সকালে যথারীতি অফিসে গিয়েছিলেন। কী বৃষ্টি হলো ক'িদিন ধরে! গলিতে পানি জমেছিল। 'এই পাড়াটা যে কবে মানুষ হবে!' বলতে বলতে, বৃষ্টির জমে থাকা পানি থেকে পা বাঁচাতে বাঁচাতে অফিসে গিয়েছিলেন শফি ভাই। প্রতিদিন যেমন যান। দুপুর সাড়ে 12 টায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃতু্যবরণ করেন সেই শফি ভাই। কত বয়স হয়েছিল? 47।
শফি ভাই ছোটখাট গড়নের ছিলেন। মুখে অযত্নের ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। প্রায়ই কাঁধে থাকত পুলিশের ব্যাগের মতো ছোট একটি খাঁকি ব্যাগ। খুব পড়তেন। বই, ম্যাগাজিন, পত্রিকায় তার ছোট্ট ঘরটা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছিল। শফিক করিম স্বরিত আবৃত্তি চক্রের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। '90-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সংস্কৃতি কমর্ীরা যখন রাজপথের আন্দোলনে বলিষ্ঠ, শফিক করিম ছিলেন তাদেরই অংশী। তার কণ্ঠে তখন কবি শামসুর রাহমানের 'এই মাতোয়ারা রাত' কবিতাটি জনপ্রিয়তা পায়। যদিও প্রিয় ছিল তার জীবনানন্দ দাশের কবিতা আবৃত্তি। 'বিশ্বাসী করতল' ও 'ভালোবাসার মিথলজী' নামে তার দুটো আবৃত্তির অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। 'ভালোবাসার মিথলজী'র পুরো স্ক্রিপ্ট আমার লেখা। দুটো ক্যাসেটের রেকর্ডিংয়েই আমি ছিলাম। প্রায়ই আমরা রাত জেগে কাজ করতাম। কী রিহার্সেলে কী রেকর্ডিংয়ে যখনই বলেছি, 'শফি ভাই, এই জায়গাটা এভাবে পড়েন।' মেনে নিয়েছেন। অথচ আমি ছিলাম তারচেয়ে বয়সে ছোট।
আমার কর্মজীবন শুরম্ন হয় ভোরের কাগজ দিয়ে। '92 সালে। তখন শফি ভাই চাকরি করেন কাকরাইল মোড়ের পেট্রল পাম্পটায়। অফিস শেষে আমি চলে আসতাম তার পাম্পে। তারপর ওখানে চলত চা, সিগারেট, পুরি খাওয়া।শফি ভাইয়ের পকেটে পয়সা আছে, কারো আব্দার অপূর্ণ থাকবে- এটা হবে না। হয়নি কখনো।
কত রাত আড্ডা দিয়েছি তার মনিপুরীপাড়ার বাসায়। গভীর রাত পর্যনত্দ চা আসতো। স্বরিত-এর কারণে একটি দীর্ঘ সময় কেটেছে আমাদের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। জ্যোতির কাঁঠাল বাগানের বাসায়। আজ কত কথা মনে পড়ে... সংস্কৃতি কমর্ী হয়েও শফিক করিম ছিলেন প্রচারবিমুখ, ভালোবাসতেন পড়তে, ভাবতেন জীবন ও সমাজের উন্নয়ন নিয়ে। জড়িত ছিলেন প্রথম আলোর পাঠক সংগঠন বন্ধুসভার সঙ্গে, ছিলেন মনিপুরীপাড়া কল্যাণ সমিতির দপ্তর সম্পাদক। এ ছাড়াও নানা সংগঠন ও মানুষের কল্যাণের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল তার কাজ।
অভিমানী ছিলেন শফি ভাই। ভেতরে ভেতরে ভীষণ অভিমানী। বিয়ে করেছিলেন বেশ দেরি করে। তার স্ত্রী বিলকিস ভাবী এখনো অজ্ঞান। মানতে পারছেন না এই মৃতু্য। পাঁচ বছরের একমাত্র ছেলে সাদ, খেলে-দৌড়ে বেড়াচ্ছে। ও তো বোঝেই না বাবার মৃতু্য কী... আমরা যারা বড় হয়ে গেছি, তারাই কী সব বুঝি! সব মানতে পারি!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৬ সকাল ৮:৪৪