স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহের কারণে সৃষ্ট প্রাথমিক আঘাতটা কেটে যাওয়ার পর আমি গভীর এবং দীর্ঘ হতাশার মধ্যে ডুবে যাই । । আমি তার এ কাজের ফলে নিজেকে চরম ভাবে লজ্জ্বিত, দুঃচিন্তিত এবং পরিত্যক্ত মনে করি । কিভাবে সে অন্য একজনকে বিবাহ করতে পারে যেখানে আমার মধ্যে কোন সমস্যা নেই ? আমি মনের সাহস হারিয়ে ফেলি । বার বার মনে হতে লাগল সে আর আমাকে ভালোবাসেনা । তার নতুন স্ত্রী আমার স্হান দখল করে নিয়েছে । আল্লাহর পরম দয়ায় আমি নিজেকে সামলাতে পেরেছি যখন প্রাথমিক অবস্হায় বাহিরে বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে অন্যদের সাথে মিলামেশা করতে হয়েছে । যদিও এটা আমার জন্য খুব কঠিন ছিলো মনের এই অবস্হায় অন্যদের সাথে মিলামিশা করা । সবাই একটু অন্যরকম দৃষ্টিতে আমার দিকে দেখত । আমিও আগের মত তেমন সহজ আর খোলামেলা হতে পারতাম না । যদিও বাহিরে নিজের আবেগকে সবার সামনে লুকিয়ে রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম কিন্তু ঘরে এসে আর নিজের আবেগকে ধরে রাখতে পারতাম না , চোখ দিয়ে টপ টপ করে অশ্রু এমনিতেই গড়িয়ে পড়ত ।
প্রথমত আমি বুঝতে পারছিলাম না এই কষ্টকর জার্নি কত দিন অব্যাহত থাকবে । কিন্তু যে কোন ভাবেই হোক আল্লাহর কাছে দোয়ার কারণে আল্লাহ স্বামীর নতুন স্ত্রী সেই বোনের প্রতি কেমন যেন একটা উদারতা এবং দয়ার অনূভূতি তৈরী হলো । মনে হয় সে যেন আমার অনূভূতিগুলো বুঝতে পারছিলো এবং তার সহৃদয় ব্যবহারও এর একটা কারণ হতে পারে । আমি এটা বলছিনা যে তার প্রতি আমার ক্রোধ এবং তিক্ত ব্যবহারের বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি । অনেক সময় তার প্রতি আমার এমন ব্যবহার প্রকাশ পেয়েছে যা একজন মুসলমান বোনের প্রতি হওয়া উচিত নয় । কিন্তু সব দিক চিন্তা করলে আমার যে অবস্হা সে সময় ছিলো সেই তুলনায় আল্লাহর একন্ত অনুগ্রহে আমি তার প্রতি যথেষ্ট সংযত আচরণ করেছি । সেও তার আচরণকে যে নিয়ন্ত্রণ করছিলো তাও বুঝতে পারছিলাম । তবে আমার অবস্হান তার থেকে বেশী খারাপ ছিলো কারণ আমি আমার স্হান হারিয়েছি আর সেও কোন আনকোরা নতুন সংসারে প্রবেশ করেনি । যার ফলে তার মধ্যেও কিছু হতাশা ছিলো তবে সেটা আমার মতো এতো তীব্র নয় ।
এই সকল অনিচ্ছাকৃত অনুভূতি সমূহ প্রেমহীনতা, নিজেকে পরিত্যক্ত মনে করা এবং অপমান এর সব কিছুই স্বাভাবিক । কিন্তু যেটা বেশী প্রয়োজন সেটা হলো এই অনুভূতিগুলো কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় । কারণ আর যাই হোক নিজেকে সব সময় দুঃখের মধ্যে ডুবিয়ে রাখা যায় না । নতুন কোন আশা নিয়ে জীবনে বেচে থাকার প্রেরণা খুজতে হবে । আমাদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম যারা আল্লাহর সর্বাপেক্ষা অনুগত । মুসলমান হিসেবে সব কিছুর সমাধান আমাদের ধর্মের মধ্যেই খুজতে হবে । যদিও যে কোন মেয়ে এসময় দুঃখিত, লজ্জ্বিত এবং অপমানিত বোধ করবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু আমি মনে করি সত্যিকার অর্থে মানুষের মর্যাদা নির্ভর করে আল্লাহকে যথাযথভাবে মেনে চলার মাধ্যমে । এটা যদিও খুব কঠিন এইরকম একটা খারাপ সময়ে বাস্তবতা অনুভব করা । এছাড়াও শয়তান এবং মেয়ে মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতিও তাকে বাস্তবতার বিপরীতে চালিত করে । কিন্তু আমাদের সবারই বোঝা উচিত যে এই জীবনে যা কিছু পাই তা হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের নিকট উপহারস্বরূপ । আমরা এগুলো ব্যবহার করি আল্লাহর ইবাদত করার জন্য । যদি আল্লাহ আমাদের থেকে উনার কোন উপহার নিয়ে যেতে চান, আমাদের মনে রাখা উচিত যে, তিনি হলেন সর্বাপেক্ষা উত্তম বিচারক এবং দয়ালূ ।
একটি হাদিসে মহানবী (সাঃ) বলেছেন যে,
" যদি কেউ কোন বিপদে পড়ে এবং বলে যে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহী রাজিউন) আমরা সবাই আল্লাহর কাছ থেকে এবং সবাই তার কাছেই ফিরে যাব । ওহ আল্লাহ, আমাকে এই কষ্টের জন্য পুরস্কার প্রদান কর এবং আরো ভালো কিছু দিয়ে আমার প্রতি রহম কর । তখন আল্লাহ উনার শক্তি এবং ক্ষমতা দিয়ে তা প্রদান করেন ।"
কুরআনের এই সব দোয়ার বরকতে আল্লাহর ইচ্ছায় আমাদের জীবনের কষ্ট দূর হয় এবং মানসিক প্রশান্তি দান করে ।
প্রথম স্ত্রী হিসেবে স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহকে মেনে নেওয়া আসলে একটি মেয়ের জন্য অনেক বড় জিহাদ । এটা এমন একটা সংগ্রাম যা ক্রমাগত চলতেই থাকে এবং খুবই ক্লান্তিকর । মাঝে মাঝে আমার খালি মনে হয় আমার আর বেচে থাকা উচিত নয় । একটি হাদিসে আছে মহানবী (সাঃ) বলেছেন, একজন মুসলমানের মৃত্যু কামনা করা উচিত নয় বরং তার উচিত আল্লাহর কাছে এই দোয়া করাঃ
হে মাবুদ, 'আমার যদি বেচে থাকা উত্তম হয় তাহলে আমাকে বাচতে সহায়তা কর আর যদি মরে যাওয়া ভালো তবে তাহলে আমাকে মৃত্যু দান কর ।' (বুখারী)
আমরা চাই আমাদের শেষ কাজটা যেন সব থেকে ভালো হয় । আমরা তখনই মরতে চাই যখন আমাদের বিশ্বাসটা সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী থাকে এবং আমাদের খারাপ কাজের থেকে ভালো কাজের পরিমাণটা বেশী । আল্লাহ আমাদের সেই সময়ে মৃত্যু দান করুক যখন তিনি আমাদের উপর সন্তুষ্ট এবং আমরাও উনার উপর সন্তুষ্ট ।
আমাদের আল্লাহর দয়ার উপর কোন সময়ই হতাশ হওয়া উচিত নয় ।
প্রায় সময়ই ভালো কিছু পাওয়া যায় অনিচ্ছাকৃত অবস্হা থেকে এবং এই সব পরীক্ষা থেকে অন্যতম পুরস্কার বা সুবিধা যেটা পাওয়া যায় সেটা হলো আল্লাহর সাথে সম্পর্কটা গভীর হয় । এই কঠিন বাস্তববাদী জীবনে আমরা যারা বাস করি, অনেকের নিকটই আধ্যাত্নিক সম্পর্কের তেমন কোন মূল্য নাই । কিন্তু আমরা যখন এই দুনিয়াতে আসার কারণটা খুজে পাই , তখন এর মূল্য অনুভব করতে পারি । আমাদের সব কিছু মূলতঃ আল্লাহর জন্যই ।
উপরোক্ত বর্ণিত আবেগ এবং অনুভূতি ছাড়াও স্বামীর প্রথম স্ত্রী হিসেবে স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহের ফলে আরো যেটা হয় সেটা হলো নিজের আত্ন-পরিচয় (loss of identity) কে হারিয়ে ফেলা । সংসারে যে আমার কোন ভূমিকা আছে সেটা নিয়ে সন্দেহ তৈরী হয় । যদিও আমরা আমাদের দৈনন্দিন প্রাত্যহিক জীবনে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করি । আমরা কেউ মা, কন্যা, বোন, শিক্ষক, ডাক্তার এবং অবশ্যই একজন স্ত্রী । একটা দায়িত্ব হারিয়ে ফেলা বা কমে যাওয়া বা শেয়ার করা যাই বলেন- সেটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা । আর এই ক্ষেত্রে তো এটা অনেক কঠিনই বটে । অন্য একজন মেয়ের সাথে নিজের স্বামীকে শেয়ার করা প্রচন্ড মানসিক কষ্টের ব্যাপার । বিশেষ করে যখন রাত্রিবেলা স্বামীকে কাছে পাওয়া যায় না আগের মতন আর এটা যদি হয় এরকম যে স্বামী আরেক জনের সাথে রাত্রি কাটাচ্ছে তাহলে সেটা মেনে নেয়া একজন স্ত্রীর পক্ষে যে কত কষ্টের তা একমাত্র ভূক্তভোগী ছাড়া আর কারো পক্ষে বুঝা সম্ভব নয় । এখন সে আর তার স্বামীর একমাত্র স্ত্রী নয় তাকে তার স্ত্রীর ভূমিকা আরেক মেয়ের সাথে প্রতিনিয়ত শেয়ার করতে হয় ।
আমি এখনও মনে করতে পারি যে, আগের দিনে স্বামীর একাধিক বিবাহে স্ত্রী এত কঠোর ছিলো না এবং বর্তমান সময়ের মত এত জটিলও ছিলো না । বর্তমানে বিশেষ করে নতুনদের এটা বেশী সমস্যা হচ্ছে মেনে নিতে । মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মনে করে যে, স্ত্রীর নিশ্চয়ই কোন না দুর্বলতা আছে যে কারণে স্বামী আরেকটি বিয়ে করেছে । প্রথম স্ত্রী এটা দৃঢ়ভাবে ধরে নেয় যে নতুন মেয়েটি তার স্বামীকে বিবাহ না করলে তার এই কষ্টটা পেতে হত না ।
একজন সত্যিকারের মুসলমান হিসেবে আমরা জানি যে আমাদের জন্মের পূর্বেই আমাদের ভাগ্য লিখিত আছে - যদিও সব সময় আমরা এটা মনে রাখি না । আবার এটাও ঠিক যে মানুষ তার কর্মকান্ডের জন্য দায়ী এবং তাদের জীবনে যা ঘটে তার জন্য সে ভূমিকা রাখে । তবে সর্বাপেক্ষা আসল বিষয় হলো আমরা জানি সব কিছু আল্লাহর হুকুমেই হয় ।
নিম্নের দোয়ার অর্থ আমাদের জীবনের সঠিক উদ্দেশ্য বুঝতে সহায়তা করে ।
'আল্লাহ আমার জন্য যথেষ্ট এবং তিনি সত্যিকারের অভিভাবক । (বুখারী)
এটা এমন একটি চমৎকার দোয়া যে, কারণ আমরা জানি যা কিছুই ঘটুক না কেন আল্লাহ আমাদের দেখছেন এবং তিনিই আমাদের একমাত্র সাহায্যকারী ও প্রতিপালক । আমাদের শুধু ধৈর্য্য ধরতে হবে এবং উনার কাছে সব সময় সাহায্য চাইতে হবে । এই কাজটা অনেক কঠিন বিশেষ করে যখন আমরা বিদ্ধস্ত থাকি তখন আরো বেশী কঠিন ।
স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের প্রথম দিক সময়টাতে আমি এই অপমান সইতে না পেরে অনেকবার আমার স্বামীর কাছে ডিভোর্স চেয়েছি । এমনকি এখনও আমি মনে মনে ডিভোর্স চাই । এই ব্যাথা, কষ্ট এবং মানিয়ে চলা আমার কাছে বড়ই অসহনীয় মনে হচ্ছিল । আমি অবশ্য ইসলামের এই প্রজ্ঞাটা দেখতে পাচ্ছিলাম যে, কেন নারীদের হাতে ডিভোর্সের ক্ষমতাটা দেয়া হয় নি । কেননা, আমি আমার ভিতর থেকে বুঝতে পারছিলাম যে, আমি আসলে ডিভোর্স চাই না । আমি শুধুমাত্র আমার স্বামীকে বুঝাতে চেয়েছিলাম যে আমি কত কষ্ট পাচ্ছি এবং আমি এ কষ্ট থেকে মুক্তি চাচ্ছিলাম ।
যেসব মুসলিম বোনেরা এই রকম স্বামীর বহু-বিবাহের স্বীকার তাদের মনে রাখা উচিত যে তুলনামূলকভাবে আমাদের সৃস্টিকর্তা আল্লাহ তার সৃষ্টি সম্পর্কে বেশী জানেন সৃষ্টি তার নিজের সম্পর্কে যতটুকু জানে । তিনি জানেন তিনি কেন কোন বিষয়সমূহ করার অনুমতি দিয়েছেন এবং কোন কোন বিষয়সমূহ করতে নিষেধ করেছেন - যদিও আমরা অনেক কিছুই জানিনা এবং বুঝিনা । তিনি মেয়েদের আবেগের বিষয়ও অবগত - যেহেতু তিনিই তাদের সৃষ্টি করেছেন । তিনি ইচ্ছে করলে মেয়েদেরকে ভিন্নভাবেও সৃষ্টি করতে পারতেন । যদিও প্রথম স্ত্রীর পক্ষে স্বামীকে একাধিক বিবাহ করার অনুমতি দেওয়ার যৈাক্তিকতা খুজে পাওয়া অনেক সময় অসম্ভব মনে হয় । প্রথম স্ত্রীর উচিত আল্লাহর উপর যথাযথ আস্হা ও বিশ্বাস রাখা যে, তিনি সব দেখছেন এবং জানেন ।
এইরূপ পরিস্হিতিতে নিজেদের ব্যথা নিরাময়ের জন্য মহিলারা যা করতে পারে তা হলো নিজেকে গুটিয়ে নেয়া । আমি এরূপ করেছিলাম । এটা করতে হবেই আমি এমন বলছিনা কিন্তু এটা একটা উপায় হতে পারে । আমি আগে থেকেই অনেক লাজুক ছিলাম । এই পরিস্হিতিতে লোকজনের সামনে যাওয়া আমি আরো কমিয়ে দিলাম । ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে মেয়েদের ঘরে অবস্হান করা যদিও পূণ্যের কাজ - তবে সবাই এক রকম নয় । একেক জনের চিন্তা-ভাবনা এবং মানসিক অবস্হা সম্পূর্ন ভিন্ন । ধীরে ধীরে সমাজের সাথে আমার মেলামেশা কমে আসল ।
একদিন আমি ওয়েটিং রুমে ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করছিলাম । কেউ একজন আমার প্রতি কমেন্ট করল যে,' তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি তোমার স্বামীকে হারিয়েছ ।' আসলে আমার চেহারা দেখে অনেকেই আচ করছিলো যে আমার কিছু একটা হয়েছে । আসলেই তো তাই - আমি তো আমার স্বামীকে হারিয়েছি । শুধু তাই নয়- আরো অনেক কিছুই হারিয়েছি - সামাজিক মর্যাদা, স্বামীর একমাত্র স্নেহের দাবী, স্বাভাবিক জীবন ব্যবস্হা - এবং অনেকে ক্ষেত্রে স্বামীকে তো হারিয়েছি বটেই ।
আমার এই বিষন্নতা ও দুঃখের কারণে আমি প্রতিদিন - হ্যা প্রতিদিন কান্নাকাটি করতাম । আমি প্রতিদিন আমার রুমে বিছানায় এত বেশী সময় শুয়ে থাকতাম যে আমি আমার সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারিনি - যা তাদের পাওনা ছিলো । আমি বুঝতে পারছিলাম যে কিভাবে একটা যৈাথ পরিবারে দাদা-দাদী বা ফূফুরা সন্তানদের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে এবং কিছুটা হলেও মায়ের অভাব পূরণ করতে পারে - আল্লাহ ভালো জানেন।
চলবে....
সংগৃহীত এবং অনুদিত ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১১:৪৯