somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

`রবীন্দ্রচর্চার জন্য সবার আগে প্রেমিক হতে হবে'- আবদুল মান্নান সৈয়দ

০৬ ই আগস্ট, ২০০৮ সন্ধ্যা ৭:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

`মরণ রে, তুঁ হুঁ মম শ্যামসমান' পঙক্তিটি যিনি লিখেছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯৪১ সালের ২২ শ্রাবণ আশি বছরের জীবনকে অতিক্রম করে এই শ্যামের কোলেই ধরা দিয়েছিলেন। ওইদিন, তাঁর শহরে বৃষ্টি হয়েছিল কি না ৬৭ বছরের দূরত্বে দাঁড়ানো এই আমরা বলতে পারব না। শুনেছি, শ্মশানযাত্রার সময় তাঁকে একনজর দেখার জন্য রাস্তায় রাস্তায় নেমেছিল মানুষের ঢল। এমনকি ভালোবাসায় ভক্তি ভরে স্মৃতি সংগ্রহের জন্য কেউ কেউ তাঁর চুল-দাড়ি পর্যন্ত ছিঁড়ে রেখে দিয়েছিল।
কেন এমন করেছিল সেদিন জনগণ? একজন তরুণ কবি হিসেবে তারুণ্যের ঔদ্ধত্যে আজ যদি রবীন্দ্রনাথকে আচমকাই অস্বীকার করে বসি, এটা কি ভুল হবে? অবাক হয়ে তাঁর বিশাল সৃষ্টি ভাণ্ডারের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করি, তাঁকে যদি স্বীকার করে নেই তিনি চিন্তার রাজ্যে আশ্রয়ের বিচিত্র আলো দেন, আর যদি অস্বীকার করতে চাই, তবু তিনি নতুন পথ সন্ধানের আলো দেন। কাউকেই বঞ্চিত করা তাঁর স্বভাবে নেই। তাহলে কি কথাসাহিত্যিক বিমল মিত্রের কথাই ঠিক, রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করে নয়, রবীন্দ্রনাথকে আত্মসাৎ করে রবীন্দ্রনাথকে অঙ্গীকার করে বহুদূর পৌঁছাতে হবে আমাদের।
এই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রসঙ্গে কথা বলার জন্যই গিয়েছিলাম কয়েকদিন আগে মৃদু ভূমিকম্পে কম্পিত বাংলাদেশের এক পরাবাস্তব জগতের কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের গ্রীনরোডের বাসায়। তাঁর জন্মদিন ৩ আগস্ট। বাসায় যেতেই তিনি ভাবীকে বললেন চা আর বিস্কুট দিতে। খাবার খেতে খেতেই শুরু হয়ে যায় আমাদের আলাপ। আলাপের এক ফাঁকে আমরা গাবও খেয়েছিলাম। মান্নান ভাই তাঁর বিখ্যাত অভিজাত হাসিটি দিয়ে বলেছিলেন, `রবীন্দ্রনাথ খাবার খেতে খুব পছন্দ করতেন। গাব খেতে খেতে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আলোচনা করাটা একটু অন্যরকমের ব্যাপার।'

ফেরদৌস মাহমুদ : মান্নান ভাই, আপনার জন্মদিনের চারদিন পরই তো ২২ শ্রাবণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুদিন। আপনি শেষ রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়লেন কবে?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : আমি এখন যেটা করি, প্রায় রোজই রবীন্দ্রনাথ শুনি এবং `গীতবিতান' আমার কাছে থাকে। রবীন্দ্রনাথে ডুবে থাকি। আগে নয়, এ ২০০৬-০৭ কিংবা ২০০৮-এ আমি রবীন্দ্রসংগীতকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পেরেছি। রবীন্দ্রনাথের আমার শেষ প্রিয় গান `আমার পথে পথে পাথর ছড়ানো'। আরও যোগ করা উচিত, কেউ কেউ আমাকে রবীন্দ্রসংগীতের খেই ধরিয়ে দেয়। আর `শেষের কবিতা' থেকে, কবিতা ও গদ্যের উদ্ধৃতি শুনিয়ে আমাকে জাগ্রত রাখেন। কয়েকদিন আগে `রক্তকরবী' নাটকটি নতুন করে পড়লাম এবং আবার অভিভূত হলাম।
: আপনার জীবনযাপনের সঙ্গে রবীন্দ্র সাহিত্যের সম্পর্কটা কেমন।
আবদুল মান্নান সৈয়দ : রবীন্দ্রনাথের কিছু গান ও কবিতার অর্থ বেশ কিছুকাল হলো আমার কাছে নতুনভাবে উদ্ভাসিত হলো। কেননা- আমি যে কোনোভাবেই হোক রাবীন্দ্রিক ওই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছি।
: `দুই বোন' উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ বর্ষা ঋতুকে বলেছিলেন `মা' আর বসন্ত ঋতুকে `প্রিয়া'। রবীন্দ্রনাথের বর্ষা আর বসন্ত বিষয়ক ভাবনাকে সামনে রেখেই এ বিষয়ে আপনার উপলব্ধিটা শুনতে চাচ্ছি।
আবদুল মান্নান সৈয়দ : রবীন্দ্রনাথের সময়ের বর্ষাকাল থেকে আমাদের বর্ষাকাল তো একটু আলাদা হয়ে গেছে। আমার কাছে বর্ষাকাল প্রিয়তম ঋতু। অনেক বছর পর এবারের ১৪১৫-এর আষাঢ়-শ্রাবণ যে অবিশ্রাম বারিধারা ছড়িয়ে দিল, তা অসম্ভব ভালো লাগল। মনে হলো খানিকটা যেন ছেলেবেলায় ফিরে যাচ্ছি। তবে আগের মতো তিন-চার দিন ধরে বিরামহীন বৃষ্টি-বাদল, এখন আর তা দেখি না। বসন্ত ভালোই। কিন্তু আমাদের কাছে বর্ষাকালই বসন্তকাল। এই যে গতকাল বা পরশু সবুজ-হলদে আর কমলা তিনটে কদম ফুল নিয়ে এসেছি, এর রূপ কে বর্ণনা করবে? গাছের পাতাই যেন ফুলে রূপান্তরিত হয়েছে। শুধু একটাই অনুরোধ, গাছ কেটে আমাদের এই সবুজ দেশটাকে আর যেন মরুভূমিতে পরিণত না করা হয়।
: রবীন্দ্রনাথ তাঁর তরুণ বয়সে একবার মধুসূদনের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লিখেছিলেন। আবার অনেক পরে তিনি মধুসূদনকে স্বীকারও করে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির এ বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন।
আবদুল মান্নান সৈয়দ : আসলে যেটা হয়েছে, আমি একটু সত্য ভাষণ করতে চাই; মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুজনই মানুষ ছিলেন। দুজনই মহৎ কবি বলে আমি বিশ্বাস করি। কথার কথা নয়, এরা চিরকালের বাংলা সাহিত্যের `মৎবধঃ ঢ়ড়বঃ'। কিন্তু কবিরা তো মানুষ। দেখুন, মাইকেল তাঁর অগ্রজ বিদেশি কবিদের তো বটেই বাঙালি কৃত্তিবাস, কাশিরাম দাশকেও অগাধ শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। এমনকি ঈশ্বর গুপ্তকেও। কিন্তু মাইকেল-পূর্ববর্তী শ্রেষ্ঠ কবি, অসাধারণ কবি ভারতচন্দ্র রায় সম্পর্কে মাইকেল ছিলেন নীরব কিংবা পরোক্ষ। চিঠিপত্রে ভারতচন্দ্রের নাম উল্লেখ না করে তিনি লিখতেন `কৃষ্ণনগরের সেই ভদ্রলোক'। এদিকে ভারতচন্দ্রকে নিয়ে না লিখলেও ভারতচন্দ্রের সৃষ্ট `অন্নদামঙ্গল'-এর দুই চরিত্রকে নিয়ে মাইকেল কিন্তু সনেট লিখেছেন। একটা `ঈশ্বরির পাটনি'; আরেকটার নাম ঠিক মনে পড়ছে না এখন।
তেমনি রবীন্দ্রনাথেরও আগের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ফলে রবীন্দ্রনাথকে নতুন পথ খুঁজতে হয়েছে। মাইকেলকে অস্বীকার না করে উপায় ছিল না তাঁর। এটা আমাদের একটু মানবিক দুর্বলতা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত বলে আমি মনে করি।
রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত সংযম সত্ত্বেও দু-একবার তিনি খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন। `যোগাযোগ' উপন্যাসের সেই মারাত্মক চরিত্রটার নাম মনে আছে তো `মধুসূদন'। যে কুমোর জীবনকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল। এত নাম থাকতে `যোগাযোগ' উপন্যাসের এ ভিলেন চরিত্রটির নাম রবীন্দ্রনাথ `মধুসূদন' না দিলেই পারতেন।
আবার আরেকবার বনফুলের `শ্রী মধুসূদন' নামের অসাধারণ নাটকটি পড়ার পর রবীন্দ্রনাথ বনফুলকে বলেছিলেন তাঁকে নিয়ে অনুরূপ নাটক লেখা যায় কি না। এমনকি তিনি ওই নাটকের কোনো কোনো অংশ সম্পর্কে আপত্তিও তুলেছিলেন।
এরকম মানবিক দুর্বলতা আর এরকম প্রবণতা পরবর্তী লেখক-কবিদের মধ্যেও আছে। কিন্তু সাতিক সময়ে বাংলাদেশে পরশ্রীকাতরতা বোধ হয় সীমা ছাড়িয়েছে।
: মাইকেলের কবিতার প্রভাব কখনো কি রবীন্দ্রনাথে পড়েনি?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : কোনো কোনো ক্ষেত্রে পড়েছে তো অবশ্যই। যেমন- মাইকেলের `কপোতাক্ষ নদ' কবিতার অনুসরণেই রবীন্দ্রনাথের `ইছামতি' একটি কবিতা আছে। তবে রবীন্দ্রনাথ যেহেতু মাইকেলের পরের লেখক, এক্ষেত্রে এ বিষয়টাতে আমি কোনো দোষের ব্যাপার দেখি না।
: রবীন্দ্রনাথকে আমাদের এখানে কিছু শুচিবায়ুগ্রস্ত লোক এক ধরনের বৃদ্ধ ঋষি হিসেবে তুলে ধরেছেন। ফলে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে খুব সহজভাবে কথা বলা যায় না। আমার মনে হয় বিষয়টা রবীন্দ্রনাথ পাঠে আগ্রহী হওয়ার ব্যাপারে একটা বড় বাধা। অথচ আমরা যখন রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখা পড়ি একজন চিন্তাশীল তরুণ-টিনএজারের দেখাই যেন পাই। এর প্রমাণ তাঁর শেষ বয়সের উপন্যাস `শেষের কবিতা' পড়লেও পাওয়া যাবে। আপনি এ বিষয়টাকে কিভাবে দেখেন?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : চমৎকার এবং প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। বছর ত্রিশ আগে আশির দশকের গোড়ায়, রবীন্দ্রসংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক, আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় ওয়াহিদ ভাই- আমাকে এরকম প্রশ্নই করেন।
তিনি বলেছিলেন, বছর দশেক হয়ে গেল বাংলাদেশ হয়েছে রবীন্দ্রচর্চা তেমন হচ্ছে না কেন? আমি সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলাম এবং এখনও তাই-ই বলব- তেমনভাবে রবীন্দ্রপ্রেমী নেই বলে। রবীন্দ্রচর্চার জন্য সবার আগে প্রেমিক হতে হবে। প্রকৃতার্থে বোদ্ধা হতে হবে। রবীন্দ্রনাথ অত সহজ নয়। ২৫ বৈশাখ আর ২২ শ্রাবণে হৈচৈ করে, গান গেয়ে, বক্তৃতা দিয়ে রবীন্দ্রপ্রেমের কোনো সাক্ষাৎ রাখা যায় না। রবীন্দ্রনাথকে অনেকেই ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারেনি, ফলে রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে তারা একটা ভুল শিক্ষা গ্রহণ করেছে- যথেচ্ছাচার।
রবীন্দ্রনাথের নামে ব্যবসা করার রেওয়াজ পশ্চিম বাংলাতেও আছে, বাংলাদেশেও কম নেই। খোদ বিশ্বভারতী রবীন্দ্রনাথ নিজে প্রতিষ্ঠা করলেও, ষাট বছর ধরে কাজ করলেও `রবীন্দ্র রচনাবলী' সম্পূর্ণ করতে পারেনি। এর চেয়ে দুঃখের কথা আর কী হতে পারে। রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলোও একত্রিত করতে ব্যর্থ হয়েছে বিশ্বভারতী। এখন তো রবীন্দ্রনাথ লুটের মাল। রবীন্দ্রনাথের ঋষিত্ব মিথ্যা নয়; কিন্তু তার তারুণ্যও সমানভাবে সত্য।
এমনসব রবীন্দ্রসংগীত আছে যা শুনলে মনে হবে আধুনিক বাংলা গান শুনছেন। রবীন্দ্রনাথের একটি নাটক পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল এ তো রাম বসুর কবিতা। রবীন্দ্রনাথ এক অফুরন্ত উৎস। আমি চাইব রবীন্দ্রনাথে নিমজ্জিত হন তরুণরা।
এ বছর বইমেলায় `মাতাল কবিতা পাগল গদ্য' নামে আমার একটি বই বেরিয়েছে। তাতে `গান' নামে আমার একটা গদ্য রচনা আছে। আমি তো বেশ খুশি যে- গদ্যে গান লিখলাম, পরে `গীতবিতানেই' দেখি বহু আগেই মিলহীন গদ্য-গান লিখে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ। দেখে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্বের সত্যকে কে অস্বীকার করবে!
: ত্রিশের কবিতায় যে নতুন কবিতার সূত্রপাত এখানে যেন রবীন্দ্রনাথ ঠিক মানসিকভাবে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেননি। তাঁর ওই সময়কার অনেক লেখা পড়লে মনে হয়, এ নতুনত্ব গ্রহণের ব্যাপারে ছিলেন সংশয়ী। এ নতুন পথকে কখনো কখনো বিদ্রুপও করেছেন। সাহিত্যের এ নতুন প্রবণতা নিয়ে তাঁর এই বিদ্রুপ আর সংশয়ের পেছনের কারণটা কি বলে আপনি মনে করেন?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : ওই যে আগে আমি বলেছি রবীন্দ্রনাথও মানুষ ছিলেন। যে-কবি অক্ষয়কুমার বড়ালের সঙ্গে লেখা শুরু করলেন তিনি যে সমর সেনকে স্বীকৃতি দিতে পেরেছেন এই কি যথেষ্ট নয়? তবে আমি মনে করি, রবীন্দ্রনাথ খুব অন্তর থেকে বুঝেছিলেন, অসংশয়ে গ্রহণ করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস। তিরিশের কবি-কথাশিল্পীদের সম্পর্কে যেটুকু প্রশংসা আমরা পাই তাঁর কাছ থেকে আমার তো মনে হয়- সেটুকুতেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে সৎ শিল্পী। কাজেই তাঁর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সংশয়গুলোও তিনি লুকোননি। এজন্যই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আমার আরও বেশি। আমার মনে হয় তিনি যদি ওই সংশয়গুলি স্পষ্টভাবে প্রকাশ না করে নীরব থাকতেন, ওটা হতো ভণ্ডামি।
: রবীন্দ্রনাথের কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রসঙ্গে বলুন ?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : রবীন্দ্রনাথ কিন্তু চলচ্চিত্র নিয়ে অসাধারণ ভবিষ্যদ্দর্শী। এ নিয়ে তিনি একটা চিঠি লিখেছিলেন একজনকে। এটা চলচ্চিত্রে আগ্রহী সবারই প্রথম পাঠ্য হওয়া উচিত। রবীন্দ্রনাথের তিনটি গল্প নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের করা তিনটা সিনামা রয়েছে,ওইগুলো আমি দেখেছি। আমি মনে করি না সত্যজিৎ যথার্থভাবে ওখানে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলোকে তুলে ধরতে পেরেছেন। তবে এটাও তো ঠিক, চলচ্চিত্রের ভাষা আর সাহিত্যের ভাষা এক নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, চলচ্চিত্র নিয়ে যত উন্মাদনাই থাকুক, যতই তার সর্বগ্রাসী ভূমিকা থাকুক- সাহিত্যই উন্নততর মাধ্যম।
: রবীন্দ্রনাথ লিখতে লিখতে একসময় যে কাটাছেঁড়া করতেন, পরর্তীকালে সেগুলোর চিত্রপ্রদর্শনী হয়েছে। এই প্রসঙ্গ ধরেই তাঁর চিত্রকলা সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গিটা শুনতে চাচ্ছি।
আবদুল মান্নান সৈয়দ : আমরা তো দেখেছি ফরাসি কবি অ্যাপোলিয়ানের হাতে এক ধরনের নকশি করা কবিতা। কাটাকুটি করা রবীন্দ্রনাথের কবিতা যেগুলো, সেগুলো ছবি আর কবিতার একটা মিশ্র মাধ্যম বলে আমি মনে করি। রবীন্দ্রনাথ তো ছেলেবেলা থেকে কমবেশি ছবি আঁকার চর্চা করতেন। ক্রমাগত বিদেশ সফরের ফলে তাঁর একটা দৃষ্টিও খুলে যায়। চিত্রকলার ক্ষেত্রে বড় বড় আন্দোলন বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই হয়েছে ইউরোপে। হয়তো এদের দ্বারাও কিছুটা রবীন্দ্রনাথ উদ্বুদ্ধ হন। পৃথিবীর মহত্তম শিল্পীদের একজন হচ্ছেন মহাকবি গ্যেটে। তাঁর প্রতি রবীন্দ্রনাথের একটি বিশেষ দৃষ্টি ছিল ছেলেবেলা থেকেই। গ্যেটের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার একধরণের মিলও হয়ত রয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। তবুও গ্যেটেকে সর্বক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথের চেয়ে অনেক বড়ই মনে করি আমি।
সে যাইহোক, ওটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেই বলি, তিনি আসলে চিত্রকলায় এমন কিছু বিষয় উপস্থাপন করেছেন, যা তাঁর পক্ষে সাহিত্যে বলা সম্ভব হয়নি। তখন তিনি `গুরুদেব' হিসেবে চিঠিতে সাক্ষর দিচ্ছেন। চিত্রকলায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর গুরুদেবত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছেন।
রামকিংকরকে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, যার ফলে তিনি এখন শ্রেষ্ঠ বাঙালি ভাস্কর- এ তো কল্পনাই করা যায় না।ং
: রবীন্দ্রনাথের `ছিন্নপত্র' নিয়ে বলুন।
আবদুল মান্নান সৈয়দ : `ছিন্নপত্র' তো ইন্দিরা দেবী চৌধুরীকে লেখা। ইন্দিরা দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের মেজদার মেয়ে। অসাধারণ রূপসী ও বিদুষী এক নারী। রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয় পাত্রী ছিলেন তিনি। ফলে মন খুলে অনেক কথাই লিখেছিলেন তিনি তাঁর কাছে। রবীন্দ্রনাথের চিঠিকেই বোধ হয়, বাংলা সাহিত্যে প্রথম পূর্ণাঙ্গ সাহিত্য বলা যেতে পারে।
: রবীন্দ্রনাথের সার্বিক সাহিত্য পাঠ করলে আমরা এক ধরনের সৌন্দর্য সৃষ্টিকারী মুগ্ধতা আর দার্শনিকতার দেখা পাই। আপনার কী মনে হয় এ ব্যাপারে?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবনে অনেক দুঃখ-কষ্ট ছিল। কিন্তু এইসবকে তিনি কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে একটু আনন্দময়তায়, মুগ্ধতায় রূপান্তরিত করার শক্তি রাখতেন। এ শক্তিই প্রতিভাবানের শক্তি। কাকে বলব প্রতিভা? যে তার পারিপার্শ্বিকতাকে অতিক্রম করে যেতে পারে। স্পর্শ করেই অতিক্রম- উন্মাদের অতিক্রম নয়, স্পর্শকারীর অতিক্রম। কঠিন সাধনা। আসলে রবীন্দ্রনাথ যেটা বলেছেন- যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই। তাঁর সাহিত্যজুড়ে এ কথাই প্রতিফলিত হয়েছে।
: সর্বশেষ প্রশ্ন। আপনি তো ইদানীং `গীতবিতান'সহ রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখাতেই ডুবে আছেন। পুনর্পাঠে আপনার নতুন কোনো অভিজ্ঞতা হলো কি?
আবদুল মান্নান সৈয়দ : হ্যাঁ, হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, দীর্ঘকাল বিশ্বভারতী একটি অন্যায় করে চলেছে। বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রনাথের নামে এমন অনেক বই বেরিয়েছে, যেগুলো রবীন্দ্র প্রযোজিত নয়, অন্যদের দ্বারা সম্পাদিত। যেমন- রবীন্দ্রনাথ বের করেছিলেন `ছিন্নপত্র'। পরে বিশ্বভারতী বের করল `ছিন্নপত্রাবলী' নামে একটি বই। রবীন্দ্রনাথ `খ্রিস্ট' বা `বুদ্ধ' নামে কোনো বই লেখেননি।
এসব সংকলিত বই। প্রচ্ছদেই পরিষ্কার লেখা উচিত ছিল- কার বা কাদের দ্বারা সংকলিত বা সম্পাদিত। তাহলে আর রবীন্দ্রনাথের লেখা নিয়ে এত বিভ্রমের সৃষ্টি হতো না। `গীতবিতান'-এর ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে। যে `গীতবিতান' আমাদের নিত্যব্যবহার্য, সেটা কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পরিকল্পিত বা অভিপ্সিত `গীতবিতান' নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের একেবারে উপান্ত পর্বে- দুই খণ্ডে যে `গীতবিতান' ছেপে রেখেছিলেন, সেই আদর্শ প্রচলিত গীতবিতানে মানা হয়নি। আমার বিবেচনায়- রবীন্দ্র পরিকল্পিত `গীতবিতান' অক্ষুন্ন রেখে পরবর্তী সংযোজন সম্পন্ন হলে রবীন্দ্রনাথের প্রতি এবং রবীন্দ্র মুগ্ধ আমাদের প্রতি সুবিচার করা হতো।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০০৮ রাত ৮:০৫
৬টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×