ইসলাম এমন এক চমৎকার শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন ব্যবস্থা যার সম্পর্কে আপনি যত জানবেন ততই মুগ্ধ হবেন। ইসলাম প্রত্যেক অধিকারীর অধিকার সঠিকভাবে ঘোষনা দিয়েছে। মানবাধিকার, নারী অধিকার, পিতা মাতার অধিকার ইত্যাদি তো বটেই পশু পাখির অধিকার এমনকি রাস্তার অধিকারও ইসলাম দিয়েছে। এটা এক বিশাল বিস্ময়ের ব্যাপার। আমরা জানি রাস্তা মানব জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। রাস্তা ছাড়া কোথাও যাওয়া কত কষ্টকর সেটা জঙ্গলে গেলেই বোঝা যায়। ভাঙা রাস্তা নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ আর প্রতিবাদ থেকেও বুঝা যায় রাস্তার গুরুত্ব। যাইহোক, আজকের আলোচনা করব রাস্তার হক নিয়ে বা রাস্তার আদব নিয়ে। বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সা.) এব্যাপারে আমাদের কিছু চমৎকার নির্দেশনা দিয়েছেন। আর প্রত্যেক মুসলিমকে অবশ্যই সেই নির্দেশ পালন করা উচিত। কিন্তু আফসোসের বিষয় আজকাল অনেক মুসলিম রাস্তার হক প্রতিনিয়ত নষ্ট করে চলেছেন। অনেকে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে হরতাল, রাস্তা জ্যাম ইত্যাদিও করছেন। অথচ ইসলামে এসব নিষিদ্ধ। আসুন হাদিস থেকে রাস্তার আদব সম্পর্কে কিছু জেনে নেই
প্রথমে আপনাদের যে হাদিসটি শুনাবো সেটা ঈমানের সাথে সম্পর্কিত। রাস্তার আদব কত গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার সেটা এই হাদিস থেকেই বুঝতে পারবেন। এটা খুব প্রসিদ্ধ হাদিস। অনেক গুলো রাবি থেকে বর্ণিত। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ঈমান ষাঠাধিক অথবা সত্তরাধিক শাখাবিশিষ্ট। তন্মধ্যে সর্বোচ্চ শাখা (কান্ড) হল ‘লা ইলাহা ইলাল্লাহ’ বলা। আর সর্বনিম্ন শাখা হল পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করে দেওয়া....’। (বুখারীর ৯নং সংক্ষিপ্ত, মুসলিম ১৬২) চিন্তা করুন, রাস্তায় পথযাত্রীদের জন্য কষ্টদায়ক বস্তু যেমন পাথর বা অন্য কিছু দূর করা ঈমানের একটা শাখা। শুধু তাই নয়, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক কিছু সরানো পাপমুক্তিরও একটা মাধ্যম। বিশ্বনবী (সা.) বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাস্তায় চলতে চলতে একটি কাঁটার ডাল পেল, সে সেটিকে সরিয়ে দিল। আল্লাহ তার এই কাজের কদর করলেন এবং তাকে পাপমুক্ত করে দিলেন’। (বুখারী/৬৫২; মুসলিম/৫০৪৯)
রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করা ঈমানের শাখা, পাপমোচনকারী, সৎ কর্ম এবং সদক্বাহও। একজন মুসলিমের জন্য সমাজ কল্যানমুলক গুরুত্বপূর্ণ যতগুলো সৎ কর্ম আছে তার মধ্যে রাস্তার আদবও একটা। নবী (সা.) বলেছেন, ‘একদা আমার নিকট উম্মতের ভালো ও মন্দ আমল পেশ করা হল। তার ভালো আমল সমূহের অন্তর্ভুক্ত একটি আমল দেখলাম, পথ হতে কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করা.....’। (মুসলিম/১২৬১)। একদা সাহাবী আবু বার্যাহ (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর নবী! আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন, যার দ্বারা আমি উপকৃত হতে পারব। তিনি বললেন, ‘মুসলিমদের রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করো’। (মুসলিম/৬৮৩৯)। ভেবেদেখুন, একজন সাহাবীকে রাসুলুল্লাহ (সা) উপকৃত হওয়ার জন্য রাস্তার কষ্টদায়ক বস্তু দূর করার নির্দেশ দিলেন। অর্থাৎ এই কাজটি কত উচু লেবেলের ভালো কাজ! বুরাইদাহ (রা.) কর্তৃক বর্ণিত আরেকটি চমৎকার হাদিস শুনুন। বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সা.) বলেন, ‘মানবদেহে ৩৬০ টি গ্রন্থি আছে। প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ঐ প্রত্যেক গ্রন্থির তরফ থেকে দেয় সদক্বাহ রয়েছে’। সকলে বলল, ‘এত সদক্বাহ দিতে আর কে সক্ষম হবে হে আল্লাহর রাসুল?’ তিনি বললেন, ‘মসজিদ হতে কফ (ইত্যাদি নোংরা) দূর করা, পথ হতে কষ্টদায়ক বস্তু (কাঁটা-পাথর প্রভৃতি) দূর করা একটা সদক্বাহ। যদি তাতে সক্ষম না হও, তবে দুই রাক’আত চাশতের নামাজ তোমার সে প্রয়োজন পূর্ণ করবে’। (আহমাদ, আবু দাউদ/৫২৪৫; ইবনে হিব্বান; সহীহ তারগীব/৬৬১)।
আবু সাইদ খুদরী (রা.) প্রমুখাৎ বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা রাস্তার উপর বসা থেকে দূরে থাকো’। তা শুনে লোকেরা বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! কিন্তু রাস্তায় না বসলে তো উপায় নাই। যেহেতু আমরা সেখানে কথা বার্তা বলে থাকি’। আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমরা না বসতে যদি অস্বীকারই করো, তাহলে রাস্তার হক আদায় করো’। লোকেরা বলল, ‘রাস্তার হক কি?’ তিনি বললেন, ‘চক্ষু অবনত রাখা, কষ্টদান থেকে বিরত থাকা, সালামের জবাব দেওয়া, (উত্তম কথা বলা, পথভ্রষ্টকে পথ বলে দেওয়া) এবং ভালো কাজের আদেশ দেওয়া ও মন্দ কাজে বাধা দান করা’। (বুখারী/২৪৬৫; মুসলিম/৫৬৮৫)। এই হাদিসে মুহাম্মাদ (সা.) রাস্তার হকের ব্যাপারে আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন যাতে আমরা অকারণে রাস্তা বা রাস্তার ধারে আড্ডা না দেয়, চক্ষু অবনত রাখি, পথযাত্রীদের কোনভাবে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকি, ভালো কথা বলি, পথযাত্রীকে রাস্তা বাতলে দেয়, মানুষকে ভালো কাজের আদেশ দেয় এবং খারাপ কাজ করতে দেখলে বাধা দেয়। কি চমৎকার শিক্ষা!
এবার, রাস্তার হক নষ্ট করার বিষয়ে হাদিস শুনুন। রাস্তার হক নষ্ট কোন সাধারণ বিষয় নয়। ইসলামে এটা খুব কঠোর একটা ব্যাপার। মু’আয বিন জাবাল (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, ‘বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সা.) বলেন, ‘তোমরা তিনটি অভিশাপ আনয়নকারী কর্ম থেকে বাচো। আর তা হল, ঘাটে, মাঝ রাস্তায় এবং ছায়ায় পায়খানা করা’। (আবু দাউদ/২৬; ইবনে মাজাহ/৩২৮; সহীহ তারগীব/১৪১)। নিশ্চয় এই কাজ গুলো পথযাত্রীদের জন্য কষ্টদায়ক। রাস্তায় পায়খানা করলে বা নোংরা ফেললে পায়ে হাটা যাত্রীদের অনেক অসুবিধা। আর গাছের ছায়ায় যারা আরাম করে তাদের জন্যও অসুবিধা। আল্লাহর রাসুল (সা.) এসব ঘৃণ্য কাজকে নিষিদ্ধ করেছেন যাতে পথিক ভালোভাবে সফর করতে পারে আর আরাম করতে পারে। কত সুন্দর সামাজিক সিস্টেম এটা। কত সুন্দর সুন্নাহ!
পরিশেষে বলব, এত সুন্দর জীবন বিধান থাকা সত্যেও মুসলিমদের মধ্যে এসব তেমনভাবে প্রচারিত হয় না, তাই খুব কম মুসলিমই রাস্তার হকের ব্যাপারে সচেতন। আমি মাঝে মাঝেই বলি, আবারো বলছি, ইসলাম শুধু প্রচলিত ইবাদত উপাসনা কেন্দ্রিক ধর্ম নয়। ইসলাম হল জীবন ব্যবস্থা। সকালে ওঠা থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত সকল বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হল ইসলাম। ইসলাম জীবনের সকল ক্ষেত্রেই আদব শেখায়। পেচ্ছাপ পায়খানারও আদব শেখায়। অথচ এটা কত সামান্য ব্যাপার। সকল অধিকারীর অধিকার দিতে বলে। এমনকি রাস্তা বা পিপড়ারও। অথচ আমাদের কাছে তা কত তুচ্ছ! আমাদের সকলেরই উচিত ইসলামকে সঠিকভাবে মেনে চলা। আল্লাহ আমাদের ইসলাম দিয়ে সন্মানিত করেছেন। জাহিলিয়াত আরবের লোকেরা ইসলামকে জীবন ব্যবস্থা রুপে গ্রহন করে যদি পৃথিবীর সেরা মানুষ হতে পারেন তাহলে আমরা কেন ইসলামকে সঠিকভাবে গ্রহন করে নিজের অবস্থা পাল্টাতে পারব না?!