somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তালেবান হামলায় পাকিস্তানে স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যু: যুদ্ধের গোয়েন্দা এজেন্ট হয়ে জাতিসংঘই নিজে লক্ষ্যবস্তু

০৬ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১২:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গত ১৮ ডিসেম্বর ২০১২ পাকিস্তানের করাচী ও পেশোয়ারে ছয় জন স্বাস্থ্যকর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বিগত কয়েক বছরে পাকিস্তানে এধরণের গুলিতে নিহত বা বোমা বিস্ফোরণ কিম্বা আত্মঘাতি বোমার আঘাতে হতাহত হওয়া প্রায় রুটিন ঘটনায় পরিণত হয়েছে। গড়ে প্রতি সপ্তাহে এরকম একটা করে ঘটনা ঘটে চলেছে। সেই বিচারে ১৮ ডিসেম্বরের এই ঘটনা আলাদা বা নতুন কিছু না। কেউ কেউ হয়ত বলবেন, সংখ্যার দিক থেকে এটা হতাহতের পরিসংখ্যানে সংখ্যা বৃদ্ধির বেশি কিছু নয়। কিন্তু একে আর দশটা রুটিন ঘটনার মতো করে দেখে এখানে ঘটনাকে বিষয় করা হ্য়নি। এই ছয় জন স্বাস্থ্যকর্মী হত্যার ঘটনায় চোখ ফেলার কারণ এখানে ভিন্ন। সে দৃষ্টিকোণের কেন্দ্রে আছে জাতিসংঘ ও জাতিসংঘের ভূমিকা। কিন্তু কোথায় এবং কিভাবে?
একথা বলবার অপেক্ষা রাখে না ২০০১ সালে আমেরিকায় বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রে হামলার ঘটনা থেকে বিশ্ব-ইতিহাস নতুন যুগে, পুনরায় মুখ্য এক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে প্রবেশ করেছে। এই দ্বন্দ্বের বৈশিষ্ট্য গ্লোবাল হলেও একথা আমাদের মনে করার কারণ নাই যে আমরা সবাই এটাকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখব। বরং এটাকে পক্ষে অথবা বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বিভক্ত হয়েই দেখব। এটাই স্বাভাবিক। যার এক পক্ষে আছে আলকায়েদা বা যারা ইসলামিষ্ট রাজনৈতিক উত্থানকে ন্যায্য মনে করেন, আর অপর পক্ষে আছেন এতদিন একচ্ছত্র হয়ে যে সভ্যতার বয়ানে পশ্চি্মের কর্তৃত্বে ও আমেরিকান নেতৃত্ব আমরা আছি, ছিলাম এমন কাছে-দূরের সকলে। আমেরিকায় ঐ (৯/১১) হামলার ঘটনার পর প্রকাশ্য হয়ে পড়া দ্বন্দ্ব আমাদের আর এই প্রশ্নে ঘটনার বাইরে থাকতে দেয়নি, সাক্ষ্যাৎ মুখোমুখি করে ছেড়েছে। আমরাও যার যার ব্যক্তিস্বার্থ, জনগোষ্ঠিগত বা রাষ্ট্রস্বার্থ অনুসারে বৈষয়িক ও চিন্তা-রাজনীতির স্বার্থে যা সঠিক মনে করেছি সেই বিবেচনায় পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছি, আমাদের অবস্থান আছে। গ্লোবাল দ্বন্দ্ব ও এর বয়ানের ঘটনাকে দেখার দিক থেকে এরকমটা হওয়ারই কথা। এখানে কে সঠিক কে বেঠিক তার বিচার নিয়ে বসাও এই লেখার মূল উদ্দেশ্য নয়। দুনিয়ার ইতিহাস এরকম হাজারো গ্লোবাল বা লোকাল দ্বন্দ্ব সংঘাতের ভিতর দিয়ে নানান যুদ্ধ ও মৃত্যুতে, একভাবে না একভাবে, ক্ষণস্থায়ী অথবা চিরস্থায়ীভাবে দ্বন্দ্ব নিরসন করে করেই এপর্যন্ত এসেছে। এই অর্থে আমরা ধরে নিতে পারি চলমান দ্বন্দ্বও একভাবে না একভাবে ক্ষণস্থায়ী বা চিরস্থায়ীভাবে মীমাংসায় নিরসন ঘটবে, ইতিহাস এভাবেই পথ করে এগিয়েছে, আগাবে। শেষমেষ কেমন চেহারায় সে দাঁড়াবে তা দেখবার জন্য অপেক্ষা করতে হবে, তা নিয়ে কথা বলবার সময় সুযোগ সামনে আছে। এর আগে এভাবেই দুনিয়ার ইতিহাস গড়াতে গড়াতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) এক পর্যায়ে জাতিসংঘ নামে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠাটির জন্ম হয়েছিল, সেই জাতিসংঘ নিয়ে কথা তুলব।
সেই জাতিসংঘ এখন বিশ্ব-ইতিহাসের সাথে নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে টিকে আছে। বিশ্ব-ইতিহাসের চলমান এই পর্যায়ে মাও সেতুংয়ের ভাষায় বললে দৃশ্যত দুনিয়ায় প্রধান দ্বন্দ্ব হলো, ইসলামি রাজনীতি বা আলকায়েদা ফেনোমেনা বনাম পশ্চিম (আলকায়েদার বয়ানে ইসলাম বনাম ক্রসেডার-জায়নিস্ট মিত্রশক্তি); যা এর আগের প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ‘শ্রম বনাম পুঁজি’ অথবা কমিউনিজম বনাম গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম—এই দ্বন্দ্বকে আড়ালে ফেলে কাজ করে যাচ্ছে। অর্থাৎ সারকথা হলো, সব পরিস্থিতিতেই দুনিয়ায় একটা প্রধান দ্বন্দ্ব থাকছেই, এই দ্বন্দ্ব, সংঘাত যুদ্ধ সহসা দুনিয়া থেকে যাচ্ছে না, জাতিসংঘ গড়ার কারণ এই যুদ্ধ সংঘাত বন্ধ হয়ে যাবে না। তবুও জাতিসংঘ গড়া হয়েছে এবং এর বিশেষ ও সুনির্দিষ্ট করণীয় আছে সে প্রয়োজনে। সেক্ষেত্রে জাতিসংঘকে ভূমিকা নিতে হবে যা হলো,
১। এসব দ্বন্দ্ব থেকে পরিস্থিতি কোন আঞ্চলিক অথবা গ্লোবাল যুদ্ধের দিকে যেতেও পারে। দুনিয়া থেকে যুদ্ধ চিরতরে মুছে ফেলার মত কোন অবাস্তব, অসম্ভব চিন্তা নয় বরং জাতিসংঘের ভূমিকা অতটুকুই যে যুদ্ধ এড়ানো, বা ছড়াতে না দেওয়া, অথবা কথা বলা বা বিবাদে ডায়লগের সুযোগ যদি থাকে তবে নিঃশেষে একে ব্যবহারের উভয় পক্ষের জন্য সুযোগ করে দেয়া, অথবা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কোন গৃহীত কনভেনশন বা বিরোধ নিষ্পত্তির ভিত্তিমুলক গৃহীত ধারণা যদি আগে থেকে থাকে তার ভিত্তিতে বিরোধ নিরসনের সুযোগ নেয়া ইত্যাদি।
২। একাজে আগাম এটা মনে করা ভুল যে যুদ্ধ কোন খারাপ সমাধান। কারণ অনেক দ্বন্দ্ব আছে যেখানে যুদ্ধই ভাল সমাধান। মনে রাখতে হবে যুদ্ধ বিরোধের কোন প্রেক্ষিতে উপস্থিত ক্ষমতা ভারসাম্যের বিরুদ্ধে নতুন ক্ষমতার উত্থান, নতুন ভারসাম্য—ফলে পালাবদলে নতুন ক্ষমতার উত্থান একটা স্বাভাবিক এবং কাম্য ঘটনা; একটা ভাল সমাধান। প্রশ্নটাতে মুখ্য বিষয় ক্ষমতা বা ক্ষমতা ধারণা; নতুন ক্ষমতা গড়ার ও পুরানোটা ভাঙ্গার। এটা খুবই গুরুত্বপুর্ণ একটা ধারণা। সেটাকে তথাকথিত যুদ্ধবিরোধী অবস্থান দিয়ে কেউ আড়ালে নিতে চাইতে পারে তবে ইতিহাস এর কোন জায়গা নাই। একারণে, বিরোধ মীমাংসার লক্ষ্যে এপর্যন্ত যতগুলো জাতিসংঘের কনভেনশন এসেছে এখানে কোথাও ধরে নেয়া হয় নাই যুদ্ধ কোন খারাপ অপশন। বরং জাতিসংঘের সিদ্ধান্তেই জাতিসংঘের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়েছে—এই উদাহরণও কম নয়।
৩। যুদ্ধে বিবদমান পক্ষের উভয়েরই, ইতিবাচক অর্থে এক নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারীর দরকার থাকে। এটা ঠিক মধ্যস্থতাকারী সব মিটমাট করে দিবে ঠিক সে আকাঙ্খা তা নয়। বরং পরস্পরকে বুঝা বুঝানো, ম্যাসেজ আদানপ্রদানের এবং সর্বপরি কিছু নিয়ম বা ফ্রেমের মধ্যে থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার তাগিদ উভয় পক্ষ সহ দুনিয়ার সবার আছে ও থাকে। সর্বশেষ এমন এক উদাহরণ হলো, ২০০৬ সালের ইসরায়েল-লেবানন অর্থাৎ ইসরায়েলের নিয়মিত সেনাবাহিনী বনাম হিজবুল্লাহ মুক্তিযোদ্ধা বা মিলিশিয়ার যুদ্ধ। যুদ্ধ শেষে প্রায় ৬০০ হিজবুল্লাহ যোদ্ধা সাথী - হয় ইসরায়েলের মাটিতে মৃত্যু ও কবর হয়েছিল অথবা ইসরায়েলের হাতে জেলে বন্দী হয়ে ছিল। অন্যদিকে ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতি সংখ্যায় কম হলেও তা ইসরায়েলি নিয়মিত সেনাবাহিনীর মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপুর্ণ। বিশেষত চার ইসরায়েলী সৈনিক যারা জীবিত ধরা পরেছিল বলে মনে করা হয় কিন্তু পরে তাদের কি হয়েছিল তা ছিল অজানা। তাই ঐ যুদ্ধে বা তারও আগের জীবিত ও মৃত (লাশ বা কবর) বন্দী বিনিময় – এটা ছিল সেই প্রেক্ষিত আর ২০১০ সালে বন্দী বিনিময়ে মধ্যস্থতার ভুমিকায় কাজ করেছিল জাতিসংঘ। এই জাতিসংঘ যদি এভাবে সবসময় যে কোন বিবাদে মধ্যস্ততার ভূমিকা রাখতে চায় তাহলে ওর প্রথম শর্ত হল, মধ্যস্ততাকারীকে নিরপেক্ষ হতে হয়, কাজে আচরণে নিরপেক্ষ একটা ইমেজ থাকতে হয়। ফলে স্বভাবতই মধ্যস্ততাকারীর নিরপেক্ষতার ইমেজ বিবদমান রাষ্ট্র বিরোধে জাতিসংঘের ভূমিকায় কাজ করার জন্য মুখ্য আমানত। এই আমানত জাতিসংঘ অনেক সময় ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে, যদিও তাতে একথা বলবার সময় হয় নাই যে জাতিসংঘের দিন ফুরিয়েছে। জাতিসংঘের কোর ডিপ্লোমেট হিসাবে যারা ক্যারিয়ার চান একাজে তাঁদের এক গুরুত্বপুর্ণ ও বিরাট ভুমিকা এখনও আছে। একাজে তাদের জাতিসংঘ ধারণাকে পরিপূর্ণ উপলব্দি করা, এর চার্টার ও ম্যান্ডেটগুলো পরিস্কারভাবে জানা, সেগুলো কোন প্রেক্ষিতে কেন এমনভাবে লেখা হয়েছে সে বুঝাবুঝি ষ্টাডি থাকা খুবই জরুরী। সদস্য ক্ষমতাধর রাষ্ট্র নানাভাবে জাতিসংঘকে নিজের পক্ষে ব্যবহার, প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে এটা স্বাভাবিক। তবে এগুলো মোকাবিলা করতে হবে। চার্টার ম্যান্ডেটগুলো দেখিয়ে তাদেরকে পরিণতি সম্পর্কে সাবধান করিয়ে দেয়া এবং সর্বপরি বিরত করা - জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল সহ যেকোন একজন কোর ডিপ্লোম্যাটের মূল কাজ। যেমন ইরাক দখলের পর সেক্রেটারী জেনারেল কফি আনান পাবলিকলি বলতে পেরেছিলেন, “ইরাকে আমেরিকা এক দখলদার শক্তি”। এতে ইরাক দখলমুক্ত হয়ে যায়নি সত্যি কিন্তু মরালের দিক থেকে নিজ জনগণ ও দুনিয়ার কাছে এতে আমেরিকা চরম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল।
দ্বন্দ্ব বিবাদের দুনিয়ায় জাতিসংঘের জন্ম ইতিহাস ও কেমন ধরনের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এটা, কি ভূমিকা রাখার সুযোগ এর আছে তা নিয়ে আলাদা বিশদ আলোচনা করতে হবে। আপাতত আলোচ্য প্রসঙ্গে মানে পাকিস্তানের ছয় স্বাস্থ্যকর্মী হত্যা নিয়ে আলাপের জন্য সংক্ষিপ্তভাবে জাতিসংঘ প্রসঙ্গ কিছু প্রাসঙ্গিক কথা বলে নেয়া হলো। এখন আমরা মূল প্রসঙ্গে যাব।
পাকিস্তানের যে ছয় স্বাস্থ্যকর্মীকে হত্যার বিষয় এখানে আমলে নয়া হয়েছে এই স্বাস্থ্যকর্মীরা জাতিসংঘের অঙ্গ বা এজেন্সী প্রতিষ্ঠান ইউনিসেফের স্থানীয় কর্মী। এরা সকলে ইউনিসেফ পাকিস্তান কান্ট্রি অফিসের ফিক্সটার্ম চাকরী শর্তে নিয়োজিত। সোজা কথায় তাঁরা জাতিসংঘের স্থানীয় কর্মচারী। অনেকেই জানেন, ইউনিসেফ দেশে দেশে Expanded Programme on Immunization (EPI) পরিচালিত করে থাকে। (EPI) মানে শুণ্য থেকে পাঁচ বছরের বাচ্চাদের নিয়মিত টিকা দেয়া, ড্রপ খাওয়ানো বা ইনজেকশন দিয়ে বাচ্চার শরীরে রোগ প্রতিষেধক তৈরির কার্যক্রম এটা। আলোচ্য ঘটনা সুনির্দিষ্ট করে বাচ্চাদের পোলিও ভাইরাসে আক্রান্ত হবার বিরুদ্ধে ওষুধের ড্রপ খাওয়ানোর বা পোলিও ভ্যাকসিন বিতরণের। সারা দুনিয়ায় এপর্যন্ত এই প্রোগ্রামকে সাফল্যজনক ও এতে কাজ হয় বলে মনে করা হয়। গ্রাম শহরে পরিচালিত এই সামাজিক কর্মসূচীর তাৎপর্য হলো, সমাজকে সংগঠিত করা, সংগঠিত কথাটা দুই অর্থে যে যারা এর সুবিধাভোগী হবে এবং সমাজের যে জনশক্তি সংগঠিত করে ও ট্রেনিং দিয়ে যাদের মাধ্যমে এই সার্ভিস সুবিধাভোগীদের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে এমন এক উপযুক্ত দক্ষ জনশক্তি সংগঠিত করে একটা মনিটরিং ব্যবস্থার অধীনে এটা পরিচালিত করা। লক্ষ্য সমাজকে পোলিও ভাইরাস থেকে মুক্ত করা। কারণ সময়ে এই যত্ন না নিলে পোলিও আক্রান্ত বাচ্চা সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে থাকতে পারে, নিজের ও সমাজের জন্য বোঝা হয়ে জীবন কাটাতে হতে পারে তাকে। যেমন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা পোলিও মুক্ত সমাজের জায়গায় পৌছেছি বলে মনে করা হয়। তাই কোন ডাক্তারখানা, অথবা কোন সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল - কোথাও পোলিও রোগীর খবর যদি পাওয়া যায় (গত কয়েক বছরে এই রেকর্ড নাই) তবে তৎক্ষনাৎ তা সিরিয়াস গবেষণার বিষয় মনে করা হয়। স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য অফিসারের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপুর্ণ একটা দায়িত্ব ও কাজ। কারণ এটা প্রোগ্রাম পরিচালনার সম্ভাব্য কোন ত্রুটি ফাঁকফোকড় এরপরেও রয়ে গেছে কিনা তা জানা খুবই জরুরী। তাই গবেষক ডাক্তারের টিম সেখানে ঘটনার খুটিনাটি ইতিহাস খুঁজে দেখতে ছুটে যায়। যদি ঘটনা সত্যি হয় তবে ত্রুটি নিরসন করতে তৎক্ষণাৎ সব ব্যবস্থা নেয়া হয়। বাংলাদেশের EPI মনিটরিং আজ এই পর্যায়ে উন্নীত করা গেছে। এই প্রোগ্রামের কথা এত বিস্তারিত বর্ণনা করলাম এজন্য যে একটা রোগের সামাজিক অভিশাপ থেকে আমরা কি করে বাচ্চাদের মুক্ত করতে পারি, এর উপায় যে চাইলে করা সম্ভব এই সাফল্যের দিকটা খুলে বলা। এটা একই সঙ্গে আমাদের সামাজিক উৎপাদনের জন্য সবল জনশক্তি তৈরির ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপও বটে। জাতিসংঘ প্রতিবছর এর বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্র সামাজিক উন্নয়নে কতটুকু আগালো তা মাপামাপির একটা সূচক (হিউম্যান ইনডেক্স রিপোর্ট) প্রকাশ করে। এই সূচকে তুলনায় পাশের বিরাট অর্থনীতির দেশ ভারতের থেকে গত কয়েক বছর আমরা এগিয়ে আছি। এর মানে হলো, বড় অর্থনীতি বা তুলনায় বেশি আয়ের দেশ হলেই সামাজিক উন্নয়নের সূচকে আপনাআপনি কেউ ভাল অবস্থানে চলে যাবে এমন কোন মানে, সম্পর্ক নাই। কারণ এটা গরীব বা বড়লোক দেশের ব্যাপার না। কাজটা সমাজকে সংগঠিত করে বাস্তবে করে দেখানোর ব্যাপার। এছাড়াও সমাজকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করা আর সামাজিকভাবে সংগঠিত করা দুটো আলাদা বিষয়, আলাদা কাজ; দুটোর মূল্য আলাদা। এই হল এক পোলিও রোগকে কেন্দ্র করে ঘটনার সুতায় জড়ানো নানান ঘটনার পারস্পরিকতা।
পাকিস্তানে পরিচালিত (EPI)প্রোগ্রামের অবস্থা খুবই নাজুক। এখন পর্যন্ত কোন এক বছরেও ঐ বছরে জন্ম নেয়া সব বাচ্চাকে এই প্রোগ্রামের আওতায় আনা যায় নাই। এছাড়া দ্বিতীয় ডোজ খাওয়ানোর ব্যাপার আছে, মনিটরিংয়ের ব্যবস্থাপনা দাঁড় করানোর ব্যাপার আছে। আর এসব কাজ করতে হলে এর সুবিধা যারা নিবে আর যারা দিবে তাদের উভয়কে সংগঠিত করার গুরুত্বপুর্ণ দিক তো রয়েছেই। এমনকি এই ভ্যাকসিন খোলা আবহাওয়ায় রাখা বা বয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। ওষুধের গুণাগুণ ঠিক রাখতে ও কার্যকর রাখতে চাইলে গাঁ-গ্রামে তা বিতরণের আগে পর্যন্ত চলমান এক ফ্রিজিং ব্যবস্থাপনায় এটা নিতে হয়, যেটা একেবারেই সহজ কাজ নয়। কর্মীদের ফাঁকিবাজিতে বা অদক্ষপনায় ওষুধ একবার খোলা আবহাওয়ায় উন্মুক্ত রেখে আবার তাকে ফ্রিজিংয়ে রাখলে ওষুধ গুণাগুণ হারাবে। পাকিস্তানের মত আবহাওয়া ও পাওয়া যায় এমন শ্রমদক্ষতাপনার পরিবেশে এদিকটা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। আবার এসব চ্যালেঞ্জের পিছনে একটা বড় কারণ পাকিস্তানের রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক অবস্থা, বিশেষত ৯/১১ এর পর থেকে আমেরিকান ওয়ার অন টেররের ফ্রন্টলাইন রাষ্ট্র হয়ে বেগাড় খাটতেই ওর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।
ঐ ছয়জন কর্মীর মৃত্যুর পর আলজাজিরার এক রিপোর্ট বলছে, পাকিস্তানের তালেবান রাজনৈতিক গোষ্ঠি ইউনিসেফের (EPI)প্রোগ্রামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা বারবার এই প্রোগ্রাম নিয়ে তাদের প্রভাবাধীন এলাকায় প্রবেশ করতে সাবধান করেছিল। কারণ এই কর্মসূচিকে ঐ কর্মসুচীর আড়ালে তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত পশ্চিমের যুদ্ধস্বার্থের কাজ বলে তারা সন্দেহের চোখে দেখে থাকে। তাই অনুমান করা হচ্ছে যে করাচী ও পেশোয়ারের কয়েক জায়গায় একযোগে চালানো আক্রমণে তালেবানেরা ঐ হত্যার জন্য দায়ী। এতদূর পড়ার পরীবার কারও মনে হতে পারে ‘পশ্চাদপদ’ ইসলামী রাজনীতির এক কারবার এটা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনার বিচার করা সহজ এবং তা পপুলারও বটে। ঘটনার পর এনিয়ে দেশে-বিদেশের মিডিয়ায় যে রিপোর্টগুলো বেরিয়েছে তার মূলসুরও এটাই। কিন্তু ঘটনাকে দেখবার বুঝবার পথ কি আসলেই এত সহজ? দুনিয়া ইসলামি ‘পশ্চাদপদতা’ ‘কুপমন্ডুকতার’ খপ্পড়ে পড়েছে ফলে এদের নিন্দা জানানো ও হাত ধুয়ে বসে থাকাই এখন আমাদের কাজ?
তালেবানদের EPI প্রোগ্রাম বিরোধীতার কারণ হিসাবে তারা কি বলছে সেদিকে নজর দেয়া যাক। টিকা ইনজেকশন ড্রপ ইত্যাদি পশ্চিমের, এই বিজ্ঞান পশ্চিমের তাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু তালেবানেরা তাদের বিরোধিতার কারণ হিসাবে এটা বলে নাই। বরং তারা মনে করে এই কর্মসূচির ছলে এরা পশ্চিমের পক্ষে তালেবান প্রভাবাধীন এলাকায় গোয়েন্দাগিরি করছে। তাই তারা এই কর্মসূচিকে পশ্চিমা ষড়যন্ত্র মনে করে ও সন্দেহের চোখে দেখে, এই ততপরতা নিজেদের বিরোধি মনে করে। অভিযোগের এই গুরুত্বের দিকটা সব মিডিয়া রিপোর্টে উপেক্ষা করেছে। এতে ঘটনার সহজ ব্যাখ্যা বয়ান তৈরি করেছে যাতে এমন মানে হয় যে, তালেবানেরা ইসলামী ‘পশ্চাদপদতা’ ‘কুপমন্ডুকতার’ কারণে বিজ্ঞান বিরোধী, ভ্যাকসিন বিরোধী। অথচ তালেবানদের অভিযোগের সারকথা হলো, জাতিসংঘ বা তার এজেন্সী সংগঠন ইউনিসেফ পশ্চিমা রাষ্ট্রস্বার্থের পক্ষে সামরিক সুবিধা নিতে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে দেবার উপায় হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। [জাতিসংঘের বিরুদ্ধে এটা এক সাংঘাতিক গুরুতর অভিযোগ। জাতিসংঘের আভ্যন্তরীণ গঠন ও পরিচালন কাঠামোতে এই অভিযোগ তাদের শুধু সিরিয়াসলি নেয়া নয় বরং কোন প্রযুডিস না হয়ে গ্রহণ ও তদন্ত করার কথা।] ওদিকে তালেবানেরা তাদের অভিযোগের প্রমাণ বা উদাহরণ হিসাবে তাঁরা বলছে এক পাকিস্তানী ডাক্তার ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রামের ছদ্মবেশে বিন লাদেনকে ধরতে তথ্য সংগ্রহে নেমেছিল আর ঐ সুত্রেই লাদেন সিআইএ এর অপারেশনে গ্রেপ্তার হয়েছে ও মৃত্যু ঘটেছে।
পাকিস্তান সরকারও এই অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে নেয় নাই। নিলে সেটাই স্বাভাবিক হত। সেক্ষেত্রে স্থানীয় জাতিসংঘ ও ইউনিসেফকে ডেকে পাকিস্তান সরকারের দাবি করার কথা যেন EPI প্রোগ্রাম চালাবার আগে জাতিসংঘ ও ইউনিসেফ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থেকে নিজেদের মুক্ত করার পক্ষে ব্যবস্থা নেয় এবং কি ব্যবস্থা নিল তা স্থানীয় সরকার ও জনগণ জানিয়ে তাদের সকলকে আস্থায় নেয়। অথচ পাকিস্তান সরকারের সংশ্লিষ্ট এক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা গুল নাজ এ প্রসঙ্গে মিডিয়াকে জানিয়েছেন, “পোলিও এর নামে পশ্চিমা ‘অবিশ্বাসী’দেরকে যারা সহায়তা করবে তারা পরে পস্তাবে” – এই মর্মে স্বাস্থ্যকর্মীরা টেলিফোনে হুমকি পেয়েছিল। সিনিয়র এক পুলিশ অফিসার শহীদ হায়াত একইভাবে তালেবান যোদ্ধাদের ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে “ফতোয়া” দেবার অভিযোগ এনেছেন। আর হত্যা ঘটনা পরবর্তিতে, পাকিস্তান ইউনিসেফের মুখপাত্র Matthew Coleman এক দায়িত্বজ্ঞানহীন বয়ান দিয়েছেন। এমনিতেই পিছিয়ে থাকা এবং অনিয়মিত হয়ে পরা EPI কর্মসুচিকে স্থগিত ঘোষণা করে তিনি বলছেন, ‘তাদের ফ্রন্টলাইন কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন’। “ঐ কর্মীরা এখন তাদের কাছে সত্যিকারের হিরো’। ওদিকে পাকিস্তানের জাতিসংঘের এজেন্সী প্রতিষ্ঠান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু বা WHO) এবং ইউনিসেফ এক যৌথ বিবৃতিতে বেশ জ্ঞানী এক অভিযোগ এনেছে। ঐ হত্যাকে নিন্দা করে তাঁরা বলছে,‘এই ঘটনা পাকিস্তানের দুস্থ শিশুদেরকে মৌলিক জীবনরক্ষাকারী স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা এক হস্তক্ষেপ”। কিন্তু কোথাও তালেবান যোদ্ধাদের ষড়যন্ত্র ও সন্দেহের অভিযোগের কোন জবাব দিতে কাঊকে দেখা যায় নাই। সকলে যে সহজ পথটা নিয়েছেন তাহলো, ইসলামি ‘পশ্চাদপদতা’ ‘কুপমন্ডুকতার’ থেকে তাঁরা কে কতটা মুক্ত সেই হিরোইজমের লাশের পাহারাদার, অধিকারের পাহারাদার সবাই হতে চেয়েছেন। এটা ওবামার আমেরিকা বনাম আলকায়েদা বা তালেবান – এই চলমান বিবদমান লড়াই যুদ্ধে ওবামার পক্ষে যুদ্ধের সাফাই এর যে বয়ান কনষ্ট্রাকশন খাঁড়া করা হয়ে আছে জাতিসংঘের কর্মচারি হয়েও এটাকেই ভালবেসে আপন মনে করে নেবার রাজনীতি। এভাবে জাতিসংঘ ও তার সব এজেন্সীগুলো একে নিজেদের অযোগ্যতা, ব্যর্থতা ঢাকবার উপায় হিসাবে নিয়েছে। তাদের এই অবস্থানকে তালেবান রাজনীতির বিরুদ্ধে তাদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে তাদের অফিসিয়াল কাজ তৎপরতার পক্ষে সাফাই দেয়া। বিশেষত হু এবং ইউনিসেফ এর বিবৃতি ও লাশের হিরোইজমের বয়ান প্রমাণ করে তারা বলতে চাচ্ছে তাদের মহান ব্রত নিয়ে কাজের মহত্ব ইসলামি ‘পশ্চাদপদতা’ ‘কুপমন্ডুকতা’ বুঝতে পারছে না। আমাদের অনেকেরও এমনটাই মনে হতে পারে। অথচ কোন পক্ষ নেয়া জাতিসংঘ বা তার কোন এজেন্সীর জন্য মারাত্মক গর্হিত কাজ; জাতিসংঘের আভ্যন্তরীণ গঠন ও পরিচালন কাঠামো বিরোধী এবং জাতিসংঘের ম্যান্ডেট বিরোধী। তাই পাঠককে ঘটনার এসব ভিন্ন দিকটার দিকে নজর ফেলতে অনুরোধ করব।
পাকিস্তানের এই ঘটনার নীট পরিণতি হলো, একদিকে ছয়জন কর্মীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া অপরদিকে কর্মসুচি স্থগিত করায় শিশু স্বাস্থ্যের যাবতীয় বিপর্যয়ের কারণ তৈরি রাখা – এর জন্য সম্পুর্ণ দায়ী ও এর দায়ভার পাকিস্তান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু বা WHO) এবং ইউনিসেফ কান্ট্রি অফিসের কর্তাব্যক্তিদের এবং সেই সুত্রে বান কি মুন সহ জাতিসংঘের কোর ডিপ্লোম্যাটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তি সকলের। উপরে লেখার শুরুতে জাতিসংঘের জন্মের পিছনের কাজ করা চিন্তা সম্পর্কে কিছু ধারণা দিয়ে জাতিসংঘের ভুমিকা কি হতে পারে তা নিয়ে তিনটা পয়েন্ট বলেছিলাম। ঐ আলোকে এখন সেকথার আরও কিছু ব্যাখ্যা করব।
১। বলেছিলাম দুনিয়ায় ইতিহাসের এই সময়ে এখন প্রধান দ্বন্দ্ব হয়ে আছে ইসলামী রাজনীতির আলকায়েদা ফেনোমেনা বনাম দুনিয়া শাসনকারী শক্তি আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিম। জাতিসংঘ বা এর পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কেঊই কোন না কোন মুখ্য দ্বন্দ্বে থাকা দুনিয়ায় কারও পক্ষ নিতে পারে না; এনিয়ে জাজমেন্টাল হতে পারে না অথবা নিজের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বিশ্বাস দিয়ে এই দ্বন্দ্ব বিচারে প্ররোচিত হতে পারে না। তাদের মনে থাকা দরকার যে কোন দ্বন্দ্ব জাতিসংঘের মুল ভুমিকা মধ্যস্থতাকারীর, কথা বলার সুযোগ থাকলে তা তালাশ ও উন্মোচনের। এই কোর ভ্যালু বা মুল্যবোধ এবং জাতিসংঘের ম্যান্ডেট সম্পর্কে উপযুক্ত বুঝাবুঝি থাকা, চাকরিতে প্রবেশ মাত্রই বান কি মুন সহ সকলকেই সম্পন্ন করতে হয়। এটা বাধ্যতামুলক। পাকিস্তানের ঘটনায় আলোচ্য ইউনিসেফের কথাই ধরা যাক। পাকিস্তানের সমাজে কি রাজনৈতিক বিরোধ বিবাদে আছে তাতে ইউনিসেফের কোন অবস্থান নেয়া, বিচারক হয়ে যাওয়া অথবা সে বিবাদে কে সঠিক কে ভুল সে বিচারে প্রলুব্ধ হয়ে জড়িয়ে যাওয়া ইউনিসেফ বা জাতিসংঘের কাউকে দেয়া হয়নি, এটা তাদের কাজ নয়। এটা জাতিসংঘের ম্যান্ডেট নয় বা দেখবার বিষয় কাজও নয়। ইউনিসেফের প্রধান কাজ ছিল সফলভাবে (EPI) প্রোগ্রাম পরিচালিত করা। ইউনিসেফের কান্টি ডিরেক্টর ষ্টেশনে যোগদানের আগে থেকে ও পরপরই কর্মসুচি চালাতে বাধা ও সুবিধাগুলো এসেসমেন্ট করা ব্রিফিং নেয়া ছিল তার প্রথম স্বাভাবিক কাজ ও দায়িত্ব। একাজে অবশ্যই তিনি জানতেন তালেবান যোদ্ধাদের মনোভাব, আপত্তির বিষয়ে। তালেবান যোদ্ধাদের EPI প্রোগ্রামের প্রতি এই মনোভাব, আপত্তির বিষয়ের পিছনে তাদের রাজনীতি সঠিক না ভুল এর বিচার করা তার কাজ নয়, তাঁর কাজের কোন টার্গেটই নয়। তার টার্গেট বরং এসব বাধা বিপত্তিগুলো এড়িয়ে শিশুদের কাছে পোলিও টিকা বা ড্রপ নিয়ে পৌছানো, ভ্যাকসিন বিতরণ সম্ভব করে তোলা। এই লক্ষ্যে কাজের একটা ষ্ট্রাটেজির ছক আঁকা। আর একমাত্র তা বস্তবায়নের পক্ষে কাজ করা। শেষ বিচারে ভ্যাকসিন বিতরণে তাঁর সফলতা কতখানি এটা দিয়েই তার দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজ তিনি কতটা করতে পারলেন এর বিচার করা হবে।
একাজে তার সম্ভাব্য ষ্ট্রাটেজি কি হতে পারত এবং যা ঘটেছে তার জন্য কারা কেন দায়ীঃ
১। সবার আগে নিজেকে তালেবানদের সহ সবার কাছে নিজের নিরপেক্ষতা, বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করা।
২। তালেবানদের রাজনীতি ভাল না মন্দ এর সাথে তার কাজের কোন লেনাদেনা নাই, তাঁর কাজের উদ্দেশ্য বাচ্চাদের কাছে পৌছানো একথা মনে রাখা এবং সে কাজে বিশ্বাসযোগ্যভাবে নিজেকে হাজির করা। ইতোমধ্যেই জাতিসংঘ সহ তার প্রতিষ্ঠান যে অভিযোগের মুখোমুখি হয়ে আছে ও বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্কটে আছে তা কাটানোর লক্ষ্যে সম্ভাব্য সব কিছু করা।
৩। সেক্ষেত্রে তার প্রথম কাজ তালেবান নেতাদের কাছে পৌছানো, কথা বলার সুযোগ পরিস্থিতি তৈরি করা বা সে লক্ষ্য অর্জনে কাজ করা। সেকাজের শুরুতে পরস্পরকে বিশ্বাস করা, নিজের নিরাপত্তা ইত্যাদির সমস্যার বাধা থাকবে এটা ধরেই নেয়া যায়। ফলে তালেবান নেতাদের কাছে পৌছানো, কথা বলার সুযোগ পরিস্থিতি তৈরি প্রত্যক্ষভাবে করা না গেলেও তা মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমেও করা যেতে পারে; একাজে তালেবানদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য, সহজেই দেখা করতে পারেন এমন স্থানীয় সরকারি কর্মচারী বা বেসরকারি লোক বা স্থানীয় মুরুব্বি গোছের নাগরিক যে কারও সহায়তা নেয়া যেতে পারত। কান্ট্রি ডিরেক্টরের মনে রাখার কথা তিনি একটা ওয়ার জোনে কাজ করতে এসেছেন। এর জন্য মানসিক প্রস্তুতি ও যোগ্যতা থাকা তার কাজের পুর্বশর্ত। ব্যক্তিগতভাবে তিনি তালেবানদের রাজনীতির ঘোর বিরোধী হতেই পারেন। কিন্তু সে অবস্থান পিছনে ফেলা ছাড়া ওয়ার জোনে নিরপেক্ষভাবে ও ইমেজে কাজ করা অসম্ভব।
৪। মনোযোগ দিয়ে তালেবানদের অভিযোগ শোনা হত তাঁর প্রথম কাজ। আর সেখানে তার টার্গেট হত - কি হলে তালেবানরা তাকে প্রোগ্রাম শুরু করতে স্বাগত জানিয়ে নিজেরাই আগিয়ে নিতে পারে, সাহায্য করতে পারে তা এসেস করা। এবং সে অনুযায়ি আগানোর রাস্তা বের করা। এই লক্ষ্যে সম্ভব প্রয়োজনীয় সবকিছু করা।
৫। যদি না তিনি আগাম জাজমেন্টাল হয়ে ধরে নেন যে তালেবান মানেই ইসলাম ধর্মের ‘পশ্চাদপদতা’ ‘কুপমন্ডুকতা’য় ডুবে থাকা কিছু ‘প্রাণী’ তবে একথা মেনে নেবার কোনই কারণ নাই যে তালেবান নেতারা তাদের সন্তানদের পোলিও ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে লুলা হয়ে আছে দেখতে পছন্দ করবে। ফলে কেন বাচ্চাদের ভ্যাকসিন নেয়া দরকার, না নিলে এর সম্ভাব্য সামাজিক ব্যক্তিগত ক্ষতি বিপদ যতটা সম্ভব পরিস্কার ও বিশ্বাসযোগ্য করে প্রচার করতে হত। কোন ওয়ার জোন নয় এমন স্বাভাবিক সমাজেও ভ্যাকসিনের পক্ষে প্রচার, সমাজে জোয়ার তোলা উদ্বুদ্ধ করার কাজটা সহজ নয়। যদি তাই হোত তাহলে তুলনামুলক ভাল অর্থনীতির ভারত বিখ্যাত সেলিব্রেটি হিরো অমিতাভ বচ্চনকে দিয়ে টিভি মিডিয়ায় ভ্যাকসিনের পক্ষে প্রচারে নামত না।
৬। এটা ঠিক যে ইউনিসেফের স্বাস্থ্যকর্মীরা সিআইএর পক্ষে গোয়েন্দাগিরির কাজ করে কি না এনিয়ে তাদের গভীর সন্দেহ,অবিশ্বাস আছে। এই সন্দেহ অবিশ্বাস দূর করতে তালেবানরা নিজেই কোন স্ক্রিনিং ও আইডেনটিফিকেশন প্রক্রিয়ার প্রস্তাব করতে পারে। এই আইডেন্টিফিকেশন প্রক্রিয়ায় ইউনিসেফের কোন কর্মী পাশ না করতে পারলে তার বদলে অন্য কাউকেও দেয়া যেতে পারত। অর্থাৎ ইউনিসেফের মুল লক্ষ্য হতে হত তালেবানদের সাথে একটা বিশ্বাসযোগ্য ও কাজের সম্পর্ক, আস্থা তৈরি করা। বলা বাহুল্য এখানে কাজের সম্পর্ক মানে এটা তালেবান রাজনীতির পক্ষে তালি বাজানো, অথবা ছলনা করে তাদের রাজনীতিকে ছদ্ম-পছন্দ দেখানো বা পিঠ চাপরানো একেবারেই নয়। বরং এটা পরিস্কার করে বলা ও রাখা যে ওয়ার জোনের কোন পক্ষের কোন রাজনীতির পক্ষেই ইউনিসেফ থাকতে পারে না, কাজ নয়। কোন রাজনীতির পক্ষে ইউনিসেফের কোন লেনাদেনা নাই, পছন্দ-অপছন্দ নাই, থাকতে পারে না। এ্টাই ইউনিসেফের ঘোষিত লক্ষ্য। এবং কাজে আচরণে ইউনিসেফ সেটা প্রমাণ করে দেখাবার সুযোগ চায়। যে কোন স্থানীয় জনগোষ্ঠির সাথে ইউনিসেফের সম্পর্ক কাজের, আস্থার, বিশ্বাসযোগ্যতার। সুনির্দিষ্ট এই ক্ষেত্রে বাচ্চাদের ভ্যাকসিন খাইয়ে রোগ প্রতিরোধক অবস্থায় রাখার পক্ষে কাজ করা – এটাই ইউনিসেফ ও স্থানীয় জনগোষ্ঠির মিলিত কমন ও একমাত্র স্বার্থ। এই ম্যাসেজ তালেবান নেতাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে উপস্থাপন ও আস্থায় নিয়ে আসা।
৭। মনে রাখতে হবে, স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস সবার আগে জাতিসংঘ বা ইউনিসেফ ভেঙ্গেছে। ওবামার রাষ্ট্রস্বার্থ বা সামরিক স্বার্থে বিশ্বাসভঙ্গ করে ছলেবলে নকল ডাক্তার দিয়ে বিন লাদেনকে ধরে মেরে মিটানো তাঁর দরকার। এতে ওবামা শান্তি পেতে পারেন। কিন্তু এতে নীট ক্ষতি জাতিসংঘের এবং গুরুত্বপুর্ণ দিকটা হলো, এতে বিশ্বাসভঙ্গের দায় ও সে কারণে সমস্ত ক্ষতি জাতিসংঘ বা ইউনিসেফের। সেটাই ঘটে গিয়েছে এবং আজকের বাস্তবতা হয়ে আছে। কারণ লাদেনকে ধরতে ফেক ডাক্তারের কথা প্রকাশ হয়ে পড়ার পর জাতিসংঘ বা ইউনিসেফের দিক থেকে দায়িত্ব নিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠানের নামে এই বদনাম কালো দাগ ধুতে তারা কিছুই করেনি। সোজা কথাটা হলো, ওবামা জাতিসংঘ বা ইউনিসেফের প্রতি যে মানুষের আস্থা বিশ্বাস ছিল তা বিক্রি করে দিয়েছে। সে হারানো ইমেজ রক্ষা, পুনরুদ্ধারে জাতিসংঘ বা ইউনিসেফে নিজের দায়িত্বে অবহেলা করেছে। নিজেকে বিক্রি হতে দিয়েছে। ঐ ডাক্তারের সাথে জাতিসংঘ বা ইউনিসেফের কোন সম্পর্ক থাকলে বা না থাকলেও নিজের ইমেজ বিক্রি হয়ে গেছে অথচ তারা চুপ থেকেছে। জাতিসংঘের ম্যান্ডেট অনুযায়ী আমেরিকার হয়ে গোয়েন্দাগিরির কাজে জাতিসংঘের নাম ইমেজ ব্যবহারের অভিযোগ একটা মারাত্মক ও কঠিনতম অভিযোগ। অথচ সে অভিযোগ থেকে নিজেকে মুক্ত ও আবার বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের কোন উদ্যোগ জাতিসংঘ বা ইউনিসেফ নেয়নি তা তো বলাই বাহুল্য। জাতিসংঘের উচিত হত খোদ ওবামার বিরুদ্ধেই জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠানের নাম, সুনাম ও ইমেজ নষ্ট করার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা। এর কিছুই তারা করেনি। তালেবানদের কোন অভিযোগকে আমলেই নেয়নি।
৮। মুল সত্য জাতিসংঘ বা ইউনিসেফ নিজ অপরাধ কর্মের কারণে আজ বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে কাতরাচ্ছে। অথচ প্রোগ্রাম বন্ধ হওয়ার জন্য তালেবানদেরকে দুষছে।
৯। এবার নিরাপত্তার দিক। সুনির্দিষ্ট করে বললে তালেবানদের অভিযোগ ও টেলিফোন হুমকি জানার পরও ঐ ছয় স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজে পাঠানোর সম্পুর্ণ (জীবনবীমা ইত্যাদির অর্থনৈতিক ও অফিসিয়াল) দায় ইউনিসেফের কান্ট্রি ডিরেকটর ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা বিভাগের। এই দায় জাতিসংঘ অফিসের এমনকি বীমা করা থাকলেও (থাকাটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক, না থাকলে সেটার দায়ও কান্ট্রি ডিরেকটরের) এর দায় বীমা কোম্পানী নিবে না।
১০। প্রত্যেক রাষ্ট্রে ইউনিসেফের মত জাতিসংঘের সব এজেন্সী অফিসগুলোর স্থানীয় ও বিদেশী কর্মীদের নিরাপত্তার দিক দেখা, মনিটর করা, মুভমেন্ট নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির কমন দায়িত্বে থাকা এক প্রতিষ্টান হলো ইউএন-ডিএসএস (ডিপার্টমেন্ট অফ সেফটি এন্ড সিকিউরিটি)। এদের লিখিত ক্লিয়ারেন্স ছাড়া কোন কর্মীর অফিসিয়াল চলাফেরা নিষিদ্ধ। বিশেষত পাকিস্তানের মত দেশে থ্রেট লেভেল যেখানে অনুমান করি সর্বোচ্চের (সর্বোচ্চ মানে ইভাকিউয়েশন বা অফিস গুটিয়ে ঐ দেশত্যাগ) একধাপ নিচে। এবং আগেই টেলিফোনে থ্রেট বা বিপদের কথা নিরাপত্তা বিভাগ সহ সকলে জানত। ফলে এই হত্যায় সবচেয়ে বেশি ডিএসএস দায়ী। আর বীমা কোম্পানী ক্ষতিপুরণ তখনই দিতে বাধ্য থাকে যখন ঘটনা পরবর্তি তদন্তে দেখা যায় আগেই প্রেসক্রাইব রুল অনুযায়ী সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা ডিএসএস নিয়েছিল এবং তার পরেও দুর্ঘটনা ঘটেছে। স্পষ্টতই এখানে দেখা যাচ্ছে ডিএসএস থ্রেট উপেক্ষা করেছে। ফলে সে দায়ী। ইসলামাবাদের কায়েদে আজম ইউনিভার্সিটির এক প্রফেসর জাফর জসপাল জানিয়েছেন, 'করাচীর মত বড় শহরে স্বাস্থ্যকর্মীরা সহজ টার্গেট, কারণ এদের নিরাপত্তা দেয়া অসম্ভব'। বলা বাহুল্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা নিয়ম ব্যবস্থা সম্পর্কে ভদ্রলোক কোন ধারণাই রাখেন না।
১১। ইউনিসেফের যে মুখপাত্র হত্যার ঘটনার ভিতর হিরোগিরি দেখেছেন, এই বক্তব্য দেবার জন্য জাতিসংঘের আভ্যন্তরীণ পরিচালনা বা ষ্টান্ডার্ড বিজনেস রুল অনুযায়ী ঐ মুখপাত্রের বরখাস্ত হওয়ার কথা এবং তা চাকরির সব বেনিফিট পাওনা ছাড়াই। কারণ,হিরোগিরি দেখানো ডিএসএস এর সিকিউরিটি গাইডলাইন অনুযায়ী অপরাধ। কর্মীদের যে কোন কাজে নামার আগে প্রথম বিবেচ্য নিজের নিরাপত্তা। নিরাপত্তার দিক উপেক্ষা করে, একশ না খাওয়া লোকের মাঝে খাদ্য বিতরণ করে তাদের জান বাচিয়ে আসলেও জাতিসংঘের ঐ কর্মীর জন্য সেটা কোন গৌরব বা হিরোগিরি তো নয়ই বরং এক বিশাল গর্হিত অপরাধ। আর এক্ষেত্রে নিজের মৃত্যুর পর তাঁর জীবনবীমার নমিনি বা উত্তরাধিকারেরা কেউ বীমা কোম্পানীর কাজ থেকে কোন ক্ষতিপুরণ পাবেন না। সিকিউরিটি গাইডলাইন ভেঙ্গে নিজেকে ও সংগঠনকে বিপদপ্রস্থ করার কারণে এই ক্ষেত্রে বীমা কোম্পানীর উপর কোন দায় বর্তাবে না। এমনকি একাজে কোন সুপারভাইজার উদ্বুদ্ধ করলে সেও অপরাধী হবে। তার বিরুদ্ধেই শৃখলাভঙ্গের ব্যবস্থায় নেয়া হবে। আর সুপারভাইজারের কথা অমান্য করলেও অমান্যকারির জন্য সেটা কোন শৃখলাভঙ্গের বা অন্য কোন অপরাধ নয়।
১২। সবশেষে, WHO এবং ইউনিসেফ যে যৌথ বিবৃতিতে দিয়েছে তাতে এটা স্পষ্ট যে তারা তালেবানরা রাজনৈতিকভাবে ভাল না মন্দ সে বিচারকের আসনে নিজেদেরকে বসিয়েছে। অন্যভাবে বললে নিজের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বিশ্বাস বা আমেরিকার রাজনীতির পক্ষে তারা অবস্থান নিয়েছে, যেটা জাতিসংঘের কোর ভ্যালুর বাইরে চলে যাওয়া, ভঙ্গ করা। কারণ চাকরিতে জয়েন করার আগেই ডিএসএস এর ওয়েব সাইটে জাতিসংঘের নিরাপত্তা ধারণা বিষয়ে পাঠ নেয়া ও অন লাইন দুটো পরীক্ষায় বসতে হয় সকল কর্মীকে ও পাশ করতে হয়। একমাত্র পাশের সার্টিফিকেট প্রাপ্তি সাপেক্ষে সে আনুষ্ঠানিকভাবে চাকরিতে যোগ দিয়েছে বলে গণ্য করা হয়। ঐ পাঠের প্রথম শিক্ষা হলো স্থানীয় কোন রাজনীতিক পক্ষের প্রতি কোন অনুরাগ বিরাগ না দেখানো, স্থানীয় কালচারাল ভ্যালুর প্রতি সেন্সেটিভ থাকা ও সম্মান করা, মাল্টিকালচারিজমের চর্চা করা ও মনে রাখা ইত্যাদি। এরা সকলে সে শিক্ষার বিপরীত আচরণ করেছেন। ফলে তালেবানদের রাজনীতির প্রতি অপছন্দ প্রকাশ দূরে থাক, যে কোন অনুরাগ-বিরাগে পক্ষাবলম্বনই বিজনেস রুল ভঙ্গ করা। এই অভিযোগে তাদের বরখাস্ত হবার কথা।
জাতিসংঘ দিন কে দিন দুনিয়ার বিবদমান পরিস্থিতিতে কোন না কোন পক্ষ নেবার কারণে এভাবে নিজেই নিজের অস্তিত্বের বিপন্ন করে তুলছে। ইতোমধ্যেই অনেক জায়গায় নিজেই আলকায়েদা বা তালেবানের টার্গেট হয়ে উঠছে। যেমন‘সন্ত্রাসবাদ’ – কাকে সন্ত্রাসবাদ বলা হবে, কোন এক্ট-তৎপরতাকে সন্ত্রাসবাদ বলা হবে, আর কাকে নয় এর কোন সংজ্ঞা নির্ধারণ ছাড়াই জাতিসংঘ ‘সন্ত্রাসবাদ’ বিরোধী অবস্থান ও প্রস্তাব নিয়েছে। বলা বাহুল্য এই ‘সন্ত্রাসবাদ’ মানে ইসলামী রাজনীতির আলকায়েদা ফেনোমেনা। কিন্তু সংজ্ঞা নির্ধারণ ছাড়া ঐ প্রস্তাব বাস্তবায়ন ও ব্যবহার করা কঠিন ছিল। আবার সংজ্ঞা নির্ধারণও তার চেয়ে কঠিন। কারণ, পশ্চিমাদেশের স্বার্থ বা আমেরিকান এমপায়ারের বিরুদ্ধে যে কোন প্রতিরোধ যুদ্ধ তা সে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী যুদ্ধ অথবা ইসলাম বনাম ক্রসেডার-জায়নিস্ট মিত্রশক্তি্র যুদ্ধ যে নামেই ডাকা হোক না কেন – একে বিপরীত পক্ষ “সন্ত্রাসবা্দী” তৎপরতা হিসাবে বয়ান তৈরি করেই লড়বে। এক পক্ষের কাছে যা আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিরোধ যুদ্ধ বিপরীত পক্ষের কাছে তা ‘সন্ত্রাসবাদ’। আবার পশ্চিমের সাবধান হবার ব্যাপারও আছে। কারণ, আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিরোধ যুদ্ধ জাতিসংঘ ন্যায্য বলে স্বীকার করতে বাধ্য এজন্য যে এটাই জাতিসংঘের জন্মের ম্যান্ডেট ও ভিত্তি। ফলে ‘সন্ত্রাসবাদের” সংজ্ঞা হাজির করতে গেলে তা বুমেরাং হবার সম্ভাবনা ছিল। তাই সবদিক থেকে বাঁচতে কোন সংজ্ঞা বা ক্রাইটেরিয়া ছাড়াই ‘সন্ত্রাসবাদী’ সংগঠনের এক তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। ঐ তালিকায় নাম থাকা সাপেক্ষে জাতিসংঘের প্রস্তাব বাস্তবায়নের করণীয় সচল ও সম্পন্ন করা হয়। এসবের অনেক আগেই আমেরিকান রাষ্ট্রও ‘সন্ত্রাসবাদ’ এর বিপক্ষে আইন পাশ করেছে আর তাদেরও এক তালিকা প্রস্তুত করা আছে, ঐ তালিকায় নাম থাকা সাপেক্ষে নিজ রাষ্ট্রের অবস্থান করণীয়, আইনের বাস্তবায়নের ভিত্তি মনে করা হয়। তবে আমেরিকান তালিকা আর জাতিসংঘের তালিকা হুবহু এক নয়। যেমন হিজবুল্লাহ আমেরিকান তালিকায় আছে জাতিসংঘের তালিকায় নাই। উপরে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হিজবুল্লাহ প্রতিরোধ যুদ্ধের কথা টেনে জাতিসংঘের মধ্যস্থতার কথা বলেছিলাম। জাতিসংঘের মধ্যস্থতার ঐ ভুমিকা নেয়া সম্ভব হয়েছিল কারণ প্রতিরোধ যোদ্ধা হিজবুল্লাহরা জাতিসংঘের ‘সন্ত্রাসবাদী’ তালিকায় নাই। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কমিউনিজম আমেরিকান আইনে ‘সন্ত্রাসবাদী’ কাজ বলে চিহ্নিত হয়েছিল কিন্তু এসত্ত্বেও জাতিসংঘের কমিউনিজমের বিপক্ষে কোন ‘সন্ত্রাসবাদী’ তালিকা বা অবস্থান ছিল না। কিন্তু এবার আমেরিকা নিজ রাষ্ট্রীয়স্বার্থ সহজেই জাতিসংঘের কাঁধে সওয়ার করতে পেরেছে। সম্ভবত এবারে তথাকথিত “সন্ত্রাসবাদী” বলে যাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়েছে এরা কেউই ষ্ট্রেট এক্টর বা কোন রাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব করে না। ফলে জাতিসংঘের সদস্য তাদের নাই বা জাতিসংঘে তাদের কোন ধরণের প্রতিনিধিত্বের বালাই নাই। তাই সহজেই জাতিসংঘকে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিম নিজেদের এজেন্ডা স্বার্থে ব্যবহার করেছে, জাতিসংঘের কাঁধে সওয়ার করতে সফল হয়েছে। কিন্তু ফলাফলে এতে খোদ জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠানটাকেই অস্তিত্বের সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। নীট ক্ষতি হয়েছে প্রতিষ্ঠানটার। এভাবে বিবাদে পক্ষভুক্ত হয়ে জাতিসংঘ আগামি দিনে সম্ভাব্য মধ্যস্ততাকারির কোন ভুমিকা নেবার শর্ত নিজেই ক্রমশ মুছে ফেলছে। ওদিকে মানি লন্ডারিং ইস্যুতেও জাতিসংঘ নিজেকে প্রধান বাস্তবায়নকারী সংস্থার ভুমিকায় নিয়ে একইভাবে নিজেকে সব পক্ষের কাছে নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসাবে অগ্রহণযোগ্য করে ফেলেছে। অবস্থা দাড়িয়েছে এমন ভুমিকা ক্রমশ ক্ষীণ ও সীমিত হয়ে এলেও কফি আনানই সম্ভবত আমাদের দেখা শেষ সেক্রেটারি জেনারেল। এভাবে চলতে থাকলে দুনিয়ায় বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে একদিন যেমন জাতিসংঘের আবির্ভাব ঘটেছিল ঠিক তেমন ভাবেই এই প্রতিষ্ঠানের বিলোপ ঘটবে। বদলে যাওয়া সে পরিস্থিতিতে খোলনলচে বদল ঘটিয়ে জাতিসংঘ এর আদলে নতুন কোন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আসন্ন হয়ে উঠবে, বলাই বাহুল্য।
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×