মানুষের একটি সহজাত প্রবণতা হলো সবার সামনে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরা। আর শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হিসেবে সে বেছে নেয় শক্তি আর ক্ষমতার বাহুল্য প্রয়োগ। যুগের পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে মানুষের চিন্তাশক্তিতে, কাজে-কর্মেও। তাই শক্তি আর ক্ষমতা প্রদর্শনের উপায়েও পরিবর্তন এসেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সতি, কল্যাণের পতাকাবাহী বিজ্ঞান; এ ক্ষেত্রে সেসব শক্তিমান মানুষের প্রধান হাতিয়ার। তাদের হাতে নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব হয়েছে। তা হলো বায়োলজিক্যাল উইপন বা জীবাণু অস্ত্র। বিশেষজ্ঞরা জীবাণু অস্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমে সংঘটিত যুদ্ধকে অভিহিত করেছেন বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বা জীবাণু যুদ্ধ নামে
ইতিহাস কথা বলে
যুদ্ধে জীবাণুর ব্যবহার পুরাতন কিছু নয়। জীবাণু যুদ্ধের প্রথম ব্যবহার লক্ষ করা যায় ১৩৪৬ সালে। তৎকালীন তাতার বাহিনী প্লেগ রোগে মৃত সৈন্যদের কাফা শহরের মধ্যে ফেলে দিয়ে সব প্রবেশপথ বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছিল। ১৭৬৭ সালে সংঘটিত ফরাসি ও ভারতীয়দের মধ্যকার যুদ্ধে ফরাসি সৈন্যরা গুটি বসন্তের জীবাণুতে ভরা কম্বল তৎকালীন স্থানীয়দের মাঝে বিতরণ করেছিল। যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ জনগণের মাঝে গুটি বসন্ত ছড়িয়ে দেয়া। ১৯০০ সালে এসে যখন মাইক্রোবায়োলজি বা অণুজীবভিত্তিক সংক্রামক রোগের উদ্ভব হলো, তখন থেকেই আধুনিক জীবাণু অস্ত্রের ধারণার শুরু। ১৯২৫ সালের জেনেভা প্রটোকলে জীবাণু অস্ত্র গবেষণা ও ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও উন্নত দেশগুলোতে এর ব্যবহার থেমে থাকেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চীনের ওপর জাপানের জীবাণু অস্ত্র ব্যবহার, বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ব্রিটেন, রাশিয়া এবং আমেরিকার গবেষণা ও উন্নয়ন প্রভৃতি প্রমাণ করে মারণাস্ত্র হিসেবে জীবাণু অস্ত্রের জনপ্রিয়তা কেমন। তবে আশার কথা হচ্ছে, ১৯৬৯ সালের ২৫ নভেম্বর এক বিবৃতিতে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তার দেশে জীবাণু অস্ত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে ঘোষণা দেন [ব্রিটেনও ১৯৬০ সালে একই ঘোষণা দেয়]। প্রথমদিকে রাশিয়া গড়িমসি করলেও ১৯৯২ সালে এসে তারাও জীবাণু অস্ত্রের গবেষণা ও ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞার দাবি মেনে নেয়।
বায়োলজিক্যাল উইপন ও বায়োলজিক্যাল এজেন্ট
সাধারণ অর্থে বায়োলজিক্যাল উইপন হলো জীবাণু যুদ্ধে ব্যবহৃত জীবাণু অস্ত্র। ন্যাটো হ্যান্ডবুকে বায়োলজিক্যাল উইপন সম্পর্কে বলা আছে, ‘জীবাণু অস্ত্র হলো একটি বিশেষ ধরনের অণুজীব বা আর্থ্রোপোডা শ্রেণীভুক্ত পোকা যা জীবাণুর অনুঘটককে প্রকল্পিত ও ছত্রভঙ্গ করে থাকে এবং তাদের তত্ত্ব প্রচার করে।’ যুদ্ধ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের জীবাণু অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। জীবাণুগুলো বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টি করে।
জীবাণু যুদ্ধের ভয়াবহতা
একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে গোটা বিশ্ব যখন শান্তির সুবাতাস পেতে শুরু করছে, তখন মৃত্যুদূতের কালো থাবার মতো বিস্তার লাভ করছে এই জীবাণু যুদ্ধের ধারণা। গত ২৫ বছরে নাগরিক সভ্যতা এবং সামরিক বাহিনীর যে বিশাল পরিবর্তন এসেছে, তার মূলে রয়েছে এই বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার। জীবাণু অস্ত্রের উন্নততর গবেষণা ও ব্যবহার ক্রমেই অস্থিতিশীল করে তুলছে গোটা বিশ্বকে। যার প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। জীবাণু যুদ্ধে ব্যবহৃত এজেন্টগুলোকে উন্নততর প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বাভাবিক কার্যক্ষমতার থেকে একশ’ গুণ বেশি কর্মক্ষম করে তোলা হচ্ছে। পরিচিত জীবাণু অস্ত্রগুলোকে জেনেটিক্যালি বদলে ফেলে তাদের আরো ভয়ঙ্কর রূপ দেয়া হচ্ছে। এভাবে বিশ্ব পরিস্থিতি ক্রমেই চরম পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
জীবাণু যুদ্ধের প্রভাব
জীবাণু যুদ্ধের ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে বর্তমান প্রজন্মের ওপর। আবার অতীতেও এ রকম ঘটনার উদাহরণ কম নয়। ১৩৪৭ থেকে ১৩৫১ এই পাঁচ বছরে প্লেগে সারা পৃথিবীতে মানুষ মারা গিয়েছিল প্রায় ৭৫ মিলিয়ন। এই ক’দিন আগেও আমাদের দেশে ওলাওঠা রোগে মারা যেত হাজার হাজার মানুষ। তবে এ ঘটনাগুলো ঘটেছে প্রাকৃতিকভাবেই। জীবাণু অস্ত্রের এই ব্যাপকতা থেকে প্রাকৃতিক মহামারী কিছুটা ভিন্ন। প্রাকৃতিক কোনো রোগ মহামারীতে রূপ নিতে এক সপ্তাহ থেকে এক মাস সময় লাগে। অপরদিকে জীবাণু অস্ত্রের মাধ্যমে খুব সহজেই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব। এ ছাড়া প্রাকৃতিক মহামারী মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর ওপর কোনো প্রভাব না ফেললেও জীবাণু যুদ্ধের প্রভাব পড়ে পুরো পরিবেশের ওপর।
২০০১ সালের আমেরিকার সাবেক সিনেটর টম ডাচলের কাছে একটি চিঠি আসে। ওই চিঠিটিতে ছিল অ্যানথ্রাক্স জীবাণু মাখানো। প্রথমে ব্যাপারটি টম বুঝতে পারেননি। তিনি চিঠিটি খুলে পড়েন। চিঠিতেই লেখা ছিল অ্যানথ্রাক্স জীবাণুর কথা। ওই সময় আমেরিকায় তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। কোনো প্যাকেট আমেরিকায় যে কোনো মাধ্যমে এলে তা আগে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হতো। ডাকে কোনো চিঠি বা কোনো পার্শ্বেল এলে তাও পরীক্ষা করা হতো। অজ্ঞাত সূত্র থেকে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয় আমেরিকাকে ধ্বংস করতে ওই জীবাণু পাঠানো হয়েছিল।
মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব
অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক প্রভাবের থেকে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বেশি ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। যুদ্ধে গুজব ছড়ানো হলো শত্রুকে হটানোর একটি প্রাচীনতম কৌশল। যদি শত্রুপক্ষকে বোঝানো যায় যে, জীবাণু অস্ত্র ব্যবহার করে তাদের সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব, তখনই শত্রুপক্ষের ওপর মানসিক চাপ তৈরি করা যায়। এমনকি ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ওপরও এটি প্রভাব বিস্তার করতে পারে। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের আদেশ দান কিংবা পালন করতে গিয়ে অনেকে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেন। তখনই যুদ্ধের ফলাফল রচিত হয়ে যায়। বর্তমানে ‘জীবাণু অস্ত্রের’ মাধ্যমে যুদ্ধের থেকে ‘জীবাণু ভয়’ দেখিয়ে যুদ্ধ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাই যুদ্ধের ময়দানে ভয়কে নিয়ন্ত্রণ করা এবং প্রতিপক্ষকে উল্টো চাপে ফেলার রীতিকে যুদ্ধের অন্যতম কৌশল বলে মানা হচ্ছে।
প্রতিরক্ষা
জীবাণু যুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষার জন্য সব থেকে প্রয়োজনীয় হলো জীবাণু অস্ত্র প্রতিরোধী স্যুট, গ্লাভস ও বুট ব্যবহার করা। সাধারণত ১-১.৫ মাইক্রোমিটার সাইজের জীবাণু থেকে রক্ষার জন্য এ ধরনের পোশাক ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধ চলাকালীন সৈনিকদের জন্য পর্যাপ্ত স্যানিটেশন এবং পরিষ্কার খাদ্য ও পানীয়ের ব্যবস্থা রাখা অত্যন্ত জরুরি। এমনকি কঠিন প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও পর্যাপ্ত সাবান, পানি এবং পরিষ্কার কাপড়-চোপড়ের ব্যবস্থা করা প্রত্যেক সেনাবাহিনীর কর্তব্য।
যুদ্ধের সময় সৈনিকদের জন্য তৈরি বিশেষ ধরনের বাঙ্কার ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একে বলা হচ্ছে ‘কল প্রো’ [কালেকটিভ প্রটেকশন] সিস্টেম। এতে এয়ারটাইম সিস্টেম ছাড়াও আছে বিশেষ ধরনের ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা। বিশেষ করে বায়োলজিক্যাল উইপনে আক্রান্ত রোগীদের জন্য এটা বেশ উপকারী।
একেক ধরনের জীবাণু অস্ত্রের জন্য একেক ধরনের চিকিৎসা কার্যকর। যেমন ব্যাকটেরিয়াল এ্রজেন্টের মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অ্যান্টিবায়োটিক, পেনিসিলিন ইত্যাদি নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আবার ভাইরাল এ্রজেন্টের মাধ্যমে আক্রান্তদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে বিশেষ ধরনের থেরাপি নেয়ার। চিকিৎসা যাই হোক না কেন, সবার আগে নিশ্চিত করা দরকার, আক্রান্ত ব্যক্তিকে খুব তাড়াতাড়ি চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে সামান্যতম দেরি হলে আক্রান্ত ব্যক্তি মারা যেতে পারে। আরেকটি ব্যাপার লক্ষণীয়, চিকিৎসার ভার অনেকখানি নির্ভর করে রোগীর পারিপার্শ্বিকতার ওপর।
মানুষ অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়। এ পৃথিবীতে যারা কলহ সৃষ্টি করে, তাদের সংখ্যা হাতেগোনা। আমরা স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করি। শুধু আমাদের স্বপ্নের পৃথিবী কেন, বাস্তবের পৃথিবীও যাতে সুন্দর ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে সে প্রত্যাশা আমাদের সবার। আজ পৃথিবীতে সবাই সোচ্চার হয়ে উঠছে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে, হাতে হাত রেখে এ বিশ্বকে সুখী করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আর কোনো হানাহানি নয়, নয় কোনো অস্ত্রের ঝনঝনানি। বিজ্ঞান মানুষের জন্য, মানুষ বিজ্ঞানের জন্য নয় এ আপ্তবাক্যটিকে মাথায় রেখে আমরা জীবাণু অস্ত্র এবং জীবাণু যুদ্ধ পরিহারে সচেষ্ট হই। বিজ্ঞানকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করে, এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলি আমাদের স্বার্থে, আমাদের বংশধরদের স্বার্থে।