র্যাবের অভিযানে ৬ বছরে ৫শ' ক্রসফায়ার গ্রেফতার ৬২ হাজার
গত ৬ বছরে র্যাব সদস্যরা সারাদেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালিয়ে প্রায় ৬২ হাজার ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে র্যাবের সঙ্গে তথাকথিত ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে ৫শ'র বেশি ব্যক্তি নিহত হয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি র্যাব সদস্যরা ছিনতাই ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। এ অভিযোগে র্যাবের বিভাগীয় বিচারে ৭শ'র বেশি র্যাব সদস্যের সাজা হয়েছে। র্যাব কর্মকর্তাদের মতে, র্যাবের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকবে। এছাড়াও কোন র্যাব সদস্য অপরাধ করলে তাকেও ছাড় দেয়া হবে না। সপ্তম বছর থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে র্যাব সদস্যরা স্থলপথের পাশাপাশি আকাশপথে হেলিকপ্টার ও জলপথে অত্যাধুনিক নৌযান নিয়ে অভিযানে নামবে। র্যাব হেডকোয়ার্টার্স সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
র্যাব হেডকোয়ার্টার্স সূত্র জানায়, ২৬ মার্চ র্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন_ র্যাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ২০০৪ সালের এই দিনে জাতীয় স্বাধীনতা দিবসের প্যারেডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এলিট ফোর্স র্যাবের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল (পয়লা বৈশাখ) র্যাব সদস্যরা রমনার বটমূলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে মাঠে নামে। প্রথম অপারেশন শুরু শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নানের গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে র্যাব সদস্যরা দেশের সন্ত্রাস দমন, আইন শৃঙ্খলার মান উন্নয়ন ও বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে।
সূত্র মতে, র্যাব সদস্যরা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও হরকাতুল জিহাদের (হুজি) কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের জঙ্গিদের গ্রেফতার ও তাদের আস্তানা থেকে অস্ত্র, বিস্ফোরকসহ বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক গ্রেনেড ও বোমা উদ্ধার করে।
র্যাব সদস্যরা চলতি বছরের ১০ মার্চ পর্যন্ত দেশব্যাপী অভিযান চালিয়ে ৬২ হাজার অপরাধীকে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে ৫৬৫ জন জামায়াতুল মুজাহিদীন (জেএমবি) ও হরকাতুল জিহাদসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। অভিযানের সময় ৬ হাজার ৮৪৪টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৫৭ হাজারের বেশি গোলাবারুদ, ৩৬শ'র বেশি গ্রেনেড, বোমা ও ককটেল এবং প্রায় ৪ হাজার কেজি বিস্ফোরক উদ্ধার করেছে।
সূত্র মতে, ২০০৯ সালে র্যাবের উল্লেখযোগ্য জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলাকালে ১৪ মে র্যাবের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব সদস্যরা রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে জেএমবির বোমা বিশেষজ্ঞ বোমা মিজান ওরফে জাহিদ হোসেন সুমন ও তার স্ত্রী হালিমা বেগম ওরফে শারমীনকে গ্রেফতার করেছে। তাদের স্বীকারোক্তি মতে, মিরপুরে বোমা মিজানের বিস্ফোরক তৈরির ল্যাবরেটরি থেকে বোমা তৈরির রাসায়নিক দ্রব্যাদি, বোমার সরঞ্জাম, মাইন তৈরির সরঞ্জামাদি উদ্ধার করেছে। এছাড়াও ২০০৯ সালের ২১ জুন র্যাব সদস্যরা পল্লবী এলাকায় অভিযান চালিয়ে জেএমবির আইটি প্রধান, বোমা ও বিস্ফোরক গবেষক ও গাহরে এহসার সদস্যসহ ৪ জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছে। তাদের আস্তানা থেকে বিপুল পরিমাণ জিহাদি বই, বোমা ও গ্রেনেড তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে। গ্রেফতারকৃত জেএমবির জঙ্গিরা হলো_ এমরানুল হক ওরফে রাজীব, আবু বক্কর ছিদ্দিক ওরফে আবু হানিফ। এদের মধ্যে গ্রেফতারকৃত এমরানুল হক ওরফে রাজীব ২০০৩ সালে বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট থেকে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করে। সে জেএমবির শীর্ষ বোমা বিশেষজ্ঞ। তার হেফাজত থেকে বোমা ও গ্রেনেড তৈরির ২৮ প্রকারের আলামত জব্দ করা হয়।
সূত্র মতে, ২০০৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর র্যাব সদস্যরা খাগড়াছড়ির দুর্গম পাহাড়ে জেএমবির প্রশিক্ষণ ক্যাম্প আবিষ্কার করে। ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে জেএমবির চট্টগ্রাম বিভাগের সেকেন্ড ইন কমান্ড সামরিক শাখার এহসার সদস্যসহ ৫ জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের আস্তানা থেকে বিপুল পরিমাণ জিহাদি বই, গ্রেনেড বডি, গ্রেনেড তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃত অন্যরা হলো_ জেএমবির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সেকেন্ড ইন কমান্ড মো. আবদুর রহিম ওরফে জাহিদ ওরফে হাবিব ওরফে সাইফুল্লাহ, দেলোয়ার হোসেন ওরফে সজীব, মো. ইউনুস আলী ওরফে ইউনুস, মনির হোসেন রিপন।
২০০৯ সালের ২৬ ও ২৭ অক্টোবর র্যাব সদস্যরা নারায়ণগঞ্জ ও রূপগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে জেএমবির শূরা সদস্য মেহেদি হাসানসহ ৬ জঙ্গিকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে ২ জন শূরা সদস্য, ২ জন এহসার সদস্য, ২ জন গাহরে এহসার সদস্য। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ বোমা ও গ্রেনেড তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে।
২০০৯ সালের ১৯ ও ২০ ডিসেম্বর র্যাব সদস্যরা নরসিংদী ও ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে জেএমবির ৫ সদস্যকে আটক করেছে। তাদের কাছ থেকে জিহাদি বই, বোমা তৈরির সঞ্জাম ও দেশী অস্ত্র উদ্ধার করেছে। গ্রেফতারকৃত জঙ্গিরা হলো_ হুরমুজ আলী ওরফে আজগর আলী, আবু রায়হান বিন সাদেক, মো. ইউসুফ, মো. হুসাইন ও কাউসার জিনুরাইন ওরফে লাল্টু।
র্যাব হেডকোয়ার্টার্স সূত্র জানায়, দেশব্যাপী র্যাবের জঙ্গিবিরোধী অভিযান অব্যাহত আছে। র্যাবের বিশেষ গোয়েন্দা ইউনিট অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করে জঙ্গিদের অবস্থান নিশ্চিত শেষে অভিযান চালিয়ে জঙ্গিদের গ্রেফতার করছে। দেশব্যাপী র্যাবের জঙ্গি কার্যক্রম অব্যাহত আছে।
সূত্র মতে, জঙ্গিবিরোধী অভিযান ছাড়াও র্যাব সদস্যরা মাদক ও ইয়াবাবিরোধী অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা, আইসপিল, ভায়াগ্রা, হেরোইন, গাঁজা, ফেনসিডিল, কোকেন ও নেশাজাতীয় ইনজেকশন উদ্ধার করেছে।
ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ : র্যাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে চলতি মাসের ১০ মার্চ পর্যন্ত রাজধানীসহ সারাদেশে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে প্রায় সাড়ে ৫শ' জন নিহত হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, র্যাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ২০০৪ সালে র্যাব ও সন্ত্রাসীদের তথাকথিত ক্রসফায়ারে ৫৪ জন, ২০০৫ সালে ১০৬ জন, ২০০৬ সালে ১০৯ জন, ২০০৭ সালে ৮১ জন, ২০০৮ সালে ৬৩ জন, ২০০৯ সালে ৩৮ জন, ২০১০ সালের চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ১০ জন মারা গেছে। অর্থাৎ তাদের হত্যা করা হয় ক্রসফায়ারের নামে। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
সূত্র মতে, র্যাবের বন্দুকযুদ্ধে (ক্রসফায়ারে) মানুষ হত্যা নিয়ে প্রতিষ্ঠার পর থেকে র্যাব সদস্যরা নানাভাবে নিন্দিত হয়েছে। ক্রসফায়ারকে বিচারবহির্ভূত হত্যা বলে অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করেন। এ নিয়ে র্যাব সদস্যরা সমালোচিত হয়েছে। অন্যদিকে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে শীর্ষ জঙ্গি ও বোমাবাজদের গ্রেফতার করে র্যাব সদস্যরা আলোচিত হয়েছে।
র্যাবের সাজা : পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত র্যাব সদস্যরা অপরাধ দমনের পাশাপাশি নিজেরাও নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ছিনতাই, চাঁদবাজি ও অপারেশনের সময় টাকা আত্মসাৎসহ বিভিন্ন আর্থিক অপরাধ রয়েছে। শৃঙ্খলাপন্থী এসব কাজের জন্য র্যাবের আদালতে ৭শ'র বেশি র্যাব সদস্যকে সাজা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩৮৪ জনকে গুরুদ- ও ৩৩১ জনকে লঘুদ- দেয়া হয়েছে। সাজাপ্রাপ্ত র্যাব সদস্যদের মধ্যে কাউকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর এবং কাউকে বিভিন্ন ভাবে সাজা দেয়া হয়েছে। আবার অনেক র্যাব সদস্যকে ছিনতাই, চাঁদাবাজির অভিযোগে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে।
র্যাবের মহাপরিচালক হাসান মাহমুদ খন্দকার জানান, র্যাব সেবা প্রদানকারী সংস্থা। গত ৬ বছরে র্যাব উল্লেখযোগ্য আস্থা এবং ভালবাসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। আগামী নতুন বছর র্যাব সদস্যরা পেশাদারিত্বের মনোভাব নিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন অব্যাহত রেখে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে। বন্দুকযুদ্ধ (ক্রসফায়ার) সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, র্যাব সদস্যরা আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের দায়িত্ব পালন করছে। নতুন বছরেও (৭ম বছরে) র্যাব সদস্যরা স্থলপথের পাশাপাশি আকাশপথ ও জলপথে অপরাধ দমনে অভিযান অব্যাহত রাখবে। এছাড়াও র্যাব সদস্যদের মানবাধিকার এবং অন্যান্য মানবিক বিষয় সংবলিত যে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে তাও অব্যাহত থাকবে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



