অপরূপ লাবণ্যের সবুজ আগুনে শাড়ী পড়া এবং সুদর্শন সঙ্গীসমেত লাস্যময়ী কবিতাপ্রেমী ধরনের এক যুবতীর অনাঘ্রাত স্তনের সাথে অন্যমনষ্ক ঠোকাঠুকি - ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে গেল আমার একটি বহুতল বিপনী বিতানের দ্বিতীয় তলায়। যদিও অন্যমনষ্কতা বহুদিন ধরে আমার নিত্যসঙ্গী আর শুন্যচোখে ভাবলেশহীন দাঁড়িয়েই ছিলাম, তারপরও সেই সুদর্শন যুবক বেশ সামজ্স্যপূর্ণ ও অখন্ডনযোগ্য যুক্তি বাণে বিদ্ধ করলো আমায় কিছুক্ষণ। তারপরও আমার নীরবতার অবকাশে আমার আধ কামানো, কাঁচা-পাকা শ্বশ্রুমন্ডিত গালে বেশ কিছুক্ষণ ধরে, উপর্যপরি চড়িয়ে দিল।
প্রতিবাদ? প্রতিবাদ তো দূর অস্ত, বরং আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে কবুল করে নিলাম সেই শক্ত চর্ম চড়, চোরের মত মিশে গেলাম ভীড়ে এবং দ্রুত পালিয়ে এসে নোনাধরা কামরায় ম্লান আলোর নিরানন্দ সন্ধ্যায় একটা সান্ধ্যকালীন নাতিদীর্ঘ নিদ্রায় অভিভূত হলাম। আমি ঘুমিয়েও স্বপ্ন দেখি ঐ সুদর্শন যুবক তার প্রিয়তমা আদুরে সঙ্গীনির চোখে এতটুকু হাসির আভা ফোটানোর জন্য বনানী শোভিত এক পাহাড়ে ইতস্তত: ব্যাঘ্র কোদাল চালিয়ে মাটি খুড়ছে আর সেই গর্তে উপর্যপুরি গণধোলাইতে নিহত আমার লাশটাকে মাটি চাপা দিয়ে আত্নাটাকেও খুঁজে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র ।
আমি স্বপ্ন থেকে হুড়মুড় করে লাফিয়ে পালিয়ে আসি বাস্তবে, আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়, গলা শুকিয়ে যায় প্রচন্ড ভয়ে।
তারপর অন্য আরেকদিন, রেলস্টেশনে ধরা পড়লাম আইন বিধাতা মোবাইল কোর্টের হাতে। ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগমুহূর্তে কামরার এক কোণে জুবুথুবু দাঁড়িয়ে থাকা উচ্ছন্নে যাওয়া টিকেটবিহীন যাত্রীটির পশ্চাৎদেশে বেশ কায়দামত কষিয়ে এক লাথি মেরে কামরা থেকে নীচে ফেলে দিলেন কর্মবীর পরিদর্শক মহাশয়। আমি বেহায়ার মত পাছা ডলতে ডলতে আবার উঠে দাঁড়াই, অল্পে বেঁচে যাওয়ার সন্তুষ্টিতে ফিচেল হাসি দেই। প্লাটফর্মে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আমি দেখি শক্তিশালী গার্ড তার সবুজ পতাকাটিকে শুন্যে তুলে আন্তঃনগর গোধূলী ট্রেনটিকে উড়িয়ে নিয়ে চললেন বাতাসে।
ট্রেনের শেষ বগির অপসৃয়মান শেষ আলোটিও যখন দূরবর্তী কুয়াশার ওপাড়ে চলে গেল তখন ভাবলাম এবারও যাওয়া হলো না মুক্তিগ্রামে। নীল জলের, ঘাসফুলের মুক্তিগ্রাম এবারও অপমানের ধুসর স্থবিরতায় ঢেকে দিয়ে আমাকে আবারও - দূরেই থেকে গেল!
অপমান? হ্যাঁ হ্যাঁ! অপমান! অপমানই আমার খাদ্য, প্রাপ্য, বেঁচে থাকার নিশ্বাস। কেন আমার এমন হলো জানতে চান? তবে শুনুন - আমার মহামান্য সম্রাজ্ঞী, প্রিয়তম প্রেমিকাই অপমানের জ্বলন্ত সৌরদ্বীপ – উত্তপ্ত গ্রহাণূতে একদা নির্বাসন দিয়েছিলেন আমাকে। বস্তুত: তিনিই আমাকে বাধ্য করে দিয়েছিলেন অপমান নামক এই অখাদ্য খেতে, ছুঁতে এবং নিশ্বাস নিতে। অপমানের জমকালো ছিপছিপে ধনুক দিয়ে আমার দিকে হেনেছিলেন বিষাক্ত তীর। ভেবেছিলেন এই মনোবৃত্তিক হেমলকের বিষক্রিয়ায় জর্জরিত হয়ে আমি কুঁকড়ে যাবো। পীতবর্ণের কষ ঝরাবে আমার জ্বিহবা, কুঁচকে যাবে আমার পুরুষাঙ্গ – আমি পরিণত হবো নির্বিষ এক ক্লীবে।
কিন্তু তিনি ভুলে গিয়েছিলেন আমি একজন অভিযোজনশীল মানুষ অর্থাৎ- যাদের নাকি কাব্য করে কবি বলা হয়। আমি প্রকৃতির নিয়মকে আমার বুড়ো আঙ্গুল কেটে উপহার দেই। তারপর নিজেকে ঘিরে অপমানের পর অপমানের চন্দন কাঠ সাজাই। সবার সামনেই জ্বলিয়ে দেই রাবণের চিতা। আর কাজ শেষ করে পুরোহিতরা ফিরে গেলে লাফিয়ে নামি চিতা থেকে। জ্বলন্ত শরীর নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে তছনছ ও অপবিত্র করে তুলি শান্ত, সৌম আর স্নিগ্ধ সরোবর। আমি, আমার প্রক্তন প্রেমিকার প্রাক্তন প্রেমিক, তাঁর ধারণাকে মিথ্যে প্রতিপন্ন করি।
আমি নিজেকে অপমান করে অপমানিত করি তাঁকেই, আমার অবশ্যম্ভাবী ও একমাত্র প্রেমিকাকে। যার জন্য গড়ে তুলে ছিলাম কুঁড়েঘর, মাত্র এক করতল ভূমিতে বুনেছিলাম ফসল, ঘাম ঝরিয়ে খুঁড়েছিলাম কুয়ো – কোন অনাগত ভবিষ্যতের জন্য। যে একদিনের জন্য হলেও ভালবেসেছিল আমাকে।
আরে আরে দ্যাখো, এ কাকে ভালবেসেছিলে তুমি! ছি ছি এত অধম, তস্য তস্কর এহেন বিলুপ্ত চরিত্রের একজনের সাথে একদা হৃদয়ঘটিত আদান-প্রদান যোগে সংযুক্ত ছিলে তুমি! কতটা নীচে নেমে গিয়েছ! অন্ধকার নরকের অতল খাদের পাড়ে সমুপস্থিত! তথাপীও জেনে রাখো, এই পাপিষ্ঠ পামর আরও অতলে ডুববে। সাথে করে ডোবাবে তোমাকেও। এই দন্ড তুমিই আমাদের দুজনের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছ। এক অদৃশ্য দড়ীতে বাধা পড়ে গেছো তুমি কোনভাবে – এই তস্করের সাথে।
যার প্রিয়তমা তাকে দেয়া কথাগুলো পুরো পৃথিবীর সামনে অস্বীকার করে তাকে মিথ্যুক প্রতিপন্ন করে, ধরে রাখা হাত অবলীলায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়, তার আর কিই বা থাকে এই নশ্বর ধরায়! যে মানুষটিকে তার প্রেমিকা পৃথিবীর সবগুলো উত্তেজক জুরীদের সামনে অপমানে চেতনাহীন করে দেয়, তাকে অন্য লোক আর কতটুকুই বা অপমান করতে পারে? এমন কি অন্য লোকের অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার নৈতিক অধিকারই বা তার আর কতটুকু থাকে! হাত বদলে তুমি বেছে নিলে যে অন্য হাত, তাতে কি প্রচন্ড অপমান ছেড়ে দেয়া হাতের তা তুমি কখনোই বুঝতে পারবে না।
তবে, শেষ পরিণতিতে, যেদিন আমি খুবই নিলিপ্ত হয়ে যাবো, কিংবা পরিণত হবো স্বভূমে আবদ্ধ মুক পাগলে বা কোন মৃত শয়তান, সাধু-সন্ন্যাসী বা ঋষিতে, সেই দিন, শুধুমাত্র তখনই শেষ হবে আমার প্রাক্তন প্রেমিকার প্রতি তার প্রাক্তন প্রেমিকের সকল অধিকারের মেয়াদ। কেননা আমি জানি, তোমার দেয়া অপমানগুলোকে পুড়িয়ে ছাই বানানোর এক এবং একমাত্র ইন্ধন হলো কবির অহংকার। আর এই অহংকারের বহ্নিশিখাতেই জ্বলে জ্বলে নিশ্চিহ্ন হবে সেই অপমান, আর সাথে সাথে অগ্নি তাপে আমিও নিঃশেষ হয়ে যাবো, কোন এক তারাজ্বলা কিংবা গ্রহণের অচেনা নিবিড় রাতে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০১৮ রাত ২:৩৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


