somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রম্য : পিকনিক ভার্সেস ফিস্টি

৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ১১:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কানায় কানায় ভর্তি, গেঁজে ওঠা ফেনিল খেজুর রসের গ্লাস গলায় ঢেলে গ্যাঁড়া বলে উঠলো, —‘শুন মাষ্টার, ফিস্টি আর পিকনিক কিন্তু এক নয়। এমনকি, ফিস্টির সাথে পিকনিকের দূরদূরান্তের কোন সম্পর্কই নেই। দুটোই আলাদা বিষয়, আলাদা প্রসিডিওর, আলাদা ভাবাবেগ, আলাদা চেতনা এবং সম্পূর্ণ আলাদা ঐতিহ্যের। তাই দয়া করে এদের এক করে দিস না। বরং আয়, দেখে নিই ফিস্টি আর পিকনিকের মধ্যে আসলে পার্থক্যটা ঠিক কোথায়।
ফিস্টি— প্রথমেই বলি, বিনা প্ল্যানে যেটা হয় সেটা ফিস্টি। সকালবেলা দুই বন্ধুর দেখা হল বাজারে, হুট করে বাইকে বসে বসেই ঠিক হল ‘চ বাড়া’। তারপর ফোনে ফোনে আর পাঁচ সাত দশ বিশজন মিলে শুরু হয়ে যাওয়ার নাম ফিস্টি।
পিকনিক— সবসময় প্ল্যান করে হয়। তিন চার মাস আগে থেকে ডেট এডজাস্ট করতে হয়। কার অফিস ছুটি থাকবে, কার স্কুল বন্ধ থাকবে, কার মামাশ্বশুর আসবে, কার ডাক্তার দেখানোর ডেট, কার ক্লায়েন্ট মিটিং। এই সবকিছু এডজাস্ট করে তবে পিকনিকের ডেট ঠিক হয়।
ফিস্টি—তে সবসময় নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে লোক বেশি হয়। মাঝরাস্তায় ‘‘কি বে, আমাকে বল্লিনি বাড়া?’’ বলে কেউ বাইকের পিছনে উঠে বসলে তাকে নামানোর নিয়ম নেই।
পিকনিক—তে অবশ্যই লোকসংখ্যা কমবে। সেই নির্দিষ্ট দিনে নিশ্চই কারও মামার শালীর বিয়ে পড়বে, অথবা অফিসের চাপ, বা বৌয়ের শরীরখারাপ, গাড়ি সার্ভিসিং, ছেলের স্কুলের এনুয়াল প্রোগ্রামের প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন সেরিমনি।
ফিস্টি—র কোন নির্ধারিত জায়গা থাকে না। হতে পারে ঘরের পাশের জঙ্গল, কারও কনস্ট্রাকশন সাইট, বাসস্ট্যান্ডের পিছনের ফাঁকা জায়গা, পাথর খাদানের সাইড, ক্লাবের ছাদ, দূর্গামণ্ডপ এমনকি বৌ বাপের বাড়ি গেলে সেই ঘরেও ফিস্টি করা যায়।
পিকনিক—এর জন্য অবশ্যই নির্দিষ্ট জায়গা থাকে। কোন পপুলার পার্ক, ট্রাভেল সাইট, দর্শনীয় স্থান, দামী রেস্তোঁরা, নিদেন পক্ষে হোটেল বুক করে পিকনিক করতে হয়।
ফিস্টি—র নির্দিষ্ট টাইম থাকে না। দুপুর বারোটায় শুরু হয়ে তিনটের মধ্যেও শেষ হতে পারে, আবার রাত্রি আটটায় শুরু হয়ে পরের দিন দুপুর পর্যন্তও চলতে পারে। মোটামুটি ঘরে ঢোকার আগে যেন মুখে গন্ধ না থাকে।
পিকনিক— নির্দিষ্ট টাইম মেনে হয়। পিকনিকের টাইম ঠিক হয় ট্রেনের টাইম ধরে, বাসের টাইম ধরে, ড্রাইভারের টাইম ধরে। পিকনিকে যাওয়ার টাইম নির্দিষ্ট, ফেরার টাইমও নির্দিষ্ট।
ফিস্টি—তে কোন ডেকোরাম মেইনটেন হয় না। ডি’লেভেলের কর্মচারিও এ’ লেভেলকে নিঃসংকোচে চুদীরভাই বলতে পারে।
পিকনিক—ডেকোরাম মেনে হয়। সবাই ভদ্রকথা বলে, স্ট্যাটাস অনুযায়ী দুরত্ব বজায় রাখে একে অপরের সাথে।
ফিস্টি—র কোন ড্রেসকোড থাকে না। দলে সাতজনের বারমুন্ডা, তিনজনের থ্রিকোয়ার্টার, প্রায় সবারই টিশার্ট যেগুলো অকুস্থলে গিয়ে আর গায়ে থাকেনা। পাঁচজনের জিনস্, চারজনের গামছা, বগলকাটা গেঞ্জি। গায়ে ঘাম আর আদা রসুন তেজপাতার গন্ধ।
পিকনিক—এ গায়ে জ্যাকেট থাকে, পায়ে দামি শ্যু থাকে, গায়ে দামি পারফিউমের সুবাস, পিঠখোলা বগলকাটা ব্লাউজ, দামি হাফপ্যান্ট, খোলা চুল অথবা ডিজাইন করে বাঁধা, চোখে জানলার কাঁচের সাইজের চশমা। হাতে প্রজাপতির মত ঝলমলে বাচ্চা, মুখে কথা কম...ট্যুইঙ্কল ট্যুইঙ্কল বেশি।
পিকনিক—এর মাঝে সবাই সাইটসিনে যায়।
ফিস্টি—র মাঝে নুন ফুরিয়ে গেলে পাশের কারো ঘরে ঠোঙা নিয়ে হাজির হয়, তেল ফুরিয়ে গেলে পনের টাকা নিয়ে দোকানে।
পিকনিক—এ কালচারাল প্রোগ্রাম হয়। বাচ্চারা নাচ, গান, রাইমস্ করে। আঙ্কল আন্টিরা হাততালি দেয়। আবার আন্টিরা রবিঠাকুর করে, আঙ্কল আর বাচ্চারা হাততালি দেয়। এটাই নিয়ম।
ফিস্টি—তে একটাই প্রোগ্রাম। শুওরের বাচ্চা...বাঁড়া..আমার পাতে মুরগির পুটকি টা কে দিলি বে? আমার পাতে খাসির বিচি এল কোত্থেকে?
পিকনিক—এ রান্নার ঝামেলা থাকে না। ক্যাটারার টিম থাকে, অথবা রান্নার লোক যায়। আমসত্ত্ব খেজুর নারকেল পেঁপে কিসমিস বেদানা আপেল কাজু কিসমিস দিয়ে ফ্রুট চাটনি হয়।
ফিস্টি—তে সবাই রাঁধুনি, সবাই। চাটনিতে বাঁধাকপির পাতা, ফুলকপির গোড়া, আড়াইশো কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, গরম মশলা এমনকি হেডফোনের স্পিকারও থাকতে পারে।
পিকনিক—এ সকালে টিফিন থাকে, স্ন্যাক্স থাকে, কফি মেশিন থাকে। চিকেন মটনের আলাদা বাটি থাকে, ডেজার্ট থাকে, মকটেল থাকে, ককটেল থাকে।
ফিস্টি—তে মটনের গায়ে খাসির কালো লোম থাকে, চিকেনের গায়ে মুরগির সাদা পালক থাকে, ডালের বালতিতে বিড়ির টুকরো থাকে।
পিকনিক—এ জি’পে থাকে, পেটিএম থাকে, ফোন’পে থাকে, নেট ব্যাঙ্কিং থাকে।
ফিস্টি—তে পিছনের পকেট থাকে, সামনের পকেট থাকে, জিনসের চোরা পকেট থাকে। বাপের পকেট থাকেই থাকে।
পিকনিক—এ দুটো সান্টাক্লজ ক্লাউন থাকে। দাড়ি মুখোশ আর লালটুকটুকে টুপি, ঢোলা পোশাক।
ফিস্টি—র মাঝপথে অন্তত তিনজনের ওপর ডাইরেক্ট সান্টা ভর করে। কোমরে গামছা, লালটুকটুকে জাঙ্গিয়া মাথার ওপর।
পিকনিক—এ ডিএসএলআর থাকে, আইফোন থাকে। সেলফি থাকে, গ্রুপফি থাকে। নাচের ভিডিও, গানের ছবি, নেভা ওভেনে খালি কড়ায় খুন্তি হাতে পোজ থাকে। মিঃ সামন্তের ফিশ ফ্রাইয়ের ডিশ হাতে ছবি থাকে, মিসেস চ্যাটার্জির স্টিলের বালতি হাতে দই পরিবেশনের ছবি থাকে।
ফিস্টি—তে ‘এই বাড়া ফোন টোন সব ত্রিপলে তলায় রাখ, ফিস্টি করতে করতে যে ফোন বের করবি, আর এই সব ছবি ফবি যে তুলবি শুনে রাখ, একটা ছবিও যদি বাইরে যায়...দুম করে পোঁদ মেরে দেব বাঁড়া।
পিকনিক—এ অরিজিৎ এর গলায় ‘দে দোল দোল দোল, তোল পাল তোল’ চলে।
ফিস্টি—তে ‘দো ঘুট মুঝে ভি পিলা দে শরাবি,
আমার প্রেমিকা কে, পহিলা ছিটায় ভিজাইন দে’, বারো মিনিটে চারবার।
পিকনিক— শেষে উদ্বৃত্ত খাবার অকুস্থলে ঘুরে বেড়ানো আদুল গায়ের বাচ্চারা পায়, ‘এই শোন, থালাবাসনগুলো ধুয়ে দে, তারপর খাবারগুলো নিয়ে যা’, অথবা নষ্ট হয় ডাস্টবিনে।
ফিস্টি—তে খাবার বাড়তি হয় না, বরং কম পড়ে। তিনবার ঝগড়ার পর ফয়সলা হয়, ‘পরেরবার থেকে কলা মাংস কম আনবি, চাল বেশি করে লিবি। ’
পিকনিক—থেকে ফেরার পথে।
‘মিঃ ঘোষের বউয়ের দিকে অমন হাঁ করে তাকিয়েছিলে কেন? মনে হচ্ছিল যেন গিলে খাবে! কেন, আমায় আর পোষাচ্ছে না?/ মিসেস পালকে দেখছিলে, ঐ শাড়িটা আমরা সেবার আমাদের কাজের মেয়ের বিয়েতে দিয়েছিলাম। / মিঃ চৌধুরী মেয়েকে নিয়ে যে এত বড়াই করছে, গুণধর কন্যা কটা ছেলের সাথে দীঘা গেছে সেটা জানে? আজ যদি হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিতাম!/ মিসেস মন্ডল যেন বাড়িতে ডিপ ফ্রিজে থাকে, এই ডিসেম্বরের রোদেও গায়ে ফোস্কা পড়ছে। /সরলা বৌদিকে দেখেছিলে, বয়স কি কমছে না কি বলতো? অমন ভাবে কাপড় পরার থেকে না পরেই আসতে পারতি, এতই যদি দেখানোর সখ পুরোটা খুলে দেখা না। / এই অমলের ছেলেটা কোন মাষ্টারের কাছে পড়ে দেখো তো, দরকার হলে দুশো টাকা বেশি দেবে তাকে নিয়ে এসো তো!/ বাব্বা, রঞ্জনার ছেলেটা কি খায় গো!! ঐটুকু ছেলে যা খায়, আমাদের ড্রাইভারটাও এত খেতে পারে না। / পিন্টুর জ্যাকেটটা দেখেছিলে, ওটা ওর কোম্পানীর, স্টিকার কেটে ফেলে দিয়েছে। / এবার বুঝলে তো তাপস বছরে দুবার প্রমোশন পায় কেন! আরে, ওর বৌকে দেখছিলে না, বসের সাথে কিভাবে ঢলে ঢলে কথা বলছিল?
ফিস্টি— থেকে ফেরার পথে।
‘ধ্যের বাঁড়া.. বিকাল হতে হতে সব কেটে গেল। বার বার বলেছিনুম বাঁড়া অত দামি আনিসনি। এই....রাত্রে বেলা আবার ফিস্টি লাগা ব্বাঁড়া আমি একটা সাড়ে সাতশ দিচ্চি, বাকিটা তোরা ম্যানেজ কর। সে’বেলার বাঁধাকপিটা দিয়েই মেরে দুব।

(আমার এক বন্ধু রামকৃষ্ণ দার সৌজন্যে অনুপ্রানিত হয়ে লেখা।)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ১১:৪১
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাকান্ড ও সরকারের পরবর্তি করণীয়!

লিখেছেন আহলান, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫১

হাদির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সে দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ইনসাফের জীবন এনে দিতে সংগ্রাম করেছে। তাকে বাঁচতে দিলো না খুনিরা। অনেক দিন ধরেই তাকে ফোনে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে এসেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×