বিজয় দিবস নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আজ ন্যায্য কারণেই মিক্সড সেন্টিমেন্ট। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যে আজ বড় সুমধুর সম্পর্ক। তিস্তার জল ডিঙিয়েও একুশ শতকে শাহবাগ আমলের 'কে প্রথম কাছে এসেছি' মার্কা যেটুকু প্রেম হয়েছিল তা বহুদিনই দেহ রেখেছে, সে মরদেহ শহীদ অভিজিৎ রায়ের মতই ধুলোয় লুটোচ্ছে। রোহিত শর্মা আউট ছিল কিনা সেই নিয়ে যে তকরার শুরু হয়েছিল তার ঠেলায় আজ ফেসবুকে কাকচিল বসতে পায় না: কপ্টার দুর্ঘটনায় ভারতীয় সেনাপতির মৃত্যু হোক বা ব্রিজ ভেঙে কলকাতায় সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু, এ ধরনের খবরে যতগুলো "হাহা" পড়ে তার নব্বই শতাংশ আসে ওয়াগা নয়, পেট্রাপোল পেরিয়ে। বাংলাদেশের (সংখ্যাগুরু) নতুন প্রজন্ম ভারতের প্রতি কী মারাত্মক বিদ্বেষ পোষণ করেন এটা গত এক দশকে পশ্চিমবঙ্গে দিনের আলোর মত পষ্ট, কারণটিও অজ্ঞাত নয়। আমরাও যে নেহাত নিত্যানন্দ এমন বলছি না, কলসীর কানার পরিবর্তে সর্বদা প্রেম ফিরিয়ে দিতে পারিনি।
এহ বাহ্য। "ভারতকে ভালোবাসে কিনা" এই দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিচার করা অর্থহীন। এই ধরুন আমরাই কী পাকিস্তানকে খুব ভালোবাসি? আপনি বলবেন, পাকিস্তান আমাদের স্বাধীনতা পেতে সাহায্য করে নি, বরং ভারতের কয়েক হাজার সৈন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছে, ক্ষুৎপীড়িত দরিদ্র পশ্চিমবঙ্গ-ত্রিপুরা নিজেদের সামান্য সম্বল তুলে দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। তাই সই, কিন্তু সেই কারণে কী বাংলাদেশবাসীর আজীবন গলবস্ত্র হয়ে থাকতে হবে? কলকাতার প্রতি বাংলাদেশের এই যে ঘৃণা, তার পিছনে পনেরো আনা অন্য কারণ থাকলেও এক আনা পরিমাণ যে কলিকাতার বাবুদের প্যাট্রোনাইজিং আচরণ সেও তো সত্য। আপনি এইবার দাঁত খিঁচিয়ে বলবেন, তবে আজ শালারা পাকিস্তানকে এত ভালোবাসে কেন? খানসেনা আর আলবদর মিলে কী ত্রিশ লাখ খুন করেনি, দুই লাখ ধর্ষণ করে নি? বাপের খুনি, মায়ের ধর্ষকের প্রতি সন্তানের এত পীরিত ক্যানো? হায় হায়, সেটাই তো বাকি পনেরো আনা কারণ!
বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গীয় প্রগতিশীল এক লাইনে সেরে দেন, পাকিস্তান খুবই অত্যাচার করছিল তাই বঙ্গবন্ধু ঢাল তলোয়ার বাগিয়ে দেশ স্বাধীন করে ফেললেন। নটেগাছটি মুড়োল। তার পরের কাহিনী আর আমরা সেভাবে জেনে উঠতে পারি না।
রাজাকার আলবদরদের বৃহৎ অংশকেই ঢালাও ক্ষমা ঘোষণা করে মুজিব যা করেছিলেন তাকে বলা যায় ডাকিনীর হাতে স্বাধীনতার শিশুপুত্র সমর্পণ: পাকিস্তানের মৃতপ্রায় ভূতকে ওভাবেই সযত্নে জিইয়ে রাখা হল। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রমশ গালফের মৌলবাদী দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা, একাত্তরের গণহত্যার কারিগর ভুট্টো চুয়াত্তরে হাসিমুখে মুজিবের সাথে ঢাকায় বিরাজমান। ক্রমশ দুর্নীতি, আদি-আওয়ামি সন্ত্রাস, রাজনৈতিক খুন, দুর্ভিক্ষ, বাকশাল... ছিদ্র পেতেই নলের শরীরে যেভাবে কলি ঢুকেছিল, সেভাবেই পাকিস্তানের মামদোভূত এসে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর ঘাড়টি মটকালো, শেখ রাসেলও ছাড় পেল না। দেশটাকে ব্যাকগিয়ারে নিয়ে যেতে যাঁরা সামান্যও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারতেন, তাজউদ্দিন থেকে কর্নেল তাহের হয়ে খালেদ মশাররফ প্রায় সকলেই একে একে সাবাড় হয়ে গেলেন।
সবথেকে বড় লজ্জার কথা, সবথেকে নির্মম গ্লানির ইতিবৃত্ত: পাকিস্তান আমলে যে বাস্তুহারা সংখ্যালঘুর স্রোত পূর্বপাকিস্তান থেকে ভারতের দিকে বহমান ছিল, বিচ্ছিন্ন কিছু সময় বাদ দিলে তা স্বাধীনতার পরেও থামল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারকাত তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ১৯৬৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট এক কোটি তেরো লক্ষ সংখ্যালঘু স্রেফ 'হারিয়ে গেছেন'। রামু-নাসিরনগর-কুমিল্লার পরে যে সেই স্রোত থেমেছে, এরকম ভরসা হয় না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সে দেশের সিকিভাগ মানুষের স্বাধীনতা হয়ে উঠতে পারেনি কোনোদিন। যাদের হাত ধরে তা হতে পারত, তাদের আট আনা অংশকে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী যুদ্ধের শেষ সপ্তাহে তাঁর বাংলাভাষী জল্লাদ বাহিনী আলবদরদের লেলিয়ে রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে সাবাড় করে গেছেন, বাকি আট আনার অধিকাংশই জিয়া-এরশাদ-খালেদার আমলে দেশ ছেড়েছেন অথবা শহীদ ব্লগারদের মত বেমক্কা খুন হয়েছেন। পরম আফশোসের কথা, এঁরা থাকলে আজ বাংলাদেশ চৈনিক আগ্রাসনের যুগে উপমহাদেশে ভারতের প্রকৃত মিত্র হতে পারত, পশ্চিমবাংলার সাংস্কৃতিক দোসর হতে পারত।
বাংলাদেশে তথাকথিত প্রগতিশীল শক্তি ক্ষমতাসীন এক যুগের বেশি সময় ধরে। নব্য রাজাকাররা আজকাল তাদের হাত দিয়েই তামাক খায়, যেমন লিখেছিলেন হুমায়ুন আহমেদ গত দশকের একটি উপন্যাসে: "অনেক শিবিরের লোকজন আজকাল ছাত্রলীগে ঢুকেছে শুনতে পাই, নিয়মিত শেভ করছে।" সিলেবাস থেকে বিধর্মীদের লেখা বাদ পড়ে, বাউলের ঘর পোড়ানো হয়, হিংস্র ওয়াজের শব্দে ময়মনসিংহ গীতিকার দেশ গমগম করে। নাগরিক সমাজ বেশি ট্যাঁ ফো করলেই তাদের সামনে খুড়োর কল ঝুলিয়ে দেওয়া হয়: রক্ষণশীল সাম্প্রদায়িক স্বাধীনতাবিরোধীরা ক্ষমতায় চলে আসবে কিন্তু (পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কোনোকিছুর সাথে মিল পেলেও চেপে যাবেন, দোহাই)!
ক্ষমতায় না এসেও স্বাধীনতাবিরোধীদের যে বিশেষ সমস্যা হচ্ছে না সে আমরা কুমিল্লা গণহত্যার ঘটনাতেই দেখতে পেলাম। খোকা ঘুমিয়ে পাড়া জুড়িয়ে যেতেই আওয়ামি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক মুখ মুছে যে বিবৃতি দিয়েছেন তার সারমর্ম: "এসব নেহাত এক পাগলের কাণ্ড (লিটারালি এটাই বলা হয়েছে)। কোনো ধর্ষণ হয়নি, দুজন সংখ্যালঘু দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।" কিন্তু ওপারের সংখ্যালঘু বা নাগরিক সমাজের তবু আওয়ামি ছাড়া গতি নেই।
দেশের সিকিভাগ যে বিজয়ের ভাগ পূর্ণ মর্যাদায় পেল না, তাদের কী গতি হবে? একটা সহজ সমাধান আছে। সিকিভাগ ইতিমধ্যেই চার দশকে দশভাগের এক ভাগে এসে ঠেকেছে, তাবড় তাবড় স্কলাররা বই লিখে গণহত্যার ত্রিশ লাখকে পঞ্চাশ হাজারে নামিয়ে এনেছেন। আর চার দশক বাদে ওই দশভাগের একভাগ যারা আছে তারাও কমতে কমতে ভোঁ হয়ে যাবে, না হয়ে যাবে; তখন নতুন স্কলাররা নতুন বই লিখে প্রমাণ করে দেবেন পুব বাংলায় সংখ্যালঘু বলতে কেউ ছিলই না।
কিন্তু সেই সুদিনের সওগাত আসতে আরও কিছুটা দেরি আছে। আমরা জানি, আর পঞ্চাশ লাখ বাঙালীর মত ঋত্বিক ঘটককেও পুব বাংলা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ঋত্বিকের ভিতর থেকে ঢাকা-বরিশাল-খুলনার নদী মাটি আকাশকে তাড়ানো যায়নি। আজীবনের সিনেমায় ঋত্বিক সেই আখ্যান শুনিয়েছেন বার বার, একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থেও প্রাণপাত করেছেন। তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হল, তবু আগের আড়াই দশকে ঘরছাড়া লক্ষ লক্ষ ঋত্বিকদের আর ঠাঁই জুটল না, পরের চার দশকে আরও অনেককে ঘর ছাড়তে হল। আগামী চল্লিশ বছর তাই আমরা বিজয়দিবসের শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি মাঝেমধ্যে হয়ত বদ প্রশ্নটাও করে ফেলব, "সকলেই কী সত্যিই স্বাধীন?"
(আমার বন্ধুর লেখা। এটিই সম্ভবত এই ব্লগে আমার শেষ পোষ্ট।)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২১ সকাল ১১:৩৬