somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য চট্টগ্রাম...ফিরে দেখা.....

১০ ই জুলাই, ২০১০ বিকাল ৪:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শাসকদের মধ্যে বিবাদ
ভৌগোলিকভাবে হিমালয় অঞ্চল হতে দূরে দক্ষিণে শাখা প্রশাখায় বিস্তৃত পাহাড়ী এলাকা নিয়ে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার অবস্থান। আসাম ও পার্বত্য ত্রিপুরা হতে আরাকান ও বার্মার সীমান্ত পর্যন্ত। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম জেলা ছিল পার্বত্য ত্রিপুরা এবং আরাকান শাসকদের একটি বিবাদের বিষয়। আর এ কারণে এ অঞ্চলের রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা যুজা রূপা (বিরা রাজা) ৫৯০ খ্রিস্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজাকে পরাজিত করেন এবং রাঙ্গামাটিতে তার রাজধানী স্থাপন করেন। আবার ঐতিহ্যগত মতানুসারে, পার্বথ্য ত্রিপুরার রাজা উদয়গিরি কিলয় ও মংলয় নামের দু’ভাইকে রিয়াং এলাকার অফিসার-ইন-চার্জ নিয়োগ করেন। তারা মাতামুহুরী নদীর দক্ষিণে পাহাড়ী অঞ্চলে বসবাস করতেন। ৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে আরাকান রাজা সুলা সান্দ্র (Tsula Tsandra) (৯৫১-৯৫৭) বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম দখল করেন। পরবর্তীতে ১২৪০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার রাজা পুনরায় এ অঞ্চল দখল করেন।



সুলতানী আমল
সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ (১৩৩৮-৪৯) চট্টগ্রাম (সম্ভবতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের অংশসহ) জয় করেণ। ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে সুয়াং মংজিৎ আরাকানের সিংহাসন জোরপূর্বক দখল করেন এবং আরাকান রাজা মং সুয়ামন ওরয়ে ন্যারা মিখলা (১৪০৪-৩৪) কে গৌড়ের সুলতান জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ (১৪১৮-৩১)-এর দরবারে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেন। ১৪১৮ সালে চাকমা রাজা মউন স্নী বৌদ্ধ মতাদর্শের প্রতি অশ্রদ্ধা জ্ঞাপনের অভিযোগে বার্মার উর্ধাঞ্চল হতে বিতাড়িত হন। তিনি তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের আলীকদম নামক স্থানে মুসলিম অফিসারের অধীনে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং রামু ও টেকনাফে চাকমাদের বসতি স্থাপন করেন। ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে সুলতান জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহের অধীনে ওয়ালী খান নামের একজন মিলিটারী অফিসার চট্টগ্রামে নিয়োজিত থাকা কালে যখন সুয়া মংজিৎকে বিতাড়িত করে মং সুয়ামনকে আরাকানের সিংহাসন পুনরুদ্ধার করে দিতে নির্দেশিত হন, তখন তিনি গৌড়ের সুলতানের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহী হন। সুলতান জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ্ একদল সৈন্য ª্ররণ করলে তারা ওয়ালী খানকে হত্যা করে এবং আরাকান আক্রমণ করে মগ রাজা মং সুয়ামনকে আরাকারে সিংহাসন পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে।



আরাকানী আধিপত্য
রাজা গনেশ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের সর্বশেষ রাজা সুলতান শামুসদ্দিন আহমেদ শাহ (১৪৩১-৪২) আরাকান সীমান্তের দূর্গকে অতিরিক্ত সৈন্য দিয়ে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সতর্ক ছিলেন না বলে মং সুয়ামনের উত্তরসুরী মংখারী ওরফে আলী খান (১৪৩৪-৩৯) পূর্ববর্তী বছরগুলোতে মুসলিসদের নিকট হারানো রাজ্য পুনঃদখলের জন্য আক্রমণ করেন এবং চাকমাদেরকে রামু ও টেকনাথ হতে বহিস্কার করতে সক্ষম হন। এ অঞ্চল বিরোধপূর্ণ থেকে যায় এবং কয়েক বছর পর্যন্ত আরাকানীদের আধিপত্য মেনে নিতে হয়।



ইলিয়াছ শাহীর আগমন
ইলিয়াছ শাহী সুলতান রুকুনউদ্দিন বারবাক শাহ্ (১৪৫৯-৭৪) তার শাসনের শেষদিকে সেখানে শাসন ক্ষমতা পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করেন। আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ্ (১৪৯৩-১৫১৯) এর শাসন আমলে আরাকানী রাজা স্বল্প সময়ের জন্য তার রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। রাজামালার উদ্ধৃতি অনুযায়ী ত্রিপুরার রাজার সাথে হুসাইন শাহের তন্ময়তার সুযোগ নিয়েছিলেন আরাকানী রাজা। ইহা ছিল স্পষ্টরূপে আরাকানীদের বিনা উত্তেজনায় আক্রমণ, যা চিল সম্ভবতঃ যুবরাজ নুসরাতের তেৃতৃতবাধীনে সেনা অভিযান। তাকে সহায়তা করেন পরাগাল খান, যিনি পরবর্তীতে জয়লাভ করা রাজ্যের মিলিটারী গভর্ণর হয়। পরাগাল এবং তৎপরে তার পুত্র ছুটি খান দৃঢ়ভাবে আরাকানীদের দক্ষিণ দিকে তাড়িয়ে দেন। এবং ত্রিপুরার রাজার প্রতি সতর্ক নজর রাখেন। ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগীজ দূত যোয়া ডি সিলভিরো চট্টগ্রামে অবতরণ করেন এবং বন্দরটি ‘‘বাংলার রাজার’’ দখলে দেখতে পান। জয়চন্দ্র (১৪৮২-১৫৩১) নামের একজন বৌদ্ধ ধর্মালম্বী মগ চীফ চক্রশালাতে বাংলার সুলতানের করদাতা হিসাবে কর্ণফুলী ও সাঙ্গু নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে শাসন ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন।



পুনরায় আরাকানী দখল
ত্রিপুরা রাজমালা গ্রন্থ অনুসারে ধন্যা মানিক্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ত্রিপুরা রাজবংশীয় শাসন ক্ষমতা পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে আরাকান আক্রমণ করেন। কিন্তু আরাকানী মগ রাজা মিন্যাজা ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যের কিছু অংশ পুনঃ জয় করেন। একই বছরে চাকমা চীফ চনু আরাকানী মগ রাজার নিকট বশ্যতা স্বীকার করেন এবং ঐ এলাকায় আরাকানী গভর্ণর হিসেবে নিযুক্ত ধ্যারাং গিরির মাধ্যমে রাজার নিকট ২টি চুন রং করা শ্বেতহস্তী উপঢৌকন হিসাবে প্রেরণ করেন। আরাকানী রাজা সন্তুষ্ট হয়ে চাকমা রাজাকে ‘‘কুফরু’’ উপাধি প্রদান করেন এবং চাকমা রাজার কন্যাকে ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে বিয়ে গরেন। পরবর্তীতে ত্রিপুরার দেব মানিক্য আরাকানীদের হাত থেকে রাজ্যের কিছু অংশ ১৫২২ খ্রিস্টাব্দে অস্থায়ীভাবে নিয়ে যান। কিন্তু আরাকানের মিবিন ওরফে যাবুক শাহ (১৫৩১-৫৩) পুনরায় ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যের দখল গ্রহণ করেন।



শেরশাহের শাসন
শেরশাহের যুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম বন্দরটি হয়ে ওঠে পর্তূগীজ সৈন্যদের মিলনস্থল (ঘাঁটি)। শেরশাহের ডেপুটি ঐ জায়গা দখল করেন। কিন্তু তিনি নিজেই চট্টগ্রামস্থ পর্তূগীজ কলোনীর প্রধান নুন ফারনান্ডিজ ফ্রাইর কর্তৃক যুদ্ধবন্দী হয়ে যান। অবশ্য শেষ পর্যন্ত এ এলাকায় শেরশাহের শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়।



ত্রিপুরার বিজয় মাণিক্য
ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার ইতিহাসে ত্রিপুরার রাজাগণ উল্লেখযোগ্য স্থান করে নেন। ‘‘আইন-ই-আকবরী’’ তে বর্ণিত মতে, বিজয় মাণিক্য (১৫৪০-৭১) ছিলেন একজন ক্ষমতাশালী শাসক। তিনি মুসলিমদের নিকট হতে চট্টগ্রাম অঞ্চলকে পুনঃলাভ করেন। যদিও সিকান্দার শাহ্ ত্রিপুরা আক্রমণ করেন এবং রাজধানী লুন্ঠন করেন। অমর মানিক্য (১৫৭৭-৮৬) আরাকানী রাজা সিকান্দার শাহের কাছে করুণভাবে পরাজয় বরণ করেন।



আরাকানীদের অভিযান
ধারণা করা হয় যে, আরাকানী রাজা পুনরায় ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে এ জেলা আক্রমণ করেন। রাফ ফিচ ১৫৮৫ সালে লিখেছেন যে, এ জেলাটি ছিল আরাকানী রাজাদের অধীনে যারা ত্রিপযুরার রাজাদের সাথে এর আধিপত্য নিয়ে অবিরত যুদ্ধে মগ্ন থাকতেন। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার বৃহৎ অংশে সম্রাট আকবরের শাসন ক্ষমতা সম্প্রসারণের জন্য তার নামমাত্র বঙ্গ জয়ের অব্যবহিত পরে এ অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ও রাজনৈতিক জটিল অবস্থার সুযোগ নেয় আরাকানের রাজা (বাহারীস্থানে বলা হয় রাখাং)। আরাকানের রাজা মং ফালং সম্পূর্ণ চট্টগ্রাম অঞ্চলকে তার কর্তৃত্বে নিয়ে আসেন এবং নোয়াখালী ও ত্রিপুরার বৃহৎ অংশ দখল করে নেন। তার পুত্র মংখামন কয়েকবার বাংলায় সামরিক অভিযান চালায় এবং মোগলদের জন্য সে ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আরাকানী রাজা সচরাচর এক ভাই কিংবা দ্বিতীয় পুত্রকে এ জেলায় অফিসার-ইন-চার্জ নিয়োগ করতেন। ১৬০১ খ্রিষ্টাব্দে মং রাজাগ্নি আরবী, বার্মিজ ও দেবনাগরী তিনটি ভাষায় মুসলিম ও বার্মিজ পদবীসহ মুদ্রার প্রচলন করেন।




পর্তূগীজ জলদস্যু
পর্তূগীজ সমুদ্র দস্যুূরা (যাদেরকে সাধারণতঃ ফিরিঙ্গি জলদস্যু বলা হয়) আরাকানী রাজার অধিকৃত এলাকায় ২টি শক্তিশালী উপনিবেশ স্থাপন করলেও (১টি চট্টগ্রাম শহরের ২০ মাইল দক্ষিণে দিয়াংগাতে এবং অপরটি আরাকান উপকূলের সিরিয়ামে তারা পুরোপুরিভখাবে আরাকান রাজার কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। উত্তর পশ্চিমে বঙ্গদেশ এবং দক্ষিণে আরাকান রাজ্যের মধ্যবর্তী এলাকায় চট্টগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চলটির অবস্থান হওয়ায় ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের চট্টগ্রামে একটি শক্তিশালী দূর্গ ছিল এবং এখান হতে তারা দক্ষিণ ও পূর্ব বাংলার উপকূলীয় এলাকায় লুঠতরাজের জন্য অবিরত হানা দিত। দিয়াংগা ও সিরিয়ামের ফিরিঙ্গি জলদস্যুরা প্রায়শঃ তাদের রাজনৈতিক অধিস্বামী আরাকানী রাজার সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হতো।



মগদের অত্যাচার
পর্তূগীজ লুন্ঠনকারীরা চট্টগ্রাম এলাকায় স্থানীয় মগদের নিবিড় সহায়তায় বঙ্গদেশে লুঠতরাজ কাজ পরিচালনা করএতা। এই মগরা ছিল সমভাবে দক্ষতাসম্পন্ন নাবিক, নিষ্ঠুর ও দুঃসাহসী জাতি এবং তারা অনুরূপ দস্যুবৃত্তি করেই জীবিকা নির্বাহ করতো। Fathiya এর লেখক এবং ইউরোপীয় পরিব্রাজক Bernier এর লেখায় সাক্ষ্য বহন করে যে, এই আধাসভ্য মঙ্গোলীয় যাযাবরদের অদ্ভূত মুখাবয়ব, রীতি ও প্রথার জন্য এবং তারা পুনঃ পুনঃ নির্মম আক্রমণ করে জনগণের গুরুতর ক্ষতিসাধন ও নিদারুণ দুঃখ কষ্টের সৃষ্টি করতো বিধায় তাদেরকে ঘৃণার পাত্র বলে মোগল অফিসার ও বাংলার লোকেরা চিহ্নিত করেন।



মোগল আমল
১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চল আরাকানীদের দখলে ছিল। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীরের অধীনে বাংলার গভর্ণর শায়েস্তা খান আরাকান দরবার ও পর্তুগীজদের মাঝে দ্বন্দের সুযোগ নিয়ে এ অঞ্চল জয়লাভ করেন এবং ধর্মপ্রাণ সম্রাটের নির্দেশে চাঁটগার নাম পরিবর্তন করে ইসলামাবাদ রাখেন। ১৭১৫ খ্রিস্টাব্দে জালাল খাঁ রাজা হওয়ার সমতলবাসীদের সাথে পার্বত্যবাসীদের বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের মোগল প্রশাসককে ১১মণ কার্পাস তুলা দিতে চুক্তিবদ্ধ হন। কিন্তু মোগল প্রশাসকগণ পার্বত্য অঞ্চলকে তাদের নিজেদের অধীনস্থ অঞ্চল হিসেবে ‘‘কার্পাস মহল’’ নাম দিয়ে কর আদায় করতে চাইলে চাকমা রাজা কর দিতে অস্বীকার করেন এবং তিনি ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দে আরাকানে চলে যান। তবে মোগল প্রশাসককে ১৭২৪ হতে ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফতে খাঁ ১১ মণ কার্পাস কর দেন। ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দে শেরমুস্ত খাঁ কার্পাস কর দেয়ার শর্তে কোদালা, শীলক, রাঙ্গুনিয়া অঞ্চলে জমিদারী লাভ করেন। রাণী কালিন্দির মতে, রাজা শেরমুস্ত খাঁর পর শুকদেব রায়, তারপর শের দৌলত খাঁ, পরে জানবক্স খাঁ, আর্য্যপুত্র ধরমবক্স খাঁ এবং পরে কালিন্দি রাণী নিজে ছিলেন চাকমা রাজার দায়িত্বে। ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা শেরমুস্ত খাঁ মৃত্যুবরণ করেন। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে অর্ধ স্বাধীন নবাব মীর কাশীম আলী খান কর্তৃক ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নিকট সমর্পিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম মোগলদের দখলে নিরাপদে ছিল।



ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী
১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম এলাকা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নিকট সমর্পিত হওয়ার পরে প্রথম কয়েক বছর সম্ভবতঃ সমর্পিত অঞ্চলের ঐ অংশের ঐ অংশের প্রশাসনের উপরই কর্তৃপক্ষের বেশি মনযোগ নিবিষ্ট ছিল, যে অংশটি পরবর্তীকালে রেগুলেশান জেলা হিসাবে (চট্টগ্রাম) গঠিত হয়। পার্বত্য উপজাতীয় হেডম্যানদের কর্তৃত্ব তখনও বহাল রাখা হয় এবং বাস্তববিক পক্ষে সরকারের অধিক্ষেত্রে কেবলমাত্র তুলা চাষের উপর কর হিসাবে রাজস্ব আদায়ের কাজই সম্প্রসারিত হয়। এই রাজস্বও পাহাড়ী উপজাতিদের নিকট হতে সরকারী কর্মকর্তা দ্বারা আদায় করা হতো না। বরং এমন এক তৃতীয় পক্ষ দ্বারা আদায় করা হতো যিনি উপজাতিদের প্রতিনিধি শাসকও ছিলেন না কিংবা উপজাতি সদস্যদের উপরও কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। যেমন- রাজা জালাল খাঁর সময় বিনোদ চৌধুরী, শেরমুস্ত খাঁ ও শের জববার খাঁ সময় রাম চৌধুরী, শের দৌলত খাঁর সময় রামতনু সেন কার্পাস কর আদায়ের জন্য ঠিকাদার নিযুক্ত ছিলেন।



ইংরেজদের বিরুদ্ধাচরণ
১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজা শের দৌলত খাঁ ইংরেজদের কর প্রদান বন্ধ করে দেন। ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র জানবক্স খাঁ অধিক শক্তি নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধাচরণ করেন। তিনি পার্বত্য অঞ্চল হতে গাছ, বাঁশ, শন, বেত প্রভৃতি বন সম্পদ সংগ্রহ করা ও পার্বত্য এলাকা সংলগ্ন জমিতে সমতলবাসীদের চাষ করা নিষিদ্ধ করে দেন। অপরপক্ষে ইংরেজগণও পার্বত্য অঞ্চলে শুটকী, তামাক, লবণ, চিটাগুড় প্রভৃতি প্রেরণ বন্ধ করেন দেন। তারপর রাজা জ্ঞানব্স খাঁকে দমন করার জন্য মেজর এলাকাকে (Ellerkar) প্রেরণ করা হয়। তখন রাজা জানবক্স খাঁ কলকাতায় গিয়ে লেঃ গভর্ণরের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। জানবক্স খাঁ ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীকালে আর কোন রাজা ইংরেজদের বিরুদ্ধাচরণ করেনি।



রোনা খানের বিদ্রোহ
১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামস্থ কোম্পানীর প্রধান গভর্ণর জেনালের ওয়ারেন হ্যাষ্টিংসকে এপ্রিল মাসে লিখেুজানায় যে, এক পর্বতবাসী রোনা খান কোম্পানীর জমিদারদের উপর বিভিন্ন রকম ট্যাক্স বল পূর্বক আদায় করে এবং কিছু দাবী তুলে উৎপীড়ন করছে। রোনা খান তাকে সাহায্য করার জন্য কুকীদের একটা বড় দলকে সঙ্গে নেন। তারা পাহাড়ের অভ্যন্তরে দূরে বসবাস করতো এবং কোন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতো না। তারা উলঙ্গ থাকতো। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক এই বিদ্রোহ দমন করা হয়। এ বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে পাহাড়ী লোকদেরকেও চট্টগ্রামের প্রতিবেশী জেলার হাটবাজারে প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু কুকীরা তারপরও অবিরত গোলযোগ সৃষ্টি করতো। ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দ নভেম্বর মাসে চট্টগ্রামস্থ কোম্পানী প্রধান ২২তম ব্যাটালিয়ানের কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) এলাকার (Ellerker) কে কিছু সৈন্য পাঠিয়ে অধিবাসীদের রক্ষা করার জন্য নির্দেশ দেন। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে গভর্ণর চট্টগ্রামের চীফকে রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দেন যে, পাহাড়ী লোকদেরকে নিম্নাঞ্চলে চাষাবাদের সুযোগ দিয়ে মান্তিকামী প্রজা হিসেবে বসবাসের ব্যবস্থা করে নিবৃত্ত করা যায় কিনা? কিন্তু এ প্রস্তাবে প্রকৃতপক্ষে কোন সুফল পাওয়া যায়নি।



আরাকানী উপজাতির আগমন



১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুন তারিখে আরাকানী রাজা কর্তৃক চট্টগ্রামের চীফের প্রতি লেখা একটি চিঠি হতে কিছু চমকপ্রদ ঐতিহাসিক তথ্য জানা যায়। আরাকান হতে পালিয়ে আসা কিছু উপজাতির নাম রাজা উলে্খ করেছিলেন, যারা চট্টগ্রামের পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিল এবং উভয় দেশের জনগণের উপরই অত্যাচার করতো। এই চিঠিতে পার্বত্য অঞ্চলে বর্তমানে বসবাসরত অন্ততঃ চারটি উজাতির নাম উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন- মগ, চাকমা, ম্যারিং বা মুরং এবং লাইস (পাংখু এবং বনযোগী)। আরাকানী রাজা চেয়েছিলেন যে, এ সকল দস্যুদেরকে পার্বত্য এরলাকা হতে বিতাড়িত করা উচিত যাতে ‘‘আমাদের বন্ধুত্ব নিষ্কলঙ্ক থাকে এবং পর্যটকদের ও ব্যবসায়ীদের জন্য রাস্তা নিরাপদ থাকে।’’



উপজাতিরা বৃটিশ প্রজা নয়, কেবল করদাত
১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে মিঃ হ্যালহেড (Mr. Halhad) কমিশনার স্বীকৃতি দেন যে, পাহাড়ী উপজাতিরা বৃটিশ প্রজা নয়, তবে কেবল করদাতা। তিনি স্বীকার করেন যে, তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থায় বৃটিশদের হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। তাই একটি শক্তিশালী ও স্থায়ী সরকারের নিকট প্রতিবেশের সুবাদে উপজাতীয় চীফগণ ধাপে ধাপে বৃটিশ প্রভাবের অধীনে আসে এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে প্রত্যেক নেতৃস্থানীয় চীফগণ চট্টগ্রাম কালেক্টরকে সুনির্দিষ্ট কর দিতে অথবা পহাড়ী অধিবাসী ও সমতলের মানুষের মধ্যে মুক্ত ব্যবসার (Free Trade) সুযোগ নেয়ার জন্য বার্ষিক উপহার দিত। প্রথম দিকে ইহার পরিমাণ হ্রাস বৃদ্ধি হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে তা বিশেষ ও নির্দিষ্ট হারে ধার্য হয়। অবশেষে তা কর হিসেবে না হয়ে রাজস্ব হিসেবেই রাষ্ট্রকে প্রদানের জন্য নির্ধারিত হয়। সরকার তারপরও পার্বত্য অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ করতো না। উল্লেখ্য, চাকমা রাজাগণের মধ্যে খাঁ উপাধির শেষ রাজা ছিলে ধরমবক্স খাঁ। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে রাজা ধরমবক্স খাঁর মৃত্যু হলে রাণী কালিন্দি রাজকার্য পরিচালনার দায়িত্ব হাতে নেন।



পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টি
দেশের মধ্যে বসবাসরত পাহাড়ী যে সকল উপজাতিদের নিয়ে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম গঠিত হয়েছে, তারা ছিল পূর্বদিকের অধিকতর দূরে অত্যাচারী উপজাতিদের জন্য অবিরত হামলার লক্ষ্যবস্ত্ত। কাপ্তাই খালের পাড়ে অবস্থিত একটি দূর্গের উপর আক্রমণের পরিণতিতে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে বিভাগীয় কমিশনার পাহাড়ী উপজাতিদের জন্য একজন সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত করে পার্বত্য অঞ্চলকে রেগুলেশান জেলা চট্টগ্রাম হতে পৃথক করার সুপারিশ করেন। এই উভয় সুপারিশই গৃহীত হয় এবং ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের ACT XXII দ্বারা ঐ বছরের ১লা আগস্ট তারিখে তা কার্যকর হয়। পার্বত্য অহ্চলকে রেগুলেশন জেলা চট্টগ্রাম হতে পৃথক করা হয় এবং একজন অফিসারকে পার্বত্য উপজাতিদের জন্য সুপারিনটেনডেন্ট পদে নিযুক্ত করা হয়। এভাবেই রেগুলেশান জেলার সিভিল, ক্রিমিনাল এবং রাজস্ব আদালত ও কর্মকর্তাদের অধিক্ষেত্র হতে পাহাড়ী ও বনাঞ্চলকে আলাদা করা হয়। একজন Hill Superintendent নিয়োগের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল তার অধিক্ষেত্রের মধ্যে অত্যাচারী উপজাতিদের প্রতিরোধ করা এবং নিরীহ উপজাতিদের রক্ষা করা। তার অধীনস্থ পাহাড়ী এলাকাকে তখন হতে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে অভিহিত করা হয় (তার পূর্ব পর্যন্ত কার্পাস মহল বলা হত) এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার সদর দপ্তর চন্দ্রঘোনাতে স্থাপিত হয়। পরবর্তী কয়েক বছরের জন্য সীমান্তের শান্তি রাক্ষার প্রতি বিশেষ মনযোগ দেয়া হয়। এ সময়ে রাণী কালিন্দি চাকমা রাজার দায়িত্বে ছিলেন। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার অফিসার ইন চার্জ এর পদবী সুপারিনটেনডেন্ট হতে পরিবর্তন করে জেলা প্রশাসক (Deputy Commissioner) করা হয় এবং সমগ্র পার্বথ্য অঞ্চলের রাজস্ব ও বিচার ব্যবস্থার যাবতীয় বিষয়ে তাকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রদান করা হয়। একই সময়ে জেলাকে যথোপযুক্ত ভাগ করে মহকুমায় ভিক্ত করা হয় এবং সেগুলোতে অধীনস্থ কর্মকর্তাও নিয়োগ করা হয়। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে চন্দ্রঘোনা হতে রাঙ্গামাটিতে জেলা সদর দপ্তর স্থানান্তর করা হয়।



কুকী ও অন্যান্য উপজাতিদের আক্রমণ
বৃটিশ শাসনকালে কুকীদের দ্বারা ১৮৫৯, ১৮৬৬, ১৮৬৯, ১৮৮৮ ও ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে লুন্ঠনের প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বৃটিশ সরকার পাহাড়ী এলাকায় অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির বিষয়ে সরকারি হস্তক্ষেপ করেনি। ঐ বছর অত্যাচারী উপজাতীয়রা, জাতিগতভাবে যাদেরকে কুকী বলা হয়, নিকটবর্তী তিপ্পেরা (Tipperah) জেলার বৃটিশ প্রজাদের উপর প্রকাশ্য অত্যাচার করে হত্যাযজ্ঞ চালায়। এ আক্রমণের ঘটনা এতই বড় ধরণের ছিল যে, সরকারের জন্য ইহা খুবই উদ্বিগ্নের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ ঘটনার ফলেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টি তরান্বিত হয়। তিপ্পেরা জেলায় কুকীদের আক্রমণের ১৮৬ জন বৃটিশ প্রজা খুন হয় এবং ১০০ জনকে বন্দী করা হয়। পার্বত্য অঞ্চলের উত্তর-পূর্ব অংশে বসবাসরত উপজাতিরা উক্ত আক্রমণ ও বন্দিদশার ঘটনা স্পষ্টরূপেই হৃদয়ঙ্গম করে এবং সে অনুযায়ী ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারী মাসে অপরাধীদের শাস্তি প্রদানের জন্য বরকলে একটি সেনা সমাবেশ ঘটানো হয়। লুসাই চীফ রতনপুয়া গ্রামটি বরকলের উত্তর-পূর্বে ১৮ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। ২৭ জানুয়ারী তারিখে ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) র‌্যাবনের নেতৃত্বে হালকা অস্ত্রশস্ত্রসহ ২৩০ জন নির্বাচিত সিপাই ও ৪৫০ জন কুলীর মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্যাদি বহন করে বরকল হতে রতনপুয়ার গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ঐ গ্রামে প্রবেশ করাই কঠিন ছিল। অবশেষে ঐ সৈন্যদল ৬দিন পর্যন্ত হেঁটে অসংখ্য পাহাড়, নদী ও কাঁটাময় ঝোপজঙ্গল অতিক্রম করে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি তারিখে ঐ গ্রামে পৌঁছে। কুকীরা সমস্ত মূল্যবান সম্পদ সরিয়ে নিয়ে গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং গ্রাম থেকে সরে গিয়ে ওৎপেতে থেকে সৈন্যদের প্রতি আকস্মিক আক্রমণের পথ বেছে নেয়। উপজাতি লোকদের অপরাধের জন্য শাস্তি স্বরূপ মাত্র ১৫০০ মন চাউল আগুনে ধ্বংস হয়- এ টুকই যা ক্ষতি। এ অভিযানে এত টুকুই সাধ্য চিল, যা সম্পাদন শেষে সৈন্যদেরকে বরকলে ফেরত আসতে হয়। অতঃপর সন্ধি স্থাপনের জন্য আলোচনা চলে এবং ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে রতনপুয়া আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়। পরবর্তী ২ বছর অর্থাৎ ১৮৬২ ও ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত পার্বত্য এলাকায় শান্তি বিরাজ করে। কিন্তু ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ১৫ ও ১৯ জানুয়ারীতে একদল সেন্দু ২টি গ্রাম আক্রমণ করে ৫ জনকে হত্যা করে এবং মহিলা ও শিশুসহ ২৩ জনকে ক্রীতদাস হিসেবে নিয়ে যায়। একই বছরে এপ্রিল মাসে একই উপজাতি দুস্কৃতিকারীরা ২৬ জনের একটি বাঙালী কাঠুরিয়া দলকে আক্রমণ করে ৫ জনকে গুলি করে এবং ৯ জনকে আটক করে। অতঃপর তারা একটি খিয়াংথা গ্রামে আক্রমণ করে এবং ৫৬ জন অধিবাসীর মধ্যে ৬ জনকে হত্যা করেও ৩০ জনকে বন্দী করে নিয়ে যায়। ১৮৬৫-৬৬ সনে সেন্দুরা পার্বত্য অঞ্চলে আরো ২টি হামলা করে। প্রথমবারে ৬ জনকে এবং দ্বিতীয়বারের ২০ জনেরও অধিক ব্যক্তিকে বন্দী করে নিয়ে যায়। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে লুসাই এর হলং জাতি আরো গুরুতর প্রকাশ্যে অত্যাচার চালায়। এ অত্যাচার চালায ৬ জুলাই। তখন তারা বনযোগী উপজাতিদের ৩টি গ্রামের ক্ষতি হয়। তাদেরকে পার্বত্য অঞ্চলের দক্ষিণে উপত্যকায় বোমাং কুকী বলা হতো। তাদেরই একটি বিচ্ছিন্ন দল বৃটিশ রাজ্যের কর্ণফুলী নদীর শাখা কাপ্তাই খালে ঢুকে পড়ে এবং সেখানে একটি গ্রাম ধ্বংস করে। তারা ৮০ জনকে বন্দী হিসেবে নিয়ে যায় এবং ৪ জনকে হত্যা করে। এ আক্রমণটি উল্লেণখযোগ্য চিল, কারণ তখন ঘটনাটি ঘটে বর্ষা মৌসুমে, যখন কুকীরা সাধারণতঃ কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকতো এবং প্রতিকূল মৌসুমে ও অনতিক্রম্য বাঁধার কারণে অভিযান চালানো কষ্টকর ছিল। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারীতে হলং জাতি পুনরায় বোমাং অঞ্চলের কিয়াংথা (মগ) গ্রামে হানা দিয়ে ১১ জনকে হত্যা ও ৩৫ জনকে দাসত্বের জন্য নিয়ে যায়। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে কোন হামলা হয়নি। কিন্তু ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারীতে সাঙ্গু নদীর উপর চিমা পুলিশ ফাঁড়িতে একটি হামলা হয় এবং ১০ জনের গার্ড পরাজিত হয় ও ফাঁড়িটি ধ্বংস হয়। ৭জন নিহত হয় এবং সমস্ত গার্ডের মহিলা ও শিশুদের বন্দী হিসেবে নিয়ে যায়। পরের মাসেই পুলিশ ফাঁড়িটি পুনঃনির্মিত হওয়ার পর সেখান হতে আধা ঘন্টার হাঁটা পথ দূরে অবস্থিত একটি গ্রামে ১৮৭০ সনের ১৯শে জুলাই ভোরে ৪০/৫০ জনের একটি দল পুনরায় আক্রমণ করে এবং ৪ ব্যক্তি ও ৬ শিশুকে আটক করে নিয়ে যায়। আবার চিমা ও পিন্দুর মাঝামাঝি স্থানে সাঙ্গু নদীর পাড়ে একটি গ্রামে একই বছরের ডিসেম্বর মাসে আরো একটি আক্রমণ সংঘটিত হয়। এতে ২ জন নিহত এবং ১জন বন্দী হয়। ১৮৭১ সনে কোন হামলা হয়নি। কিন্তু ১৮৭২ সনের জানুয়ারীতে একটি সেন্দু দল পিন্দু সীমান্ত পুলিশ ফাঁড়িতে আকস্মিক হামলা চালায়। এ অসম সাহসিক কর্মটি সংঘটিত হয়েছিল সুসংহতভাবেই। তবে হামলাকারীদের কয়েকজন প্রবেশ পথেই প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় এবং তাদেরকে শীঘ্রই ১৮৭০-৭১ সনে লুসাই এর হলং উপজাতিরা কেচার (Cacher) এর প্রতিবেশী বৃটিশ জেলায় বেশ কয়েকবার অস্বাভাবিক উত্যক্ত হবাবর মতো আক্রমণ সংঘটিত করে, যাতে কয়েকজন ইউরোপীয়কে জীবন বিসর্জন দিতে হয়। এছাড়া একজন রোপনকারীর কন্যাসহ স্থানীয় কয়েকজন বৃটিশ প্রজাকে আক্রমণকারীরা বন্দী করে নিয়ে যায়। এ সকল নির্যাতন অত্যাচারের ঘটনা তৎকালীন সরকারকে কার্যকর প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ করে এবং লুসাই অঞ্চলে একই সাথে ২টি প্রতি আক্রমণ পরিচালিত হয়। একটি কেচার হতে জেনারেল বাউচারের নেতৃত্বে এবং অপরটি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল হতে জেনালের ব্রাউনলো, সি.বি. এর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। এ যুদ্ধাভিযান পাঁচ মাসব্যাপী চলে এবং সম্পূর্ণরূপে সফল হয়। যুদ্ধবন্দীরা পুনরুদ্ধার হয় এবং অপরাধী উপজাতিরা আত্মসমর্পণ করে। তাদেরকে বেআইনী ও অকারণে আক্রমণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ জরিমানা দিতে বাধ্য করা হয়। তৎপরে আর কোন গোলোযোগ সংঘটিত হয়নি। যদিও ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে বর্ষা শুরু হওয়ার সামান্য পূর্বে সেন্দুদের দত্বারা একটি প্রচেষ্টা নেয়া হয়, কিন্তু আকম্রণের সম্ভাব্য গ্রামটি তাদের মোকাবেলা করার জন্য প্রস্ত্তত ছিল বলে তারা দ্রুত পশ্চাদপসরণ করে। সেন্দুজাতি ও অন্যান্য উপজাতিরা উচ্চভূমিকে অধিকারে রেখে জেলার দক্ষিণাংশে আক্রমণ করার জন্য আড়াল (প্রতিবন্ধক) হিসেবে ব্যবহার করতো। কুকীরা এবং অন্যান্য উপজাতিরা মাঝে মাঝে আক্রমণ অব্যাহত রেখে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতো। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে উজাতিদের বিরুদ্ধে একটি চূড়ান্ত সেনা অভিযান পরিচালিত হয় এবংতারপর হতে এ এলাকায় সম্পূর্ণরূপে শান্ত হয়।



জেলায় মর্যাদা হ্রাস বৃদ্ধি ও রেগুলেশান জারী



ইতোপূর্ভে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ কর্তৃক লুসাই পাহাড় দখল হওয়ার পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার গুরুত্ব অনেকটা হ্রাস পায় এবং এর মর্যাদা কমিয়ে মহকুমা করা হয়। তখন জেলাটি বিভাগীয় কমিশনারের অধীনস্থ একজন সহকারী কমিশনারের দায়িত্বে দেয়া হয় (উল্লেখ্য, ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে রাণী কালিন্দির মৃত্যু হলে হরিশচন্দ্র রায় রাজা হন। হরিশচন্দ্র ছিলেন ধরমবক্সের তৃতীয় রাণী হারিবীর কন্যা মেনকার সন্তান। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা হরিশচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ভূবন মোহন রায় রাজা হন। ১৯০০ সমনের ১নং রেগুলেশান অনুযায়ী অঞ্চলটি পুনরায় জেলায় উন্নীত করা হয় এবং অফিসার-ইন-চার্জ এর পুরাতন পদবী সুপারিনটেনডেন্ট প্রত্যার্পণ করা হয়। জেলার সীশানা সংশোধন করে দেমাগিরির ১৫০০ জনের বসতিসহ পূর্বাংশের একটা লম্বা অংশ লুসাই জেলায় স্থানান্তর করা হয়। জেলাটি একই সময়ে চাকমা, মং ও বোমাং সার্কেলের বিভক্ত করা হয় এবং স্ব স্ব সার্কেল চীফদের কাছে ন্যস্ত করা হয়। সার্কেল চীফকে রাজস্ব আদায়ের এবং নিজ নিজ এলাকার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। চাকমা সার্কেলের অধীনে থাকে জেলার মধ্যবর্তী ও উত্তরাঞ্চল, বোমাং সার্কেলের অধীনে দক্ষিণাংশ এবং মং সার্কেলের অধীনে থাকে উত্তর-পশ্চিমাংশ। এ সার্কেলগুলো অনুরূপ অংশ নিয়ে ৩টি মহকুমা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও রামগড় স্থাপন করে মহকুমা প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয় এবং তাদেরকে সার্কেল চীফের কার্যাবলী তদারকী ও লিঁয়াজো করার দায়িত্ব দেয়া হয়।


রেগুলেশান সংশোধন
১৯০০ সালের রেগুলেশানটি পার্বত্য চট্টগ্রাম (সংশোধন) রেগুলেশান, ১৯২০ দ্বারা সংশোধিত হয় এবং সুপারিনটেনডেন্ট পদটি পরিবর্তণ করে জেলা প্রশাসক ও এসিসট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট পদটিকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর করা হয়। দ্বৈতশাসনের প্রশাসনিক পদ্ধতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘‘শাসনবহির্ভূত অঞ্চল’ হিসাবে নির্বাহী পরিষদের সহায়তায় গভর্ণরের একচেটিয়া দায়িত্বে সংরক্ষিত রাখা হয়। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা ভূবন মোহন রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নলিনাক্ষ রায় রাজা হন। চাকমা রাজাদের মধ্যে তিনিই প্রথম স্নাতক ডিগ্রিধারী ছিলেন।



পাকিস্তান আমল



১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাটি বৃটিশ শাসনের অধীন হতে পাকিস্তানের অধিক্ষেত্রে আসে এবং অনেক পরিবর্তন ও উন্নয়নের আওতায় আনা হয়। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা নলিনাক্ষ রায়ের মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র ত্রিদিব রায় চাকমা রাজা হন। তিনি পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানের সমর্থন করে সেখানে অবস্থান করেন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে কর্ণফুলীতে নদীতে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হলে পার্বত্য রাঙ্গামাটির ভৌগলিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তণ আসে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, কাপ্তাই বাঁধের কারণে ১,০০,০০০ অধিবাসী ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং পাহাড়ী অধিবাসীদের মধ্যে অসন্তোষের কারণগুলোর মধ্যে তা ছিল অন্যতম।



বাংলাদেশের অভ্যুদয়
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭১ হতে ১৯৭৮ পর্যন্ত রাজা ত্রিদিব রায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র দেবাশীষ রায় অপ্রাপ্ত বয়স্ক থাকায় ত্রিদিব রায়ের কনিষ্ঠ ভ্রাতা কুমার সমিত রায় রাজকার্য পরিচালনা করেন। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দ হতে দেবাশীষ রায় চাকমা রাজার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১০ সেপ্টেম্বর তারিখে নতুন মহকুমা খাগড়াছড়ি, লামা ও কাপ্তাই গঠন করার জন্য পুরাতন মহকুমাগুলোও পুনর্গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে বান্দরবান ও লামা মহকুমা নিয়ে নতুন জেলা বান্দরবান গঠিত হয়। পরে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে জেনালের এরশাদ সরকারের সময়ে সারাদেশে প্রশাসনিক সংস্কারের প্রক্রিয়ায় খাগড়াছড়ি ও রামগড় মহকুমা নিয়ে খাগড়াছড়ি জেলা সৃষ্টি করা হয়। আরো পরে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারী রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা, বান্দরবান পার্বত্য জেলা ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার আলাদা নামকরণ ও সীমানা নির্ধারিত হয়। বর্তমানে রাঙ্গামাটি জেলার বৃহত্তর অংশ ও খাগড়াছড়ি জেলার কিছু অংশ নিয়ে চাকমা সার্কেল, খাগড়াছড়ি জেলার বৃহত্তর অংশ নিয়ে মং সার্কেল এবং বান্দরবানস জেলার বৃহত্তর অংশ রাঙ্গামাটি জেলার কিয়দংশ নিয়ে বোমাং সার্কেল রয়েছে।


জেনারেল এরশাদের শাসনকালে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে তিন পার্বত্য জেলায় স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠন করে পরিষদগুলোকে অনেক ক্ষমতা প্রদান করা হয়। স্থানীয় সরকার পরিষদের চেয়ারম্যান পদটিকে উপমন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন করা হয়। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে শান্তিচুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার পরিষদের নামকরণ পরিবর্তিত হয়ে পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং আরও বেশি ক্ষমতা প্রদান করা হয়। চুক্তির পরে তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে একটি আঞ্চলিক পরিষদও গঠিত হয়। আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন। আঞ্চলিক পরিষদের সদর দপ্তর রাঙ্গামাটি শহরে অবস্থিত। সুতরাং রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় এক জটিল ও বিশেষ ধরণের প্রশাসনিক কাঠামো কার্যকর।
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৃদ্ধাশ্রম।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৬



আগে ভিডিওটি দেখে নিন।

মনে করেন, এক দেশে এক মহিলা ছিলো। একটি সন্তান জন্ম দেবার পর তার স্বামী মারা যায়। পরে সেই মহিলা পরের বাসায় কাজ করে সন্তান কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

টের পেলে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৭

টের পেলে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

টের পেলে গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী/ পরিপূর্ণ যৌবনে যুবতীর নিখুঁত অনুভূতি। আমার চাওয়া, ইচ্ছে, স্বপ্ন! আমার পছন্দ বুঝদার, সুন্দর হৃদয়ের রূপ! সৌন্দর্য সুন্দর যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×