somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আল-কুরআন মুত্তাকীদের জন্য হেদায়াত এবং মুত্তাকীদের পরিচয়

২২ শে জুন, ২০১০ ভোর ৬:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আল-কুরআন মুত্তাকীদের জন্য হেদায়াত এবং মুত্তাকীদের পরিচয়


(1) الم ـ (2) ذلِكَ الْكِتَابُ لاَ رَيْبَ فِيْهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِيْنَ ـ (3) الّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلوةَ وَمِمَّا رَزَقْنهُمْ يُنْفِقُوْنَ ـ (4) وَالَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِمَآ اُنْزِلَ اِلَيْكَ وَمَآ اُوْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَبِالاخِرَةِ هُمْ يُوْقِنُوْنَ ـ (5) اُوْلئِكَ عَلى هُدًى مِّنْ رَّبِّهِمْ وَاُولئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ـ

উৎসঃ সূরা আল-বাকারা মদীনায় অবতীর্ণ : আয়াত- ২৮৬, রুকূ- ৪০ আলোচ্য আয়াত নং- ১-৫ পর্যন্ত

অর্থঃ সূরা আল-বাকারা মদীনায় অবতীর্ণ : আয়াত- ২৮৬, রুকূ- ৪০ আলোচ্য আয়াত নং- ১-৫ পর্যন্ত


শব্দার্থ : الم –আলীফ-লাম-মীম। ذلِكَ –সেই, رَيْبَ সন্দেহ, هُدًى সৎপথ প্রদর্শক, لِّلْمُتَّقِيْنَ পরহেযগার, يُؤْمِنُوْنَ –বিশ্বাস করে, بِالْغَيْبِ অদৃশ্যে, َيُقِيْمُوْنَ প্রতিষ্ঠিত করে, مِمَّا তা হতে যা, رَزَقْنهُمْ তাদেরকে আমরা রিযিক দিয়েছি, يُنْفِقُوْنَ তারা খরচ করে, بِمَآ ঐ বিষয়ে যা, اُنْزِلَ নাযিল করা হয়েছে, اِلَيْكَ তোমার উপর, قَبْلِكَ তোমার পূর্বে, يُوْقِنُوْنَ দৃঢ় বিশ্বাস রাখে, اُوْلئِكَ তারাই (প্রতিষ্ঠিত), هُدًى সত্য পথের رَّبِّهِمْ তাদের প্রভুর, هُمُ যারা, الْمُفْلِحُوْنَ কল্যাণ লাভকারী।

নামরকরণ: এই সূরার ৬৭ নং আয়াত وَاِذْ قَلَ مُوْسى لِقَوْمِهِ اِنَّ اللهَ يَأمُرُكُمْ اَنْ يَذْبَحُوْن ا بَقَرَةَ ـ ‍"যকন মূসা তাঁর জাতিকে বললো, আল্লাহ তোমাদের একটি গাভী যবেহ করার হুকুম দিচ্ছেন।"
আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা (আ) এর মাধ্যমে বনী ইসরাঈল জাতিকে একটি গাভী যবেহ করার নির্দেশ অনুযায়ী কুরআনের অধিকাংশ সূরার শিরোনামের পরিবর্তে আলামত স্বরূপ নাম রেখেছেন। এখানেও আলবাকারা সম্বন্ধে কোন আলোচনা নেই।
নাযিল হওয়ার সময়কাল: এ সূরার বেশীর ভাগ অংশ মাদানী যিন্দেগীর প্রথম যুগে নাযিল হয়। আর এর কম অংশ পরে নাযিল হয়। সুদ নিষিদ্ধকরণ আয়াতগুলো তাঁর যিন্দেগীর একেবারে শেষ পর্যায়ে নাযিল হয়। যে আয়াতগুলো দ্বারা সমাপ্তি হয়েছ, সেগুলো হিজরতের পূর্বে মক্কী যুগে নাযিল হয়। বিষয়বস্তুর সামঞ্জস্যের ক্রমধারার সাথে মিল রেখেই এভাবে সাজানো হয়েছে।

ঐতিহাসিক পটভূমি: ঐতিহাসিক পটভূমি ভাল করে বুঝে না নিলে এ সূরাকে সহজে বুঝা সম্ভব হবে না।

(১) হিজরতের পূর্বে ইসলামী দাওয়াতের কথা সাধরণত মক্কার মুশরিকদের লক্ষ্য করেই বলা হয়েছে। তাদের নিকট ইসলামের এই বাণী ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। হিজরতের পর ইসলামের দাওয়াত ইহুদীদের সম্মুখীন হলো। তারা হযরত মূসা (আ) এর উপর নাযিলকৃত তাওরাত কিতাবের অনুসারী হয়ে তাওহীদ, রিসালাত, আখেরাত, ওহী ও ফেরেশতায় বিশ্বাসী ছিল। বহু শতাব্দী কালের ক্রমাগত পতন ও অবনতির ফলে এবং নিজেদের দুনিয়াবী স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে তারা তাওরাতের অনেক পরিবর্তন ঘটিয়েতার সাথে মানুষের কথা মিশিয়ে দিয়েছিল। তার এতই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যে, কোন প্রকার সংস্কার সংশোধন নিয়ে যদি কেউ অগ্রসর হতো তবে তারা তাঁকে দুশমন মনে করে তার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার জন্য উঠে পড়ে লাগতো। শত সহস্র বছর ধরে এই ধারা ক্রমাগত চলতে থাকে।

দীন বহির্ভূত বিষয়গুলো দীনের মধ্যে শামিল, ছোটখাট বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বাদ দিয়ে গুরুত্বহীন বিষয় নিয়ে মাতামাতি, আল্লাহকে ভুলে যাওয়া ও পার্থিব লোভ-লালসায় মত্ত হয়ে তারা পতনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। মুসলিম নাম ভুলে গিয়ে নিছক ইহুদী নামের মধ্যেই তারা নিজেদেরকে ধরে রেখেছিল। ১৫ ও ১৬ রুকূতে ইহুদীদের সমালোচনা করে তাদের বিকৃত ধর্ম ও নৈতিকতার মুকাবিলার যথার্থ ধার্মিকতার দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে।

(২) মদীনায় ইসলামী দাওয়াতের একটি নতুন পর্যায় আরম্ভ হলো। মক্কায় তো কেবল দীনের মূলনীতির প্রচার এবং দীন গ্রণকারীদের নৈতিক প্রশিক্ষণের মধ্যেই দাওয়াতের কাজ সীমাবদ্ধ ছিল।
হিজরতের পর মদীনায় মুসলমান সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আনসারদের সহায়তায় একটি ছোট ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো। তখন আল্লাহ তায়ালা সমাজ, সংস্কৃতি, আইন ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কীয় মৌলিক নির্দেশ জারী করতে থাকেন। ইসলামের ভিত্তির উপর নতুন জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পন্থাও বলে দিলেন।

(৩) হিজরতের পূর্বে কাফেরদের ঘরেই ইসলামের দাওয়াতী কাজ চলছিল। যেসব লোক দাওয়াত গ্রহণ করেছিল, তারা নিজ নিজ স্থান থেকেই দাওয়াতী কাজ করতো। কিন্তু হিজরতের পর বিক্ষিপ্ত মুসলিমগণ যখন একত্র হয়ে ক্ষুদ্রায়তন একটি স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলো, তখন একদিকে এই ক্ষুদ্র ইসলামী রাষ্ট্র, আর অপরদিকে সমগ্র আরবদেশ একত্র হয়ে তার ধ্বংসের চেষ্টায় সমগ্র শক্তি নিয়োগ করেছিল। তখন এই মুষ্ঠিমেয় সংখ্যাবিশিষ্ট দলের সাফল্য ও অস্তিত্ব নির্ভর করতে লাগলো প্রধানত পাঁচটি কাজের উপর।
এক- পূর্ণ শক্তি, উৎসাহ-উদ্দীপনা ও হেকমতের সাথে দাওয়াতী কাজের প্রসার ঘটিয়ে সর্বাধিক সংখ্যক লোককে ইসলামের অনুসারী করার চেষ্টা করা।
দুই- বিরোধীরা ভ্রান্ত পথের অনুসারী, বিষয়টি তাদের এমনভাবে প্রমাণ করতে হবে যেন কোন বিবেকবান ব্যক্তির মনে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় না থাকে।
তিন- তারা আশ্রয়হীন, প্রবাসী ও সমগ্র দেশের শত্রুতা ও প্রতিকূলতার মুখোমুখী হওয়ার দরুন দারিদ্র্য, উপবাস এবং সর্বদা অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতার অস্বস্তিকর অব্স্থার শিকার হয়েও তারা হতাশ না হয়ে পূর্ণ ধৈর্যসহকারে এই প্রতিকূল অবস্থায় মুকাবিলা করে এবং তাদেরে সংকল্পে কোনরূপ দুর্বলতা প্রবেশ করতে দেয় না।
চার- ইসলামী দাওয়াতকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য যে কোন দিক থেকে সশস্ত্র আক্রমণের মুকাবিলা করার জন্য ধৈর্য ও সাহসিকতার সাথে তাদের সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। বিরোধী পক্ষের জনসংখ্যা ও শক্তির আধিক্যের পরোয়া করা চলবে না। বিশ্বাস রাখতে হবে যে, শয়তানের চক্রান্ত অতি দুর্বল।
পাঁচ- ঈমানদারদের মধ্যে এমন দৃঢ় সাহস ও হিম্মত জাগিয়ে তুলতে হবে। যাতে আরববাসীরা ইসলামী সমাজ ব্যবস্থাকে আপোষ গ্রহণ করতে না চাইলে বল প্রয়োগে জাহেলী ব্যবস্থাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করতে দ্বিধা-সংকোচ করবে না।


আলোচ্য সূরায় আল্লাহ তায়ালা এই পাঁচটি কাজের প্রাথমিক উপদেশ দিয়েছেন।
(৪) মদীনায় ইসলামী দাওয়াতের এ পর্যায়ে মুনাফিকের দল আত্মপ্রকাশ করতে লাগলো। নবী করীম (সা) এর মক্কী যিন্দেগীরর শেষের দিকে মুনাফিকির প্রাথমিক আলামত লক্ষ্য করা যায়।
(ক) মক্কার মুনাফিকের স্বরূপ ছিল এমন- তারা ইসলামের সত্যতা স্বীকার করতো এবং ঈমানের ঘোষণাও দিতো। কিন্তু ইসলামের খাতিরে কোন ত্যাগস্বীকার করতে তার প্রস্তুত ছিল না। মদীনায় আসার পর আরও অনেক ধরণের মুনাফিক ইসলামী দলে দেখা যেতে লাগলো। ইসলামকে সম্পূর্ণ রূপে অস্বীকারকারী মুনাফিক দল ফিতনা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে ইসলামী দলে প্রবেশ করতো।
(খ) দ্বিতীয় মুনাফিক দলের অবস্থা এই ছিল যে, ইসলামী কর্তৃত্ব ও প্রশসন দ্বারা পরিবেষ্টিত হওয়ার কারণে তারা নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে একদিকে ইসলাম ও অন্যদিকে ইসলাম বিরোধীদের সাথেও সম্পর্ক রাখতো। এভাবে তারা উভয় দিকের লাভের অংশ ভোগ করতো এবং উভয় দিকের বিপদের ঝাপটা থেকেও রক্ষা পেতো।
(গ)তৃতীয় শ্রেণীর মুনাফিক, যারা ইসলাম ও জাহেলিয়াতের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে দোদুল্যমান ছিল। তাদের বংশের অধিকাংশ লোক ইসলাম গ্রহণ করায় তারাও বাধ্য হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে।
(ঘ) চতুর্থ শ্রেণীর মুনাফিক, যারা ইসলামকে সত্য বলে স্বীকার করতো, কিন্তু জাহেলিয়াতের আচার-আচরণ ও বিশ্বাসগুলো ত্যাগ করে ইসলামের নৈতিক বাধ্যবধাকতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে তাদের মন চাইতো না।
মহান আল্লাহ এই সূরায় তাদের প্রতি সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিত করেছেন। পরবর্তীকালে তাদের গতি প্রকৃতি অনুযায়ী তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা পৃথক পৃথকভাবে নির্দেশ দিয়েছেন।

ব্যাখ্যা:(ক)الم ـ এরূপ "হুরূফে মুকাত্তাআত"- বিচ্ছিন্ন অক্ষরসমূহ আল-কুরআনের অনেক সূরার শুরুতে আছে। আল্লাহ পাকই এসব সম্পর্কে সঠিক ও সর্বোত্তম জ্ঞানের অধিকারী। কুরআন মজীদের ২৯ টি সূরায় পুনরুক্তিসহ মোট ২৮ টি অক্ষর এসেছে। পুনরুক্ত অক্ষরগুলো বাদ দিয়ে সূরাসমূহের প্রথমে এ প্রকারের চৌদ্দটি অক্ষর এসেছে। অক্ষরগুলো হচ্ছে-
ال مصر&كهىعطسحقن
এগুলোর অর্থ জানা একজন পাঠকের জন্য আবশ্যক নয়। কারণ এগুলোর অর্থ জানা কুরআন থেকে হেদায়াত লাভের ক্ষেত্রে শর্ত নয়।
(খ) ذلِكَ الْكِتَابُ لاَ رَيْبَ فِيْهِ ـ "এটি সেই কিতাব, যার মধ্যে কোন সন্দেহ নেই"।هذَا; এই, ذلِكَ ঐ,। এখানে আরবী ভাষায় এই দুইটি শব্দ অধিকাংশ ক্ষেত্রে একে অপরের বিকল্প হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আরবরা এতদুভয়ের মাঝে তেমন কোন পার্থক্য করেন না। ذلِكَ প্রকৃতপক্ষে দূরের ইঙ্গিতের জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু কখনও কখনও নিকটবর্তী বস্তুর জন্যও আসে। তখন তার অর্থ হবে 'এই'।

এখানেذلِكَ الْكِتَابُ দ্বারা কুরআন মজীদকে বুজানো হয়েছে।
দুনিয়ার মানুষের বুদ্ধিজ্ঞান বহির্ভূত বিষয় নিয়ে ধারণা, কল্পনা ও আন্দাজ-অনুমানের ভিত্তিতে যতগুলো গ্রন্থ লিখিত হয়েছে, এগুলোর লেখকগণ নিজেদের গ্রন্থাবলীর নির্ভূলতা সম্পর্কে যত শপথই করুক না কেন তাদের গ্রন্থাবলী সন্দেহমুক্ত নয়। কিন্তু এ কুরআন মজীদের রচিয়তা এমন এক সত্তা যিনি সমস্ত তত্ত্ব ও তথ্যের জ্ঞান রাখেন। অতীত ও ভবিষ্যৎ সবই তাঁর নিকট বর্তমান। কাজেই এর মধ্যে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

(গ) هُدًى لَّلْمُتَّقِيْنَ ـ -"এটি মুত্তাকীদের জন্য হেদায়াত।" এই পথ নির্দেশিকা গ্রন্থ থেকে হেদায়াত পেতে হলে মানুষকে মুত্তাকী হতে হবে। ভালো ও মন্দের পার্থক্য করার ক্ষমতা তার মধ্যে থাকতে হবে। ভালোকে গ্রহণ এবং মন্দ বর্জন করা মুত্তাকীর বৈশিষ্ট্য। সেই বৈশিষ্ট্য সৃষ্টিতে তাকে আগ্রহী হতে হবে। যারা দুনিয়ায় পশুর মতো জীবন যাপন করে, নিজেদের কৃতকর্ম সঠিক কিনা সে ব্যাপারে কোন চিন্তা করে না, দুনিয়ায় গড্ডালিকা প্রবাহে যারা গা ভাসিয়ে দেয়, তার নফস তাকে যেদিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে অথবা মন যেদিকে যেতে চায় সেদিকে চলতে অভ্যস্ত, তাদের জন্য আল-কুরআনে কোন পথনির্দেশ নেই।

ঐসব মুত্তাকীদের জন্য এ গ্রন্থ 'হেদায়া' বা পথপ্রদর্শক হবে যারা কিছু মৌলিক গুণ অর্জন করতে পেরেছে। সেই গুণগুলো হলো:
الّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلوةَ وَمِمَّا رَزَقْنهُمْ يُنْفِقُوْنَ ـ (4) وَالَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِمَآ اُنْزِلَ اِلَيْكَ وَمَآ اُوْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَبِالاخِرَةِ هُمْ يُوْقِنُوْنَ ـ
১। "যারা অদৃশ্যে ঈমান আনে, ২। নামায প্রতিষ্ঠিত করে, ৩। যে রিযিক আমরা তাদেরকে দিয়েছি, তা থেকে খরচ করে, ৪। তোমার উপর যে ওহী এবং তোমার আগে যেসব ওহী নাযিল হয়েছিল, সেগুলোর উপর ঈমান রাখে, ৫। আর আখেরাতের উপরও ঈমান আনে"। এগুলোই মুত্তাকীর বৈশিষ্ট্য।
১। অদৃশ্যে ঈমান আনয়ন- যা দেখা যায় না, শোনা যায় না এবং অংগ ও প্রত্যংগ দ্বারা অনুভব করা যায় না, অর্থাৎ মানুষের ইন্দ্রিয়াতীত এবং মানুষের প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় ধরা পড়ে না। যেমন আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী, ওহী, ফেরেশতা, আখেরাত, জান্নাত ও জাহান্নম ইত্যাদি। এ সত্যগুলোকে না দেখে বিশ্বাস করা এবং প্রদত্ত খবরের উপর আস্থা রেখে এগুলোকে মেনে নেয়াই হচ্ছে সেই ঈমান বিল-গায়েব বা অদৃশ্যে বিশ্বাস।

আল-কুরআন থেকে কেবল সেই ব্যক্তিই হেদায়াত বা পথনির্দেশ লাভ করবে যে এই না দেখা সত্যগুলো মেনে নিতে প্রস্তুত হবে। আর যদি কেউ এমন চিন্তা করে যে, না দেখে, না বুঝে, পরিমাপ বা ওজন না করে, ইন্দ্রিয় দ্বারা স্বাদ আস্বাদান না করে বোকার মত কোন জিনিস আমি মেনে নিতে পারি না, সে এ কিতাব থেকে হেদায়াত লাভ করতে সক্ষম হবে না।

২। নামায কায়েম করা- কোন নির্দিষ্ট স্থানে আযানের দ্বারা প্রকাশ্যভাবে নামাযের জন্য মানুষকে আহবান জানিয়ে সামষ্টিকভাবে জামায়াতবদ্ধ হয়ে নামায পড়াকে 'ইকামতে সালাত' বলে। আল্লাহ আনুগত্যের বাস্তব ও স্থায়ী নমুনা হচ্ছে নামায। মুয়াযযিন প্রতিদিন পাঁচবার নামাযের জন্য আহবান জানায়, ঈমানের দাবিদার কোন ব্যক্তি এ আহবানে সাড়া না দিলে বুঝা যায় যে, সে আল্লাহর আনুগত্য ত্যাগ করেছে। কোন লোকালয়ে প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে নিয়মিত নামায আদায় করে, কিন্তু জামায়াতের সাথে ফরয নামায পড়ার ব্যবস্থা না করে থাকে, তবে সেখানে নামায কায়েম আছে, একথা বলা যায় না।

কাজেই আল-কুরআন থেকে হেদায়াত লাভের তৃতীয় শর্তই হলো, কোন ব্যক্তি চুপচাপ বসে না থেকে নামায কায়েম করার জন্য তৎপর হবে। সমাজের অন্যান্য ঈমানদার লোকদের সংগঠিত করে জামায়াতে নামায আদায়ের ব্যবস্থা করবে।

৩। যে রিযিক আমরা তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে খরচ করে- বান্দা প্রথমেই স্বীকার করে নেয় যে, তাদের ধন-সম্পদ যা কিছু আছে তা আল্লাহ প্রদত্ত, তাদের নিজেদের সৃষ্ট বা উপার্জিত নয়। কাজেই এ সম্পদে আল্লাহ ও বান্দার অধিকার রয়েছে। আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার আান্দোলনে খরচ করা প্রথম কর্তব্য।

আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী হকদার হচ্ছে তার পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিত ব্যক্তিরা। অত:পর দূরের লোক। প্রথমে সাধারণ দান-সদকার বিধান প্রবর্তিত হয়েছিল। পরে যাকাত একটা স্বতন্ত্র বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে নাযিল হয়। কিন্তু সাধারণ দান-সদকাও এর পাশাপাশি চালু থাকে। আল্লাহ তায়ালা সূরা তাগাবুনের ১৭-১৮ নং আয়াতে বলেছেন
وَمَنْ يُّوْقَ شُحَّ نَفْسِه فَأُولئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ اِنْ تُقْرِضِوُا اللهَ قَرْضَأ حَسَنًا يُّضعِفْهُ لَكُمْ ـ
"যারা দিলের সংকীর্ণতা থেকে বেঁচে আছে তারাই কামিয়াব। তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিলে তিনি তা তোমাদের জন্য কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে ফেরৎ দিবেন"।
আল্লাহ তায়ালা সূরা মুনাফিকূনের ১১ নং আয়াতে বলেন:
وَاَنْفِقُوْا مِنْ مَّا رَزَقْنَكُمْ مَّنْ قَبْلِ اَنْ يَّاتِىْ اَحَدَكُمْ الْمَوْتُ ـ
"আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তোমরা তা থেকে তোমাদের কারো মৃত্যু আসার আগেই খরচ কর"।
কাজেই সংকীর্ণমনা ও অর্থলোলুপ না হয়ে মানুষকে হতে হবে আল্লাহর ও বান্দার হক আদায়কারী।

বাখিলী চরিত্রের লোকদের মত ঈমানদার ব্যক্তি হাত গুটিয়ে রাখবে না। সে আল্লাহর পথে বে-হিসাব ব্যয় করবে, আর এ বিশ্বাস রাখবে যে, আল্লাহর ভাণ্ডার অফুরন্তু। তিনি বান্দাকে পরীক্ষা করেন মাত্র। তিনি এই দুনিয়ায়ই বান্দাকে তার ব্যয়িত সম্পদ কয়েক গুণ বেশী করে ফেরৎ দিতে পারেন।

৪। তোমার উপর এবং তোমার পূর্বে যেসব ওহী নাযিল হয়েছিল তার প্রতি ঈমান আনে- আল্লাহ তায়ালা ওহীর মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সা) ও পূর্ববর্তী নবীগণের উপর বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন স্থানে যে সকল কিতাব নাযিল করেছেন সেসবের উপরও ঈমান আনতে হবে। যারা এগুলোকে বাদ দিয়ে নিজেদের মনগড়া মতবাদকে আল্লাহর বিধান বলে চালিয়ে দেয় এবং তাদের বাপ-দাদারা যেগুলোকে মেনে আসছে সেগুলো ছাড়া অন্যগুলোকে অস্বীকার করে তাদের সকলের জন্য আল-কুরআনের হেদায়াতের দরজা বন্ধ। আল-কুরআন তার অনুগ্রহ কেবলমাত্র তাদের উপর বর্ষণ করে যারা নিজেদেরকে আল্লাহর বিধানের মুখাপেক্ষী মনে করে। যারা বংশ, গোত্র বা জাতি প্রীতিতে লিপ্ত হয় না, বরং নির্ভেজাল সত্যের প্রতি অনুগত, সত্য যেখানে যে আকৃতিতে আবির্ভূত হোক তার সামনে তার মাথা নত করে দেয়।
৫। আর যারা আখেরাতের উপর ঈমান আনে- এটি ষষ্ঠ ও সর্বশেষ শর্ত। আখেরাতের একটি ব্যাপক ও পরিপূর্ণ অর্থবোধক শব্দ। আকীদা-বিশ্বাসের বিভিন্ন উপাদানের সমষ্টির ভিত্তিতে এ আখেরাতের ভাবধারা গড়ে উঠেছে। বিশ্বাসের নিম্নোক্ত উপাদানগুলো এর অন্তর্ভূক্ত।
এক: ; এ দুনিয়ায় মানুষ কোন দায়িত্বহীন জীব নয়। নিজের সমস্ত কাজের জন্য তাকে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে।
দুই: দুনিয়ার বর্তমান ব্যবস্থা চিরন্তন নয়। একটি মুহূর্তে এর মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে এবং সেই সময়টা একমাত্র আল্লাহই জানেন।
তিন: এ দুনিয়া শেষ হবার পর আল্লাহ আর একটি দুনিয়া তৈরী করবেন। সৃষ্টির আদি থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে যত মানুষের জন্ম হয়েছে সবাইকে সেখানে একই সংগে পুনর্বার সৃষ্টি করবেন। সবাইকে একত্র করে তাদের কর্মকান্ডের হিসাব নিবেন। সবাইকে নিজ নিজ কাজের পূর্ণ প্রতিদান দেবেন।
চার:আল্লাহর এ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে সৎ লোকেরা জান্নাতে স্থান পাবে এবং অসৎ লোকদেরকে নিক্ষেপ করা হবে জাহান্নামে।
পাঁচ:বর্তমান জীবনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও প্রশ্চাতপদতা, সাফল্য ও ব্যর্থতা আসল মানদন্ড নয়। বরং আল্লাহর শেষ বিচারে যে ব্যক্তি উতরে যাবে সে-ই হচ্ছে সফলকাম আর সেখানে যে উতরাবে না সে ব্যর্থ।
এ সমগ্র আকীদা-বিশ্বাসগুলোকে যারা মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি তারা কুরআন থেকে কোনক্রমেই উপকৃত হতে পারবে না। কারণ এ বিষয়গুলো অস্বীকার করা তো দূরের কথা, এগুলো সম্পকেৃ কারো মনে যদি সামান্যতম দ্বিধা ও সন্দেহ থেকে থাকে, তাহলে মানুষের জীবনের জন্য কুরআন যে পথ নির্দেশ করেছে সে পথে তারা চলতে পারবে না।
(ঙ) اُولئِكَ عَلى هُدّى مَِنْ رَّبِْهِمْ وَاُلئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ـ"তারাই নিজেদের প্রতিপালকের পথে আছে এবং তারাই সফলকাম"।

সূরা বাকারার প্রথম চারটি আয়াতের উপর ঈমান ও আমলের দ্বারাই মুত্তাকী হওয়া যায়। তৃতীয় আয়াতে মুত্তাকীর যে ৫টি বৈশষ্ট্য আলোচিত হয়েছে, যারা এগুলো হাসিল করতে পারেনি। তারা ব্যর্থ। আর যারা এ গুণগুলো হাসিল করতে পেরেছে তারা সফলকাম হয়েছে। আর মুত্তাকীরাই আল্লাহর পছন্দনীয় পথে আছে এবং তারই পূর্ণ সফলতা লাভ করবে।
শিক্ষাঃ
১)আল্লাহ তায়ালা নিজেই ঘোষণা দিয়ে বলেছেন- এই শ্রেষ্ঠ আসমানী কিতবা আল-কুরআনের মধ্যে কোন সন্দেহপূর্ণ কিছু নেই।
২)সূরা ফাতেহায় আমরা যে সরল প্রার্থনা করেছিলাম, এখানে সেই সরলপথ মানুষকে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে।
৩)পাঁচটি গুণবিশিষ্ট মুত্তাকীরাই আল-কুরআন থেকে হেদায়াত পাওয়ার যোগ্য (যা পূর্বে উক্ত হয়েছে)
বাস্তবায়নঃ মানুষকে আল্লাহ তায়ালা আশরাফুল মাখলুকাত হিসাবে ঘোষণা দিয়েছেন। আল-কুরআন থেকে হেদায়াত নিয়ে ঈমান ও আমলের দ্বারা আমরা সকলে যেন আশরাফুল মাখলুকাত (সৃষ্টির সেরা) হিসাবে ভূষিত হতে পারি, সেই তাওফীক কামনা করে দারস এখনেই শেষ করছি।




৮টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিজয় দিবসের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদ ও ঘৃণা জানিয়ে । সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান ২০২৫, ১৬ই ডিসেম্বর।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:১৯




দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ত্রিশ লক্ষ তাজা প্রানের এক সাগর রক্তের বিনিময়। দুই লক্ষাধিক মা বোনের সম্ভ্রম হারানো। লক্ষ শিশুর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত‍্যু। এক কোটি মানুষের বাস্তুহারা জিবন। লক্ষ কোটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×