প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর কাছে পরাজিত হয়েছিল তৎকালীন ওসামানী সাম্রাজ্য একসময় যার দখলে ছিল মধ্যপ্রাচ্য সহ বিশাল একটি অঞ্চল। ইউরোপীয় শক্তিগুলো তখন ওসমানী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধের নামকরণ করেছিল দ্য ওয়ার টু এন্ড ওয়ার, অর্থাৎ যে যুদ্ধ সকল যুদ্ধ শেষ করবে। কিন্তু তখনকার এক ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা যার নাম ছিল আর্চিবাল্ড ওয়াভেল তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে আসলে এটি হচ্ছে এ পিস টু এন্ড পিস, অর্থাৎ এমন শান্তি প্রক্রিয়া যেটি সকল শান্তির অবসান ঘটাবে। তখন মন্তব্যটি করার সময় তিনি হয়তো ভাবতেও পারেননি যে তার কথাটি এভাবে ফলে যাবে। সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই অঞ্চলটিতে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের শাসন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে আসছে যার ফলে একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান, বিপ্লব, দুঃশাসন এবং মহামারীর মত জিহাদী সহিংসতা চলেই আসছে। ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমনকে বলা যায় পশ্চিমা শক্তিগুলোর শাসন চাপিয়ে দেওয়ার সর্বশেষ উদাহরণ।
তবে ওসমানী সাম্রাজ্যের অন্যান্য দেশ এসব ঝামেলার মধ্যে ডুবে থাকলেও আধুনিক তুরস্ক কিন্তু সবসময় এসব থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছে। অনেক পর্যবেক্ষকদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যে যে দীর্ঘমেয়াদী সংকট তার আসল সুবিধাভোগী ইরান নয়, তুরস্ক। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইরাকের সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেনে ইরানের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে তুরস্ক। এই জায়গাটিতে অনেক মার্কিন কোম্পানি এই দুই দেশের সঙ্গে টিকতে না পেরে সাইডলাইনে চলে গেছে। আর আঞ্চলিক প্রভাবের কথা যদি ধরা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে তুরস্কের সেই অর্থে কোন শত্রু নেই। তুরস্কের কঠিন মানসিকতার প্রধানমন্ত্রী রেচেপ তাইয়েপ এরদোয়ান মার্কিন আধিপত্য থেকে ক্রমেই তাঁর দেশকে বের করে নিয়ে আসার শক্তি সঞ্চয় করে চলেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি তেহরানে তাঁর বন্ধু মাহমুদ আহমাদিনেজাদের সঙ্গে হাসিমুখে দেখা করেছেন এবং এসময় ইরানের পরমাণু কর্মসূচীকে সমর্থনও করেছেন।
এটা হচ্ছে মাত্র একটা উদাহরণ, এরকম আরও অনেক কারণে ন্যাটোর অনেক দেশ তুরস্কের প্রতি বিরক্ত। উল্লেখ্য, তুরস্ক ন্যাটোর অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য। এসব কারণের সবচেয়ে বড়টি হচ্ছে দীর্ঘদিনের বন্ধুরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্ক। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য মতে গত বছর গাজায় ইসরায়েলী হামলায় ১৪০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এই অভিযানের প্রতিবাদে তার কিছুদিন পরই দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সভা থেকে ওয়াক আউট করেন এরদোয়ান। অনেক দিন ধরে হয়ে আসা ইসরায়েলের বিমান বাহিনীর সঙ্গে তুর্কি সামরিক বাহিনীর নিয়মিত যৌথ মহড়াও বাতিল করেন তিনি। এছাড়া সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির যিনি দারফুর গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযুক্ত তাকেও সমর্থন করেছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট। এই মুহুর্তে ওয়াশিংটনের সঙ্গে আঙ্কারার মিলের চেয়ে অমিলই বেশি দেখা যাচ্ছে।
তবে যে জিনিষটি সবচেয়ে বেশি ওয়াশিংটনকে ভাবিয়ে তুলেছে তা হলো তুরস্কের এসব পদক্ষেপ যতটা না জাতীয় স্বার্থে তার চেয়েও এরদোয়ানের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন দলের গোপন ইসলামী এজেন্ডার কারণে। যদিও এরদোয়ান রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মেলানোর কথা অস্বীকার করে আসছেন কিন্তু তার দল একেপি এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকবার আদালতের তদন্তের মুখোমুখি হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে বারবার। আনুষ্ঠানিকভাবে এখন পর্যন্ত মার্কিন বিরোধী কোন মনোভাব দেখায়নি তুরস্ক। তবে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে পশ্চিমা মূল্যবোধকে অস্বীকার করার একটি মানসিকতা লক্ষ্য করা গেছে।
অপরদিকে তুরস্ক সবসময় সচেতন রয়েছে তাদের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর অবদানের ব্যাপারে। স্নায়ু যুদ্ধ চলাকালে ওয়াশিংটন ইরানের শাহ এবং তুর্কি সামরিক বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে এসেছে। অবশ্য এর ফলাফল যে খুব ভালো হয়েছে তা নয়। ইরানে শাহ উৎখাত হয়েছেন এবং একটি চরম বৈরি দেশ তৈরি হয়েছে। ২০০৩ সালে বুশ প্রশাসন যখন ইরাকে হামলা চালাতে যায় তখন তুরস্কের ভূমি ব্যবহার করার অনুমতি চেয়েও পায়নি। তুরস্কের সংসদ ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল।
তবে তুরস্কের বর্তমান অবস্থানের কারণে ভবিষ্যতে দেশটির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কেবল সহযোগী নয় বরং একজন বড় মিত্র হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রী আহমেদ দাভুতোগ্লু বলেছেন, তারা চান আঞ্চলিক সংকট নিরসনে অংশীদার হতে। তাদের এই কথার পেছনে উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন, ২০০২ সালে এরদোয়ান ক্ষমতায় আসার পর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে সেই সক্ষমতা অর্জন করেছে তারা। গত এক দশকে তুরস্কের অর্থনীতির আকার দ্বিগুনেরও বেশি হয়ে গেছে যা তাদেরকে আঞ্চলিক পাওয়ার হাউসে পরিণত করেছে। একই সঙ্গে এখন তারা প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গেই অর্থনৈতিক লেনদেনে মনোযোগ দিয়েছে। ইউরোপের দেশগুলোর চেয়ে রাশিয়া, ইরান ও ইরাকের সঙ্গেই তাদের বাণিজ্যিক লেনদেন বেশি।
দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানেও তারা দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। কুর্দিদের সঙ্গে তারা একটি বোঝাপড়া করে নিয়েছে। সিরিয়া, ইরান ও আর্মেনিয়ার সঙ্গেও তারা শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এসব কিছু সম্ভব হচ্ছে তুরস্কের বিচক্ষণ কূটনীতি এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য প্রসারের জন্য। প্রতিবেশীদের সঙ্গে কোন ধরণের ঝামেলায় না জড়ানোর নীতি অনুসরণ করে চলেছে দেশটি। ফলে আঞ্চলিক অনেক সমস্যা সমাধানেই তুরস্ককে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দেখা যাচ্ছে। যেমন ফিলিস্তিনের হামাস ও ফাতাহ, ইরাক ও সিরিয়া এমনকি ইসরায়েল এবং সিরিয়ার মধ্যেও মধ্যস্থতা চালানোর চেষ্টা করেছে তুরস্ক। কারণ তুর্কি কূটনীতিকরা সংকট নিরসনে অত্যন্ত দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত যেটা ইরানের বেলায় একেবারে দেখা যায় না। তেহরান নিজেকে ক্রমেই একঘরে করে ফেলছে এবং গোটা আরব অঞ্চল থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছে।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচীকে তেহরানে গিয়ে তুর্কি প্রধানমন্ত্রী সমর্থন জানালেও মূলত এই ক্ষেত্রে তুরস্কের দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিমাদের মতই। তবে বিষয়টি তুর্কিরা নিজেদের মত করেই ফয়সালা করতে চায়। যখন আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি সংস্থা ইরানকে প্রস্তাব দিয়েছিল ফ্রান্সের ফুয়েল রডের বিনিময়ে ইউরেনিয়াম রপ্তানি করতে তখন তুরস্কই কিন্তু ইরানকে পাল্টা প্রস্তাব দিয়েছিল তুরস্কে ইউরেনিয়াম জমা রাখতে। বলাই বাহুল্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবুজ সঙ্কেত পেয়েই এই প্রস্তাব দিয়েছিল তুরস্ক। তবে তুরস্কের এই প্রস্তাবের জবাবে তেহরান না বলে দেয়। তুরস্কের এই প্রস্তাব কার্যকর না হলেও বোঝা গিয়েছিল যে আঞ্চলিক শান্তি বজায় রাখতে তুরস্কের আগ্রহ রয়েছে। উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে ইরানের পরমাণু কর্মসূচী নিয়ে মধ্যস্থতা করারও প্রস্তাব দিয়েছে তুরস্ক। এর বাইরে আঙ্কারা বরাবরই দাবি করে আসছে যে পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক সবসময় বজায় থাকবে। তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রী দাভুতোগ্লুও বলে দিয়েছেন যে ন্যাটো হচ্ছে তুরস্কের সবচেয়ে বড় মিত্র এবং ইউরোপে একীভূত হওয়াটাই তুর্কি পররাষ্ট্র নীতির মূল লক্ষ্য। সেক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে ওসামানী সাম্রাজ্য পতনের পর এই পর্যন্ত তুরস্কই সবচেয়ে সফল দেশ।