somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ উৎসবের শহরে দুমড়ানো নারীদেহ

২২ শে জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শহরের রাস্তার বাতির দিকে এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমান্ডার চোখ কেমন যেন হয়ে গেল। এখন সে যেদিকেই তাকায় সেদিকে একটা আলোর বিন্দু দেখে। ব্যাপারটা তার কাছে মজাই লাগে। ছোটো বেলায় রবসনের সাথে এই খেলাটা প্রায়ই সে খেলতো। কোনো কোনো সন্ধ্যায় তারা খেলতে খেলতে রাস্তায় চলে আসতো। তারপর নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতো রাস্তার নিয়ন বাতির দিকে। বেশীক্ষণ তাকালে তাদের মনে হত আলোটা তাদের চোখের ভেতরে ঢুকে গিয়েছে। সে কবেকার কথা! এখন রবসনের সাথে তার তেমন কথাও হয়না। পাড়ার ছেলেদের সাথে ভারিক্কি চালে রবসন হেঁটে চলে। ছেলেবেলার সঙ্গী আমান্ডার দিকে ফিরে তাকানোর অবকাশও নেই তার। অবশ্য আমান্ডারও এসব ব্যাপার নিয়ে একেবারেই দুঃখবোধ জাগেনা।

সময় আমান্ডাকে অনেক বেশী কঠোর করে ফেলেছে। তার বয়স মাত্র তেরো অথচ আজকাল ক্ষুধা-তৃষ্ণার অনুভূতি ছাড়া তার ভিতরে কেন যেন কিছুই কাজ করেনা। কিন্তু তার শরীরে ক্ষুধা থাকা দরকার। তার পেশাই যে মানুষের শরীরের ক্ষুধা মিটিয়ে নিজের পেটের ক্ষুধা নেভানো। এই শরীরি ক্ষুধাটুকু না থাকলে সে পেটের ক্ষুধাই বা মেটাবে কি করে?

নিজেকে যৌনকর্মী ভাবতে কখনই আমান্ডার বাধে না। বরং সে ধরেই নিয়েছে এটাই তার নিয়তি। আমান্ডার বড় বোন আনিতাও একই কাজ করে। তবে আমান্ডার তুলনার তার চাহিদা কয়েকগুন ভালো। পরিবারের লোকদের কাছে আনিতার কদর বেশ। অথচ সে আমান্ডা শত চেষ্টার পরেও তার বোনের মত আয় করতে পারেনা। তার আনিতার মত শরীরী সৌন্দর্য নেই। আটোশাটো পোশাকে আনিতাকে যতটাই আকর্ষণীয় মনে হয়, আমান্ডাকে ঠিক ততখানিই হাস্যকর লাগে।

প্রথম কবে এই কাজ শুরু করেছিলো তা আমান্ডার ঠিক মনে আছে। তারা তখন ব্রাজিলের বোলো হরাইজেন্টোতে থাকতো। তার বয়স তখন সাত কি আট। একদিন তার নানী হুট করে তাকে একটা লোকের সাথে ধরে ঢুকিয়ে দেয়। সেদিন বাঁচার জন্য আমান্ডা প্রাণপনে চিৎকার করেছিলো। নিজেকে রক্ষা করার জন্য গলা কাকিয়ে ঐ তল্লাটের সবাইকে জানান দিতে চেষ্টা করেছিলো। আজকাল আমান্ডার মনে হয়- তার বেচে থাকার চেষ্টা সেদিনই শেষ হয়ে গিয়েছে। হয়তো ঐদিনই সে মারা গিয়েছে। আজ যা আসলে আমান্ডার দেহ বেচে আছে, আত্মার মৃত্যু সেদিনই হয়েছে।

আমান্ডা এখন রিও ডি জেনেরিওর একটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ফুটবল বিশ্বকাপ উপলক্ষে শহরটা কি অসাধারণ সাজে সেজেছে। আলো ঝলমল করছে চারিদিকে। পর্যটকদের ভীড়ে মুখরিত প্রতিটি খাবারের দোকান,হোটেল, নাইট ক্লাব। তার মত যৌনকর্মীদের চাহিদাও বেড়ে গিয়েছে। সেদিন তার বান্ধবী রোজ তো খুশিতে ঝলমলে চেহারা নিয়ে ফিরে এল। এক খদ্দের নাকি তাকে নিয়ে খেলাও দেখতে গিয়েছিল। শুধু রোজ না, তার সমসাময়িক অনেকেই বেশ ভালো পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে। সবাই যে ভালো রোজগার করতে পারছে এ কথা অবশ্য ঠিক না। আমান্ডার মত কেউ কেউ আছে যারা দেখতে ভালো না, যাদের কোনো সৌন্দর্য নেই, যাদের চোখে কোনো কামুক ভাব নেই, অতএব তাদের কোনো তেমন দামও নেই।

আমান্ডা ভেবেছিলো বিশ্বকাপ শুরু হলে তার খদ্দের কিছুটা বাড়বে। অন্তত এই কয়েকদিন পেটে দানাপানি নিয়মিতই পড়বে। কিন্তু ঘটনা আসলে সেভাবে ঘটেনি। খদ্দের কিছু জুটেছিল কিন্তু দাম ওভাবে পায়নি। বরং কয়েকবার এক প্যাকেট সিগারেট, এক প্যাকেট গাঁজার বিনিময়ে কাজ সারতে হয়েছে। গাজা আমান্ডা তেমন নেয় না। কিন্তু ওটার একটা সুবিধা আছে। গাঁজা নেয়ার সাথে সাথে ক্ষুধাতৃষ্ণার ব্যাপারটা সে বেমালুম ভুলে যায়। এটাই বা কম কিসে। এই যে সে রোজ সন্ধ্যায় চুল সাজায়, মুখে কড়া মেকাপ দেয়, আটসাট সংক্ষিপ্ত পোশাক পরে এই সবটুকু আয়োজনই তো পেটের ক্ষুধা দমনকে কেন্দ্র করে। গাঁজা খেয়ে ক্ষুধা ভুলে থাকা গেলে মন্দ কি?

আজকে ব্রাজিলের খেলা আছে। কাদের বিপক্ষে ব্রাজিল খেলবে তা অবশ্য আমান্ডা জানে না। তবে যেদিন ব্রাজিলের খেলা থাকে সেদিন রাতে শহরের রাস্তা একদম ফাঁকা হয়ে যায়। লোকজন চুপচাপ টেলিভিশনের সামনে বসে যায়। ফুটবলের দেশের মানুষেরা ফুটবলকে নিজের আত্মার সাথে মিশিয়ে নিয়েছে। তাদের কাছে ফুটবল হল দেশপ্রেমের অংশ। কিন্তু আমান্ডার তাতে তেমন কিছু আসে যায়না। একদম যে আসেনি কখনও তা বললে অবশ্য ভুল হবে। বছর খানেক আগে সে গর্ভধারণ করেছিলো। বাচ্চাটাকে এবরোশন করে বাড়ি ফেরার পথে তার একবার মনে হয়েছিল- এই শিশুটা বেচে থাকলে হয়তো বড় কিছু হতে পারতো। হয়তো বড় কোনো ফুটবলার হয়ে সারা দুনিয়াকে চমকে দিতে পারতো। ফুটবল নিয়ে আমান্ডার ভাবনা এমনই। এর বেশী কিছুনা।

আমান্ডা আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। রাস্তায় ছুটে যাওয়া গাড়িগুলোর দিকে ইশারা করলো, কাজ হল না। লাল বাতি জ্বলে উঠতেই থেমে যাওয়া গাড়ির জানালায় উকি দিলো। কেউ আমান্ডার আমন্ত্রণে আজ সারা দিচ্ছে না। অথচ ক্ষুধা নামক জন্তুটা ভিতর থেকে ক্রমশ ডাক ছাড়া শুরু করেছে। আমান্ডার আর ভালো লাগে না।

রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। অথচ শহরের কোনো বাতিই নিভছে না আজ। প্রতিটা ঘরে আজ কেউ উৎসব। বিশ্বকাপের উন্মাদনায় শহরে আলোর উৎসব। অথচ আমান্ডা নিজেকে এই উৎসবে সামিল করতে পারেনি। দূর থেকে মানুষের উল্লাসিত চিৎকার শোনা যায়। নিশ্চয়ই ব্রাজিল গোল করেছে! আমান্ডা এবার খদ্দের খোজায় হাল ছেড়ে দেয়। আজ সেও সবার সাথে উৎসব করবে। ক্ষুধার জ্বালা কিছুটা ভুলবে ফুটবল খেলা দেখে। ফুটবলের এই দেশে আমান্ডা আলাদা কেউ না।

( সেদিন একটা নিউজ পড়ে গল্পটা মাথায় ঘুরছিলো। সেই সাথে মাহমুদ মামুর ফুটবলের গল্প লেখার অনুরোধ তো ছিলোই। এই গল্পটা তাই মাহমুদ মামুকেই উৎসর্গ করলাম।)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫৬
৭১টি মন্তব্য ৬৯টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×