আমাদের সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন, যারা নিষিদ্ধ উৎস থেকে প্রচুর অর্থ-সম্পদ উপার্জন করেন আবার এই সম্পদ মসজিদ, মাদরাসাসহ বিভিন্ন জনকল্যাণকর কাজে ব্যয় করেন এবং ইয়াতীমদের লালনপালন করেন। আবার অনেকে এমনও আছেন যারা রাতারাতি বড়লোক হবার আশায় জেনে বুঝে অবৈধ উপায়ে সম্পদ উপার্জন করেন, কোন সচেতন কল্যাণকামী ব্যক্তি বা আলিম-উলামা যদি এ ব্যক্তিকে এ ধরনের কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন তাহলে বলে, একবার যেনতেন প্রকারে টাকা-পয়সা উপার্জন করে নিই পরে হজ্ব করে তাওবা পড়ে, দাড়ি টুপি লাগিয়ে একদম ফেরেশতা হয়ে যাব। ইসলামের দৃষ্টিতে আয় উপার্জনের এ ধরনের নীতি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এর কারণ হলো, ইসলাম শারী‘আহসম্মত পবিত্র শুধুমাত্র উপার্জনকে স্বাগত জানায় ও এর অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করে। আর অপবিত্র অর্জনকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে, কারণ ইসলাম এসেছে পবিত্র বস্তুসমূহকে হালাল করার জন্য এবং অপবিত্র বস্তুসমূহকে হারাম করার জন্য। অপবিত্র উপার্জন হলো ঐ সব উপার্জন যা জুলুম ও অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে হরণ করার মাধ্যমে আসে। যেমনÑ ছিনতাই, চুরি, ধোঁকাবাজি, ঘুষ নেয়া, ওজনে কম দেয়া, মজুদদারী, অভাবীর অভাবের সুযোগ নেয়া ও অন্যের জিনিসপত্র তি করা ইত্যাদি। অথবা পরিশ্রম বা অংশীদারিত্ব ছাড়াই উপার্জন করা যেমনÑসুদ, জুয়া ইত্যাদি অথবা নিষিদ্ধ সম্পদের বিনিময়ে উপার্জন করা যেমনÑ মদ, শূকর, মূর্তি, ভাস্কর্য, নিষিদ্ধ থালা-বাসন, নিষিদ্ধ উপহার, কুকুর ইত্যাদি। অথবা শারী‘আহ্স্বীকৃত নয় এমন সেবা কার্যক্রমের বিনিময়ে উপার্জন করা, যেমনÑধোঁকাবাজ, ভাগ্যগণনাকারী জ্যোতিষী, সুদের হিসাবরক এবং পানশালা, নৃত্যশালা ও নিষিদ্ধ নাইটকাবের শ্রমিকদের পারিশ্রমিক।
রাসূল (সা) হারাম মাল ভণকারীদেরকে জাহান্নামের আগুনের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন। তাই তিনি বলেছেনÑ “যে শরীর অবৈধ সম্পদ ভণ করে বৃদ্ধি লাভ করেছে সে শরীরের জন্য আগুনই অধিক উপযোগী।”
উপার্জনের পথ যদি নিষিদ্ধ হয় তাহলে ইসলাম নিয়্যাতের পরিচ্ছন্নতা ও ল্েযর মহত্ত্বের কোন মূল্যায়ন করে না। যে ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বা এতিমদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা বা এ ধরনের মহৎ কাজের জন্য সুদ গ্রহণ করে ইসলাম তাকে কোন মূল্যায়ন করে না। সহীহ মুসলিমে আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত আছেÑ“আল্লাহ তায়ালা পবিত্র, তিনি পবিত্র বস্তু ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করেন না।”
অন্য একটি হাদীসে আছেÑ “নিশ্চয়ই অপবিত্র কর্ম অন্য একটি অপবিত্র কর্মকে মোচন করতে পারে না।”
ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম হারামই। বিচারক যদি আপাতদৃষ্ট দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে তা হালাল বলে হুকুম দেয় তবু তা হারামই থাকবে। আল্লাহ তায়ালা বলেনÑ“তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ, করো না এবং জনগণের সম্পদের কিয়দংশ জেনে-শুনে পাপ পন্থায় আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে শাসন কর্তৃপরে হাতে তুলে দিও না।” আল-বাক্বারা ঃ ১৮৮
এই প্রসঙ্গে রাসূল (সা)-এর একটি হাদীস আছে। রাসূল (সা) বলেছেনÑ“তোমরা আমার নিকট যুক্তি পেশ করছো, হতে পারে তোমাদের কেউ কেউ অন্যদের চেয়ে যুক্তি পেশের েেত্র অধিক চতুর। আমি তোমাদের নিকট থেকে যা শ্রবণ করি তার ভিত্তিতে বিচার করি। এই ভিত্তিতে আমি যদি কাউকে তাঁর মুসলিম ভাইয়ের হক থেকে অধিকারহীনভাবে কিছু নেয়ার বিষয়ে রায় দিয়ে থাকি, তা হলো একটি আগুনের টুকরা। সে ইচ্ছা করলে তা গ্রহণ করতে পারে আবার ইচ্ছা করলে তা ছেড়ে দিতে পারে।” এই হাদীসটি বুখারী শরীফে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ বিচারক যদি রাসুল (সাঃ)ও হন তবুও হারাম হারামই কেননা তাঁর নিকট যা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ভিত্তিতে তিনি বিচার করতেন।
এর মাধ্যমে ইসলাম মুসলিমের অন্তরে তাকওয়াকে তাঁর অর্থনৈতিক জীবনের রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। বিচারক যদিও প্রকাশ্য দলীল প্রমাণের ভিত্তিতে বিচার করেন কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তো সকল বাস্তবতা ও গোপনীয়তা সম্পর্কে সম্যক অবগত।
যে বিষয়টি সম্পর্কে ইসলাম তীব্রভাবে সতর্ক করেছে তা হলো, দুর্বলের উপর সবলের সুযোগ সন্ধান, যেমন ‘অছি’ (অভিভাবক) কর্তৃক ইয়াতীমদের সম্পদ ভণ, পুরুষ কর্তৃক নারীর সম্পদ ভণ, শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক শাসিতদের সম্পদ ভণ, মালিক কর্তৃক শ্রমিকের অধিকার হরণ, জমির মালিক কর্তৃক কৃষকদের মজুরি ভণ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন: যারা ইয়াতীমদের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কওে তারা তো তাদের পেটে আগুন পূর্তি করে; তাঁরা অচিরেই জ্বলন্ত আগুনে জ্বলবে। সুরা নিসা, আয়াতঃ ১০।
আরো একটি বিষয় সম্পর্কে ইসলাম কঠোরভাবে সতর্ক করেছে, তা হলো, সর্ব সাধারণের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করা, কেননা জনগণের প্রত্যেকেরই এতে অধিকার রয়েছে। সুতরাং যদি তা থেকে কেউ আত্মসাৎ করে সে যেন সকলের প্রতি জুলুম করলো এবং ক্বিয়ামাতের দিন সকলেই তাঁর প্রতিপে পরিণত হবে।
এ কারণেই গণিমতের মাল আত্মসাৎকারী সম্পর্কে এত কঠোর ও নিন্দনীয় শাস্তির হুমকি এসেছে। ক্বোরআন শরীফে আল্লাহ তায়ালা বলেন, যেই ব্যক্তি আত্মসাৎ করবে সে ক্বিয়ামাতের দিন সেই আত্মসাৎকৃত বস্তু নিয়ে উপস্থিত হবে। অতপর তা পরিপূর্ণভাবে পাবে প্রত্যেকে, যা সে অর্জন করেছে। আর তাদের প্রতি কোন অন্যায় করা হবে না।” সুরা আলে ইমরান ঃ ১৬১
সর্বসাধারণের সম্পদ শাসকদের জন্য যেমনি নিষিদ্ধ তেমনি তা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্যও নিষিদ্ধ। তা থেকে এক পয়সা এমনকি সিকি পয়সাও অধিকারহীনভাবে নেয়া বৈধ নয়। তেমনিভাবে কমিশন বা উপহারের নামে পয়সা বানানোর জন্য পদমর্যাদার সুযোগা গ্রহণ করাও বৈধ নয়। প্রত্যেক জ্ঞানবান ও বিবেকবান ব্যক্তিই জানে যে এটিও ঘুষ।
উমার বিন আব্দুল আযীয (রাঃ) কে এক ব্যক্তি কিছু হাদীয়া দিতে চাইলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করলেন। অতপর উপহার প্রদানকারী তাকে বললো ঃ “আল্লাহর রাসুল (সাঃ) হাদীয়া গ্রহণ করেছেন” এর প্রত্যুত্তরে উমার বিন আব্দুল আযীয বলেন ঃ “রাসুল (সাঃ) এর জন্য ছিল ‘হাদীয়া’ আর আমাদের েেত্র তা ঘুষ।”
‘ইবনে লাত্বীয়াহ’ নামে পরিচিত একজন কর্মকর্তার উপর নাবী (সাঃ) সাংঘাতিকভাবে রেগে গিয়েছিলেন। এই ব্যক্তি যাকাত আদায়ের দায়িত্বপালন করে ফিরেছিলেন। তার সাথে কিছু অতিরিক্ত মাল ছিল। তিনি রাসুল (সাঃ)কে বললেন, “এই হল জাকাতের মাল, আর এগুলি আমাকে হাদীয়া দেয়া হয়েছে।” তখন রাসুল (সাঃ) তাঁর উদ্দেশ্যে ভৎসনা করে বলেন ঃ “সে কেন তাঁর মা-বাবার ঘরে বসে থাকে না, তাহলেই দেখতে পাবে যে তাকে হাদীয়া প্রদান করা হয় কি না?” বুখারী ও মুসলিম শরীফে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ উক্ত হাদীয়া ব্যক্তিত্বের কারণে, বন্ধুত্বের কারণে বা নিকটাত্মীয় হওয়ার কারণে আসেনি বরং তা পদের কারণে এসেছে। সুতরাং এতে তাঁর কোন অধিকার নেই।
তাইতো ইসলামই প্রথম শাসক প্রশাসকদেরকে এই প্রশ্ন করেছে ঃ “এই সম্পদ তোমার নিকট কিভাবে আসলো ?”
অপবিত্র উপার্জনের উৎস সমূহকে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে ইসলাম কতিপয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করেছে ঃ
প্রথমত ঃ মানুষের পরস্পরের মাঝে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হলো ন্যায় বিচার, ভ্রাতৃত্ব, সম্মান রা ও প্রত্যেক হক্বদারকে হক্ব বুঝিয়ে দেয়া।
দ্বিতীয়ত ঃ বিভিন্ন ব্যক্তি ও শ্রেণীর মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবধান সৃষ্টিকারী গুরুত্বপূর্ণ কার্যকারণ সমূহের মুলোৎপাটন। কারণ নিকৃষ্ট মুনাফা ও অঢেল উপার্জন বেশিরভাগ েেত্রই নিষিদ্ধ পন্থায় আসে। পান্তরে শারীয়াহ সম্মত পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে বেশীরভাগ েেত্রই ন্যায়সঙ্গত মুনাফা ও যুক্তিসঙ্গত উপার্জন আসে।
তৃতীয়ত ঃ মানুষকে কর্মমুখী ও পরিশ্রমী করে তোলা। তাই ইসলাম অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভণ বৈধ করেনি অর্থাৎ পরিশ্রম, বিনিময় ও লাভ-তির অংশীদার হওয়া ছাড়া যেমন- জুয়া, সুদ, ইত্যাদি। সন্দেহ নেই যে এতে দেশ ও জাতির জন্য অর্থনৈতিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে।