somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

I Quit !

০৮ ই নভেম্বর, ২০২৩ রাত ১১:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সে অনেক দিন আগেকার কথা। তখন'ও আমার খুব চেনা পরিচিত নদীর বুকে অনেক জল। তখনও সে পূর্ণযৌবনা। অবশ্য নদীর বয়স নিয়ে আমার বরাবরের একটা ধন্দ । যে নদীকে যুবতী লাগে, সে তো অনেক বছরের পুরনো, তবুও তাকে কেন নবীনা মনে হয়? অনেক পরে উপলব্ধি করেছি, আমরা সকলেই একটা নদীকে সঙ্গে নিয়ে জন্মাই। সে আমাদের সাথেই বেড়ে ওঠে, আমাদের সাথেই বুড়ো হয়। পারিপার্শ্বিক একই থাকে, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিই স্রেফ পালটে যায়।
আচ্ছা, কখনও কোন লেখক লিখতে লিখতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন ? মানে লেখা অসমাপ্ত রেখে চিরতরে নিস্তেজ হয়ে যাওয়া আর লিখতে লিখতেই টেবিলে মাথা রেখে চিরতরে ঘুমের দেশে চলে যাওয়ার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। হয়ত লেখক একটা অসাধারণ বর্ণনা লিখছেন, একটা বাক্য সমাপ্ত করতে যাবেন কিন্তু সেটা আর শেষ করা হল না । সেই অসমাপ্ত বাক্য অন্য কেউ টেনে নিয়ে যেতেই পারেন, কিন্তু সেটাই যে মৃত লেখকের আসল অভিব্যক্তি তার নিশ্চয়তা কোথায়?
আমাদের জীবনটাও একটা অসমাপ্ত বাক্যের মত, শেষ হয় অনেক না বলা কথা বুকের মধ্যে নিয়ে। সেই না বলা কথার সাক্ষী থাকে শুধু ওই নদীটা। বুকের মধ্যে জন্ম নেয়, আমাদেরই সাথে বড় হয়, যুবতী হয়, বুড়ো হয় আবার পথ পালটে অন্যের বুকে জন্ম নেয়। সেই নদীকে নিয়েই যদি লিখতে বসি, তাকে ঠিক আত্মজীবনী বলা চলে না। আত্মোপলব্ধি বলা যেতে পারে।
আচ্ছা, দেবযানীর'ও তো সেই নদী ছিল নিশ্চয়। বেঁটেখাটো, গোলগাল, ছটফটে মেয়েটি নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সময় একবার'ও নিজের কথা ভাবল না? অবশ্য নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সময় আর কেই বা নিজের কথা ভাবে? স্বপ্নভঙ্গের বেদনা যে বড়ই করুণ হয় ।
ছটফটে মেয়েটা আমাদের সাথে টিউশনে পড়ত। স্যারের অনুপস্থিতিতে অন্য ছাত্রছাত্রীরা যখন পড়াশুনো বাদে অন্য সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম, দেবযানীর উৎসাহের বিষয় ছিল স্রেফ অন্যদের খাতার নোটস।
আমরা বলতাম নোটস লোভী। কে কোন নোটসটা ঠিকঠাক নিচ্ছে, ঠিক খেয়াল থাকত তার। এমনিতে মেয়েদের নোটসের খাতা দেওয়া নিয়ে ছেলেদের একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা থাকত। আমাদের সাথেই পড়ত সুগতা। জয়দীপ না প্রশান্ত, কার কাছে সুগতা খাতা চাইবে, এই নিয়ে আমার এবং সুদীপ্ত'র মধ্যে হামেশাই আড়ালে বাজি ধরা চলত। কিন্তু দেবযানীকে খাতা দেওয়া নিয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র উৎসাহ ছিল না কারণ আমরা নিশ্চিন্ত ছিলাম যে ফেরতা নোটস খাতায় কোন হাতচিঠি বা গোলাপ ফুলের পাপড়ি থাকবে না । বরং খাতা থেকে দু একটা পাতা হাপিস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
খাতা থেকে পাতা হাপিস করার কথায় নির্মাণ কুমারের কথা মনে পড়ে গেল। নির্মাণ আমার স্কুলের ব্যাচমেট। এক কথায় জিনিয়াস। ক্লাস সেভেন থেকে ক্যালকুলাস ধরেছিল, ম্যাথস অলিম্পিয়াডে সুযোগ পেয়েছিল এবং আই আই টি-র প্রবেশিকা পরীক্ষাতে চতুর্থ স্থান অধিকার করেছিল। সেই নির্মাণ হঠাৎ ক্লাস এইটে দুদিনের জন্য সাস্পেন্ডেড হয়েছিল? কারণটা জানা গেল পরে। ছুটির পর লাইব্রেরিতে বসে একটা বই থেকে অঙ্ক কষছিল, সেই সময় স্কুল বাসের তাড়া থাকায় আধকষা অঙ্কের পাতাটাই বই থেকে ছিঁড়তে গিয়ে ধরা পড়ে সে । ফলস্বরূপ সাসপেনশন।
নির্মাণের অবশ্য এ কারণে কোন আফশোস ছিল না, জিনিয়াসরা একটু খ্যাপাটেই হয়। তবে দেবযানীকে ঠিক জিনিয়াসের পর্যায়ে ফেলা যায় না। একবগগা, একরোখা একটি মেয়ে। যার জীবনের একটাই স্বপ্ন ছিল জয়েন্টে চান্স পাওয়া। আজকের দিনে অবশ্য এটাকে বিরাট কিছু স্বপ্ন বলা চলে না, কিন্তু সেই সময় যখন সারা রাজ্যে মেরেকেটে ২৫০০ আসন থাকত, সেই সময় এটা স্বপ্নই ছিল বটে। আর এই স্বপ্নের পেছনে আমরা সবাই দৌড়তাম।
দেবযানীও দৌড়ত। আমাদের চেয়ে এক বছরের বড়ই ছিল। আমরা প্রথমবার জয়েন্টে অকৃতকার্য হয়ে দুর্গাপুর গভর্মেন্ট কলেজে ফিজিক্স অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম, কিন্তু ওইটুকুই। কলেজের খাতায় নামটা লেখা থাকত, কিন্তু তলে তলে জয়েন্টের প্রস্তুতি। দেবযানী আমাদের ব্যাচে দুবার অকৃতকার্য হয়ে নাম লিখিয়েছিল। এবং তৃতীয়বার'ও চান্স পেল না ।
আমাদের ফিজিক্স অনার্স ব্যাচের প্রায় পুরোটাই ফাঁকা হয়ে গেল। সুগতা আর জয়দীপ ডাক্তারিতে চান্স পেল। তীর্থ, সুদীপ্ত, আমি আর প্রশান্ত ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ঢুকলাম। সন্দীপ সেবারে ব্যর্থ হলেও পরের বার ডাক্তারি পড়তে ঢুকল। কিন্তু দেবযানী অকৃতকার্য্যই রয়ে গেল। ফাইনাল ইয়ারে পড়ার সময় খবর পেলাম মেয়েটি সুইসাইড করেছে। কারণটা সহজেই অনুমেয়।
আজ বেশ কিছুদিন ধরে দেবযানীর ভুত আমার ঘাড়ে চেপে বসেছে। শেষ দেখা হয়েছিল কলেজ থেকে টি সি নিয়ে বেরিয়ে আসার দিন। হাত ধরে বলেছিল, " তোদের সবাইকে গুড লাক। কিন্তু আমি বড় একা হয়ে গেলাম রে। " আমাদের সবারই তখন নতুন জীবনে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাড়া। ফলে তাকে সামান্য শুকনো উৎসাহপ্রদান ছাড়া কিই বা সম্ভব ছিল?
আর কিই বা করতে পারতাম আমরা? আমাদের সবার লড়াই আমাদের নিজেদেরই লড়তে হয়, কিন্তু আমরাও কি ব্যর্থ হই নি? হয়ত জয়েন্ট নামক সেই স্বপ্নের শৃঙ্গটি পার হলেও কে আর কতটা সফল হয়েছি? কেউ ভাল মানুষ হতে পারিনি, কেউ ভাল বাবা কিংবা মা, কেউ পেশাদারী জীবনে অনন্ত স্থবিরতার শিকার হয়েছি। কেউ কেউ হয়ত এর কোনটাই হতে পারি নি। কিন্তু কেউ কি পালিয়েছি? দেবযানীর হতাশা ছিল তার ব্যর্থতায়। কিন্তু টাপুনের অপ্রাপ্তি কোথায় ছিল? সোনার চামচ মুখে দিয়ে জম্মানো টাপুনের তো সে অর্থে কোন অভাবই থাকার কথা নয়? তবুও সে.......
অনেকবার চোখ বুজে এক আত্মহত্যাকারীর মানসিক অবস্থার কথা ভাবার চেষ্টা করেছি। সামনে জীবন নামক এক ক্যানভাসে সুখ-দু:খ-হাসি-কান্না-সাফল্য-ব্যর্থতা-অপমান-গঞ্জনা নামক অজস্র রংবেরঙের আঁচড়, সেই রঙ আস্তে আস্তে ধূসর হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এরকম ক্যানভাসের সামনে আমরাও তো প্রতিনিয়ত দাঁড়াই। আর দাঁড়িয়েও সেই ধূসর রঙটাকে ভালবেসে ফেলি।
আসল কথাটা হল সেই ক্যানভাসে এক লহমায় কালির পোঁচ লেপে দেওয়ার মধ্যে এক রোমান্টিসিজম আছে। হে লাইফ, আই গিভ ইউ এ ফাক, এই কথাটা চিৎকার করে বলার মধ্যে এক স্পর্ধা কাজ করে। সেই স্পর্ধাটা দেবযানীর ছিল, টাপুনের ছিল। আমরা তো বহুবার মনের অদৃশ্য দেওয়ালে " I Quit " লিখে কেটে দিয়েছি জীবনের ব্যপকতার সামনে নতজানু হয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৩ রাত ১১:৫৩
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মাদ্রাসা শিক্ষা, বৈশ্বিক রাজনীতি, সহিংসতা ও জঙ্গিবাদ

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪৫


লেখাটির শুরুতে একটি ভূমিকা দেওয়া যাক। সর্বশেষ দেশে গিয়ে কয়েকদিন গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। উত্তরবঙ্গে, নিতান্ত অনুন্নত আমাদের সেই গ্রামে এতগুলো কওমি মাদ্রাসা হয়েছে দেখে অবাক হয়েছিলাম। আগে গ্রামে... ...বাকিটুকু পড়ুন

চোখের জল

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৪৬


সুদীর্ঘ ১৭ বছরের জমে থাকা
বিনম্র চোখের এক কোণে জল!
প্রকাশে এলো এই জনসমুদ্রে-
জনসমুদ্র তুলছে আনন্দাশ্রুর
ঢেউ- দেখছে নতুন ফুলের গন্ধ;
এ নৈঃশব্দের আর্তনাদ বুঝতে
হবে শুধু তোমাকে- আমাকে
গড়ে তুলতে হবে মনুষ্যের প্রণয়ে
সূর্য ভোর- যেখানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকার মানুষের জীবন

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪


ঢাকাতে মানুষ বড় বিচিত্র ভাবে বেঁচে থাকে। নিয়মিত ঢাকার রাস্তার ঘুরে বেড়ানোর কারণে এই রকম অনেক কিছু আমার চোখে পড়ে। সেগুলো দেখে মনে হয় মানুষ কত ভাবেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

পৃথিবীর কিছু অঞ্চলে প্রায় সারা বছর বৃষ্টিপাতের কারণ কী?

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯

পৃথিবীর কিছু অঞ্চলে প্রায় সারা বছর বৃষ্টিপাতের কারণ কী?



পৃথিবীর কিছু অঞ্চলে প্রায় সারা বছরই বৃষ্টিপাত হয়। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকার কিছু দেশ এবং দক্ষিন আমেরিকার কিছু দেশ ও অঞ্চলে বছরের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশ কখনো এমন করে বলতে পেরেছে কি?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


ভারতে গরু ও গোমাংস নিয়ে হত্যা বা সহিংসতার নির্দিষ্ট সংখ্যা বলা কঠিন কারণ এটি রাজ্য, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং 'গরু রক্ষা' বাহিনী ইত্যাদীর কারণে একেক যায়গাতে একেক রকম। ভারত গোমাংস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×