somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"একজন মানুষ না হতে পারার দুঃখ!"

১০ ই মে, ২০১৫ দুপুর ১:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অনেকদিন আগের ঘটনা। ক্লাস ফাইভে পড়ি। একা একা স্কুলে যাওয়ার জন্যে , যথেষ্ট বয়স। সেদিন সকালেও স্কুলে যাচ্ছি। শীতের সকাল। ছোটকালে কত শীত পড়েছে , সেটা মাপতাম , মুখে কুয়াশা টেনে আবার ছেড়ে দেয়ার হিসেবে। যত বেশি ধোঁয়া বের হবে , তত বেশি শীত ! হিসেব অনুযায়ী সেদিন ছিল , প্রচণ্ড শীত। এখন অনেক বয়স হয়েছে , তাও ছেলেমানুষি অভ্যেসটা বিদায় হয়নি।

শীতে একই সাথে সবচেয়ে মজার এবং বিরক্তিকর বিষয় ছিল , গাছের উপর থেকে টুপটুপ করে গায়ে পানি পড়াটা। একদিকে মজাও লাগে , অন্যদিকে লাগে ঠাণ্ডার ভয়। আশেপাশে ধানের খেত। সবুজ সবুজ ধানগুলোর গায়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি লেগে আছে আর গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষা করছে - এটা সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটি। সেটাও , ছিল সেদিন। সেদিনের ঘটনার প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি ডিটেইল আমার মনে আছে। কারণ , ঘটনাটা খুবই সামান্য ছিল , অথচ জীবনের স্মরণীয় ঘটনা। খুব সামান্য , তুচ্ছ ঘটনাগুলোই , একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা হয়ে উঠতে পারে। কারণ , ঐ যে কথায় বলে না - দ্যা ক্লোজার ইউ লুক , দ্যা লেসার ইউ সী!

তো , মনের আনন্দে হেঁটে যাচ্ছি। কাঁধে স্কুল ব্যাগ। নিজের ওজনের সমান স্কুল ব্যাগ। বুঝাই যাচ্ছে , কাঁধে করে নিয়ে দুনিয়ার যত জ্ঞান বিজ্ঞান রয়েছে সব একসাথে নিয়ে যাচ্ছি।

তো সেখানে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। এক বৃদ্ধ মানুষ। বলা চলে আশি বছরের উর্দ্ধে। সাদা ধবধবে চেহারা। একটা কাশ্মীরি শাল গায়ে জড়িয়ে আছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে - কোন দাম্ভিক গ্রিক দেবতা তাকিয়ে আছে। উনি আমাকে থামালেন , এই দাঁড়াও!

আমি থমকে দাঁড়ালাম। উনি জিগ্যেস করলেন , কোন স্কুলে পড়ো ! এতো বই কি কারণে ?
থতমত খেয়ে কোনমতে উত্তর দিলাম। এবার বৃদ্ধ লোকটি আমাকে একটা প্রশ্ন করলেন , "বললেন , তো অনেক পড়ালেখাই তো করছও , একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো ! বল তো , মানুষের চোখ কয়টা! "

আমি ভেবেচিন্তে , চূড়ান্ত রকমের কনফিউজড হয়ে উত্তর দিলাম - , "চোখ তো দুইটাই?" উত্তরটা দিতে এতই কনফিউজড হয়েছিলাম , যে জীবনে এতো কনফিউজড এ যাবতকালে হই নি , ভবিষ্যতেও যে হব না , সেটা মোটামুটি নিশ্চিতই বলা চলে।

এবার বৃদ্ধটি একটা চরম তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। এই শিখায় স্কুলে। এতদিনে এই শিখছো। আমি প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে রইলাম?

এবার বৃদ্ধটি বলল , "মানুষের চোখ তিনটা। তৃতীয় চোখ হচ্ছে অন্তর্দৃষ্টি ! এটা দিয়েই সবকিছু মানুষ দেখে। এটাই , আসল চোখ। যাও স্কুলে গিয়ে কিছু শেখার চেষ্টা করো!"

আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। বৃদ্ধটি হেঁটে চলে গেলো। পরে আমি অনেক অনেকবার ভেবেছি , কথাটা নিয়ে। বড় হয়ে বুঝেছি , এটা খুবই সাধারণ প্রচলিত একটা দার্শনিক কথা। তবে , ক্লাস ফাইভের একজন বাচ্চার জন্যে , এটা উঁচুমানেরই বলা চলে। বলা চলে - এই কথা দিয়েই আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘতে। সবসময় , মনে মনে বলতাম - ভেতরের চোখ দিয়ে কি দেখা যায়। বাস্তবিকভাবে , ভেতরের চোখ দিয়ে কিছুই দেখতে পারি নি। ঐ বয়সে সে সামর্থ্যও ছিল না। তবে , জিনিসটা যে মনের মধ্যে গেঁথে নিয়েছি , সেটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া।

একজন শিশুকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে , দার্শনিক কথা বলে , তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা - আর যাই হোক। খুব সচারচর দেখা যায় না। যাওয়ার কথাও না। বৃদ্ধ লোকটি এই কাজটি কেন করেছিল , সেই উত্তর এখনো আমি খুঁজি। উত্তরটা পাইনি বলেই , এতো বছর পরেও ঘটনাটা মনের ভেতরে দাগ কেটে আছে।

শেষমেশ , আমি একটা থিওরি দাঁড় করিয়েছিলাম - বৃদ্ধ লোকটি , হয়তো এ যাবতকালের ঠুনকো , একমণী ওজনের ব্যাগের প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি বড় অসন্তুষ্ট ছিল। এতটা , অসন্তুষ্ট যে একজন ক্লাস ফাইভের বাচ্চাকে ধরেও , জীবনধর্মী শিক্ষায় যে তোমরা কত নিচু দেখে নাও , এটা বলতে চেয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন , বাচ্চাটি বুঝবে। এই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য বাচ্চাটার মধ্যেও ঢুকে যাবে , সে খালি হার্ডডিস্কের মত তথ্য সেভ করে রেখে , খাতায় উগরে দেয়ার চেষ্টা বাদ দিয়ে নতুন করে জীবনধর্মী কিছু শেখার চেষ্টা করবে। সত্যিকারের মানুষ হবে।

আমি সেদিন হয়ত বুঝি নাই , আজকে বুঝেছি। তবু , বড্ড দেরী হয়ে গেছে। নিজেকে প্রশ্ন করি - তুমি কি মানুষ , সত্যকারের মানুষ। মানবীয় গুণগুলো কি মোটাদাগে আছে , নাকি আছে শুধু আত্মতুষ্টি আর আত্মবন্দনা। বাইরের চোখ আছে বললেও , ভেতরের সেই আধবোজা চোখটা যেদিন উনি খুলে দিতে চেয়েছিলেন , যা আজও পুরোপুরি খুলে নি - সে উত্তর দেয় , না এখনো হতে পারো নি। হবার সম্ভাবনাও দেখছি না! আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলি।

এই দায় আমি কাকে দেবো। জানি না। নিজেই যখন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারি নি , তখন অন্যরা মানুষ হয়েছে কি সে খবর নেয়া নিতান্তই ছেলেমানুষি। তবে , আমি এখন এই ছেলেমানুষি কাজটাই করি। বাচ্চাদের সাথে ফাঁক পেলে , সাধারণ দার্শনিকতা নিয়ে তাকে প্রশ্ন করি। ভুলেও লেকচার দেই না। শুধু প্রশ্নটা করি। এক কথায় বলতে গেলে , তাকে প্রশ্নটা দিয়ে দেই। সে প্রশ্নটা নিয়ে খেলুক। বেশিরভাগ সময়েই বাচ্চাটা বুঝেই না। তবে , আমার ধারণা , অনেক অনেক প্রশ্নের ভিড়ে কিছু প্রশ্ন একদিন মনে গেঁথে যাবে। সে সারাজীবন উত্তর খুঁজবে ... এটাই হবে জীবনকে বোঝার পথে তার মহা যাত্রা। হয়ত , সেও একদিন পথ খুঁজে পাবে।

তবে , একটা ভুলেও অন্য কারো সামনে এইসব প্রশ্ন করি না। যখন , একান্তে পাই তখন। কারণ , সামনাসামনি করলে অন্যরা আধ-পাগল মনে করার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ! অবশ্য , আমার নিজেরও মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় - আমি আধ-পাগল নাতো!

সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০১৫ দুপুর ১:৫২
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অসমাপ্ত সংগীত

লিখেছেন স্প্যানকড, ১২ ই জুন, ২০২৫ বিকাল ৫:০৬

ছবি নেট।



তুমি এক প্রিয় সুর
আমি হারিয়ে যাওয়া অসমাপ্ত সংগীত!
অথবা,
তুমি পরিবর্তনশীল ঢেউ
আমি নামহীন নাবিক!
আমাকে তুমি ফিরিয়ে নিয়ে যাও
গল্প শোনাও এক অদৃশ্য পৃথিবীর।

বুঝিয়ে দিয়েছ তুমি
আমার নেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙালির কপালে সুখ নাই

লিখেছেন রাজীব নুর, ১২ ই জুন, ২০২৫ বিকাল ৫:৪৮



সময় তখন ১৯৪৩ সাল।
ব্যবসায়ীদের অতি লোভের কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই দুর্ভিক্ষে কমপক্ষে এক লাখ মানুষ মারা যায়। ক্ষুধা কোনো ধর্ম মানে না। হিন্দু যায় মুসলমানের বাড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেমিনাই, অর্থাৎ মিথুন রাশি

লিখেছেন করুণাধারা, ১২ ই জুন, ২০২৫ রাত ৯:৫৪

এক সপ্তাহের মধ্যে তিনজনের জন্মদিন। তারমধ্যে আজকে যার জন্মদিন তার উদ্দেশ্যে এই পোস্ট নিবেদিত!!

রাজীব নুরের বড় মেয়ে পরীর জন্মদিন ৬ জুন। আগে পরীর জন্মদিনে উপলক্ষে রাজীব নুরের পোস্ট দেখতাম।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসাদের পতনের পর নতুন ভূ-রাজনীতির মুখোমুখি সিরিয়া !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১২ ই জুন, ২০২৫ রাত ১০:৪১

[media pointer="file-service://file-26h7VczEB5tkxCSLjrwomQ"]
সিরিয়ার দীর্ঘকালীন শাসক বাশার আল-আসাদের পতন কেবল একটি স্বৈরাচারী সরকার পরিবর্তনের ঘটনা নয়; বরং এটি মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যবাহী রাষ্ট্রব্যবস্থার ভাঙনের প্রতিচ্ছবি। ২০১১ সালে আরব বসন্তের ছায়ায় শুরু হওয়া সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

Between Mars and the Moon

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৩ ই জুন, ২০২৫ রাত ১২:৩৮



মডেল: ভিভিয়ান লি, সিঙ্গাপুর

I dwell in the rust-red silence of Mars,
Where winds whisper through canyon scars.
The sun sets low in a sky so wide,
But without your... ...বাকিটুকু পড়ুন

×