তালাক নিয়ে কিছু বলার আগে আমার বুঝে নেওয়া উচিত তালাক সবক্ষেত্রেই ঘৃণ্য নয়। অনেক ক্ষেত্রে তালাক রহমত। কাউকে বিয়ে করা মানেই সাত জন্মের সম্পর্ক হয়ে যায় না। দুজন মানুষের একে অপরের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, দায়িত্ব ইত্যাদি দিয়ে একটা মজবুত সম্পর্ক গঠিত হয়। কিন্তু সবাই বিয়ে করলেই কি সুখী হয়! কত মানুষের জীবন বিয়ের পরে কষ্টের হয়ে যায় তার উদাহরণ কি আমাদের জানা নেই? একটা মেয়ের বিয়ে দেওয়া হল, তার কিছুদিন পর তার উপর যৌতুক নিয়ে অত্যাচার শুরু হল। শারীরিক অত্যাচার, মানসিক অত্যাচার। পুরো শ্বশুরবাড়ীর লোক মিলে বাড়ির সব কাজ একাই সেই মেয়েকে দিয়ে করাই, কাপড় কাঁচায়, রান্না করায়। তার উপর সারা দিন খোঁচা দিয়ে কথা বলা তো আছেই! এ অবস্থায় সেই মেয়ে কি করবে? বিয়ে করেছে বলে সারাজীবন কষ্ট করে, মার খেয়ে, কেঁদে কেঁদে কাটিয়ে দেবে নাকি তালাক নিয়ে মুক্ত হবে? নিঃসন্দেহে তালাক তার জন্য রহমত।
তাই যদিও আল্লাহর অপছন্দনীয় বস্তু সমূহের অন্যতম হল বিচ্ছেদ বা তালাক তারপরেও ইসলামে তালাকের বিধান আছে। জাহিলিয়াত যুগে বিবাহ বিচ্ছেদ ছিল খুব কঠিন নারীদের জন্য। শুধু জাহিলিয়াত কেন মাত্র এক দুই শো বছর আগেও সারা দুনিয়ায় বিবাহ বিচ্ছেদ নেওয়াটা ভয়ংকর ছিল স্ত্রীদের জন্য। এক্ষেত্রে ইসলাম এবং মুসলিম নারীরাই ব্যতিক্রম ছিল। আপনারা জানেন, ইসলামে তালাকপ্রাপ্তা নারী কোন ঘৃণ্য বা অপমানিত নারী নয়। বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তদেরও বিবাহ করার অধিকার আছে। আর শুরু থেকেই তা হয়েও আসছে। মুসলিমদের মধ্যেই দেখবেন সবথেকে কম মেয়ে, বিধবা, তালাকপ্রাপ্তারা অবিবাহিত হয়ে আছেন। কারন, বিধবা বা ডিভোর্সীদের সহজেই বিয়ে হয়ে যায়। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.)-ও বিধবা এবং ডিভোর্সীকে বিয়ে করেছেন। আর উনি আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।
আর ইসলামে শুধু পুরুষদের বিচ্ছেদের অধিকার দেয়নি। নারীদেরও দিয়েছে। পুরুষরা যে পদ্ধতিতে বিচ্ছেদ করে সেটাকে তালাক বলে। আর মেয়েরা যে পদ্ধতিতে বিচ্ছেদ করে সেটাকে খোলা বলে। স্ত্রীদের বিচ্ছেদ করার সিস্টেম গণতান্ত্রীক দেশের আইন ছাড়া অন্য কোন ধর্ম বা মতবাদে সম্ভবত নাই। ইসলামই শুধু মেয়েদের সেই অধিকার দিয়েছে। আপনারা জানেন বুখারী এবং অনান্য হাদীস গ্রন্থে খোলা ও তালাক অধ্যায়ে একটি ঘটনার উল্লেখ আছে। একটি মেয়ে এসে রাসুলুল্লাহ (সা.) -কে অভিযোগ করেন তার স্বামী তাকে মেরেছে এবং অঙ্গহানী করেছে। এবং সে আরো অভিযোগ করেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) তার স্বামীকে ডাকেন এবং সব শোনার পর তাদের বিচ্ছেদ করিয়ে দেন। এটাই ইসলামের ইতিহাসের প্রথম খোলা। এই ঘটনার পরিপেক্ষীতেই সুরা বাক্বারার ২২৯ এর দ্বিতীয়াংশ নাযীল হয়।
তালাকে বিদ’আহ মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড, কোর্ট এবং মিডিয়া্র কারণে এত চর্চায় এসেছে যে একটা ধারণা সৃষ্টি হয়েগেছে ইসলামে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ খুব সহজ। তালাক তালাক তালাক বলো আর বিবাহ থেকে মুক্তি পাও। আসলে কিন্তু এরকম না। ইসলাম কখনোই তালাককে উতসাহ দেয়নি বা বিবাহ বিচ্ছেদ সিস্টেমকে তিনবার মুখে উচ্চাচরণ করার মতো সহজ করে দেয়নি। আল্লাহর অপছন্দনীয় বস্তু সমুহের অন্যতম হল স্বামী স্ত্রীর বিচ্ছেদ বা তালাক ব্যবস্থা। একটা সম্পর্ক যাতে সুসম্পর্কে পরিণত হয় এবং বিচ্ছেদের দিকে না যায় তার জন্য ইসলামে অনেক গুলো উপদেশ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুরুষদের বেশি বলা হয়েছে কারণে পুরুষদের পক্ষ থেকে যত তালাক হয়, নারীদের পক্ষ থেকে খোলা তেমন হয় না। নারীরা এমনিতেই কষ্ট সহ্যকারী, পরনির্ভরশীল এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। সংসার এবং সন্তান নিয়ে পুরুষদের থেকে অনেক বেশি সিরিয়াস তারা। শুধু সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে কত নারী স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার সহ্য করে থাকে। তবুও বিবাহ বিচ্ছেদ চাই না। নারীদের প্রতি অত্যাচার একটা বাস্তব সত্য। তাই কিছুদিন আগে লিখেছিলাম আরো অনেক নারী সংগঠন দরকার যারা নারীদের অধিকার নিয়ে লড়বে। বিশেষ করে গ্রামের দিকে। যাইহোক, ইসলামে সেজন্য পুরুষদেরই বেশি উপদেশ দেওয়া হয়েছে সুসম্পর্ক গড়ার ব্যাপারে এবং সাবধান করা হয়েছে অনেক ব্যাপারে।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘স্ত্রীদের সাথে সৎ ভাবে জীবন যাপন করো, তোমরা যদি তাদেরকে ঘৃণা করো, তাহলে এমনও হতে পারে যে, আল্লাহ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন, তোমরা তাকে ঘৃণা করছ’ (সুরা নিসা/১৯)। কত সুন্দর উপদেশ! স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে কোন স্বামী যদি তার স্ত্রীকে পছন্দ না করে, ভালো না বাসে বা তার চেহারা সুরত তাকে পছন্দ না হয় তাহলেও যেন তার সাথে ভালোভাবে জীবন যাপন করে। কারণ, তার মাধ্যমে আল্লাহ প্রভূত কল্যান দিতে পারেন। প্রকৃত মুসলিম ব্যক্তি কিন্তু এ অবস্থাতেও আল্লাহর প্রভূত কল্যানের আশায় স্ত্রীর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে। এখানে কিন্তু সমস্যা থাকা সত্তেও তালাকের দিকে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘কোন বিশ্বাসী পুরুষ যেন কোন বিশ্বাসী নারী (স্ত্রীকে) ঘৃণা না করে। যদি সে তার একটি আচরণে অসন্তুষ্ট হয়, তবে অন্য আচরণে সন্তুষ্ট হবে’। [মুসলিম/১৪৬৯] নবীজীও আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন স্ত্রীদের খারাপ গুণের কারণে আমরা যাতে তাদের ঘৃণা না করি। কারণ খারাপ জিনিসের পাশাপাশি ভালো জিনিসও আছে। যা আমাদের সন্তুষ্ট করবে। এখানে সমস্যা ভুলে সুসম্পর্ক গড়তেই উতসাহিত করা হচ্ছে।
এছাড়া মুহাম্মাদ (সা.) অনেক উপদেশ দিয়েছেন স্বামীদের। একটি হাদীসকে আমি দাম্পত্য টিপসের জন্য সেরা টিপস মনে করি। স্বামীদের জন্য সতর্কবানীও এটা। নবী (সা.) বলেন, ‘সবার চেয়ে উত্তম ব্যক্তি সে, যার চরিত্র সবার চেয়ে সুন্দর এবং তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম ব্যক্তি সেই, যে তোমাদের মধ্যে নিজ স্ত্রীদের নিকট উত্তম’। (আহমাদ; তিরমিযী; ইবনে হিব্বান; সহীহুল জামে/১২৩২)। অর্থাৎ সর্বোত্তম ব্যক্তি হওয়ার জন্য স্ত্রীর নিকট সর্বোত্তম হতে হবে। স্ত্রীর সার্টিফিকেট দরকার। তাহলে কতই না ভালো ব্যবহার করার নির্দেশ আছে স্ত্রীর প্রতি। আরো বলা হয়েছে, তোমরা স্ত্রীদের জন্য হিতাকাঙ্খী হও, মঙ্গলকামী হও, তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করো, স্ত্রীদের জন্য সজসজ্জা করো, তাদের সাথে ভালো সময় কাটাও, হাসি মজাক করো। বলা হয়েছে, স্ত্রীর মুখে খাবার তুলে দেওয়া, ভালাবাসার নজরে তাকানো নেকির কাজ। স্ত্রীকে সংসারী কাজে সাহায্য করা সুন্নাহ, স্ত্রীর এঁটো খাবার খাওয়া সুন্নাহ, স্ত্রীর সাথে খেলা সুন্নাহ। এসবই আসলে সুসম্পর্ক গড়ার জন্যই। একটা ঘটনা দিয়ে দ্বিতীয় পর্ব শেষ করছি, এক ব্যক্তি তার স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের কথা চিন্তাভাবনা করছিলেন। হযরত উমার (রা) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কেন তোমার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাও?” সে উত্তর দিলো, “আমি তাকে ভালোবাসি না।” উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, “সমস্ত সংসারের ভিত্তি কি ভালোবাসা হতেই হবে? পারস্পারিক সহানুভূতি আর আনুগত্যের কী হবে?” [আল-বায়ান আত-তাবাঈন, ২/১০১]