somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডেসটিনি কিংবা অন্যান্য এম.এল.এম. কোম্পানী প্রসঙ্গে!!!! রিপোস্ট

১৭ ই এপ্রিল, ২০১২ রাত ৮:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সবার জন্য আবার রিপোস্ট করিলাম

খুব বেশী দিন আগের কথা নয়। কোকাকোলা তখন ্ পাওয়া যেত কাচের ছোট বোতলে। মাঝে মধ্যেই বিক্রি বাড়ানোর জন্য এর ধাতব ঢাকনির নিচের গুপ্তধনের লোভ দেখানো হত। হয়ত এক কোটি বোতলের মধ্যে একটিতে গাড়ির ছবি, তিনটিতে মোটর সাইকেলের ছবি আর একশটিতে টি-শার্টের ছবি একে বাজারে ছেড়ে দেয়া হত। মানুষজনকে পেপার, টিভিতে এমনভাবে বিজ্ঞাপনে ভুলিয়ে দেয়া হত যে পরিসংখ্যানের শিক্ষকও মনে করতেন কোক খেলেই গাড়ি পাওয়া যাবে। আর গাড়ি না মিললেও নিদেন পক্ষে মোটর সাইকেল তো মিলবেই। ফলাফল - কোকের রমরমা ব্যবসা হত। আট লাখ টাকার পুরষ্কার আর বারো লাখ টাকার বিজ্ঞাপন - একুনে ২০ লাখ টাকা খরচ করে প্রতি বোতল মাত্র দুই টাকা লাভেও দু’কোটি টাকা হাতিয়ে নিত ধুরন্ধর কোমল পানীয়ের কোম্পানিগুলো। অবস্থা এমন হল যে শেষে হাইকোর্ট এ ধরণের আগ্রাসী বিপণন বন্ধ করতে নির্দেশ দিতে বাধ্য হয়েছিল।

মার্কেটিং বা বিপণনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র মানুষের লোভ। আর এই লোভ ব্যবহার করে যত ধরণের নোংরা ব্যবসা টিকে আছে তার অন্যতম হল এমএলএম বা মাল্টি লেভেল মার্কেটিং। আমার এ নাতিদীর্ঘ জীবনে বহু এমএলএম কোম্পানিকে আসা যাওয়া করতে দেখেছি, কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মত সফলভাবে পুরো একটা দেশকে অক্টোপাসের মত জড়িয়ে ধরতে পেরেছে ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড।

চার মাস আগে থেকে যখন এই লেখার প্রস্তুতি শুরু করি -এদের বই, পত্রিকা, সিডি, ট্রেনিং ম্যাটেরিয়াল যোগাড় করে দেখতে দেখতে তখন থেকেই এদের ধূর্ততার সূক্ষ্মতায় আশ্চর্য হয়ে যাই। এদের সাফল্যের কারণ বিশ্লেষণে আমি তিনটি মূল বিষয় পেয়েছি -


১. নিয়মতান্ত্রিকতা,
২. ধর্মীয় ও সামাজিক অপব্যাখ্যা,
৩. লোভের পারমাণবিক বিষ্ফোরণ।

এদের প্রতিটা কাজ দেশের প্রচলিত আইন মেনে করা হয়, প্রতিটি আইনের ফাঁক-ফোঁকর কাজে লাগানোর জন্য একটি দক্ষ আইনজীবি দল পোষা হয়। কর আদায় হয় কড়ায় গন্ডায় যেন সরকারের মুখ বন্ধ থাকে। খুব উচু মানের একাউন্টিং সফটওয়ার দিয়ে প্রতিটা হিসাব সংরক্ষণ করা হয়। পেপারওয়ার্ক এমনভাবে করা হয়, চুক্তিগুলো এমনভাবে সাজানো হয় সাম্রাজ্যবাদীদের অত্যাচার কৌশলের মত। কাচের বোতলে গরম পানি ভরে পায়ের তলায় মারলে কোন দাগ পড়েনা, কিন্তু এত ব্যাথ্যা হয় যে অত্যাচারী ব্যক্তি দাঁড়াতেই পারেনা, পালিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা। একবার যে ডেসটিনির সাথে ব্যবসায় ঢুকে পড়েছে তার দুটি রাস্তা খোলা থাকে -ক্ষতি সহ্য করে চুপচাপ পালিয়ে যাওয়া নয়ত ডেসটিনির অংশ হয়ে আরো মানুষদের শিকার করে নিজের ক্ষতিকে লাভে বদলে দেয়া।

ডেসটিনির নিজস্ব শরীয়া বোর্ড আছে, সত্যিকার অর্থেই অর্থ দিয়ে পোষা কিছু আলিম আছে। এদের কাজ আল্লাহর আইনকে অপব্যাখ্যা করা। এই অপব্যাখ্যা ক্ষেত্র বিশেষে স্থুল - যেমন বিয়ের আগে খাদিজা (রাঃ) এর সাথে রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে মুদারাবা ব্যবসা ছিল তা নাকি এমএলএম ছিল। আবার কখনো তা খুবই সূক্ষ্ম, যেমন- নেটওয়ার্কিং এর সাথে পণ্য বিক্রয়কে যুক্ত করেছে কিন্তু তার জন্য আলাদা আলাদা চুক্তিপত্র করার মাধ্যমে এরা সত্যের সন্ধানী আলিমদেরও ধোঁকা দিয়েছে। এরা ভাড়া করে কবি-সাহিত্যিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, এমপি-মন্ত্রীদের তাদের অনুষ্ঠানে আনে। এরা সবাই অকুন্ঠ কন্ঠে ডেসটিনির প্রশংসা করে, বেকারত্ব দূর করার মহান প্রয়াসের সার্টিফিকেট দেয়। সাধারণ মানুষের ঘাড় ভাঙাকে এরা দেশের উন্নতির জন্য কাজ বলে তকমা দেয়, তাকে শুধু কর্ম না বরং পূণ্যকর্ম, পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে দেখতে বলে।

এমএলএম তথা ডেসটিনির মূল ব্যবসা যে ইসলাম সম্মত নয়, মানবরচিত আইনকে পুঁজি করে মানুষ ঠকানোর একটা খেলা তা শ্রদ্ধেয় জিয়াউর রহমান মুনশীর “ইসলামে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) এর বিধান” শীর্ষক লেখাটিতে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। এটি ড. মানযুরে ইলাহীর সম্পাদনার পর ইসলাম হাউস ওয়েবসাইটে [ http://www.islamhouse.com/p/344613 ] সংরক্ষিত হয়েছে। বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ না থাকলেও এক কথায় বললে - যে কাজ করবে সেই ফলভোগ করবে এটাই ইসলামের মূলনীতি। কোন ঝুঁকি ছাড়াই বসে বসে আমার মেহনতের লাভ লুটবে আপলাইনের একশ জন - এই বাটপারী ইসলামে নেই। আমি কোন কিছু বিক্রি করলে আমি কমিশন পেতে পারি, কিন্তু অন্য কেউ নয়।

এগুলো গেল ডেসটিনির বাহ্যিক রূপ। কিন্তু এর যে চেহারাটা আলিম কিংবা তাত্ত্বিক - যারাই ডেসটিনির বাইরের লোক তারা ধরতে পারছেনা সেটাই এর সবচেয়ে ভয়াবহ দিক। আর তা হচ্ছে ডেসটিনির ব্রেন-ওয়াশ। এর পরিচালকের ভাষায় তারা মানুষকে প্রোগ্রাম করেন যেভাবে একটা রোবটকে ম্যাশিন ল্যাংগুয়েজে প্রোগ্রাম করা হয়। এই ব্রেন-ওয়াশ শেষ হলে সে একটি নতুন মানুষের পরিণত হয়। এই নতুন মানুষ সকল নীতিবোধ, বিবেচনাবোধ আস্তাকুড়ে ফেলে ডেসটিনি সাম্রাজ্যের একটি ভাইরাসে রূপান্তরিত হয়। তখন থেকে এ আর একা একা বাঁচতে পারেনা, পরজীবি ভাইরাসের মত অন্য সুস্থ মানুষকে সে আক্রমণ করে। দখল করতে সফল হলে হয় সে চেষ্টা করে সেটারও মনুষ্যত্ব নষ্ট করে আরেকটা ভাইরাস তৈরী করতে। যারা জীববিজ্ঞান পড়েছেন তারা বুঝবেন -ভাইরাসের লাইসোজেনিক জীবনচক্রের মত এখানেও একের পর এক চক্র চলতে থাকে যতক্ষণ না পুরো দেহটাই দখল হয়ে যায়।

এই ব্যাপারটা কিভাবে কাজ করে তা বোঝার জন্য আমাদের আগে ‘দাসত্ব’ - এই ব্যাপারটি বুঝতে হবে। দাস বা গোলাম বলতে আমাদের চোখের সামনে যে দৃশ্যটি ভাসে তা হল -পায়ে বেড়ি পড়া কিছু শৃংখলিত মানুষ যারা প্রভুর আদেশে কাজ করে চলেছে, আদেশের বাইরে গেলেই তাদের চাবুক মারা হচ্ছে। দাস আর চাকরের পার্থক্য হচ্ছে -দাস পরাধীন আর চাকর স্বাধীন। চাকর কাজ করার বিনিময় পায়, কাজ না ভালো লাগলে ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু দাসের ভালো লাগুক আর না লাগুক তাকে কাজ করেই যেতে হয়। চাকরের service আর দাসের slavery এর মধ্যে পার্থক্য হল স্বাধীনতা। আমরা জানি আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন তার দাসত্বের জন্য। কিন্তু এই দাসত্বের সাথে আগের দৃশ্যপটের দাসত্বের পার্থক্য কী? এখানেও পার্থক্য স্বাধীনতা! একজন মানুষ কখনোই শখ করে, খুশি হয়ে অন্য একজনের মানুষের ক্রীতদাস হয়না, হবার কোন কারণও নেই। কিন্তু একজন মুসলিম খুশি মনে, স্বেচ্ছায় আল্লাহর কাছে নিজের স্বাধীনতা বিক্রি করে দেয়। কেন?

আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামিন -সব প্রশংসা এই বিশ্ব চরাচরের প্রতিপালকের জন্য যিনি আমাকে, আমার চারপাশের সব কিছুকে সৃষ্টি করেছেন, প্রতিপালন করছেন। - তাওহিদ আর রুবুবিয়াহ। আর রহমানির রহিম -তিনি তার পরম দয়া দিয়ে আমাকে, আমাদের সবাইকে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন। - তাওহিদ আর রুবুবিয়াহ। মালিকি ইয়াওমিদ্দিন -এই পৃথিবীতে যত অন্যায় হয়েছে তার শাস্তি তিনি একদিন দেবেন, যত ভাল কাজ হয়েছে তার পুরষ্কার তিনি এক দিন দেবেন। - তাওহিদ আর রুবুবিয়াহ। ইয়্যাকা না’বুদু -আমরা একমাত্র তোমারই দাসত্ব করি। - তাওহিদ আল ইবাদাহ। যিনি আমাকে সৃষ্টি করলেন, প্রতিপালন করছেন, যিনি আমার কাজের প্রতিদান দেবেন, আমাকে অনন্তকালের জন্য স্বাধীনতা দেবেন -পৃথিবীর এই ক্ষণিক জীবনে আমি তার খুশি মনে তার দাসত্ব করতে রাজী হলাম।

আবিদ অর্থাৎ উপাসক আর আব্দ বা দাসের মধ্যে পার্থক্য এই যে, উপাসনার কিছু নিয়ম আছে আর তা নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু একজন মুসলিম তার জীবনের চব্বিশ ঘন্টাই দাস। সে যখন যুহর ও আসরের সলাতের জন্য মসজিদে যাচ্ছে তখন সে আবিদ। কিন্তু যখন সে দুই সলাতের মাঝে বাজারে গিয়ে সবজি বিক্রি করছে তখন সে আব্দ্, তাই সে ওজনে কম দিচ্ছে না, পচা সবজি ভাল সবজির সাথে মিশিয়ে মানুষ ঠকাচ্ছেনা।

মানুষ প্রকৃতিগত এমনভাবে তৈরী যে সে দাসত্ব মেনে নেয়। শয়তানের কী আপন প্রবৃত্তির, অর্থ-সম্পদের কী যৌন-কামনার, খ্যাতির কী ক্ষমতার, সম্মানিত ব্যক্তির কী ব্যক্তির দর্শনের - কোন না কোন কিছুর মানসিক দাসত্ব মানুষ করবেই করবে। একজন মুসলিমের মা’বুদ থাকে একজন - আল্লাহ, অমুসলিমের মা’বুদ অনেক - যে কোন পার্থিব ব্যক্তি বা বস্তুকেই সে আপন দাসত্ব নিবেদন করতে পারে। যখন ব্যক্তি আল্লাহর বদলে অন্য কিছুকে মা’বুদের স্থানে বসিয়ে দেয় তখন সে শির্ক করে, তার নাম হয় মুশরিক। আর যেহেতু সে শির্ক করে তাকে সৃষ্টির উদ্দেশ্যটাই মিথ্যা করে দেয় তাই তার পরিণতি হয় অনন্ত আগুন। অন্য কোন পাপ আল্লাহ ক্ষমা করলেও করতে পারেন, কিন্তু শির্ক? কখনোই না।

ডেসটিনি মানুষকে দাসত্ব শেখায়, দাস হবার সুফল দেখায়, দাস না হবার কুফল দেখায়। তবে এক্ষেত্রে মা’বুদ আল্লাহ নয়, সাফল্য। আর তাদের সাফল্যের সংজ্ঞা পরকালের মুক্তি নয় - ইহকালের সম্পদ আর খ্যাতি। ডেসটিনির পরিচালক যখন কানাডা থেকে বাংলাদেশে আসেন তখন তিনি পশ্চিমা সভ্যতার বস্তুবাদী সাফল্যের এ দৃষ্টিভঙ্গীটি নিয়ে আসেন। ডেসটিনির সামগ্রিক কার্যক্রমকে তাই দুটি ভাগে ভাগ করা যায় –

১. এমএলএম এর মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় ভিত্তিক কমিশন ব্যবস্থা।
২. মোটিভেশনাল বা উদ্বুব্ধকরণ কার্যক্রম।

প্রথমটাকে যদি কোন প্রাণীর দেহ ধরি তবে দ্বিতীয়টি তার প্রাণ। এটি ডেসটিনির মূল চালিকাশক্তি, এর স্ট্র্যাটেজিটা একান্তই ডেসটিনির নিজস্ব আবিষ্কার। মজার ব্যাপার হচ্ছে একজন মানুষ যখন একবার ডেসটিনির ভিতরে ঢুকে যায় তখন প্রথমটির ব্যাপারে কার্যক্রম খুবই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়; মূল কাজ হয় মোটিভেশনাল প্রোগ্রামগুলোতে অংশগ্রহণ নয়ত সেগুলোর আয়োজন। সেলস ট্রেনিং এর সময় বিপণনের মূল কৌশলে শেখানো হয় কিভাবে নতুন খদ্দের ধরতে হয়; সেখানে পণ্যের গুণাগুণ সম্পর্কে কথা বলা হয়না বললেই চলে। আর যে পণ্যগুলো বিক্রয় করা হয় তার নিজস্ব মূল্য আসলে খুবই কম, এর আসল আকর্ষণ বিক্রয় পরবর্তী কমিশনে। আর তাইতো এদের পণ্যের তালিকাতে 'মোটিভেশনাল ট্রেনিং' নিজেও একটা পণ্য। কিন্তু ভয়াবহ ব্যাপার হল এই অংশটা থাকে অন্তরালে - কোন সৎ আলিমের কাছে ফতোয়া নেয়ার সময় বা মানুষকে বোঝানোর সময় মোটিভেশনের ব্যাপারটা প্রায় উপেক্ষাই করা হয়। অথচ এদের সবচেয়ে জাঁকজমক করে যে অনুষ্ঠানগুলো করা হয়, যেমন ডায়মন্ড সেলেব্রেশন প্রোগ্রাম, তার মূলমন্ত্র একটাই - To ignite one's desire and to keep it fired up.

ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে, প্রবৃত্তিপূজার এই জঘন্য বিষয়টিকে ডেসটিনির সদস্যরা খুবই সহজভাবে নেয়। তাদের ধারণা সফল হবার তীব্র আকাঙ্খা না থাকলে কেউ সফল হতে পারেনা। ডেসটিনি তাই বেঁচে আছে ডাউনলাইনের মনে 'সফল' হবার প্রজ্জলিত সুতীব্র বাসনাকে জ্বালানী করে। 'আমি পারবই' – এটি ডিস্ট্রিবিউটরদের মগজে গেঁথে দেয়া হয়। হাজারো উপেক্ষা, অপমান, প্রত্যাখান সব কিছুকে হাসিমুখে সহ্য করে ডেসটিনির পরিবেশকরা বারবার মানুষদের কাছে যান, তাদেরও ডেসটিনির জালে জড়াতে। নিরাশা বা থমকে যাওয়া থেকে কর্মীদলকে রক্ষা করতে সুন্দর সব উপমা, খ্যাতিমানদের উক্তি, শিক্ষণীয় নানা গল্প দিয়ে একটা জিনিসই প্রমাণ করে ছাড়া হয় তা হল – একজন নতুন মানুষকে ডেসটিনিতে ঢুকানোর মাধ্যমে নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি করাতেই জীবনের সব সাফল্য লুকিয়ে আছে।

ব্যাপারটা লক্ষ্যণীয় - ডেসটিনির মাথাদের মূল কাজ কিন্তু কর্মীদের দিয়ে পণ্য বিক্রয় করানো নয়, তাদের সফল হবার জন্য তাতিয়ে দেয়া। তাদের এই বোধ দেয়া যে তুমি একটা স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছ। এবং সফল হবার এই স্বপ্নকে সত্যি করতে হলে তোমাকে তোমার ডাউনলাইনের মনে আগুন জ্বালাতে হবে, তাদেরকেও সফল হবার স্বপ্ন দেখাতে হবে। এজন্য ডেসটিনির নেটওয়ার্কের উপরের দিকের লোকেরা নতুন কাস্টমার ধরে কম, তাদের মূল কাজ ম্যারাথন প্রোগ্রাম, ট্রেনিং প্রোগ্রাম, সেলেব্রেশন প্রোগ্রাম এবং সবচেয়ে ভয়াবহ – টিম মিটিং গুলোর মাধ্যমে কর্মীদের মনে সবসময় স্বপ্ন দেখানোর ইনপুট দিয়ে যাওয়া। এই কাজে এরা সাইকোলজিকাল যত অস্ত্র আছে তার সবই ব্যবহার করে। যেমন ডেসটিনির এমডির মতে আমি ও আপনি - আমাদের মত মানুষরা ব্যধিগ্রস্থ। কারণ আমাদের মাধ্যমে অনেক টাকা কামানোর ইচ্ছা নাই। সুতরাং আমাদের রোগ সারাবার জন্য তার ঔষধ হচ্ছে - প্রতিদিন ঘুমাতে যাবার আগে 'উচ্চাকাংখার ম্যাজিক' নামে একটি বইয়ের অন্তত ছয় পৃষ্ঠা পড়ে ঘুমানো। যারা মানুষের মনের বিজ্ঞান সম্পর্কে জানেন, তার বুঝতে পারবেন –এই ঔষধের মাজেজা। একটা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার সবচেয়ে সফল উপায় হল তার অবচেতন মনকে দখল করে ফেলা। আর অবচেতন মনকে কব্জা করার সবচেয়ে সহজ পন্থা হল ঘুমানোর আগে একটি মেসেজ বারবার মানুষের মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া।

একটি মোটিভেশনাল ট্রেনিং এ একজন পিএসডি সে নিজে কতটা মোটিভেটেড তা বুঝানোর জন্য নিজের জীবনের গল্প বলছে - ডেসটিনি নিয়ে ব্যস্ত থাকা অবস্থায় সে একদিন খবর পেল তার মা অসুস্থ, কিন্তু সে যেতে পারেনি। এরপর খবর এল তার মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, ট্রেনিং-মিটিং-ক্লোজআপ আর জয়েনিং এ ব্যস্ত মানুষটির তাও সময় হয়নি অসুস্থ মাকে দেখতে যাবার। কয়েকদিন পর সে জানতে পারলো তার মা আর বেঁচেই নেই। এই ঘটনাকে এই প্রবৃত্তি-পূজারী গর্ব করে বলে বেড়ায় আর বলে: আমি সফল হবার জন্য এতটাই স্যাক্রিফাইস করেছি। মফস্বল নিবাসী এক মহিলা পিএসডির স্বামী দেশের বাইরে থাকতো। দেশে ফিরে আসার পর সে যখন স্ত্রীকে ঢাকা ছেড়ে নিজের বাড়ী যেতে বলে তখন মহিলা অস্বীকৃতি জানিয়ে বলে: "ওকে (স্বামী) দিয়ে আমার কি লাভ? ডেসটিনি আমাকে সম্পদ দিয়েছে সফলতা দিয়েছে। আমি জীবনে যা চাই পেয়েছি, ওর ঘর করতে গিয়ে আমি এই সুখের জীবন হারাতে পারবোনা"

মন্দিরে পূজা দেয়ার সময় মন্ত্র পড়া হয়, গীর্জাতে হাইম গাওয়া হয় ঠিক তেমন ডেসটিনিতেও শির্ক করানোর প্রধান অস্ত্র 'কথা'। যে আপলাইনের যত উঁচুতে তার কথাও তত রিফাইনড্। একটা মিথ্যাকে সত্যি বানিয়ে দেবার চাতুর্যতা দেখলে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথার সত্যতা: “নিশ্চয় কিছু কথাতে যাদুর প্রভাব আছে”।১ শয়তান যখন মানুষের কাছে এসে তাকে কোন বুদ্ধি দেয় তখন কিন্তু ভুলেও নিজেকে শয়তান হিসেবে পরিচয় দেয়না, বরং ঐ ব্যক্তিটির শুভাকাঙ্খী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে। আজকের ডেসটিনির হর্তা-কর্তারা শয়তানের এই সুন্নাত পালন করে। তারা মানুষকে বোঝায় - দেখ আমরা নিজেরা একা বড়লোক হতে চাইনা, তোমাদেরকেও বড়লোক বানাতে চাই। অথচ সত্যি তো এই যে যদি ডাউনলাইন কাজ না করে তাহলে আপলাইন কখনোই ধনী হতে পারবেনা। তাই আপলাইনের মানুষরা ডাউনলাইনকে ব্যবহার করে শোষক বাড়ানোর জন্য। বেকারত্ব দূরীকরণ, সম্পদের সমবন্টন –- এগুলো নেহায়েত কথার কথা।

মানুষ যেন প্রবৃত্তিকে ইলাহ্ বানিয়ে নিতে ভুল না করে সেজন্য ডেসটিনি আয়োজন করে তাদের দৃষ্টিতে 'সফল' মানুষদের বর্ণাঢ্য উপস্থাপনে। চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের মত ব্যয়বহুল জায়গায় ভাড়া করে হাজারো মানুষের সামনে একজন ডায়মন্ড এক্সিকিউটিভকে যখন গাড়ীর চাবি তুলে দেয়া হয় তখন তাদেরকে বলা হয় –- একদিন তুমিও এই খানে আসতে পারবে, শুধুমাত্র এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে তুমি এখানে আসতে পারবে। একই সময়ে ঢোকা এক হাজার মানুষের মধ্যে একজন যে গাড়ীর চাবী বাগাতে পারলো, কিন্তু বাকি নয়শ নিরানব্বই জন যে হারিয়ে গেল - এই নির্মম সত্যটা ঢেকে রাখা হয়। বলা হয় যারা গাড়ী পায়নি তারা অলস, তাদের মধ্যে সফল হবার চেষ্টার অভাব ছিল। কিন্তু পিরামিড স্কিমের ধোঁকাবাজীতে যে লক্ষজনের টাকাতে একজনকে গাড়ী দেয়া হয় এই অঙ্কটা কখনোই সামনে আনা হয়না। এভাবে আল্লাহর উপর ভরসা তো দূরের কথা, মানুষকে নিজের ভাগ্যনির্মাতা বানিয়ে দেয়া হয়। মানুষ নাকি চিন্তার মাধ্যমে ভাগ্য গড়তে পারে। অথচ ভাগ্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত এবং তার ভাল-মন্দও সুনির্ধারিত। ক্বদরে বিশ্বাস ঈমানের শেষ স্তম্ভ। ডেসটিনিতে সফল হবার দেখানো দিবা স্বপ্নের জন্য অবশ্য ক্বদরে বিশ্বাস বড়ই ক্ষতিকর। তাই তাদের বোঝানো হয়- ভাগ্য তো মানুষের হাতের মুঠোয়।

ডেসটিনি যে এভাবে কত মানুষের মগজ ধোলাই করে তাকে পার্থিবতার দাস বানিয়ে দিচ্ছে সেটার কোন পরিসংখ্যান নেই। কারণ দেহের মৃত্যু রেকর্ড করে রাখা যায়, মনের মৃত্যু দেখাই যায়না। ডেসটিনির ভয়াবহতা তাই তুলে আনা দায়। যারা দুনিয়াকে জান্নাত হিসেবে দেখে তাদের আসলে কিছু বোঝানোই মুশকিল। হালাল-হারাম তো পরের কথা - তারা যে একটা সিস্টেমের দাস বনে গেছে সেটা তারা ঐ সিস্টেমের ভিতরে আছে বলে বুঝতেই পারেনা। আর যারা বাইরে তারা ঐ সিস্টেমটা যে কত জঘন্য সেটা জানেইনা। যারা জানতে ভেতরে ঢোকে তাদের খুব কমই ঈমান নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। হৃদয়হীন যন্ত্রমানব তৈরীর এই সিস্টেমকে খুব স্পষ্ট করে দায়ী করাও যায়না কারণ সিস্টেম জিনিসটাই একটা বিমূর্ত ধারণা। সিস্টেমের দোষ বোঝা যায় তার প্রোডাক্ট দেখে। যখনই ডেসটিনির কোন হর্তা-কর্তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় - তার প্রোডাক্ট মাইন্ডলেস রোবটদের ব্যাপারে, তখনই তারা ব্যাপারটাকে ব্যক্তিগত আচরণ বলে পার পেতে চায়। যে মন্ত্রে একজন মানুষ আল্লাহ, পরিবার, নৈতিকতার প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে টিম-মিটিং এ বসে অন্যের মনে কামনার আগুন জ্বালানোকেই তার সাফল্যের চাবীকাঠি মনে করে সেই মন্ত্রের কোন দোষ নেই, সে মন্ত্র যারা পড়লো তাদেরও কোন দোষ নেই, দোষ কেবল তাদের যাদের উপর মন্ত্র পড়া হয়েছে - এটা কি সুস্থ বিবেক মেনে নেবে?

রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: ধ্বংস হোক দিনারের পূজারীরা, ধ্বংস হোক দিরহামের পূজারীরা। মানুষ কি টাকার বান্ডিলে সিজদা করে? পয়সার কাছে দু'আ করে? না। সে অর্থের আবিদ হয় না, আব্দ্ হয়। ইসলামের বেঁধে দেয়া উচিত-অনুচিতের গন্ডী ছাড়িয়ে সে তার যা ভালো লাগে তাই করা শুরু করে। প্রবৃত্তি, অর্থ, খ্যাতি, গাড়ী, বাড়ী - এগুলোর দাস হয়ে যায় মানুষ। ভুলে যায় আল্লাহর দাসত্বের কথা। এমন একটা জীবনে সে জড়িয়ে পড়ে যেখানে সে আরো মানুষকে আল্লাহর দাসত্ব থেকে বের করে নিয়ে যায়। সফল থেকে সফলতর হবার দৌড় থামিয়ে কখনো তার সময় হয়না আল্লাহ তাকে কেন পৃথিবীতে পাঠালেন সেটা নিয়ে চিন্তা করার। লক্ষ টাকার হারাম আয় ছেড়ে হালাল রুযি দিয়ে সাধাসিধে জীবন যাপন করার। এদের মধ্যে যারা নামায পড়ে আল্লাহকে ধন্য করে দেয় তারাও চোখ বন্ধ করলে 'প্রাডো' গাড়ীর ছবি দেখে, চোখ খুললে পটেনশিয়াল খরিদ্দার দেখে। ইসলাম পালন হয়ে দাঁড়ায় নিতান্তই আনুষ্ঠানিকতা।

পৃথিবীতে সফল হবার জন্য প্রত্যেক মানুষের চেষ্টা করা উচিত। কিন্তু সেই সফলতা যেন আখিরাতের সফলতার বিনিময়ে না আসে। আমাদের ভালো খাবার, ভালো পড়ার অনুমতি ইসলাম দিয়েছে। কিন্তু স্বচ্ছল থাকতে গিয়ে 'অনুচিতের' সাথে, 'হারামের' সাথে আপোষ করাকে ইসলাম ঘৃণা করে। একজন খাঁটি মুসলিম কখনো দ্বীন বিক্রি করে দুনিয়া কেনেনা, কারণ সে জানে, আল্লাহ তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন –

যদি কোন পুরুষ বা মহিলা সৎকর্ম করে, এবং সে মুমিন হয়, আমি অবশ্যই তাদেরকে (দুনিয়াতে) পবিত্র জীবন দিয়ে জীবিত রাখবো এবং (আখিরাতে) সর্বোত্তম আমলের উপর ভিত্তি করে তাদের পুরষ্কার দান করব। ২

ডেসটিনি এবং এর মত আরো যেসব প্রতিষ্ঠান প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানুষকে সফলতার ভুল সংজ্ঞা আমাদের মগজে প্রোথিত করে দিচ্ছে, আমাদের আল্লাহ থেকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে তাদের থেকে আল্লাহ আমাদের হিফাজাত করুন। আমিন।

-------------------------------------------------------------
১ সহীহ বুখারী, কিতাবুন নিকাহ, খন্ড ৭ হাদিস ৭৬
২ সুরা নাহল (১৬) আয়াত ৯৭
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

সম্পর্ক

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২


আমারা সম্পর্কে বাঁচি সম্পর্কে জড়িয়ে জীবন কে সুখ বা দুঃখে বিলীন করি । সম্পর্ক আছে বলে জীবনে এত গল্প সৃষ্টি হয় । কিন্তু
কিছু সম্পর্কে আপনি থাকতে চাইলেও থাকতে পারবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×