
শুধু কি আর নাম্বার যোগ করতাম? চিত্তাকর্ষক কিছু দেখলে সেটা পড়েও ফেলতাম অবশ্যই। এই খাতা-দেখা থেকে হাতের লেখা পড়ে মর্ম বোঝার অধ্যয়ন হয়ে যেত আমার। তাই পরের দিকে ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন – যদিও সেটা ইংরাজিতে আর খাতাগুলো বাংলায় – বুঝতে অসুবিধা হ’ত না। স্যারদের ক্লাশে পড়ানো থেকে যা শিখেছি, সাহিত্য ও ভাষা তার চেয়ে অনেক বেশি শিখেছি এই খাতা-দেখা থেকে।
সে আপনার চল্লিশ বছরেরও আগের কথা। তার কথা হুবহু নামিয়ে দেব, আমি তো স্বামী বিবেকানন্দর মতো তেমন স্মৃতিধর নই। তবে যেটুকু মনে আছে, একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি।
আমাদের সময় অশোকবিজয় রাহার ‘মায়াতরু’ নামে একটা কবিতা ছিল। সেই যে – এক যে ছিল গাছ, সন্ধে হলেই দু-হাত তুলে জুড়ত ভূতের নাচ – সেই কবিতাটা। তার দুটো লাইন ছিল এই রকম -
কোথায়-বা সেই ভালুক গেল, কোথায়-বা সেই গাছ,
মুকুট হয়ে ঝাঁক বেঁধেছে লক্ষ হীরার মাছ।
এই লাইন দুটো তুলে পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছিল, এখানে কবি ‘লক্ষ হীরার মাছ’ বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন?
তো একজন বেশ ফেনিয়ে লিখেছে এর উত্তর। দু-পাতা জোড়া শুধু এরই উত্তর। স্যার তাতে শূন্য দিয়েছেন দেখে বুঝলাম উত্তরটা স্যারের পছন্দ হয়নি। এমনিতে স্যারের কাছে যেটুকু শুনেছিলাম, বাংলা পরীক্ষা বেশ উদারধর্মী। বানান ভুলে সামান্য নম্বর কাটা যায় বটে, তবে হেড-এগজামিনারদের নির্দেশ ছিল, মোটামুটি কেউ যদি প্রশ্ন বুঝতে পারে, তবে তাকে একেবারে নিরাশ না করা। মানে যাই লিখুক, আধ নম্বর দেওয়া যায় আর-কি। স্যার এখানে এতখানি লেখার জন্য আধও দেননি দেখে আমার প্রবল কৌতূহল হ’ল, কী লিখেছে দেখি।
হাতের লেখা যে কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং, তাও না। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। দেখে মনে হ’ল মেয়েদের। কিন্তু এ ব্যাপারে বাজি ধরতে গেলে আমাকে অনেকে পুরুষতান্ত্রিক শূকর বলে গালাগালি দিতে পারে ভেবে সেই ঝুঁকি নিচ্ছি না। উত্তরটা পড়ে আমি বেশ মজাই পেলাম, এ জন্যই হয়ত আজও ভাসা ভাসা মনে আছে। বানানগুলোও।
উত্তরদাতা – দাত্রীও হ’তে পারে – শুরুতেই অফেন্সিভ খেলেছে। লিখেছে, কবিদের মনে নানা সময় নানারকম ভাব আসে। তারা সেই অনুজায়ি কবিতা লেখে। আমাদের সার বলেছেন কবিতায় শব্দের মানে বোঝা অনেক কঠিন। তা অনেক রকম হোতে পারে। এখানে উনি কি বোঝাতে চেয়েছেন, সেটা উনিই জানেন। আমি শিসু, এটা তো আমার জানার কথা না।
তবে আগের লাইনে গাছ আছে বলে কবিতায় মিল দিতে উনি মাছ শব্দটা বেবহার করেছেন। গাছের সঙ্গে মাছ মেলে বলে। এর ফলে কবিতাটা সুন্দর হোয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে উনি একে লক্ষ হীরার মাছ কেন বলেছেন। এটা একটা অত্তন্তো জটিল প্রশ্ন। মনের ভাব অনুজায়ি কবিতা লেখা হয়। কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি কবিতায় কবি যেমন কুমোর পাড়া শব্দটা বেবহার করেছেন, কিন্তু আমরা জানি কুমোর পাড়া ছারাও কামার পাড়া হয়, জেলে পাড়া হয়, চাসাপাড়া হয়, অনেক রকম হয়। কিন্তু তা শত্তেও তিনি কুমোর পাড়া লিখেছিলেন, কেননা তিনি কুমোরদের দুক্ষ কষ্ট খুব ভালো বুজতেন। কুমোরদের কস্টে তার পরানটা ফেটে যেত। সেই কারনে তিনি কামার পাড়া জেলে পাড়া না লিখে কুমোর পাড়া লিখেছিলেন। এখানেও তেমন এই কবি লক্ষ হীরার মাছ শব্দটি লিখেছেন। আমাদের গ্রামে আমরা রুই মাছ, কাতলা মাছ, ইলিস মাছ, বোয়াল মাছ এইসব খাই। এখানে পুকুরে বা বাজারে আমরা লক্ষ হীরার মাছ দেখতে পাই না। হয়ত কবি শহরের মানুষ, সেখানে লক্ষ হীরার মাছ পাওয়া যায়। এমনিতেই নাম দেখে মনে হচ্ছে মাছটা খুব সুন্দর। আমি জোদিও দেখিনি, তাও লক্ষ হীরার মাছের দুটি চোখ, একটি কাঁটা, দুটি কানকো, দুটি পিঠ অ্যাবং একটি লেজ আছে। এই মাছটি খুবই সুন্দর দেখতে অ্যাবং খুবই সুস্যাদু। এই মাছ ভাজা অ্যাবং ঝোল উভয়ই খাওয়া যায়। এই সব কারনে কবির মুড ভালো থাকায় উনি একে এই সুন্দর কবিতাটায় লক্ষ হীরার মাছ বলেছেন বলে আমার মনে হয়। এর আরও অনেক কারন হোতে পারে।
স্যার পাশে খাতা দেখছিলেন। আমি খুব দুঃখ পাওয়ার ভঙ্গিতে স্যারকে বললাম, স্যার, এতখানি গুছিয়ে লিখেছে, এত সুন্দর বর্ণনা, এতে একেবারে শূন্য দিলেন?
স্যার বললেন, যোগ ঠিক করেছি কিনা চেক করেছিস?
আমি বললাম, স্যার, শূন্য যার সঙ্গেই যোগ করা হোক, তা তো বাড়েও না, কমেও না।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০২৩ রাত ১২:২৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




