somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লালন শাহের গানে গানে সারাটি রাত

২৭ শে অক্টোবর, ২০১০ সকাল ১১:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এবারের পূর্ণিমাটা পড়েছে শুক্রবার, পরদিনই আমার ছুটির দিন। মন চাইছে ঢাকার বাইরে কাছাকাছি কোথাও যেতে। সবচেয়ে ভালো হয় পূর্ণিমাটা যদি নৌকায় চড়ে কোনো নদীর মাঝখানে কাটানো যেত। কোথায় যাওয়া যায় এই নিয়ে যখন মনে মনে নানা পরিকল্পনা, তখনই হঠাৎ রাতে কবিবন্ধু রুদ্র আরিফের ফোন। জিজ্ঞেস করেন, মুন্সিগঞ্জ রাতব্যাপী লালনের গান শুনতে যাব কিনা। অনুষ্ঠানের আয়োজনের সাথে জড়িত আমাদেরই এক সাংবাদিক বন্ধু গোলাম রাব্বানী। আমি সামান্য ভেবেই জানিয়ে দিলাম, যাব।

২২ অক্টোবর শুক্রবার বিকেলে আমি, রুদ্র আরিফ, গোলাম রাব্বানী, আহসান পাভেল ও জাহিদুল হক পাভেল... রওনা দিলাম মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের উদ্দেশে। গুলিস্তান থেকে যাত্রা করা আমাদের বাস কখনো যানজটে আটকে থাকে, কখনো চলে সাবলীল গতিতে। এভাবে আমরা যখন সিরাজদিখান বাজারে এসে থামি, তখন চারদিকের পৃথিবীতে সন্ধ্যা। এখানে পরিচিত দু-একজনের সঙ্গে দেখা। স্থানীয় হোটেলে হালকা খাবার খেয়ে হাজির হলাম ট্রলারঘাটে।

আমাদের ট্রলারে চড়েই যেতে হবে সিরাজদিখানে, ইছামতি নদীর পাড়ে দোসরপাড়ার টেকেরহাটে। প্রতি বছরই পদ্মহেম ধামের উদ্যোগে এখানে বেশ বড় আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় দুদিনব্যাপী লালন শাহ বটতলা মধুপূর্ণিমা সাধুসঙ্গ। এবার এ উৎসবের পঞ্চম আয়োজন। এখানে দরবেশ নহীর শাহ, টুনটুন বাউল, রব বাউল, আনুশেহ, রিংকু, বজলু শাহ, খিজমত ফকির, স¤্রাট বাউল, দীলিপ দাস, সুমন্ত বাউল, ভজন দাশ বৈরাগীসহ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের তরুণ-প্রবীণ অনেক লালন শিল্পী সারারাত গান গান।

আমাদের ট্রলার চলছিল লালন উৎসবের দিকে। আকাশে চাঁদ-তারা কিছুই দেখা যাচ্ছিল না, সারা আকাশ মেঘে ঢাকা। নিম্নচাপের ফলে আশপাশে রহস্যময় অন্ধকারে ছেয়েছিল, দূরে কোথাও হয়তো বৃষ্টি হচ্ছিল। আমাদের আশঙ্কা আজ সারারাত আর চাঁদের দেখা মিলবে না। উৎসবও হয়ত ভ-ুল হয়ে যেতে পারে। যাত্রীদের প্রত্যেকের মনে মনে কামনা, তাদের শঙ্কা যেন মিথ্যা প্রমাণিত হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রলার থেকে আমাদের চোখে পড়ে কিছুটা সামনেই মিটি মিটি আলো। বুঝতে পারি ওটাই টেকেরহাট। একসময় যখন আমাদের ট্রলার স্পর্শ করে ইছামতির পাড়ের নরম মাটি, তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা।

২.
দোসরাপাড়া টেকেরহাটে নেমেই আমাদের মন একদম ভালো হয়ে যায়। পুরো চরাঞ্চলটাতেই যেন জোয়ারের পানির মতো আনন্দ আর গভীর উল্লাস পাশাপাশি নৃত্য করছিল। জ্বলজ্বলে আলোর মতো মানুষের কলকাকলিতে মুখর পুরো হাট। লালনের গানের প্রেমে মুন্সিগঞ্জ, সিরাজদিখান, মাতুব্বরবাড়ি, দোসরপাড়া, টেকেরহাট, ঢাকা এবং দেশের নানা জায়গার হাজারো হাজারো লালনভক্ত ও অনুসারীদের পদচারণায় মুখর ইছামতি পাড়ের লালন শাহ বটতলা মধুপূর্ণিমা সাধুসঙ্গ ।

টেকেরহাটে ছোট ছোট কুপিতে আলো জ্বালিয়ে জিলিপি, সন্দেশ, চটপটিসহ বিভিন্ন ঝাল-মিষ্টি খাবারের দোকান নিয়ে বসেন দোকানিরা। বসে চুরি-ফিতা-লিপস্টিক, ছোটদের বিভিন্ন খেলনা বা শাড়ি, লুঙ্গির দোকান। বটগাছের তলায় চলছে লালনের জীবন ও দর্শন নিয়ে আলোচনা। ঝাকড়া চুলের বাউলরা কেউ একতারা হাতে, কেউ এমনিতেই কথা বলছিলেন নিজেদের মধ্যে। ঘণ্টখানেকের মধ্যেই শুরু হবে লালনের গান।

আমরা দেখি, মেঘের ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ তীব্র আলো নিয়ে জেদি চাঁদ উঁকি মারছে। দেখা যাচ্ছে দু-একটি তারাও। কিন্তু পরক্ষণেই আবার যেন মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে চাঁদকে। চরের আশপাশ আমরা ঘুরে দেখি, আমরা যাই লালনের সঙ্গীত শেখার স্কুল পদ্মহেম ধামে। চেনা-জানা আরও অনেকের সাথেই দেখা হয়ে যায়। ফাঁকে খেয়ে নিই সদ্যভাজা গরম জিলিপি, চটপটি বা চানাচুর। আকাশে একসময় চাঁদ মেঘকে পরাজিত করে জ্যোৎস্ন্যার প্লাবন নিয়ে হাজির হয়। আমরা ঘণ্টাখানেকের জন্য ইছামতির বুকে ঘুরতে একটি ডিঙ্গি ভাড়া করি।

ইছামতি নদীতে কোনো স্রোত নেই। খুবই শান্ত এ নদীতে চাঁদের আলোয় ঘুরে বেড়ানোটা ছিল আমাদের জন্য এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। নৌকায় ঘুরতে ঘুরতেই আমরা শুনতে পাই লালনের গান শুরু হয়ে গেছে।

৩.
নৌকা ভ্রমণ শেষ করে, রাত ১০টা-১১টার দিকেও দেখছিলাম লোকের পর লোক আসছিলেন। বটতলার চারদিক ঘিরে ছিল শ্রোতাদের ভিড়। আমরা বটতলা থেকে কিছুটা সরে গিয়ে চরের মাঠে খোলা আকাশের নিচে শীতল পাটিতে শুয়ে-বসে শুনছিলাম গান-

‘আমি অপার হয়ে বসে আছি
ওহে দয়াময়
পাড়ে লয়ে যাও আমায়

আমি একা রইলাম ঘাটে
ভানু সে বসিলো পাটে
তোমা বিনে
ঘোর সংকটে না দেখি উপায়
পাড়ে লয়ে যাও আমায়।’

কিংবা,
‘বাড়ির পাশে আরশিনগর
সেথা এক পড়শি বসত করে’

কিংবা,
‘মানুষ ছাড়া খ্যাপারে তুই কুল হারাবি
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’

আমাদের মতো আরও অনেকেই এভাবে শীতল পাটিতে শুয়ে-বসে শুনছিলেন গান। মধ্যরাত একসময় আরও গভীরে যায়। দর্শক-শ্রোতার ভিড় কিছুটা কমতে থাকে। আমরা গিয়ে বটতলায় বসি। এ সময় বাউলরা লালনের প্রচলিত গান ছাড়াও অনেক অপ্রচলিত গানও পরিবেশন করেন। রাত বাড়ার সাথে সাথে যেন উপস্থিত ভক্তদের ভাবও বাড়তে থাকে। একজন প্রবীণ বাউল গান গান তো পরমুহূর্তেই আবার আরেকজন তরুণ গান গাইতে শুরু করেন। গানের ফাঁকে ফাঁকে উপস্থাপক গানের মর্মবাণী সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেন। শ্রোতারা যার গাওয়া গান বেশি পছন্দ করেন তাকে বকশিস দেন, তাকে বার বার গাইতে অনুরোধ করেন। প্রত্যেক গায়কই লালনের প্রতি গভীর ভক্তি নিয়ে গান পরিবেশন করেন।

গানে গানে যখন সারা টেকেরহাট লালনে মত্ত, তখন আমরা নিজেদের মধ্যে বিস্ময় প্রকাশ করি লালনের গানের গভীরতা নিয়ে। আমরা অনুভব করার চেষ্টা করি লাখ লাখ ভক্তকে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণীভেদে লালন কীভাবে আজও মাতিয়ে রেখেছেন। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো লালনের বাণীর মধ্যে খুঁজে বেড়াই নিজেদের!

এই মন্ত্রমুগ্ধতার মধ্যেও একটি দুঃসংবাদ আমাদের সবাইকে হয়তো ভেতরে ভেতরে বিষাদগ্রস্ত করে রেখেছিল। আমরা শুনতে পেয়েছিলাম গান শুনতে টেকেরহাটে আসার পথে ট্রলার ডুবিতে ৩-৪ জন মারা গেছেন!

৪.
গান শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। এক সময় আবিষ্কার করি আমরা শুয়ে আছি শীতলপাটিতে, খোলা আকাশের নিচে। হালকা রোদ এসে লাগে চোখে। যে টেকেরহাটকে, যে ইছামতিকে গভীর রাতে খুব রহস্যময় মনে হচ্ছিল, ভোরের রোদে তা যেন নতুন রূপে দেখা দেয়। আমরা ভোরে ‘গোষ্ঠগান’ শুনে পুনরায় উঠে পড়ি ট্রলারে, রওনা দিই ঢাকার উদ্দেশে। তখন কেউ যেন খুব চুপে আমার কানে কানে গাইতে থাকে একটি গান : ভবে আসার আগে যখন,/বলেছিলে কর্মসাধন/লালন বলে সে কথা মন,/ভুলেছো এই ভবের লোভে।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×