটির সঙ্গে এই শিশুটির তুলনা করেন। মরমে মরে যান। অস্থির হয়ে ভাবেন—কীভাবে আমি দুুপুর বেলায় এদের কথা ভারতে ভারতে চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় খাব! অবশ্য মনের আবেগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুটি টাকা প্রদানের মাধ্যমে আস্তে আস্তে প্রশমিত হয়ে যায়। দানের মাধ্যমে তিনি নিস্তার পান।
কিন্তু এবার পয়লা বৈশাখে ঘটনাটা ঘটল অন্য রকম। সেই উচ্চবিত্ত সমাজমনস্ক পরিবারগুলো স্থির করল যে তাদের যে প্রায় এক শ পথশিশুর একটি স্থানীয় নাইটস্কুল আছে, যেখানে তারা নিজেরাই অবসর সময়ে তাদের পড়ায়, সেই পথশিশুদের নিয়েই সম্মিলিতভাবে এবার তারা ভোরবেলায় পয়লা বৈশাখের মিছিল করবে। আসুক না আসুক এলাকার মান্যগণ্যদের শিশুদেরও মিছিলে থাকার অনুরোধ করবে। এ যেন প্রকৃত শ্রেণীহীন এক পয়লা বৈশাখের আয়োজন এবং যাদের ঘিরে তা হতে যাচ্ছে, তারা সবাই মানুষের সন্তান—এই তাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়। চিন্তা করে দেখুন, সেই শিশুরা এ খবরটা পেয়ে কী আনন্দই না পেয়েছিল। ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভাঙার’ গান আমরা শুনেছি কিন্তু সেদিন ভোরবেলায় শিশুদের আনন্দ-হাসি-কলতানে ‘প্রাণের বাঁধ ভাঙার’ গান কেউ শুনতে চাইলে সেই মিছিলে থাকতে হতো। গল্প কি শুধু এটুকুই? না এটুকু নয়। আসল পর্বটা এখন আমি তুলে ধরছি।
১০০ জন শিশুর জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজকেরা ১০০টি রঙিন মুখোশ বানিয়েছিল। সঙ্গে হয়তো আরও অপেক্ষাকৃত কম দামি বেলুন, পতাকা, খেলনার আয়োজন ছিল। ছিল মিষ্টিমুখের ব্যবস্থা, যা হয়, সেদিন বাচ্চারা এসেই খেলনা ও মুখোশগুলো নেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিল। ওদের যিনি প্রধান শিক্ষিকা, তিনি ওদের ডেকে প্রথমে স্থির হতে বললেন। তারপর বললেন, ‘দেখো বাবুরা, আমরা আগামী বছরও এই উৎসব আবার করতে চাই। সে জন্য বড় দামি মুখোশগুলো আরেকবার বানানো যাবে না। আর তোমরাও তা রক্ষা করতে পারবে না। তাই মিছিল শেষ হলে মুখোশগুলো যথাস্থানে জমা দিয়ে যাবে।’ সব শিশুই সানন্দে উচ্চ স্বরে ‘হ্যাঁ’ বলে উঠল।
আমি আমার গল্পের শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেছি। সেদিন মিছিল শেষে গুনে গুনে ৮৫টি মুখোশ উদ্যোক্তাদের হাতে ৮৫ জন পথশিশু জমা দিয়েছিল। যে ১৫টি পাওয়া যায়নি, তা সম্ভবত বাইরের অংশগ্রহণকারীরা নিয়ে গিয়েছিল। তারা এই মুখোশ জমাদানের তাৎপর্যই হয়তো অনুভব করেনি।
গল্পটা শুনে আমি ভেবেছি, ছোট ‘পথশিশুদের’ যে দায়িত্ববোধ, লোভ ও আকাঙ্ক্ষা দমন করে ভবিষ্যৎ এবং সবার জন্য সহজ স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ, তা কেন বড় হলে আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যায়?
এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সুত্র
৮টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×