somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রবিউল আওয়াল প্রসঙ্গ

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ৯:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রবিউল আওয়াল প্রসঙ্গ
প্রতি বছর রবিউল আওয়াল মাস আসলেই আমাদের সমাজে মীলাদুন্নবী (সা.) এবং সীরাতুন্নবী (সা.) ইত্যাদি শিরোনামে মাহফিল, জলসা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের ধুম পড়ে যায়। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনী আলোচনা একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ ইবাদত ও ঈমানের প্রাণ।
রাসূল (সা.) এর জন্ম, শৈশব, কৈশোর, যৌবন, নবুওয়ত লাভ, দাওয়াত, জিহাদ, যিকির ও ফিকির, ইবাদত ও বন্দেগী, আখলাক-চরিত্র ও আচার-আচরণ, যুহদ ও তাকওয়া, উঠা, বসা, চলা-ফেরা, শয়ন ও জাগরণ, আকার-আকৃতি, অবয়ব-গঠন, রাগ ও দয়া, হাসি ও কান্না ইত্যাদি- এক কথায় তাঁর (সা.) এর সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়ই উত্তম আদর্শ ও হিদায়াতের নমুনা।
অতএব এসব বিষয়ের শিক্ষা গ্রহণ করা, শিক্ষা দেওয়া, পারস্পরিক আলোচনা করা এবং অন্যদেরকে এর প্রতি আহবান করা উম্মতের কর্তব্য ও গুরু দায়িত্ব।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের সমাজে এসব গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়াবলীকে শুধু রবিউল আওয়াল মাসের সাথে; বরং বলা চলে শুধু মাত্র বারই রবিউল আওয়ালের সাথে খাস করে নেওয়া হয়েছে। তাও আবার কেবল আনুষ্ঠানিকতাই সীমাবদ্ধ। এর অন্তর্নিহিত লক্ষ-উদ্দেশ্য অর্জনের কোন চিন্তা-ভাবনা করা হয় না। ইত্তেবায়ে সুন্নত তথা রাসূল (সা.) এর সীরাত ও আদর্শের অনুসরন করার কোন গরজই দেখা যায় না। নিজেকে আশেকে রাসূল প্রমাণিত করার জন্যই এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে ও তাতে অংশ গ্রহণ করতে দেখা যায়। অথচ এসব অনুষ্ঠানের সাথে নবী করীম (সা.) এর সুন্নতের কোন মিল নেই। সবচেয়ে বড় দুঃখজনক বিষয় হল এসব অনুষ্ঠান করতে গিয়ে রাসূল (সা.) এর নামে এমন সব মিথ্যা ও জাল হাদিস বর্ণনা করা হয়, নির্ভরযোগ্য হাদিসের কিতবসমূহে এসব আজগুবী কিসসা-কাহিনীর নামগন্ধ পর্যন্ত নেই। রাসূল (সা.) এর জন্ম তারিখের ঐতিহাসিক বর্ণনাসমূহের সাথেও এসব অনুষ্ঠানের তেমন সামঞ্জস্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না। সামনে এ বিষয়গুলো নিয়ে সংক্ষেপে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করার চেষ্টা করব। আল্লাহই উত্তম সাহায্যকারী।
মহানবী (সা.) এর জন্মের পূর্বাভাষ
‎নিঃসন্দেহে মানবতার মুক্তির দূত, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহা মানব, সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর শুভ জন্ম একটি বরকতময় ও মহিমান্বিত অবিস্মরণীয় ঘটনা। মহানবী (সা.) এর জন্মের বহু পূর্ব থেকেই আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন পৃথিবীতে এমনসব অলৌকিক ঘটনার জন্ম দিতে থাকেন যদ্বারা পৃথিবী বাসী তাঁর (সা.) এর জন্মের পূর্বাভাষ পেতে থাকে।
কা’বা শরীফকে নিশ্চি‎হ্ন করতে আসা হস্তি বাহিনীকে এক দল ছোট পাখি দিয়ে অলৌকিকভাবে ধ্বংস করণ, (সূরায়ে ফীল) মা আমেনার গর্ভ ধারণকালে স্বপ্নের মাধ্যমে তাঁকে মানব জাতির শ্রেষ্ঠতম সন্তানের সুসংবাদ দান, (ইবনে হিশাম ১/১৬৪) বিভিন্ন ইয়াহুদী পন্ডিতগণের সন্দেহাতীতভাবে শেষ নবীর সুসংবাদ প্রদান ও মহরে নবুওয়াত দিয়ে তাঁকে জন্মের পরই চিহ্নিত করণ, (আল মাওয়াহিবুল্লাদুনিয়্যা -১/১২৭, ১৩০) এবং খতমে নবুওয়াতের আলামতসহ জন্ম গ্রহণ, (বিদায়া-২/২৪৮) ইত্যাদি বহু নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত অলৌকিক ঘটনা দ্বারা শিশু মুহাম্মদের জন্মের বিশেষ বৈশিষ্ট ও তাৎপর্য ফুটে উঠে। যা দেখে তখনকার বিশিষ্ট জন জ্ঞানী-গুণী পন্ডিত ব্যক্তিবর্গ তাঁকে নিঃসন্দেহে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব ও সর্বশেষ নবী হিসেবে চিহ্নিত করতে একটুও সংশয়ে পড়তে হয়নি।
তাইতো জন্মের পরপরই সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হিসেবে তাঁকে চিহ্নিত করেন তাঁরই পিঠে অবস্থিত মহরে নবুওয়াত দেখে মক্কায় অবস্থান রত এক ইয়াহুদী পন্ডিত। (আল মাওয়াহিবুল্লাদুনিয়্যা-১/১৩০)
জন্ম তারিখ নিয়ে মতপার্থক্যের কারণ
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্মের বিষয়টি এত পরিষ্কার ও সুনিশ্চিতভাবে জানতে পেরেও তখনকার কোন লোক তাঁর জন্মের তারিখটি সুনিশ্চিতভাবে কোথাও উল্লেখ করেননি। এ সম্পর্কে হযরত (সা.) এর শ্রদ্ধেয়া মাতা হযরত আমেনা বা সম্মানিত দাদা আব্দুল মুত্তালিব বা অন্য কোন নিকটাত্মীয় থেকেও কোন বর্ণনা পাওয়া যায়না। তখনকার কোন ঐতিহাসিকও হযরত (সা.) এর জন্মের তারিখটি কোন গ্রন্থে লিখে রাখার গরজ বোধ করেননি। আর তখনকার যুগে কোন গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়ও লিখে রাখার তেমন প্রচলন ছিল না।
সংগত কারণেই পরবর্তী ঐতিহাসিকগণ যারা হযরত (সা.) এর জন্মের তারিখ নির্দিষ্ট করার চেষ্টা করেছেন তাদেরকে অনেকটাই হিসাবের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। বিভিন্ন বিষয় ও ঘটনাবলীর হিসাব মিলিয়ে তারা রাসূল (সা.) এর জন্মের তারিখ নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন। আর এসব হিসাবের ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই নিজ নিজ জ্ঞানের পরিধি অনুযায়ী কথা বলেছেন। তাইতো রাসূল (সা.) এর জন্মের তারিখের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বর্ণনাসমূহের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। জন্মের বছর, মাস ও তারিখ প্রতিটি বিষয় নিয়েই রয়েছে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বন্ধ ও মতপার্থক্য। নিম্নে এ সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোকপাত করা হলো।
প্রিয় নবীজী (সা.) এর জন্মের বছর
হযরত রাসূলে কারীম (সা.) কোন্ বছর জন্ম গ্রহণ করেন এ সম্পর্কে বর্ণনাগুলোর মধ্যে সামান্য মতপার্থক্য দেখা যায়। কোন বর্ণনায় এসেছে যে, হযরত (সা.) হস্তি বাহিনীর ঘটনার দশ বছর পর জন্ম গ্রহণ করেছেন। আর কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি উক্ত ঘটনার পনের বছর পূর্বে জন্ম গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এসব বর্ণনার কোনটিই সঠিক নয়।
এ ব্যাপারে সঠিক মত হলো এই যে, তিনি (সা.) হস্তি বাহিনীর ঐ ঘটনার বছরই ঘটনার ৫০/৫৫ দিন পর জন্ম গ্রহণ করেন। কোন কোন আলেম এ মতের উপর সমস্ত ঐতিহাসিকগণের ঐক্যমত হওয়ার কথাও বর্ণনা করেছেন। (আল মাওয়াহিবুল্লাদুনিয়্যা-১/১৩৯, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা-১/২০)
এ সম্পর্কে তিরমিযী শরীফে বর্ণিত আছে,
عن قيس بن مخرمة قال : ولدت أنا ورسول الله صلى الله عليه و سلم عام الفيل.
হযরত কাইস ইবনে মাখরামাহ (রা.) বলেন, “রাসূল (সা.) এবং আমি হস্তি বাহিনীর ঘটনার বছর জন্ম গ্রহণ করি।”
(তিরমিযী শরীফ-২/২০৩)
তিরমিযী শরীফ ছাড়াও হাদিসটি আরো উল্লেখ আছে মুসনাদে আহমদ-২৯/৪২২, সীরাতে ইবনে হিশাম-১/১৬৭, তারীখে কাবীর-৭/১৪৫ ও তারিখে দিমাশক-৩/৭৩ ইত্যাদি গ্রন্থসমূহে।
অতএব হস্তি বাহিনীর ঘটনার বছরই রাসূল (সা.) জন্ম গ্রহণ করেন এ কথা মোটামোটিভাবে নিশ্চিত করেই বলা যায়।
রাসূল (সা.) এর জন্মের মাস
রাসূল (সা.) কোন মাসে জন্ম গ্রহণ করেন এ সম্পর্কেও ঐতিহাসিকগণের মধ্যে কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। তারিখে দিমাশকের এক বর্ণনানুযায়ী তিনি রমাযান মাসের ১২ তারিখ জন্ম গ্রহণ করেন। (তারিখে দিমাশক-৩/৭০)
তবে বিশিষ্ট হাদিস বিশারদ ইমাম যাহাবী রহ. (মৃত-৭৪৮ হিজরী) এ বর্ণনাটিকে অগ্রহণযোগ্য বলেছেন। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা-১/১৯)
অন্য এক বর্ণনা মতে তিনি সফর মাসে জন্ম গ্রহণ করেন। কেও রবিউল আখার মাসের কথাও বলেছেন। (সীরাত বিশ্বকোষ-৪/২১০)
কিন্তু এ বর্ণনাগুলো নিতান্তই দুর্বল।
এ ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য মত এটিই যে, রাসূল (সা.) রবিউল আওয়াল মাসে জন্ম গ্রহণ করেন। এটিই অধিকাংশ উলামায়ে কোরামের মত। (সীরাতে ইবনে হিশাম-২১৩, তারিখে ইবনে আসাকির-৩/৭৩, ইবনে সা’দ-১/১০০, ওয়াফাউল ওয়াফা-৮৬, আল মুন্তাযাম-২/২৪৫, রাহীকুল মাখতূম-৬১)
রাসূল (সা.) এর জন্মের তারিখ
রবিউল আওয়াল মাসের কত তারিখ রাসূল (সা.) জন্ম গ্রহণ করেন এ বিষয়টি নিয়ে ঐতিহাসিক আলেমগণ ও মুহাদ্দিসগণের মধ্যে যথেষ্ট মত পার্থক্য রয়েছে। আল্লামা ইবনে আব্দুল র্বার (রহ.) ‘আল ইস্তী’আব’ কিতাবে বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা.) রবিউল আওয়াল মাসের ২ তারিখ জন্ম গ্রহণ করেন।
(আল বিদায়া-১/২৪২, সীরাত বিশ্বকোষ-৪/২১০)
ঐতিহাসিক আবূ মা’শার আল মাদানীও এই মতের প্রবক্তা ছিলেন।
(তারিখে দিমাশক-৩/৭০)
আল্লামা আবুল হাসান মুহাম্মদ ইবনে আহমদ রাসূল (সা.) এর জন্ম ৮ই রবিউল আওয়াল বর্ণনা করেন। (আল মুন্তাযাম-২/২৪৫)
আল বিদায়া গ্রন্থে ইবনে কাছীর (রহ.) রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্ম সম্পর্কিত সূদীর্ঘ আলোচনার পর উপসংহারে বর্ণনা করেছেন যে, এ প্রসঙ্গে বিশুদ্ধতম ও সঠিক মত হল ৮ই রবিউল আওয়াল। ইমাম মালেক (রহ.), আকীল (রহ.) এবং অন্যান্য বিজ্ঞজন ইমাম যুহরী (রহ.) হতে এটি বর্ণনা করেন। ইবনে আব্দুল র্বার (রহ.) প্রখ্যাত ঐতিহাসিকদের উদ্বৃতি উল্লেখ করে বলেন, তারা এ মতকে বিশুদ্ধ মনে করেন। (আল বিদায়া-১/২৪২-২৪৩, সীরাত বিশ্বকোষ-৪/২০৯)
ক্বাযী সুলায়মান মনসুরপুরী (রহ.) এর গবেষণানুযায়ী ৯ই রবিউল আওয়াল মোতাবেক ২০/২২ এপ্রিল রাসূল (সা.) এর জন্ম।
(রহমতুল লিল আলামীন-১/৩৮, আর রাহীকুল মাখতূম- ৬১)
হিফযুর রহমান সীওয়াহারবী উল্লেখ করেন যে, মাহমুদ পাশা ফালাকী কনষ্টানটিনোপল এর একজন প্রসিদ্ধ ও খ্যাতনামা জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি তাঁর গবেষণার আলোকে এ কথা প্রমাণে সচেষ্ট হয়েছেন যে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্ম হতে তার সময় পর্যন্ত সংঘটিত সবগুলি সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণের নিখুঁত হিসাব করলে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলে কারীম (সা.) এর শুভ জন্ম তারিখ ১২ রবিউল আওয়াল হতে পারে না। বরং উহা ৯ রবিউল আওয়াল। ইবনে হাজার আসকালানী (রহ:) ও শায়খ বদরুদ্দীন আয়নী (রহ.) প্রমূখ উলামার এটিই অভিমত।
(কাসাসুল কুরআন- ৪/২৫৩-২৫৪,সীরাত বিশ্বকোষ-৪/২০৮-২০৯)
ইমাম আবু জা’ফর আল বাকির (রহ:) এর বর্ণনা মতে রাসূল (সা.) এর জন্ম ১০ই রবিউল আওয়াল। (তাবাকাতে ইবনে সা’দ:১/১০০,তারীখে ইবনে আসাকির-৩/৭৫,আল-ওয়াফাউল ওয়াফা-৮৬)
আল্লামা ইবনুল জাওযী (রহ:) ১১ই রবিউল আওয়াল এর একটি মতের কথাও উল্লেখ করেছেন। (আল-মুন্তাযাম-২/২৪৫)
তবে ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক এর মত হলো রাসূল (সা.) এর জন্ম তারিখ ১২ই রবিউল আওয়াল। (সীরাতে ইবনে হিশাম-১/৮২,তারীখে ইবনে আসাকির-৩/৭৩,আল-বিদায়া-২/২৪২)
ইবনে ইসহাকের এমতটি সাধারণ জনগণের নিকট অধিক প্রসিদ্ধ হলেও মুহাক্কিক উলামায়ে কেরাম এটি গ্রহণ করেননি।
কোন কোন ঐতিহাসিক ১৭ই রবিউল আওয়াল আবার কেহ ১৮ই রবিউল আওয়াল আর কেহ কেহ ২২শে রবিউল আওয়াল কেও রাসূল (সা.) এর জন্ম তারিখ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। (সীরাত বিশ্বকোষ-৪/২১০)
রাসূল (সা.) এর জন্ম তারিখ সম্পর্কে পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ এতগুলি বর্ণনা (২/৮/৯/১০/১১/১২/১৭/১৮/২২ রবিউল আওয়াল) এটাই প্রমাণ করে যে, এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট করে কোন একটি তারিখ ঠিক করা দুষ্কর। তবে মুহাক্কিক আলেমগণের তাহকীক অনুযায়ী-৮ বা ৯ ই রবিউল আওয়াল এর মতটিই অধিক প্রাধান্য পায়।
কিন্তু ১২ই রবিউল আওয়ালের মতটি যে কেন এত প্রসিদ্ধি পেল তা বোধগম্য নয়। সম্ভবত ৬০৪ হিজরী থেকে ইরবিল দেশের বাদশাহ মুজাফফরুদ্দীন কোকবুরীর মীলাদ মাহফিল পালনকে কেন্দ্র করে এমতটি জন সাধারণের নিকট প্রসিদ্ধ হয়ে যায়। তবে রাসূল (সা.) এর জন্ম তারিখে মতানৈক্য থাকার কারণে ঐ অনুষ্ঠানও এক বছর ১২ তারিখ আরেক বছর ৮ তারিখ পালন করা হত।
কিন্তু আমাদের দেশের একশ্রেণীর নামধারী সুন্নী লোক জন ১২ই রবিউল আওয়ালে ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করার দ্বারা মনে হয় এ তারিখের ব্যাপারে তাদের নিকট ওহী এসেছে। অথচ রাসূল (সা.) এর জন্ম তারিখ সম্পর্কে কুরআন, হাদিসের কোথাও সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। সংগত কারণেই বিষয়টি সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি হয়।
তাই প্রকৃত অর্থে রাসূল (সা.) এর জন্ম তারিখে যদি ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন করতে হয়, তবে এসম্পর্কে ইতিহাসের কিতাব সমূহে বর্ণিত প্রতিটি তারিখেই ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করা উচিৎ। অথচ তখন বিষয়টি খেলনার বস্তুতে পরিণত হবে। কারণ একই ব্যাক্তির জন্ম দিবস তো এতগুলো হতে পারেনা। আসল কথা হলো যেহেতু ইসলামী শরীয়তে কারো জন্ম দিবস বা ঈদে মীলাদ পালন করার কোন সুযোগ নেই তাই রাসূল (সা.) এর জন্ম তারিখটিও সুনির্দিষ্ট করে কোথাও বলা হয়নি।
তবে এসম্পর্কে যে ইসলামী শরীয়ত কোন দিক নির্দেশনা দেয়নি তা কিন্তু নয়। অবশ্যই ইসলামী শরীয়তে মানব জীবনের প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা রয়েছে। এ সম্পর্কে দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে অধ্যায়নকালে অধমের লিখিত একটি ফাতাওয়া পাঠকবৃন্দের জ্ঞাতার্থে উল্লেখ করা হল।

একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ ফাতাওয়া
প্রশ্ন
১। বিদ্আত কাকে বলে ও এর হুকুম কি? বিদআত চিনার উপায় কি? এবং কোন বিষয়ে সন্দেহ হলে করণীয় কি?
২। মাহফিলে মীলাদ ও তাতে কিয়াম করার বিধান কি? এটা কখন থেকে চালু হয় এবং এর ইতিহাস কি?
জনাব মুফতি সাহেব হুজুরের কাছে আবেদন এই যে, উক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে সঠিক শরয়ী সমাধান দিয়ে আমাদেরকে রাহনুমায়ী করবেন।

নিবেদক
এখলাসপুর এলাকাবাসী
বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী
শরয়ী সমাধান
حامدا و مصليا و مسلما، اما بعد۔
১নং প্রশ্নের উত্তর:-
বিদআত এর পরিচয়
আভিধানিক অর্থে প্রত্যেক নতুন বিষয়কে বিদআত বলা হলেও ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় ঐসব নতুন বিষয়কে বিদআত বলে যা দ্বীন ও ধর্ম মনে করে করা হয়। অথচ ইসলামী শরীয়তে এর কোন প্রমাণ নেই।
অর্থাৎ শরীয়তের চার দলীল কুরআন, হাদিস ইজমা এবং কিয়াসে যে সব বিষয়ের কোন ভিত্তি নেই; অথবা ইসলামের প্রথম তিন স্বর্ণ যুগে (সাহাবা, তাবেঈন ও তাবে’-তাবেঈনের যমানায়) যে বিষয়কে দ্বীন বা সওয়াবের কাজ মনে করে করা হয়নি; এসব বিষয়কে ধর্মীয় কাজ বা সওয়াবের কাজ মনে করে করার নাম বিদআত।


এ প্রসঙ্গে হাফেয ইবনে রজব (রহ.) “জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম” গ্রন্থে লিখেন:-
و المراد بالبدعة ما احدث مما لا أصل له في الشريعة يدل عليه و أما ما کان له أصل من الشرع يدل عليه فليس ببدعة شرعا و إن کان بدعة لغة۔
)جامع العلوم و الحکم صفحه ۱۹۳ بحواله راه سنت صفحه ۷۷۔(
অর্থ:- বিদআত ঐ নতুন বিষয়কে বলে যার প্রামাণ্য কোন ভিত্তি শরীয়তে নেই। আর যে নতুন বিষয়ের কোন প্রামাণ্য ভিত্তি শরীয়তে পাওয়া যায় তাকে শরয়ী বিদআত বলে না, যদিও আভিধানিক অর্থে তাকেও বিদআত বলা হয়।
আল্লামা সা’দুদ্দীন তাফতাযানী (রহ.) মৃত: ৭৯২ হিঃ তাঁর “শরহুল মাক্বাসিদ” গ্রন্থে উল্লেখ করেন:-
إن البدعة المذمومة هو المحدث في الدين من غير أن يکون في عهد الصحابة و التابعين ولادل عليه الدليل الشرعي۔
(شرح المقاصد جلد ۲ صفحه ۲۷۱ بحوالهء راه سنت صفحه ۸٤)
অর্থ: নিন্দনীয় বিদআত হলো ধর্মীয় ব্যাপারে কোন নবআবিষ্কৃত বিষয় যা সাহাবা ও তাবেঈনের যমানায় ছিলো না এবং এর পক্ষে শরয়ী কোন প্রমাণও নেই।
বিদআতের হুকুম
বিদআত অত্যন্ত মারাত্মক গোনাহ। কেননা এটি হলো ইসলামী শরীয়তে পরিবর্তন বা পরিবর্ধন। এর দ্বারা দ্বীনের আসল রূপ-রেখা বদলে যায়। ফলে সত্য-মিথ্যা ও হক এবং বাতিলের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। মানুষ মিথ্যা ও বাতিল কাজটিকেই সহিহ্ ও হক এবং সওয়াবের কাজ মনে করে করতে থাকে। ফলে এ থেকে তাওবা করারও সুযোগ হয় না। তাই এটি মানুষকে ধোকা দেয়ার জন্যে শয়তানের এক বড় হাতিয়ার। শয়তান মানুষকে এর দ্বারা খুব সহজেই পথভ্রষ্ট করতে পারে। কাল কেয়ামতের ময়দানে বিদআতী লোকেরা অনেক আশা-ভরসা নিয়ে উঠবে। তাদের ধারণানুযায়ী কৃত সৎকর্মের পুরস্কার লাভের আশায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এরাই হবে সবচে’ বেশী ক্ষতিগ্রস্ত। তারা সেদিন তাদের কৃত সব আমলকে বৃথা এবং নিষ্ফল দেখতে পাবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন:-
قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا (১০৩) الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا (১০৪)
অর্থ:- বলুন, আমি কি তোমাদেরকে সে সব লোকের সংবাদ দেব, যারা কর্মের দিক দিয়ে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত? তারাই সে লোক, যাদের পার্থিব জীবনের প্রচেষ্টা পন্ড হয়। অথচ তারা মনে করে যে, তারা সৎকর্ম করছে।
অতএব বিদআত হলো মিথ্যাকে সত্য, বাতিলকে হক ও গোনাহ্র কাজকে সওয়াব মনে করা, যা ইসলামী শরীয়তে একটি জঘন্যতম অপরাধ। শয়তান এর দ্বারাই মানুষকে বেশী পথভ্রষ্ট করে। কাল কেয়ামতের মাঠে এই বিদআতী কর্ম কান্ডের কারণেই মানুষ সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাইতো মানবতার মুক্তির দূত, বিশ্ব জাহানের করুণার আঁধার হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিদআত ও বিদআতী সম্পর্কে উম্মতকে এত বেশী সতর্ক করেছেন যা শিরক ব্যতীত হয়ত অন্য কোন গোনাহ থেকে করেননি। নিম্নে এ সম্পর্কে কতিপয় সহিহ্ হাদিস পেশ করা হলো-
قال رسول الله صلي الله عليه و سلم أَمَّا بَعْدُ فَإِنَّ خَيْرَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللَّهِ وَخَيْرُ الْهُدَى هُدَى مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الْأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ .
(مسلم شريف صفحه ۔۲۸۵۔۲۸٤جلد ۱،(
و في رواية النسائي وکل ضلالة في النار.
(نسائي شريف جلد۱ صفحه ۱۷۹)
অর্থ:- নবী করীম (সা.) এরশাদ করেন: জেনে রাখ, সর্বোত্তম বর্ণনা হলো আল্লাহর কিতাব পবিত্র কুরআন। সর্বোত্তম আদর্শ হলো মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শ। আর সর্বনিকৃষ্ট কাজ হলো বিদআত তথা নবআবিষ্কৃত বিষয়সমূহ। প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী। আর প্রত্যেক গোমরাহীই জাহান্নামে নিয়ে যাবে।
قال رسول الله صلي الله عليه و سلم من أحدث فيها حدثا أو أوي محدثا فعليه لعنة الله و الملئکة و الناس أجمعين۔ لا يقبل منه صرف و لا عدل- (بخاري شريف جلد۱ صفحه ۲۵۱)
অর্থ: রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি মদিনা শরীফে কোন বিদআত আবিষ্কার করবে অথবা কোন বিদআতীকে আশ্রয় দিবে তার উপর আল্লাহর লা’নত ও ফিরিশতাগণের লা’নত এবং সমস্ত মানব জাতির লা’নত। তার থেকে ফরয বা নফল কোন এবাদতই কবুল করা হবে না।
উল্লেখ্য যে, বিদআত কাজ সব জায়গায় অপরাধ, তবে পবিত্র নগরী মদিনাতে এহেন কাজ করার দ্বারা অপরাধের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। কেননা এ নগরী হলো হিদায়াত ও সুন্নতের আলো বিচ্ছুরিত হওয়ার নগরী।
قال رسول الله صلي الله عليه و سلم أبي الله أن يقبل عمل صاحب بدعة حتي يدع بدعته۔ (إبن ماجه صفحه ٦)
অর্থ:- রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহ্ তায়ালা বিদআতীর কোন আমল কবুল করা থেকে অস্বীকার করেছেন, যে পর্যন্ত সে তার বিদআত ছেড়ে না দেয়।
قال رسول الله صلي الله عليه و سلم من وقر صاحب بدعة فقد أعان علي هدم الإسلام (شعب الإيمان للبيهقي جلد ۷ صفحه ٦۱ رقم الحديث ۹٤٦٤)
অর্থ:- রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোন বিদআতীর সম্মান দেখাল, সে যেন দ্বীন ইসলামকে ধ্বংস করতে সহযোগীতা করল।
বিদআত ও বিদআতীর নিন্দা ও তা থেকে সতর্ক করে রাসূল (সা.) প্রিয় উম্মতকে অনেক কথা বলে গেছেন, হাদিসের কিতাবসমূহ থেকে যদি শুধু এ বিষয়ের হাদিসকে একত্রিত করা হয় তবে এক বিশাল ভান্ডার জমা হয়ে যাবে। তবে হক পিপাসুদের জন্যে যা উল্লেখ করা হয়েছে তাই যথেষ্ট। অতএব প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য হলো সর্বপ্রকার বিদআতী কর্মকান্ড থেকে নিজেকে দূরে রাখা। নিজের ঈমান ও আমল হেফাজত করা। পরকালের জীবনের চরম ক্ষতি থেকে নিজেকে রক্ষা করা। আল্লাহপাক আমাদের সকলকেই তাওফিক দান করুন! আমীন!!
বিদআত নির্ণয়ের মানদন্ড
প্রশ্ন:-অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, কোন একটি বিষয় বিদআত হওয়া ও না হওয়ার মধ্যে আলেমগণের ইখতিলাফ হয়। উভয় পক্ষই কুরআন-হাদিস থেকে দলীল প্রমাণ উপস্থাপন করে। এক্ষেত্রে বিদআত নির্ণয়ের সঠিক মানদন্ড কি?
উত্তর:-একথায় কোন সন্দেহ নেই যে, প্রত্যেক বাতিল ফিরকাই; চাই তা কাদিয়ানী হোক বা রাফেজী, নাস্তিক হোক বা বিদআতী; নিজ নিজ দাবীর পক্ষে কুরআন-হাদিস থেকে কিছু দলীল দেয়ার চেষ্টা করে। তাই এক্ষেত্রে কোন বিষয়ের চূড়ান্ত ফয়সালার একমাত্র সঠিক মানদন্ড হলো তা’আমুলে সালফে সালেহীন। অর্থাৎ ইসলামের প্রথম তিন স্বর্ণ যুগ সাহাবা, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনের আমল। এই তিন যুগই হলো সুন্নত-বিদআত পার্থক্য করার মানদন্ড। সুতরাং যে কাজটি ঐ যুগে করার মত পরিবেশ-পরিস্থিতি ও কারণ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা দ্বীন মনে করে করেননি, এমন কাজকে পরবর্তীতে দ্বীন মনে করে সওয়াবের উদ্দেশ্যে করাই হলো বিদআত।
এ প্রসঙ্গে এক হাদিসের বর্ণনায় এসেছে
عن العرباض بن سارية قال وعظنا رسول الله صلي الله عليه و سلم موعظة ذرفت منها العيون و وجلت منها القلوب، قلنا يا رسول الله، إن هذه لموعظة مودع، فماذا تعهد إلينا، قال׃قد ترکتکم علي البيضاء ليلها کنهارها، لا يزيغ عنها بعدي إلاهالک، و من يعش منکم فسيري إختلافا کثيرا، فعليکم بما عرفتم من سنتي و سنة الخلفاء الراشدين المهديين، و عليکم بالطاعة و إن عبدا حبشيا عضوا عليها بالنواجذ، فإنما المؤمن کالجمل الأنف حيثما أنقيد انقاد۔ (مسند الإمام احمد بن حنبل جلد۲۸ صفحه ۳٦۷ رقم الحديث ۱۷۱٤۲)
অর্থ:- হযরত এরবায ইবনে সারিয়া (রা.) বর্ণনা করেন যে, একদা রাসূল (সা.) আমাদেরকে এমন ওয়াজ করলেন যার কারণে চক্ষু থেকে অশ্র“ প্রবাহিত হলো, এবং অন্তর সমূহ ভীতসন্ত্রস্ত হলো। আমরা বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! এটি তো বিদায়ী ভাষণ। অতএব আপনি আমাদেরকে কিসের ওসিয়ত করেন? তখন রাসূল (সা.) বললেন, আমি তোমাদেরকে ছেড়ে যাচ্ছি এমন সাদা স্পষ্ট ময়দানে যার রাত্র ও দিন সমান। আমার পরে এখান থেকে কেউ বিচ্যুত হবে না কেবল ধ্বংসপ্রাপ্ত ছাড়া। আর আমার পরে যারা জীবিত থাকবে তারা অনেক মতানৈক্য দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নত ও আমার হিদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নতকে আঁকড়িয়ে ধরবে। আর তোমরা (আমীরকে) অনুসরণ করবে যদিও সে একজন হাবশী গোলাম হয়। একথা গুলোকে দাঁত দিয়ে আঁকড়িয়ে ধর কেননা মুমিন হলো লাগাম লাগানো উটের ন্যায়। তাকে যেদিকেই নেয়া হয় সেদিকেই যায়।
অন্য এক বর্ণনায় রাসূল (সা.) বলেনÑ
خير أمتي قرني ثم الذين يلونهم ثم الذين يلونهم۔
(بخاري شريف جلد۱ صفحه ۵۱۵)
অর্থ:- আমার উম্মতের সর্বোত্তম যুগ হলো আমার যুগ, অতঃপর তাদের সাথে মিলিত পরবর্তী যুগ, অতঃপর তাদের সাথে মিলিত পরবর্তী যুগ।
এ ধরণের সহিহ্ হাদিসের বহু বর্ণনা থেকে স্পষ্ট হয় যে, সাহাবা, তাবেঈ এবং তাবে’ তাবেঈগণের আমল ইসলামী শরীয়তের দলীল। এবং যে কোন বিষয়ের সুন্নত ও বিদআত হওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক মানদন্ড। এই তিন যুগ সম্পর্কেই রাসূল (সা.) সর্বোত্তম হওয়ার স্বাক্ষ্য দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে আল্লামা সাআদ রুমী (রহ.) “মাজালিসুল আবরার” কিতাবে লিখেনÑ
لا يجوز أن يقلد الإنسان في دينه إلامن هو معصوم و هو صاحب الشريعة أو من شهد له صاحب الشريعة بالخير و هم القرون الثلاثة۔ (مجالس الأبرار صفحه ۱۳۳ بحواله اشرف الفتاوي جلد ۱ صفحه ٤۲۸)
অর্থ:- দ্বীন ইসলামের ক্ষেত্রে নিষ্পাপ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর স্বাক্ষ্য অনুযায়ী সর্বোত্তম তিন যুগ (সাহাবা, তাবেঈ ও তাবে’-তাবেঈ) ছাড়া অন্য কারো অনুসরণ করা বৈধ নয়।
অতএব কোন বিষয়ে যদি সুন্নত ও বিদআত হওয়ার ব্যাপারে দ্বন্ধ বা মতানৈক্য হয় তবে ইসলামের প্রাথমিক তিন যুগ সাহাবা, তাবেঈ ও তাবে তাবেঈগণের আমলই হবে সেখানে চূড়ান্ত ফয়সালাকারী। যে আমল তাদের মধ্যে পাওয়া যাবে তা সুন্নত বলে বিবেচিত হবে। আর যে আমলের কোন অস্তিত্ত্ব তাদের মধ্যে পাওয়া যাবে না তা বিদআত বলে গণ্য হবে।
সন্দেহযুক্ত বিষয়ে করণীয়
প্রশ্ন:- কোন বিষয়ে যদি কারো সন্দেহ হয় যে, বিষয়টি সুন্নত না বিদআত? সুনির্ধারিত ভাবে কোন একদিকে ফয়সালা করতে না পারে তবে ঐ ব্যক্তির জন্যে করণীয় কি?
উত্তর:-ধর্মীয় কিতাব অধ্যয়ন ও আলেমগণের বয়ান ইত্যাদির পরও যদি কোন বিষয়ে মতানৈক্যের কারণে কারো সন্দেহ থেকে যায় যে, এটি সুন্নত না বিদআত? তখন ঐ ব্যক্তির জন্যে সঠিক রাস্তা হলো এই যে, সন্দেহযুক্ত এই বিষয়টিকে সে সম্পূর্ণ ছেড়ে দিবে। এটাই ইসলামী শরীয়তের নির্দেশনা।
এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা.) এরশাদ করেন,
ألحلال بين و الحرام بين و بينهما مشتبهات، لا يعلمها کثير من الناس، فمن اتقي الشبهات إستبرأ لدينه و عرضه، و من وقع في الشبهات وقع في الحرام کالراعي حول الحمي، يوشک أن يوقع فيه (بخاري شريف جلد۱ صفحه ۱۳)
অর্থ:- হালাল ও হারাম সুস্পষ্ট এবং এতদুভয়ের মাঝে রয়েছে সন্দেহযুক্ত বিষয় যা অনেক মানুষই জানে না। অতএব যে ব্যক্তি এসব সন্দেহযুক্ত বিষয় থেকে দূরে থাকল সে যেন নিজের দ্বীন ও সম্মানকে বাঁচাল। আর যে ব্যক্তি এসব সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হলো, তার উদাহরণ হলো ঐ রাখালের ন্যায় যে সংরক্ষিত চারণভূমির আশেপাশে জন্তু চড়ায়, যার ফলে কখনো ঐ চারণভূমিতেও পতিত হতে পারে।
এমন বহু সহিহ্ হাদিসের দ্বারা একথা সুস্পষ্ট হয় যে, কোন বিষয়ের ক্ষেত্রে যদি কারো সন্দেহ হয়, এটি সুন্নাত না বিদআত? মুস্তাহাব না মাকরূহ্? তখন সেক্ষেত্রে রাসূল (সা.) এর দিক নির্দেশনা হলো সে কাজটি ছেড়ে দেয়া। তাইতো হানাফী মাযহাবের সুপ্রসিদ্ধ ফাতাওয়া গ্রন্থ “ফাতাওয়ায়ে শামী” তে উল্লেখ আছে-
اذا تردد الحکم بين سنة و بدعة کان ترک السنة راجحا علي فعل البدعة۔ (فتاوي شامي جلد۱ صفحه ٦۰۰)
অর্থ:- যখন কোন বিষয়ে সুন্নত ও বিদআত হওয়া সম্পর্কে সন্দেহ হয় তখন বিদআত করার চেয়ে সুন্নত ছেড়ে দেয়াই অগ্রগণ্য।


২নং প্রশ্নের উত্তর ঃ মাহ্ফিলে মীলাদের পরিচয়
মাহ্ফিল শব্দের অর্থ অনুষ্ঠান আর মীলাদ শব্দের অর্থ জন্ম। মাহফিলে মীলাদ অর্থ হলো জন্ম বৃত্তান্তের অনুষ্ঠান। তবে যে কারো জন্মের আলোচনাকে মাহ্ফিলে মীলাদ বলে না বরং বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনার উদ্দেশ্যে প্রতি বৎসর ১২ই রবিউল আওয়াল মহা ধুমধামের সহিত যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় তাকেই মাহ্ফিলে মীলাদ বলে। তবে পরবর্তীতে এর ব্যবহার আরো ব্যাপক হয়ে যায়। বৎসরের যে কোন সময় বরকতের উদ্দেশ্যে বা দোয়া কবুলের জন্য মীলাদ পড়া হয়। তবে এই মীলাদে রাসূল (সা.) এর জন্ম আলোচনা কোন মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে না। বরং রাসূল (সা.) এর শানে কিছু আরবি, ফারসি, উর্দু ও বাংলা শে’র ও কবিতা পাঠ করে উপস্থিত সকলেই সুর মিলিয়ে এক সাথে দুরূদ পড়া ও দোয়া করাই এর উদ্দেশ্য। এ পদ্ধতিতে দুরূদ পড়া ও দোয়া করাকেও মাহ্ফিলে মীলাদ শরীফ বা মীলাদ বলে অভিহিত করা হয়।
মীলাদ মাহ্ফিলের বিধান
একথায় সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে, রাসূল (সা.) এর সাথে মুহাব্বত, ভালবাসা ও এশকের নামই হলো ঈমান। তাঁর (সা.) এর শুভ জন্ম থেকে নিয়ে ইন্তেকাল পর্যন্ত পবিত্র জীবনের প্রতিটি অংশের বর্ণনা ও ঘটনাবলী সহীহ্ভাবে জানা এবং তা আলোচনা করা অত্যন্ত বরকতময় ও আল্লাহ্ তায়ালার রহমত লাভের মাধ্যম। প্রত্যেক মুসলমানেরই কর্তব্য হচ্ছে, রাসূল (সা.) এর পূর্ণ জীবনী বিশুদ্ধভাবে জানা এবং তাঁকে নিজের জীবনের দিশারী বানানো। বছরের প্রতিটি মাস, মাসের প্রতিটি সপ্তাহ্ এবং সপ্তাহের প্রতিটি দিন ও দিনের প্রত্যেকটি ঘন্টা ও মিনিটের মধ্যে এমন কোন মুহুর্ত নেই যেখানে রাসূল (সা.) এর জীবনী আলোচনা নিষেধ। বরং বছরের যে কোন দিনের যে কোন সময়ে রাসূল (সা.) এর জন্ম বৃত্তান্ত বা জীবনী আলোচনা করা খুবই বরকতময় মুস্তাহাব কাজ।
কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হলো এই যে, রাসূল (সা.) এর জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনার জন্যে ১২ই রবিউল আউয়াল কে নির্ধারিত করা, তাতে মহা ধুমধামের সহিত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা, শিন্নী ও রকমারী খানার ব্যবস্থা করা, বিশেষভাবে এদিনেই গরীব-মিসকীনকে খানা খাওয়ানো, এবং জশনে জুলুস ও মিছিল বের করা এরূপ মীলাদ মাহ্ফিলের আয়োজন ইসলামের অনুসরণীয় প্রথম তিন স্বর্ণ যুগের কোথাও কোন অস্তিত্ত্ব নেই। রাসূল (সা.) এর নবুওয়াতের ২৩ বছর, তারপর খোলাফায়ে রাশেদীনের ৩০ বছর এবং সাহাবায়ে কেরামের যমানা ১১০হি. এবং তাবিয়ীনের যমানা ১৭০ হিঃ ও তাবে তাবেঈনের যমানা প্রায় ২২০ হি. পর্যন্ত। রাসূল (সা.) এর এশ্ক তাঁদের মধ্যে পরিপূর্ণ ছিল। মুহাব্বত ও ভালবাসা অনেক বেশী ছিল। রাসূল (সা.) এর সম্মান ও মর্যাদা তাঁরাই সবচেয়ে বেশী করেছেন। এতসব কারণ থাকা সত্যেও ঐ তিন স্বর্ণ যুগের কেউ এই মীলাদ মাহ্ফিলের আয়োজন করেননি। এবং এভাবে করাকে সওয়াবের কাজও মনে করেননি। তাই প্রচলিত এই পদ্ধতিতে মীলাদ মাহ্ফিলের আয়োজন ধর্মীয় ব্যাপারে একটি নবআবিষ্কৃত বিষয়। যা শরীয়তের দৃষ্টিতে নিকৃষ্টতম বিদআত বলে গণ্য। এ প্রসঙ্গে আল্লামা আবুল হাসান আলী বিন ফজল মুকাদ্দাসী স্বীয় কিতাব “জামিউল মাসায়িলে” বলেনÑ
إن عمل المولد لم ينقل من السلف و إنما أحدث بعد القرون الثلاثة في الزمان الطالح و نحن لا نتبع الخلف فيما أهمله السلف لأنه يکفي بهم الإتباع فأي حاجة لنا إلي الابتداع۔
অর্থ:- মীলাদ শরীফের আমল সালফে সালেহীন (সাহাবা, তাবেঈ ও তাবে তাবেঈন) থেকে বর্ণিত নয়। বরং তা প্রথম তিন যুগের পর খারাপ যমানায় আবিষ্কৃত। অতএব পূর্ববতীরা যে কাজ ছেড়ে দিয়েছেন সে ক্ষেত্রে আমরা পরবর্তীদের অনুসরণ করবনা। কেননা পূর্ববর্তীদের অনুসরণই যথেষ্ট। নতুন বিষয় আবিষ্কারের আর কি দরকার?
আল্লামা আব্দুর রহমান মাগরিবী (রহ.) লিখেন:Ñ “নিশ্চয় মীলাদ শরীফের আমল বিদআত। কেননা রাসূল (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদীন এবং আয়িম্মায়ে মুজতাহিদীন কেউই এটা করেননি। এবং করার জন্য বলেনওনি।”

মীলাদ মাহ্ফিলে কিয়াম
মীলাদ মাহফিলের আরেকটি কাজ হলো রাসূল (সা.) এর জন্মের আলোচনার সময় বা সালাত ও সালাম পাঠের সময় মাঝখানে হঠাৎ সবাই মিলে দাঁড়িয়ে যায়। অনেকের আক্বীদা-বিশ্বাস যে, রাসূল (সা.) সেই মাহফিলে উপস্থিত হন। তাই তারা রাসূল (সা.) এর শুভাগমণের সম্মানার্থে কিয়াম করে। আবার অনেকেই কিয়ামকে দুরুদ শরীফ পড়ার আদাব বলে ভাবে। অনেকেই এই কিয়ামেকে ওয়াজিব-ফরযের ন্যায় মনে করে। যারা এভাবে মীলাদ ও কিয়াম করে না তাদেরকে ওয়াহাবী, কাফের, বেআদব ইত্যাদি বলে গালাগালি করে।
এভাবে কিয়াম করার কোন বিধান ইসলামী শরীয়তে নেই। ইসলামের প্রথম তিন যুগে এর কোন প্রচলন ছিল না। তাই এ কাজটিও একটি নিন্দনীয় বিদআত। যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। এর পেছনে যেসব যুক্তি প্রমাণ দেয়া হয় তার কোন ভিত্তি নেই। মীলাদ মাহ্ফিলে রাসূল (সা.) আসেন এ মর্মে কুরআন হাদিসের কোথাও কিছু বলা হয়নি। বরং এর বিপরীতে বলা হয়েছে:-
قال رسول الله صلي الله عليه و سلم إن لله ملائکة سياحين في الأرض يبلغوني من أمتي السلام. (نسائي شريف جلد ۱ صفحه ۱٤۳)۔
অর্থ:- রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহ্র একদল ফিরিশতা এমন রয়েছে যারা যমীনে বিচরণ করে এবং আমার উম্মতের পক্ষ থেকে আমার কাছে ছালাম পৌঁছায়।
এরূপ অনেক সহীহ্ হাদিস দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে, কোন মীলাদ বা দুরূদের মাহ্ফিলে রাসূল (সা.) নিজে উপস্থিত হন না। বরং তাঁর কাছে দুরূদ ও ছালাম পৌঁছানোর জন্য আল্লাহ্ তায়ালা পৃথিবীতে বিচরণশীল বিশেষ একদল ফিরিশতা নিয়োজিত রেখেছেন। অতএব একথা ভিত্তিহীন বানোয়াট যে, রাসূল (সা.) মীলাদ মাহ্ফিলে এসে উপস্থিত হন। বরং এটি সহিহ্ হাদিসের পরিপন্থী কথা। সুতরাং এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে কিয়াম করাও ভিত্তিহীন অবৈধ এবং বিদআত।
আর এ ধারণাও ভুল যে, কিয়াম করা দুরুদের আদাব। যদি তাই হতো, তাহলে তারা মীলাদ মাহফিলের পুরো সময়টাতেই দাঁড়িয়ে থাকতো। কিন্তু তারা মাঝখানে কেবল অল্প সময় দাঁড়িয়ে থাকে। অথচ নামাযে দুরূদ শরীফ পড়ার মাসনুন পদ্ধতি হলো বসে পড়া। যদি দাঁড়িয়ে দুরূদ পড়াই আদাব হতো তাহলে নামাযেও দাঁড়িয়ে পড়া সুন্নত হতো। এ ছাড়া দুরূদ পড়ার সময় বা রাসূল (সা.) এর আলোচনার সময় এভাবে কিয়াম করার কোন বিধান ইসলামী শরীয়তের কোন দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়। সাহাবা, তাবেঈ ও তাবে তাবেঈগণ কেউই এভাবে কিয়াম করেননি। এমনকি স্বয়ং রাসূল (সা.) নিজে কোন মজলিসে উপস্থিত হলেও সাহাবায়ে কেরাম কিয়াম করতেন না। কেননা রাসূল (সা.) কিয়াম করাকে অপছন্দ করতেন, যা সহিহ্ হাদিসে বর্ণিত আছে।
এজন্যই হক্কানী আলেমগণ সর্বদা উম্মতকে এরূপ মীলাদ ও কিয়াম থেকে বারণ করেন ও তাদেরকে সতর্ক করেন। এ প্রসঙ্গে ক্বাযী শিহাবুদ্দীন দৌলত আবাদী (রহ.) তাঁর “তুহফাতুল ক্বাযা” গ্রন্থে লিখেনÑ
“মীলাদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যাবে না। কেননা তা নবআবিষ্কৃত। আর প্রত্যেক নবআবিষ্কৃত বিষয়ই গোমরাহী। আর প্রত্যেক গোমরাহীই জাহান্নামে নিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে জাহেলগণ প্রতি বছর রবিউল আউয়াল মাসে যা করে তার কোন ভিত্তি নেই। আর তারা রাসূল (সা.) এর জন্মের আলোচনার সময় কিয়াম করে ও ধারণা করে যে, রাসূল (সা.) এর পবিত্র আত্মা সেখানে উপস্থিত হয়। তাদের এ ধারণা বাতিল বরং শিরকী আক্বীদা। ইমামগণ এরূপ কাজ থেকে নিষেধ করেছেন।”
উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা একথা স্পষ্ট হলো যে, মীলাদ ও কিয়াম শরয়ী কোন দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়। ইসলামের প্রথম তিন যুগে এর কোন অস্তিত্ত্ব ছিলো না। বরং তা নবআবিষ্কৃত বিষয়। যে কারো জন্ম দিবস অথবা মৃত্যু দিবস ইত্যাদি পালন করা বা উদযাপন করা ইসলামের মূল শিক্ষার পরিপন্থী।
দিবস পালন ইসলামে নিষিদ্ধ
এ সম্পর্কে আল্লামা ইউসুফ লুধিয়ানবী (রহ.) লিখেন, বস্তুত প্রাক ইসলামী যুগে মানুষের মধ্যে নিজেদের মহা পুরুষ ও ধর্ম প্রবর্তকদের জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালনের প্রথা ছিল। যেমন খৃস্টান বিশ্ব অদ্যাবধি হযরত ঈসা (আ.) এর জন্ম দিবসকে কেন্দ্র করে ‘জন্মানন্দ দিবস’ (ক্রিসমাস ডে) পালন করে। এর পিরীত ইসলাম দিবস পালন বা বার্ষিকী পালনের প্রথা বন্ধ করে দিয়েছে। এতে দুটি হেকমত নিহিত ছিল।
এক, দিবস পালনের নামে যা কিছু করা হয় তা কেবল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। ইসলামের দাওয়াত, প্রাণ ও প্রকৃতির সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। ইসলাম এই বাহ্যিক সাজ-সজ্জা, রং-তামাশা ও শ্লোগান সমর্থন করে না। ইসলাম এসব হৈচৈ ও হট্টগোল হতে দূরে অবস্থান করে স্বীয় দাওয়াতের কাজ অন্তরের পরিবর্তন সাধন হতে শুরু করে। সঠিক আকীদা-বিশ্বাস, উত্তম স্বভাব-চরিত্র ও নেক আমলের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানুষ তৈরীর কাজ করে। ইসলামের দৃষ্টিতে এসব বাহ্যিক জাক-জমকের একটি কানা পয়সারও মূল্য নেই। এসব জাক-জমক সম্পর্কেই বলা হয় ‘উপরে ফিটফাট, ভিতরে সদরঘাট’।
দ্বিতীয় হিকমত হল, ইসলাম অন্যান্য ধর্মের ন্যায় কোন বিশেষ মৌসুমে পল্লবিত হয় না, বরং তাতো সদা বসন্তের এমন উত্তম বৃক্ষ, যার ফল ও ছায়া সর্বদা বিদ্যমান। ইসলামের দাওয়াত ও বার্তা কোন বিশেষ দিন তারিখের অনুগ্রহের কাছে বন্ধক নয়। বরং সর্বব্যাপী ও প্রতি মুহুর্তের।
তাছাড়া অন্যান্য জাতির তো দু’-চারজন মহা পুরুষ থাকে যাদের বার্ষিকী পালন করে তারা অবসর হয়ে যায়। পক্ষান্তরে ইসলামের আঁচলে হাজার-হাজার ও লক্ষ লক্ষ নয়, বরং অসংখ্য অগণিত এমন ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যাদের শ্রেষ্ঠত্বের সামনে আকাশের উচ্চতাও তুচ্ছ। ইসলামের কাছে কম-বেশী সোয়া লাখের সংখ্যা তো শুধু নবী-রাসূলের, তাঁদের পর আছে সাহাবাদের কাফেলা, যাদের সংখ্যাও কি সোয়া লাখের চেয়ে কম হবে?
এখন চিন্তা করুন, ইসলাম যদি দিবস পালনের দার উন্মুক্ত করত, তাহলে মুসলমানরা কি সারা বছর দিবস পালন ব্যতীত অন্য কোন কাজের জন্য এক মুহুর্তও সুযোগ পেত? (হযরত মুহাম্মদ সা. স্মারক-৪১২-৪১৩)
তাই ইসলাম সকল প্রকার দিবস পালন নিষিদ্ধ করেছে। সে জন্যই সাহাবা, তাবেঈ ও তাবে’তাবেঈগণের সময়ে মীলাদ মাহফিলের কোন অস্তিত্ত্ব ছিল না। এখন আমাদের জানা প্রয়োজন এই মীলাদ মাহফিল কোথা থেকে আবিস্কৃত হল?
মীলাদ মাহ্ফিলের ইতিহাস
ইসলামের ইতিহাসের পূর্ণ ছয়শত বছর অতিবাহিত হয়ে গেল মীলাদ মাহ্ফিল নামে কোন অনুষ্ঠান বা এবাদতের নামগন্ধও তাতে ছিলো না। ৬০০ বা ৬০৪ হিজরীতে ইরবিল দেশের বাদশাহ্ মুজাফফরুদ্দীন কোকবুরীর সহযোগিতায় কতিপয় দুনিয়ালোভী নামধারী আলেমের মাধ্যমে প্রচলিত এই মীলাদ মাহ্ফিলের আবিষ্কার হয়।
বাদশাহ মুজাফফরুদ্দীন কোকবুরী সরকারী কোষাগার থেকে মীলাদ অনুষ্ঠানের জন্যে অনেক অর্থ সম্পদ ব্যয় করত। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন এসে সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিত। রাসূল (সা.) এর জন্ম তারিখে মতানৈক্য থাকার কারণে এই অনুষ্ঠান এক বছর ৮ই রবিঃ আউঃ আরেক বছর ১২ই রবিঃ আউঃ করা হত।
ছয়শত চার হিজরীতে একজন অপব্যয়কারী বাদশাহ্ ও কতিপয় দুনিয়ালোভী চাটুকার আলেমদের মাধ্যমে আবিষ্কৃত এই মীলাদ মাহ্ফিল আস্তে আস্তে মুসলিম সমাজে প্রচলিত হতে থাকে। প্রত্যেক যুগের হক্কানী আলেমগণ এ থেকে বারণ করলেও মুর্খ ও জাহেল লোকেরা একে অত্যন্ত পুণ্যের কাজ বলে মনে করে। নামধারী দুনিয়ালোভী কতিপয় বিদআতী মৌলভীগণ একে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এর মুহাব্বতের প্রকাশ বলে চালিয়ে দেয়। ফলে এক সময় এই মীলাদ অনুষ্ঠানই ঈদে মীলাদুন্নবীতে পরিণত হয়। এমনকি অনেক অতিভক্ত মুর্খ লোকদেরকে এই শ্লোগান দিতেও শুনা যায় যে, সকল ঈদের সেরা ঈদ/ ঈদে মীলাদুন্নবী।
ইসলামে ঈদ দু’টি না তিনটি?
আবূদাউদ শরীফে সহিহ্ সনদে বর্ণিত এক হাদিসে আছে:-
عن أنس قال قدم النبي صلي الله عليه و سلم المدينة ولهم يومان يلعبون فيهما فقال ما هذان اليومان، قالوا کنا نلعب فيهما في الجاهلية، فقال رسول الله صلي الله عليه و سلم قد ابدلکم الله بهما خيرا منهما يوم الأضحي و يوم الفطر۔ (أبو داؤد جلد۱ صفحه۱٦۱، مشکوة جلد ۱ صفحه ۱۲٦(
অর্থ: হযরত আনাস (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) যখন মদিনায় আসেন। তখন মদিনাবাসীদের জন্য বছরে দু’টি দিন ছিল যাতে তারা উৎসব করত। রাসূল (সা.) এ দিন দু’টি সম্পর্কে জিজ্ঞাস করলেন, তখন তারা বলল, আমরা জাহেলী যুগে এ দু’দিন উৎসব করতাম। তখন রাসূল (সা.) বললেন, আল্লাহ্ তায়ালা তোমাদের এ দু’দিনকে আরো উত্তম দু’দিনের দ্বারা পরিবর্তন করে দিয়েছেন। তা হল ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর।
এরূপ আরো অসংখ্য হাদিসের দ্বারা ইসলামের বাৎসরিক ঈদ দু’টি বলে প্রমাণিত হয়। তিনটি ঈদ বা ঈদে মীলাদুন্নবী নামে কোন ঈদ এর পক্ষে হাদিসের কিতাব সমূহে সহিহ্ হাদিস তো দুরের কথা কোন যয়ীফ বা মওজু রেওয়ায়েতও পাওয়া যায়না। সাহাবা, তাবেঈ ও তাবে তাবেঈগণের যমানায় এ নামে কোন ঈদের নাম নিশানাও ছিলো না। নামধারী সুন্নী আশেকে রাসূলগণ অতিভক্তি দেখাতে গিয়ে ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করে সরাসরি রাসূল (সা.) এর সহিহ্ হাদিস সমূহের বিরোধীতা করছে। রাসূল (সা.) এর রেখে যাওয়া ইসলামের দুই ঈদের সাথে আরেকটি বাড়িয়ে নবী করীম (সা.) এর সাথে ধৃষ্টতা প্রদর্শন করছে। “অতিভক্তি চোরের লক্ষণ” একেই বলা হয়। তাই এহেন বেআদবী মূলক ধৃষ্টতা প্রদর্শন ও বিদআত কাজ থেকে বেঁচে থাকা মুসলমানদের জন্য অতীব জরুরী।

রাসূল (সা.) এর জন্ম দিবস কি চায়? ঈদ পালন না সওম সাধন?
নিঃসন্দেহে রহমাতুল্লিল আলামীন, সায়্যিদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্ম বিশ্ববাসীর জন্য এক বড় নেয়ামত ও আনন্দের বিষয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই আনন্দের দিনটিকে মানুষ কিভাবে পালন করবে? যারা ঈমান আনেনি, রাসূল (সা.) এর আনুগত্য স্বীকার করেনি, তাদেরকে নিয়ে তো কোন কথা নেই। কিন্তু যারা ঈমান এনেছে, ইসলামের লাগাম লাগিয়েছে, সর্বক্ষেত্রে রাসূল (সা.) এর আনুগত্য স্বীকার করেছে, তাদের জন্যে করণীয় হলো এক্ষেত্রে রাসূল (সা.) কি করেছেন বা করার নির্দেশ দিয়েছেন তা জেনে সে অনুযায়ী আমল করা। তাই এখানে রাসূল (সা.) এর জন্ম দিনে কি আমল ছিল তা উল্লেখ করা হলো।
সহিহ্ মুসলিম শরীফের এক হাদিসে বর্ণিত আছেÑ
عن أبي قتادة الأنصاري قال و سئل عن صوم الإثنين، قال ذاک يوم ولدت فيه و يوم بعثت أو أنزل علي فيه۔ (مسلم شريف جلد۱ صفحه۳٦۸)
অর্থ:- হযরত আবু কাতাদাহ্ আনসারী (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) কে সোমবারে রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাস করা হলে তিনি বলেন, এদিনেই আমি জন্ম লাভ করি এবং এদিনেই আমার উপর ওহী অবতীর্ণ করা হয়।
এই হাদিস এবং এরূপ আরো অনেক সহিহ্ হাদিসের দ্বারা জানা যায় যে, রাসূল (সা.) জন্ম দিনের শুকরিয়া পালনার্থে সোমবারে রোযা রাখতেন। আরো বিস্তারিত জানার জন্যে দেখুন:- আস সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী- ৪/২৮৬, তারীখে দিমাশ্ক- ৩/৬৬।
অতএব কোন মুসলমান যদি সত্যিকার অর্থে আশেকে রাসূল ও নবী প্রেমিক হতে চান এবং রাসূল (সা.) এর জন্ম দিবস পালন করতে চান তবে তাঁর জন্য করণীয় হলো রাসূল (সা.) এর অনুসরণে সোমবারে রোযা রাখা। তা না করে যদি কেউ শুধুমাত্র বৎসরে একবার ১২ই রবিউল আউয়ালে রাসূল (সা.) এর জন্ম দিবস পালন করে, তাও আবার রোযার পরিবর্তে ঈদ করে। তবে তা হবে রাসূল (সা.) এর সাথে চরম গোসতাখী ও বেআদবী। যা কোন আশেকে রাসূল তো দূরের কথা কোন সাধারণ মুসলমানও করার দুঃসাহস দেখাতে পারে না। তাই সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমান ভাইদের কর্তব্য হলো কুরআন-হাদিস বিরোধী নবআবিষ্কৃত প্রচলিত এসব মীলাদ মাহ্ফিলের মত গর্হিত বিদআত কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখা। নিজের মূল্যবান হায়াতকে এসব কাজে ব্যায় না করে ইহকালের দুর্গতি ও পরকালের ক্ষতি থেকে নিজেকে বাঁচানো। আল্লাহ্পাক সকলকেই দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন!!
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কাঁচা আম পাড়ার অভিযান

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২



গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×