হাত
ফিরোজ খান তুষার
রাইত বাড়ে লগে গরম ও বাড়ে। বিছনা পুরা ঘামে পিছলা হয়া আছে। ফ্যান এর বাতাস ও লাগে যেন উনুন এর ধারে বসানো। ভাদ্র মাসে এমন গরম পরেই, কিন্তু এইবার যেন একটু বেশিই। সাবের একলা এক খাটে ঘুমায় না বহুদিন। আজকে মেস এর একটা লোক ও নাই। ঠিক করছিলো সুযোগ টা কাজে লাগাবে। হৃৎপিন্ড ধুকপুক ধুকপুক কইরা ফাইটা যাইতেছিলো রমনার সামনে দিয়া যখন রাতের ৯ টার দিকে সে একজন মোটামুটি দেখতে পার্টনার খুজতেছিলো। ধুকপুকানি টা বাইড়া ঘাম ঝড়ায় দিসে হালায় ৩ টা চ্যাংড়া। গলায় ব্লেড ধইরা পকেটের যা যা আছিলো সাথে ভাংগাচুড়া মোবাইল টা নিয়া গেলো। হালায় নিসোস ভালো, চড় থাপ্পড় দেবার দরকার টা ছিলো কি? মেজাজ টাই খিচড়ায় আছে সেই থিকা। তার উপর আবার এই গরম।
সবাইরে দিয়া সব পাপ হয় না। এইটা আজকে সে খুব ভালো মত বুঝে ফেলছে। বাংলামোটর এ একটা প্রাইভেট ফার্ম এ জুনিয়র এক্সিকিঊটিভ সাবের। নাম টা ভারিক্কি, বেতন মাসে ১৮ হাজার। মেস ভাড়া, যাওয়া আসা, খাওয়া মিলায়া হাতে খুব কম ই থাকে। সেই থিকা কিছু বাচায়া বাড়িতে পাঠায় নানা রে। বাপ মা নাই, নানা মানুষ করছে। চাকরীর পাশাপাশি মাস্টার্স টা শেষ এর দিকে। মাস্টার্স শেষ করলে একটা ভালো চাকরি দেখে এই চাকরী ছেড়ে দিবে। একে তো বেতন কম, তার উপর বস একটা মা**চো*। কথায় কথায় গালি দেয়, মুখের উপর কাগজ ছুড়ে মারে।
নাহ, আজকে এই গরমে আর ঘুম আসবে না। বাড়িওয়ালা হালায় আবার ছাদে রাখছে তালা মাইরা। যাওয়া নিষেধ। মশারি থিকা বাইরায়া জানালার সামনে যায়া একটা বিড়ি ধরায় সাবের। রমনার ঘটনা আবার মনে পইড়া যায়। নাহ, আজকের রাত টাই মাটি হয়ে গেছে। হঠাৎ গলির মুখে ট্রান্সফর্মার টা বিকট শব্দ আর ঠাডা পড়ার মত আলোর ঝলকানি দিয়া গেলো ব্রাস্ট হইয়া। শালায় এই গরমে ফ্যান টা না চললে মাংস ভূনা হয়া যাইতে হবে। ঘরে তালা মাইরা রাস্তায় আইসা নামে। সে একা না, আরো বেশ কিছু ব্যাচেলর ভাই বেরাদার ও নামছে রাস্তায়। সে তাদের সাথে যোগ না দিয়া আস্তে আস্তে বড় রাস্তার দিকে আগাইতে থাকে। ঐখানে খোলা অনেক। বাতাস থাকে সব সময় ই। সামনে একটা মাঠ আছে, ঐখানে যায়া বসে। আজকে আকাশে চাঁদ দেখা যাইতেছে না, এই মাত্র খেয়াল করলো সাবের। আকাশ পুরাটা হালকা হালকা মেঘ এ ঢাকা। সাদা হয়া আছে, রাস্তায় চাঁদ ছাড়াই আলো আলো লাগতেছে। হাতের বিড়ি টা আগেই শেষ, আরেকটা ধরারে ঠিক করে। প্যাকেট থিকা একটা বিড়ি বাইর কইরা ম্যাচ এর জন্যে বুক পকেট হাতায়। পায় না। লুংগির কোচে হাতায়, নাই। সাবেরের মন চায় নিজের গালে নিজে একটা চটকানা বসায়। আশেপাশে তাকায় কেউ আছে কি না দেখার জন্যে। কেউ নাই। আবার হাইটা নিজের গলিতে যাইতে মন চাইতেছে না। বিড়ি টা ঠোটে নিয়া বইসা থাকে। আকাশ দেখে। দুঃখ বিলাশ করতে মন চায় তার। গরীবী নিয়া হা হুতাশ করতে মন চায়। খেয়াল করে এইটা নিয়া তার বিন্দু মাত্র হতাশা কাজ করতেছে না। তাইলে কি সে এই গরিবি তেই খুশি? হইতে পারে। আজকে তার মেজাজ টা খারাপ হয় রমনার সামনের ঘটনা টা নিয়া। একে তো টাকা পয়সা গেলো, সাথে রাইত টাও মাটি। কালকে শুক্রবার, ছুটির দিন। ওহ কালকে না, আজকেই। ১২ টা তো অনেক আগেই পার হইছে। ইস, তার অনেক টাকা থাকলে সে এখন কোনো হোটেলে যায়া উঠতো, তারপর একটু লালনীল শরবত খায়া কোনো নায়িকা রে ফোন দিতো। নায়িকা নখরা করলে সাথে থাকা নায়ক রে বলতো শালা তুই আয়। নায়ক তখন ভয় পায়া বলতো ভাই, আমার পেট খারাপ। মনে মানে এইগুলা ভাবতে ভাবতে হো হো কইরা হাইসা উঠে সে। তার হাসি শুইনা একটু দূরে একটা কুত্তা আউউউ কইরা চিৎকার দিয়া উঠে, আর তারপরেই শুরু করে ঘেউ ঘেউ। একটা ইটা তুইলা মারে কুত্তার গা বরাবর। কেউ কেউ করতে করতে পলায়। নাহ, অনেকক্ষন হয়া গেছে। আজকে মনে হয় কারেন্টওয়ালা রা আসবে না এইটা ঠিক করতে। ঠিক করে বাসার গ্রীল বায়া ছাদে উঠবে। মাঠ থিকা উইঠা হাটা শুরু করে সাবের। কিন্তু বাসার সামনে এতো মানুষ, এর মাঝেখানে গ্রীল বায়া উঠা যাবে না। সে আস্তে কইরা বাসার পিছনে যায়। নীচতলার একটা জানালা খোলা। ঠিক করে এই জানালা দিয়া ই উঠা লাগবে। গ্রামে থাকতে ঘরের জানালার সাথে লাগানো বড়ই গাছে কত উঠছে এইভাবে।
জানালার গ্রীল এ পা রাইখা সে ছাদে উঠা শুরু করে। অনেক কসরত কইরা জানালার উপরে একটা পা রাইখা রেলিং এ হাত টা খালি রাখছে, অমনি জানালা দিয়া কে জানি তার পা টাইনা ধরে।
চোর চোর বইলা চিক্কার দিলে কেলেংকারি হয়া যাবে। সে আগেই সারেন্ডার কইরা বসে – “ভাই ভাই, আমি ৩ তলার সাবের। ছাদে যামু ভাই।“
তার পা টা ছাইড়া দেয়, কিন্তু সে এক্সপেক্ট করতেছিলো ঘর থিকা কেউ বলবে ওহ আচ্ছা যান ভাই, বা এইভাবে যান কেনো এইটা ঠিক না এই টাইপ কোনো কথা আসবে। কিন্তু কেউ কিছু বলে না। কোনোমতে রেলিং এ হাত রাইখা ঝিলা ছিলো, পেশি তে টান লাগে, ঝুইলা থাকতে পারে না। নাইমা যায়। নাইমা আবার লাফ দিতে হবে। সে নাইমা আর চোখে ঘরের দিকে তাকায়। কিছু দেখা যায় না। না গেলে না যাক। সে আবার জানালার গ্রীল দুই হাতে ধইরা জানালার উপর পা রাখার প্রস্তুতি নেয়। তার হাত জানালার গ্রীল এ। পা টা কেবল উঠাবে, এমন সময় আবার ও দুইটা হাত তার দুই হাত চাইপা ধরে। প্রথমে বিরক্ত হইলেও হাত দুইটা দেইখা ধক কইরা ধাক্কা খায় সাবের। পাউডার এর মত সাদা দুইটা হাত। এই মাত্র ফ্রিজ পরিষ্কার কইরা আসা হাতের মত ঠান্ডা। সে টের পায় তার হাতে ঠান্ডা লাগে কিন্তু কোনো চাপ লাগে না। সে অনুভব করে কেউ তার হাত চাইপা ধরছে, কিন্তু তার হাতে কোনো চাপ সে পায় না। যেনো হিমালয়ের প্রবল ঠান্ডা হাওয়া প্রচন্ড বেগে আইসা তার হাতে বসছে। সে কেবল হাত দুইটাই দেখে, হাতের কোনো শরীর তার চোখে আসে না।
সকালে এলাকার ঝাড়ুদার ঝাড়ু দিতে আইসা দেখে একটা লোক সরদার সাহেবের বাড়ির পিছে জানালা ধইরা দাঁড়ায় আছে। সে ভাবে চোর। হাতের লাঠিওয়ালা লম্বা ঝাড়ু টা নিয়া সে তারে মারতে যায়। কিন্তু সামনে যায়া ই সে এমন চিৎকার দেয় যে, এলাকার অনেক লোক আইসা জড়ো হয়। লোকটা যে সাবের বুঝতে অনেক কষ্ট হয় সবার। সারা গায়ে যেনো এক ফোটা রক্ত নাই। সাদা ফ্যাকাসে হয়া একদম ফ্রীজ হয়া দাড়ায়া আছে সাবের। সাবের দাড়ায়া আছে সরদার সাহেবের নীচতলার সেই ঘরের সামনে যেই ঘর টা গত ১১ বছর ধইরা বন্ধ। সরদার সাহেব নিজেও জানেনা কেনো এই ঘর বন্ধ। সে জানে, যার থেকে বাড়ি টা কেনা হইছিলো, সে বলে দিসিলো নীচের উত্তর দিকের ঘরের দরজা জানালা খোলা যাবে না। ঐ ঘর ভাড়া ও দেয়া যাবে না। সরদার সাহেব ও এক বাক্যে কেন জানি মাইনাও নিছিলো। আজকে হঠাৎ সরদার সাহেবের সেই সব কথা মনে পইড়া যায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ৯:৫৭