চাকুরীর প্রয়োজনে যেখানে থাকতে হয় সেটিকে আসলে কিভাবে বর্ণনা করব? ঢাকা হতে সড়ক পথে দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার! কিন্তু মাঝে মাঝে এই ৭৫ কিলোমিটারকে হাজার কিলোমিটারেরও বেশি মনে হয়। যদি ঢাকা হতে অফিস করি তবে আমাকে অফিসের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে ভোর ৫.৩০ হতে। সকাল ৬.৩০-এ যদি অফিসের মাইক্রোতে উঠি তবে হয়ত ৮.৩০-এর আগে অফিসে পৌছুতে পারব। যদি এর মাঝে কোথাও ৫/১০ মিনিট দেরী হয়ে যায় তবে নিশ্চিত সেটি অফিসে পৌছানোর আগেই ঢাকার রাস্তায় চক্রাকারে বেড়ে ২০/৩০ মিনিট-এ দাঁড়াবে নিশ্চিত। তার আগেই বলে নিই অফিস বলতে আমি যা বুঝাচ্ছি সেটি কিন্তু মোটেও আপনার কল্পনার বা বাস্তবের কোন ঝা চকচকে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান নয়। সোজা কথায় সবাই যেটিকে বলি গার্মেন্টস কারখানা। আর আমরা বলি নিট কম্পোজিট ফ্যক্টরি। ঢাকার অলিতে গলিতে বহুতল ভবনে আমরা যেসকল গার্মেন্টস দেখি, সেগুলো আর আমাদের এইসব কম্পোজিট ফ্যাক্টরীর মাঝে আসলে বিস্তর ফারাক। ঢাকার মিরপুর-১/২/১০, শ্যামলী, কল্যাণপুর, ফার্মগেট, মৌচাক, রামপুরা, সহ পুরান ঢাকায় যত্রতত্র যে গার্মেন্টস আমরা দেখি সেগুলো মূলত ছোট বিণিয়োগে গড়ে উঠা কাটিং এবং সু্ইং ইউনিট। অর্থাৎ এ সকল গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কেবল কাপড় কেটে সেলাই করে পোষাক তৈরী করা হয়। সেই তুলনায় ঢাকা এবং এর আশেপাশের বিভিন্ন জেলা যেমন গাজিপুর, নারায়নগঞ্জ, নরসিংদীতে গড়ে উঠা কম্পোজিট ফ্যাক্টরীগুলো হল নদী আর সাগরের মত। যেমন বিরাট বিনিয়োগ তেমনি ব্যাপক পরিসরে এসব ফ্যাক্টরি গড়ে তোলা হয়েছে। অসংখ্য দেশী বিদেশী এক্সপার্ট এখানে কাজ করেন। অসংখ্য স্বয়ং সম্পূর্ন ইউনিট নিয়েই আমাদের এসব ফ্যাক্টরী। তবে আজ আমি কেবল আমার নিজ ফ্যাক্টরী নিয়েই কথা বলব। আর এর মাধ্যমে যে চিত্র তুলে ধরা হবে তাতে পাঠকরা অন্তত কিছুটা ধারনা পাবেন আমাদের লাইফ স্টাইল সম্পর্কে। আমাদের কাজ সোজা কথায় বলতে গেলে আমরা এ দাবী করতেই পারি যে, দেশের অর্থনীতি আমরাই টিকিয়ে রেখেছি! কিছু বেশী বলে ফেল্লাম নাকি? আপনার কাছে বেশী বলে মনে হবার আগে একটু বিশ্লেষণ করে নিতে পারি নিশ্চয় এ সেক্টর সম্পর্কে। দেশের টোটাল রপ্তানি আয়ের ৭৬-৮০% আসে তৈরী পোষাক শিল্প হতে। ২০১০-২০১১ অর্থ বছরে টোটাল রপ্তানি আয় ছিল $২২.৯৩ বিলিয়ন। কর্মসংস্থানেও এর অবদান অনেক। এ সেক্টর প্রায় ২.৫ মিলিয়ন মানুষের কর্মসংস্থান করেছে, এর ৮০% নারী (প্রকৃত পক্ষে এ সংখ্যা আরো বেশী এবং আরো অনেকর কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে এখানে)। শুধু শ্রমিকই নয় আপনার আমার মত শিক্ষিত গ্রাজুয়েটরা এখানে আসতে পারেন একজন টেক্সটাইল প্রকৌশলী হিসেবে অথবা টেক্সটাইলের সুবিশাল আঙ্গিনার যেকোন কোনে। বিডি জবস্-এ যদি একবার ঢু মারার সুযোগ হয়, তাহলে পরিষ্কার দেখবেন সবচেয়ে বেশী সার্কুলার এই টেক্সটাইল সেক্টরের। প্রসঙ্গত বলে রাখি আমাদের টোটাল জবের খুব সীমিত সংখ্যকই আপনি বিডি জবসে্ দেখতে পান! কিন্তু যিনি এ সেক্টরে কাজ করেন তিনি জানেন কত পরিশ্রমের ফসল এই সেক্টর। পুরো সেক্টরটাই প্রাইভেট! সরকারী হাতে গোনা যে কয়টি মিল/ফ্যাক্টরী বিটিএমসি নামক সংস্থার হাতে ছিল সেগুলো চিরায়ত নিয়মে গণতন্ত্রের ভোগে পরিণত হয়েছে। আর আমরাই(টেক্সটাইল প্রকৌশলীদের কথা বলছি) হলাম এ সেক্টরের মূল স্তম্ভ! যারা নিজেদের তৈরীই করেছি এ সেক্টরকে সার্ভ করার জন্য। অন্যান্য যারা আছেন কারও অবদানই কম নয়। কিন্তু আমাদের কথাই আজ বলছি। আপনারা যখন পহেলা বৈশাখে পরিবার নিয়ে পান্তা ইলিশ অথবা ঢাকার পার্কে পার্কে সময় কাটাচ্ছেন, তখন আমরা ফ্যাক্টরির প্রডাকশান কিছুটা বাড়িয়ে নিতে ব্যাস্ত। কারণ চরম প্রতিযোগিতার মাঝে এক সেকেন্ডর-ও অনেক দাম। আর তাইতো আপনার ছুটির দিনেও আমরা জেগে থাকি, দেশের ইকনমিকে জাগিয়ে রাখব বলে।
(প্রথম পর্বের সমাপ্তি)