somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাঁচায় তিস্তা, বাঁচাও তিস্তা

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



যখন রংপুর অঞ্চলের তিস্তাতীরবর্তী অনেক মানুষের তিনবেলা খাওয়ার সামর্থ্য ছিল না, তখন তিস্তা সেচ প্রকল্প তাদের সৌভাগ্যের ঠিকানা হয়ে উঠেছিল। নামমাত্র টাকায় তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হতো। এই প্রকল্পের আশীর্বাদে তারা তিনবেলা খাওয়ার নিশ্চয়তা পেয়েছিল। তাদের সন্তানদের স্কুলে যাওয়ার নিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। এককথায় তিস্তাতীরবর্তী অভাবী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করেছিল তিস্তা সেচ প্রকল্প। নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে নদীতে ছিল পর্যাপ্ত পানির প্রবাহ। যাদের জমিজমা ছিল না, তারা নদীতে মাছ শিকার করত। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহকে পেশা হিসেবে নেওয়া জেলেদের জীবনেও ছিল তিন বেলা খাওয়ার নিশ্চয়তা। বর্তমানে ভারত বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারাজ থেকে ১০০ কিলোমিটার উজানে গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে তিস্তার পানি সরিয়ে নেওয়ার কারণে তিস্তা সেচ প্রকল্প কার্যত অচল হয়ে পড়েছে।
তিস্তা সেচ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রায় ১ লাখ ১১ হাজার হেক্টর জমি। দ্বিতীয় পর্যায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল আরও ৬ লাখ হেক্টর জমি। দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজের আশায় অপেক্ষা করেছিলেন আরও লাখ লাখ কৃষক। কিন্তু আশায় গুড়েবালি। দ্বিতীয় পর্যায়ের কথা দূরে থাকুক, প্রথম পর্যায়ে যে এলাকায় সেচ দেওয়া হতো, তা-ও আর সম্ভব হচ্ছে না। এখন শুষ্ক মৌসুমে নদীকেই আর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীতে ৭ হাজার কিউসেক পানির প্রবাহ পরিমাপ করে সেচ প্রকল্পের কাজ হাতে নেয় সরকার। সেই পানি কমতে কমতে গত বছর ২০০ কিউসেকেরও নিচে নেমে এসেছিল। ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হয়েছে। ২০১৪ সালেও ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ শুরু হয়েছিল। অভিন্ন নদী হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই ভারত একতরফা তিস্তার পানি সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করে নেওয়ার কারণে, হঠাৎ করে পানি আসা বন্ধ হয়ে যায়। কৃষকেরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। যাদের একটুখানি সামর্থ্য ছিল, তারা গভীর নলকূপ বসিয়ে কোনোরকমে ধান ঘরে তুলতে পেরেছে। আর যাদের সামর্থ্য ছিল না তারা ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। জমি ফেটে চৌচির হয়েছিল।
২০১৫ সালে ২০ হাজার হেক্টর জমি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও ৮ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ, রেশনিং সিস্টেমে পানি দিতে হলে যে ন্যূনতম পানির প্রবাহ প্রয়োজন, তা-ও কখনো কখনো ছিল না। ২০১৬ সালে তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতায় জমি নেওয়া হয়েছে মাত্র ৮ হাজার হেক্টর। এই ৮ হাজার হেক্টর জমিতে শেষ পর্যন্ত পানি দেওয়া সম্ভব হবে কি না, সন্দেহ রয়েছে।
ভারত পানি সরিয়ে নেওয়ার কারণে নভেম্বর মাসেই তিস্তা অনেকটাই শুকিয়ে যায়। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে পানির প্রবাহ ১ হাজার কিউসেকের নিচে। মার্চ-এপ্রিলে বাস্তবতা আরও ভয়াবহ হবে। তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে যে ৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হচ্ছে, তা বন্ধ করা প্রয়োজন। কারণ, ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা ব্যারাজ পর্যন্ত সামান্য পানি থাকলেও সেখান থেকে কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিলোমিটার তিস্তা একেবারেই পানিশূন্য থাকে। সেচ প্রকল্প বন্ধ রাখলে চুইয়ে চুইয়ে হলেও তিস্তায় সামান্য পানি থাকবে। আগে বাঁচাতে হবে নদীকে। সেই সঙ্গে সরকারের উচিত বর্ষা মৌসুমের পানি জলাধার তৈরি করে ধরে রাখার ব্যবস্থা করা।
তিস্তায় পানি না থাকলে দুই ধরনের ক্ষতি হয়। পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক। বর্তমানে সেচ প্রকল্পের পানি না পাওয়ার কারণে শুধু কৃষকেরা একরপ্রতি লোকসান করছেন ৮ হাজার টাকা। দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু করতে না পারার কারণে আমাদের ১৮ লাখ ৫০ হাজার (সাড়ে ৭ লাখ হেক্টর) একর জমিতে কৃষকের ক্ষতি হচ্ছে ১ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। হাজার হাজার জেলে পেশাহীন হয়ে পড়েছেন। কোটি কোটি টাকার মৎস্যসম্পদ হারাচ্ছে বাংলাদেশ। জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে স্থাপন করা তিস্তা ব্যারাজ কোনো কাজে আসছে না। তিস্তায় পানি না থাকার কারণে তিস্তা-সংলগ্ন বিশাল এলাকার পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যায়। এতে করে ভূমির যে ক্ষতি হচ্ছে তা অর্থমূল্যে কত টাকার, তা হিসাব করার জন্য বিশাল গবেষণার প্রয়োজন। সেচ প্রকল্পের জন্য হাজার হাজার একর জমিতে ক্যানেল করা হয়েছে, সেগুলো এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।
ভারত বাংলাদেশের উজানে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে। অভিন্ন নদীতে অভিন্ন অধিকারের সূত্রে সেই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে বাংলাদেশের অধিকার রয়েছে। সবকিছু মিলে ভারতের কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা বছরে পাওনা হচ্ছে। এই ক্ষতিপূরণ ভারত সরকারের কাছে বাংলাদেশের দাবি করা জরুরি।
২০১৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত জাতিসংঘে নদী অধিকার প্রতিষ্ঠায় শক্ত আইনি কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ১৯৯৭ সালের আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশনটি ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট আইনে পরিণত হয়েছে। ভারত বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। দীর্ঘ ৬৮ বছর ঝুলে থাকা বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তিস্তার পানি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা হলে সুসম্পর্ক কীভাবে বজায় থাকবে? যেকোনো উপায়ে হোক তিস্তায় বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সামনে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন। নির্বাচনের আগে ভারত এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে হয় না। গত বছর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশ সফরের সময় তাঁর ওপর আস্থা রাখার কথা বলেছিলেন। আস্থা রাখার অর্থ তো জলশূন্য তিস্তা নয়। ২০১১ সালে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি তাঁর কারণেই হয়নি।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন রয়েছে। বছরে চারবার তাদের একটি করে সভা হওয়ার কথা থাকলেও ২০১০ সালের পর আর কোনো সভা হয়নি। এতে ভারতের কোনো ক্ষতি নেই। ক্ষতি বাংলাদেশের। যে তিস্তা মানুষের জীবন রক্ষা করে, সেই তিস্তাকে বাঁচাতেই হবে।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:৩৭
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষায় বসতে না পারার কষ্টটা সমালোচনার কোন বিষয়বস্তু নয়

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩৬

গতকালের একটি ভাইরাল খবর হচ্ছে কয়েক মিনিটের জন্য বিসিএস পরীক্ষা দেয়া হলো না ২০ প্রার্থীর !! অনেক প্রার্থীর কান্নাকাটির ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।এ বিষয়ে পিএসসি চেয়ারম্যান এর নিয়ামানুবর্তিতার জ্ঞান বিতরনের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×