somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গোলাপ ও ভালোবাসা না পাওয়া মেয়েটি !

১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


যে পথ মাড়িয়ে আমি আমার নানা বাড়ি, ফুফুর বাড়ি বেড়াতে যেতাম তা ছিল মূলত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ । বেশ প্রশস্ত । উপজেলার উত্তর থেকে দক্ষিণের শেষ পর্যন্ত লম্বা । বাঁধের দু ধারে ঘন বসতি । নদী সিকস্তি নিঃস্ব মাটির মানুষের । এখন আর তেমন একটা মাটির মানুষ নেই । সবখানেই আবেগশূন্য প্রযুক্তি মানুষগুলোকে অন্যরকম বানিয়ে ফেলেছে । গ্রাম্য পুচকু ছেলেরা তখন নিজ বাড়ি হোক বা আত্মীয় বাড়ি হোক, সবখানেই হাফ-প্যান্ট পরেই যেত । হাটু পরিমাণ ধূলোর পথ মাড়িয়ে যেতে যেতে দু পা ধবধবে সাদা হয়ে যেত । লজ্জা আর সংকোচে আত্মীয়বাড়ির টিউবয়েলের পাড় আগে খুঁজে নিতে হত আমাদের । তো পুরো পথটা যেন ছিল একটা সাজানো উপন্যাস বা দীর্ঘ গল্প । পথের সমস্ত দৃশ্য আমার মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল । কোন্‌ জায়গার পরে কোন্‌ জায়গা আসবে, কোন্‌ কোন্‌ জায়গায় সম্ভাব্য কোন্‌ কোন্‌ মানুষের দেখা পাব – এর সবকিছুই । এই পথে পথে পরিচিত প্রত্যেকটি মানুষ যেন একেকটা মহামায়ার জীবন চরিত্র । কত উথান পতন তাদের জীবনে, কত ছিন্ন ভিন্ন ঠাঁই, টেনে বেড়ানো এক অসহায় ইতিহাস তাদের – আমি মানুষটা তখন ছোট, কিন্তু সবকিছুই যেন ভাবতাম বৃদ্ধের মত । সবার কথা বলতে চাই না, শুধু একটি চরিত্রের গল্পই আজ বলা যেতে পারে ।

দেবডাঙ্গা নামের গ্রামটি এই পথের প্রায় মাঝামাঝি একটা জায়গায় । নদী থেকে একটা গ্রোয়েন বাঁধের রাস্তা এসে মিলে তিন মাথা হয়েছে । তিন মাথার তিনদিকে কিছু মুদির দোকান , চা স্টল, মোবাইলের দোকান । পাশে দু একটা মুড়ি চানাচুরওয়ালা বা জলপাইয়ের আচার বিক্রেতার ভিড় থাকতো । এর একটু পরেই শিমুল পাগলীকে দেখতে পেতাম । পাগলীর মাথায় জটা চুল, পরনে সালোয়ার কামিজ, হাতের নখে সবসময়ই নেল পালিশ মাখা, কিন্তু মুখে রুক্ষতা, শুষ্কতা আর উদাসীনতা ভর করে থাকত দিনভর । একদিন ফুফুর বাড়ি যাওয়ার পথে প্রথম দেখি পাগলীকে । দেখে অনেকটা ভয়ই পেয়ে যায় । কারণ তখন পর্যন্ত আমি জটা চুল পুরুষের মাথাতেই দেখেছি, কোন মেয়ে মানুষের নয় । ঐটুকু পথ দাদীর হাত শক্ত করে ধরে যেতাম পাগলীকে ভয় পেয়ে । দাদী অভয় দিত যে, ও কিছুই বলবে না, কিন্তু আমার মন তবুও সাহস পেতনা । সেই প্রথম দিনেই দাদীর মুখে পথ চলতে চলতে পাগলীর করুণ কাহিনী শুনতে পাই । খুব বনেদী আর শিক্ষিত বংশের মেয়ে সেই শিমুল পাগলী । ওর বাবা তখন ওখানকার নামকরা হাইস্কুলের মাস্টার । সম্ভবত ওর বংশের মধ্যে আর ঐ গ্রামের মধ্যে তখন ওর মত সুন্দরী মেয়ে আর ছিলনা । সুতরাং ছেলেরা যেমন ওকে নিয়ে সিনেমার নায়ক বনে যেতে চাইত, মেয়েরা হিংসায় হয়ে যেত ঘষেটি বেগম । কিন্তু ও ব্যবহারের দিক দিয়েও ছিল যেমন অমায়িক তেমন বাবা মার একদম বাধ্য সন্তান । ক্লাস নাইনে উঠতে না উঠতেই নিজ গ্রাম, পাশের গ্রাম, পাশের উপজেলার নানা প্রভাবশালী বংশের ছেলেদের সাথে ওর সম্বন্ধ আসতে থাকে । কিন্তু বাবা শিক্ষক হওয়াতে মেয়েকে পুরোপুরি শিক্ষিত না বানিয়ে বিয়ে দেয়ার ব্যাপারটি তাই ভেস্তে যেতে থাকে । শিমুল পড়াশুনায়ও যথেষ্ট ভালো । বরাবরই ক্লাসে প্রথম হত ।

শিমুল চুলে বেণী গেঁথে স্কুল ড্রেস পড়ে রাস্তায় হাটলে ওকে অসম্ভব সুন্দর লাগতো । হাসলে আরো বেশী সুন্দর লাগতো । ছেলেরা পিছু পিছু হাটতো । সিনেমার অনেক ডায়ালগ বলে, গান বলে মাতিয়ে রাখতো পুরোটা পথ । শিমুল তখন মাথা নিচু করে দ্রুত পদক্ষেপ ফেলত । একসময় স্কুলে, বাড়িতে শিমুলের নামে অনেক চিঠি আসতে শুরু হল । চিঠির মধ্যে শিমুলের নামে প্রেম উথলিয়ে উঠতো, ভালোবাসায় সুগন্ধি ছড়াতো । কেউ আবার হাত কেটে তাজা রক্তেও চিঠি পাঠাত । শিমুল সব চিঠি ফেলে দিত, প্রেরকের নামগুলে দেখে নিত যাতে রাস্তায় চলার পথে তাদেরকে এড়িয়ে যাওয়া যায় । আয়নায় দাঁড়িয়ে শিমুল নিজেকে দেখে অবাক হত আর ভাবত, আমি কি এতই সুন্দর ! এই যে এত ছেলেরা যে পাগলামি করে আমার জন্য । তাহলে আমার রাজকুমারটা কোথায় ? যে রানী করে নিয়ে যাবে আমায় । খোঁপায় গেঁথে দিবে লাল গোলাপ । দোলনায় পাশে নিয়ে দোল খাবে, আমার মাথা থাকবে তার কাঁধে, চোখ দুটো পরম আনন্দে বন্ধ করে থাকবো আমি । হঠাৎ শিমুলের খেয়াল আসে । লজ্জায় কুঁকড়ে উঠে । যাহ্‌ , কী যে আবোল তাবোল ভাবি আমি !
একদিন পাশের কোন এক গ্রামের এক সাধারণ ছেলে শিমুলকে রাস্তায় তার ভালোবাসার প্রস্তাব করে , খুব জোরালো প্রস্তাব । শিমুলকে ছেলেটি বলে
- ‘তুমি আমাকে ভালো না বাসলে আমি মরে যাব, শিমুল ।
- তাতে আমার কী করার আছে ? আমি বাবা মা’র অমতে কাউকেই ভালবাসতে পারবোনা ।
- দেখ শিমুল, তোমার বাবা মাকে আমি রাজি করাব, যদি তুমি রাজি থাক ।
- না, আগে বাবা মাকে রাজি করান ।
- শিমুল, আমি তোমাকে যতটা ভালবাসতে পারব, পৃথিবীর অন্য কেউ ততটা ভালবাসতে পারবেনা ।
- বুঝলাম, কিন্তু কিছুই করার নেই আমার । আমি আমার বাব মাকে এক বিন্দু পরিমাণও কষ্ট দিতে পারবো না ।
- শিমুল, তুমি আমাকে একবার বুঝার চেষ্টা কর ।
- আপনিও আমাকে একবার বুঝার চেষ্টা করেন না ?
শিমুল জোরে জোরে পা ফেলে সেদিনের মত রক্ষা পায় । বাড়িতে এসে বাবার বুকে হুমড়ি খেয়ে পরে কাঁদতে কাঁদতে সবকিছু খুলে বলে । বাবা খুব দুশ্চিন্তায় পড়েন । পরের দিন ছেলেটির বাড়িতে চলে যান । ছেলেকে , তার বাবা মাকে খুব ভালো করে বুঝান । এর পরেও ছেলেটি পথে তাকে বিরক্ত করতে শুরু করে ।


প্রায় সপ্তাহখানেক পরে একদিন গভীর রাত্রে কেউ একজন শিমুলের বাবার নাম ধরে জোরে জোরে ডাকতে থাকে । চাচা, তাড়াতাড়ি বের হন, সর্বনাশ হয়ে গেল ! হুড়মুড় করে বাড়ির সবাই উঠে পরে । ঘরের বাইরে আসলে লোকটি বলে , চাচা , সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে, শিমুল কোথায় ? সবাই শিমুলের ঘরে গিয়ে দেখে শিমুল নাই । সে, বলে শিমুলের মত কেউ একজন বাতাসের গতিতে নদীর দিকে দৌড়ে যাচ্ছে । পরে আমাদের বাড়ির কয়েকজন ওর পিছে পিছে নদীর দিকে দৌড়ে গেছে আর আমি আসলাম আপনাকে খবর দিতে । নদী পাড়ের অনতিদূর থেকে শিমুলকে সে রাতেই উদ্ধার করা হয় জীবিত অবস্থায় । তবে এর পরে সে হয়ে যায় জীবন্মৃত ! কারো সাথে কথা বলত না, খেত না, চুলগুলো টেনে টেনে ছিড়ে ফেলতে চাইত । বাড়িতে থাকত না, রাস্তায় উঠে এসে এদিক সেদিক হাটতো । একসময় মুখটা হালকা বিকৃত হয়ে যায় ওর , চুলে ধরে যায় জট । পরে শোনা যায় এক কবিরাজের মুখে, ওকে কেউ একজন শয়তানী জাদুটোনা বা ব্ল্যাক ম্যাজিক করেছে ! আমার পক্ষে এটা ভালো করা সম্ভব নয় । পরে আর কোন কবিরাজই পারেনি । শিমুল পাগলী আজও তাই রাস্তায় হাটে আর বলে, রাজকুমার, তুমি আসবে না ? খোঁপায় আমার গোলাপ গুঁজে দিবে না ? বাসবে না ভালো আমায় ? আমি আছি তোমারই অপেক্ষায় !
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:০৮
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে দেখা - ১৩ মে

লিখেছেন জোবাইর, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:০৩

১৩ মে ২০০৬


দমননীতির অদ্ভুত কৌশল
সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের ওপর দমন নীতির আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দ্রুত বিচার আইন ও পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে দমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁচা আম পাড়ার অভিযান

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২



গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×