somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এয়ারপোর্ট কথনঃ জোহানেসবার্গ

২৮ শে নভেম্বর, ২০১১ রাত ১১:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




২০শে অক্টোবর ২০১১। জোহানেসবার্গ ও আর ট্যাম্বো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। সকাল ১০টা ২৬ মিনিটে সাউথ আফ্রিকান এয়ার লাইন্সের বিশাল যাত্রীবাহি বিমানটির চাকা রানওয়ে স্পর্শ করল। এন্টেবে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের টিকিট কাউন্টারে বসা কৃঞ্চ সুন্দরীকে ভূবন ভোলানো হাসি আর “ম্যাম” সম্বোধন করার ফলাফল হিসেবে জানালার পাশে সিট পেয়েছিলাম। এন্টেবে থেকে আসার পথে গত চার ঘন্টার সাড়ে তিন ঘন্টাই কেটেছে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকে। আকাশ থেকে ধরণীকে দেখার মজাই আলাদা। ল্যান্ড করার পর ধীর গতিতে প্লেনটি ট্যাক্সিওয়ে ধরে টারমাকের দিকে এগিয়ে চলেছে। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। স্পিকারে এয়ার ক্রু সবাইকে জোহানেসবার্গে স্বাগত জানাচ্ছে।

বিশাল বিমানের দরজা খুলে যেতেই একরাশ ঠান্ডা হাওয়া চোখমুখ বুজে দিল। আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানে মোটামুটি ২৬-২৮ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা। আর এখানে ১৬ ডিগ্রি সে.। তাপমাত্রার এই হঠাৎ তারতম্য শরীরে মৃদু কাঁপন ধরিয়ে দিল। এয়ারলাইন্সের বাসে করে এয়ারপোর্ট বিল্ডিং এ নেমে ফ্রেশ হয়ে ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে পা বাড়ালাম। লম্বা লাইন আর সাপ-লুডুর গোলকধাঁধা পেরিয়ে কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালাম। বিভিন্ন দেশের নাগরিক সাউথ আফ্রিকায় এসেছেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবার দিকে চোখ বুলাচ্ছিলাম। এক জোড়া ভারতীয় তরুন-তরুনীর দিকে তাকিয়ে ছিলাম এমন সময় ডাক পেলাম। কাউন্টারে বসা এক সাদা মহিলা। বয়স ৩৫ মত হবে। “মর্নিং” বলে ভূবন ভোলানো হাসি দিয়ে পাসপোর্টটা বাড়িয়ে দিলাম তার দিকে। মহিলা হাসির জবাব না দিয়ে পাসপোর্ট উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলেন। সবকিছু চেক করে হঠাৎ মাথা তুলে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “হোয়ার ইজ ইয়োর ভিসা!?”

আমি এটার অপেক্ষাতেই ছিলাম। জানতাম সাউথ আফ্রিকা অন এরাইভাল ভিসা দেয়না। সেজন্যই একটু উদাস গলায় বললাম, “আই ডোন্ট হ্যাভ এনি ভিসা!”
মহিলা পাতলা ফ্রেমের চশমার ভিতর দিয়ে আমার দিকে সরু চোখে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, “হোয়ার ডু ইউ ফ্রম?”
“উগান্ডা”
“হোয়াট ইজ ইয়োর ন্যাশনালিটি?”
যদিও সেটা আমার পাসপোর্টেই লেখা আছে তবু আমি কিছুটা গর্ব করে বললাম “বাংলাদেশী।”
মহিলার চোয়াল মনে হয় একটু শক্ত হয়ে গেল। বিভিন্ন এয়ারপোর্টে বাংলাদেশী দেখলেই ইমিগ্রেশন সতর্ক হয়ে যায়। বুঝলাম এরাও এর ব্যতিক্রম নয়। যাহোক মহিলা একটু কঠিন কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারনে বলল, “ইউ ক্যা নট এন্টার সাউথ আফ্রিকা উইদাউট এ ভিসা!”

লম্বা দম নিলাম। আমার নীল পাসপোর্ট দেখিয়ে বলা শুরু করলাম, “এটা বাংলাদেশ সরকারের দেয়া অফিশিয়াল পাসপোর্ট। ....আর এটা জাতিসংঘের দেয়া পরিচয়পত্র”—বুকে ঝোলানো আইডি কার্ডটা খুলে দিয়ে বললাম, “আমি একজন চিকিৎসক। আমার দেশের একজন ব্যক্তি প্রিটোরিয়াতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আছে। তিনি একা বিমান ভ্রমন করতে পারবেন না বিধায় আমি অফিশিয়ালী এসেছি তাকে একমপ্যানি করে দেশে ফিরিয়ে নিতে। রোগীর শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে রোগীকে আমি যেকোন সময় বিশ্বের যেকোন দেশে নিয়ে যেতে পারি। এই অথরিটি জাতিসংঘ আমাকে দিয়েছে”-–বলে নিউইয়র্কের (জাতিসংঘ সদর দপ্তরের) মেডিকেল সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্টের চিঠিটা পকেট থেকে বের করে দেখালাম।
মহিলা দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার, ইউ প্লিজ কাম উইথ মি”, বলে মহিলা আমাকে নিয়ে গেল চীফ কাস্টমস্ অফিসারের রুমে, ইয়া মোটা, থলথলে এক নিগ্রোর কাছে। মহিলা তার সাথে পরিচয় করে দিল। নিগ্রো হ্যান্ডশেক করে ফ্রুটস আর কফি খাওয়াল। এবং কথা প্রসংগে জিজ্ঞেস করল, “হোয়াই ডিডেঞ্চ ইউ ইউজ দ্যা ডিপ্লোম্যাটিক কাউন্টার?”
আমি আবারো হাসলাম এবং মনে মনে বললাম “তাহলে তো ব্যাটা তুই আমারে ডেকে নিয়ে ফ্রুটস-কফি খাওয়াইতি না!”
যাহোক আমাকে ইমিগ্রেশনের মহিলা পাসপোর্সে ৭ দিনের ভিসার সিল মেরে সসম্মানে আমাকে এয়ারপোর্টের এক্সিট দেখিয়ে দিল। এবং সবশেষে হাসি হাসি মুখ করে বলল, “ওয়েলকাম টু সাউথ আফ্রিকা!”

আমার কাজ এখনো শেষ হয়নি। খুঁজে বের করতে হবে সেই ব্যক্তিকে যে আমাকে রিসিভ করতে আসবে। ও আর ট্যাম্বো যে কতবড় এয়ারপোর্ট তা টের পেলাম হাঁটতে গিয়ে। হাঁটছি তো হাঁটছিই, মেইন এক্সিট আর পাইনা। একই রকম সমস্যায় পড়েছিলাম দুবাই এয়ারপোর্টে। সে অন্য কাহিনী ....প্রায় এক কিলো হাঁটার পর বের হলাম এয়ারপোর্ট থেকে। বের হয়েই দেখি প্রায় শ’খানেক লোক হাতে প্ল্যাকার্ড হাতে দাড়িয়ে আছে। কাউকে চিনলাম না। চেনার কথাও না। আমাকে বলা হয়েছে একজন ইউএন রিপ্রেজেন্টেটিভ আমাকে খুঁজে নেবে। কাজেই দাঁড়িয়ে রইলাম। ১৫ মিনিট দাঁড়ানোর পরেও যখন কেউ এলনা তখন মানি এক্সচেঞ্জ বুথের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। আমার কাছে ইউএস ডলার। সাউথ আফ্রিকান রেন্ডে ভাঙাতে হবে। ডলার চেঞ্জ করে বুথ থেকে বের হতেই কে যেন চিকন সুরে ডাকল “মি. জর্জিস?”

ঘুরে প্রশ্ন কর্তার দিকে তাকালাম এবং ছোটখাট একটা ধাক্কা খেলাম। ২৫-২৬ বছরের এক সাদা স্বর্নকেশী দাঁড়িয়ে আছে। পরনে টিপিক্যাল সাদা মেয়েদের স্কার্ট, বুকের সামনে হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে কালো কালিতে লেখা আমার নাম।
স্বর্ণকেশী তার হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে “হাই আই এ্যাম ক্যাথি এন্ড প্লেজার টু মিট ইউ মি. জর্জিস”
তার বাড়ানো হাত ধরলাম এবং কিছুটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, “হাউ ডিড ইউ রিকগনাইজ মি?”
সে আমার বুকে ঝোলানো জাতিসংঘের আইডি কার্ড দেখিয়ে বলল, “আমি তোমাকে অনেকক্ষন থেকেই লক্ষ্য করছিলাম কিন্তু তোমার আইডি কার্ড দেখে নিশিচত হয়েছি”।
আমি আমার পুরো নাম, পরিচয় ব্যাখা করলাম। ডাক্তার শুনে সে অবাক। বলল, “আমি একজন নার্স”। এবার আমি কিছুটা অবাক হলাম। সে বলল “ডক্টর, ইটস মাই প্রিভিলেজ টু অফার ইউ আ কাপ অফ কফি উইথ মি”

কফি খেয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বের হলাম। সে চকচকে কালো এক শেভরোলেট গাড়ি নিজেই নিয়ে এল পার্কিং লট থেকে। ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসতে বসতে বললাম “নাইস কার!”
সে বলল, “ইয়েস! আই বট ইট টু মান্থস্ ব্যাক!”
আমার আবারো অবাক হবার পালা। ভেবেছিলাম এটা ইউএন এর গাড়ি। ডাক্তার হয়েও দেশে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড টয়েটো গাড়ি কিনতে পারলাম না আর এদেশে ২৫-২৬ বছরের এক নার্স নিজের শেভরোলেট চালায়!!

জোহানেসবার্গ থেকে প্রায় ৫০ কিমি উত্তরে প্রিটোরিয়া—দক্ষিন আফ্রিকার প্রশাসনিক রাজধানী। ছিমছাম হাইওয়ে দিয়ে যাচ্ছিলাম। গাড়ি থেকে প্রিটোরিয়ার সুন্দর বেগুনী রঙের জাকার্ডানা ফুল দেখব নাকি পাশে ড্রাইভিং সিটে বসা স্বর্ণকেশীর দিকে মনোযোগ দেব-ভাবছি। অবশ্য সে নিজেই কিছু কথাবার্তা বলছিল। কোন হোটেল বুক করেছে আমার জন্য, আমার পরবর্তী কার্যক্রম, কি কি করব ইত্যাদি। সাউথ আফ্রিকান ইংলিশে একটা টান আছে; অনেকটা অস্ট্রেলিয়ানদের মত। মাঝে মাঝেই দু একটা শব্দ মিসিং হচ্ছিল। আধাঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম প্রিটোরিয়ার ভুরট্রেকার রোডে—গন্তব্যস্থলে।


বেগুনী জাকার্ডানা গাছ

আমার হাতে দুদিন সময় আছে। দুদিন প্রিটোরিয়া/জোহানেসবার্গ ঘুরে বেড়ানো যাবে। ভাবছি লাঞ্চের পর দুপুর বেলায়ই বেড়িয়ে পড়ব ক্যাথিকে নিয়ে। হাজার হলেও আমার লিঁয়াজো অফিসার সে নিজেই।

হাসপাতাল গেটে নেমে সে কথা তাকে বলতে যাব এমন সময় সে আগ বাড়িয়ে বলে উঠল, "ডক্টর, মাই বয়ফ্রেন্ড ইজ ষ্টিল ওয়েটিং ফর দ্য লাঞ্চ, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আই উইল পিক আপ ইউ এট দ্য ইভনিং!"

সে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। আমি একা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

অ.টঃ সে কথা রেখেছিল। সন্ধ্যায় সে আমাকে পুরো প্রিটোরিয়া দেখিয়েছে। ভুরট্রেকার মনুমেন্ট, প্রিটোরিয়া ইউনিভার্সিটি, সেন্ট্রাল চার্চ, পল ক্লুগারের বাড়ি ও মিউজিয়াম, ইউনিয়ন বিল্ডিং, মার্লোজ হাউজ, স্টেট মিউজিয়াম, সিটি হল সহ বেশ কয়েকটা বার আর নাইট ক্লাবে নিয়ে গিয়েছিল।
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×